#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব১৮

0
622

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব১৮
-Farhina Jannat

১৮.

জঙ্গল শেষ হয়নি, কিন্তু আর সামনে এগোনোর উপায় নেই। বিশাল একটা কাঁটাতারের বেড়া সিদ্রার সকল আশায় জল ঢেলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে ওর, কিন্তু সেই শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। এখন কি করব আমি! কিচ্ছু বুঝতে পারছেনা সিদ্রা, কোন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেনা। ঠিক এইসময় কেউ একজন ওর কাঁধে হাত রাখলো, চমকে উঠে পেছনে তাকাল সিদ্রা।

খালা দাঁড়িয়ে আছে শক্তমুখে। ভয় পেয়ে গেল সিদ্রা, আবার বন্দী ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতেই ইচ্ছাশক্তির শেষ বিন্দুটাও ফুরিয়ে গেল, মাথাটা ঘুরে উঠল ওর। তাড়াতাড়ি করে ধরে ফেলল খালা। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকাল সিদ্রা। খালা ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। ভয় কেটে গিয়ে যেন খালার মধ্যেই আশ্রয় খুঁজে পেল সিদ্রা। কেঁদে উঠল ও, ব্যর্থতার গ্লানিগুলো বেরিয়ে এল চোখের জল হয়ে। সিদ্রার পিঠে হাত বুলাতে থাকল খালা, যেন অভয় দিচ্ছে ওকে।

কান্নার দমক কমলে চোখ মুছিয়ে ওকে শান্ত করল। তারপর একটা প্লাস্টিকের টিফিন বাটির মুখ খুলে ওর হাতে দিল খালা। ভেতরে বিস্কিট ছিল। কয়েকটা বিস্কিট আর পানি খেয়ে শান্ত হয়ে খালার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল সিদ্রা।

খালা ওকে ইশারায় বলতে শুরু করল, আমি বলেছিলাম না, এখান থেকে পালানো সম্ভব না। কয়েকদিন ধরে তোমার আচরণ দেখে আমি বুঝেছি যে তুমি পালাতে চাও। সেজন্যই তোমাকে বুঝানোর জন্য আজকে পালানোর সুযোগ করে দিয়েছি। হা হয়ে গেল সিদ্রা। আর তারপর তোমাকে অনুসরণ করেছি, বলে চলল খালা। তোমার নিজে থেকে থেমে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

“ক-ক্কিন্তু আপনাকে তো ঘরে আটকে রেখে এসেছিলাম, আপনি কিভাবে বের হলেন?”

খালা ইশারায় বুঝিয়ে দিল, উনি আগে থেকে বাইরেই ছিল, কাঁথার নিচে বালিশ আর কাপড় দিয়ে রেখেছিল ওকে ভুল বুঝানোর জন্য। তারপর ওকে জিজ্ঞেস করল খালা, এখন কি তুমি বুঝেছো যে আমি ঠিক বলেছি?

কোন উত্তর দিলনা সিদ্রা। একদিক দিয়ে হয়তো হয়নি, অন্যদিক দিয়ে হবে, মনে মনে ভাবল ও।

ঠিক আছে, তুমি এখনো বিশ্বাস করছোনাতো আমার কথা, এসো আমার সাথে। এই বলে খালা ওকে ধরে উঠাল। তারপর ওকে নিয়ে কাঁটাতারের বেড়া বরাবর হাঁটতে লাগল সামনের দিকে। একটু আরাম করার পর আর পেটে খাবার পড়ার কারণে এখন হাঁটতে আগের মত আর কষ্ট হচ্ছেনা সিদ্রার। কিন্তু বুঝতে পারছেনা খালা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওকে। কাঁটাতারের বেড়ার গায়ে কিছুক্ষণ পর পর সাইনবোর্ড ঝুলানো, “জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ, আদেশক্রমে বন বিভাগ”। বেশ খানিকক্ষণ হাঁটার পর জঙ্গল থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এল ওরা।

সামনের অপার সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে হা হয়ে গেল সিদ্রা। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল ও আর অবশেষে বুঝতে পারল, ও কোথায় আছে।

সিলেট! আমি সিলেটে! লোকটা আমাকে ঢাকা থেকে সিলেটে এনে রেখেছে? ভেবেই মাথা চক্কর দিচ্ছে সিদ্রার। সামনে যতদূর চোখ যাচ্ছে, উঁচুনিচু পাহাড় আর তার গায়ে আঁকাবাঁকা চা গাছের সারি, অপূর্ব দৃশ্য। এরকম জায়গা বাংলাদেশে একমাত্র সিলেট ছাড়া আর কোথাও নেই, ভাল করেই জানে সিদ্রা।

কাঁটাতারের বেড়া এখানে বাম দিকে বেঁকে গিয়েছে। আর ওরা দাঁড়িয়ে আছে একদম পাহাড়ের কিনারে। খালা ওকে নিচের দিকে তাকাতে ইশারা করল। দেখল সিদ্রা, শুধু গাছ আর ঝোপে ঢাকা পাহাড়ের খাড়া দেয়াল। নিচে নামার মত কোন উপায় নেই। খালার দিকে তাকাল ও। খালা ওকে বুঝিয়ে বলল, এখানে সবদিকেই এই একই অবস্থা। যেখান দিয়েই নামতে যাক, পা হড়কে পড়ে গিয়ে মৃত্যু ঘটবে ওর। হতাশ হয়ে বসে পড়ল সিদ্রা।

“তাহলে কি করব আমি? এই জঙ্গলের ভেতরেই কাটাব বাকি জীবন?”

নীরব সম্মতি জানাল খালা।

“কিন্তু কেন? যে অপরাধ আমি করিইনি তার জন্য আমাকে কেন শাস্তি পেতে হবে? কেন কেন কেন?” আরও একবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল সিদ্রা। খালা ওকে কাঁদতে দিল।

“এই যে আপনি, আপনি আমাকে বলেন, আমার অপরাধ কি? আমি এসব করিনি। আমি ওই ছেলেটার নাম পর্যন্ত জানিনা, প্রেম করে ধোঁকা দেওয়া তো অনেক দূরের কথা!”

খালা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, কোন উত্তর নেই তার কাছে। চুপ করে থাকতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাতে খালার কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিল সিদ্রা, চিৎকার করে বলল, “কথা বলছেননা কেন?”

খালা ইশারায় বোঝাল যে, উনি কিছু বলতে পারবেননা। যা জানার, বোঝার, সব ওই লোকের হাতে। উনার কিছুই করার নেই। হাত দুটো খসে পড়ল সিদ্রার। ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল ও, খালা সামলালো ওকে। সিদ্রাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল খালা, ওকে স্বাভাবিক হওয়ার সময় দিচ্ছে যেন। সিদ্রা শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সামনের দিকে, সামনের এই অনাবিল সৌন্দর্য এখন আর ওকে মুগ্ধ করতে পারছেনা।

***
সন্ধ্যার আগ দিয়ে ওরা আবার চালাঘরে ফিরে আসল। প্রথমে ওরা ফিরে গিয়েছিল ওই কাঁটাতারের বেড়ার কাছে, যেখানে সিদ্রা আটকে গেছিল। সেখানে থেকে ওদের জিনিষপত্রগুলো নিয়ে ফিরে এসেছে এখানে। আশ্চর্যের বিষয় হল, ওখান থেকে ফিরে আসতে বেশি সময় লাগেনি ওদের। সিদ্রার মনে হয়েছে এক ঘণ্টা হবে কি হবেনা। তার মানে জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে আমি মাত্র ওইটুকু পথ গিয়েছি অর্ধেক দিন পার করে! এক জায়গাতেই ঘুরেছি বারবার!! অথচ মনে করেছি কতদূর চলে এসেছি আমি!! পণ্ডশ্রম হয়তো একেই বলে, ভাবল সিদ্রা।

খালা ওকে ঘরে ঢুকিয়ে দিলে মেঝেতেই গুটিসুটি মেরে পড়ে রইল সিদ্রা। আজকের ব্যর্থতা ওর সকল প্রাণশক্তি যেন শুষে নিয়েছে। এমনকি নামাজের কথাও মনে পড়লনা ওর। চোখের পানিও যেন ফুরিয়ে গেছে। ঘরের অন্ধকারের সাথে হতাশার অন্ধকার আজ মিলেমিশে একাকার। ঘুম আসার কথা ছিলনা, কিন্তু শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে কখন যেন দুচোখ বুজে এল সিদ্রার।

কে যেন খুব সুন্দর করে কুরআন তেলাওয়াত করছে। কান পাতলো সিদ্রা, বোঝার চেষ্টা করল কোন সূরা পাঠ করছে। শুনলো লোকটা তেলাওয়াত করছে, “লা তাক্বনাতু মির রহমাতিল্লাহ” একই আয়াত সুর করে বারবার পড়ছে লোকটা। এত সুন্দর সে তেলাওয়াত যে অন্তর শীতল হয়ে যাচ্ছে, খালি শুনতেই ইচ্ছে করছে। শুনেই যাচ্ছে ও, শুনেই যাচ্ছে। হঠাৎ চোখ খুলে গেল সিদ্রার।

স্বপ্ন দেখছিলাম আমি! কিন্তু কানে এখনো ভাসছে সেই তেলাওয়াত।

“তোমরা আল্লাহ্‌র রহমত হতে নিরাশ হয়োনা”!!

সুবহানআল্লাহ! আল্লাহ আমাকে এতবড় সান্ত্বনা দিয়েছেন। অপরিসীম আনন্দে সেজদায় পড়ে গেল সিদ্রা। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় দুচোখ পানিতে ভরে গেল ওর। সেই সাথে মনে পড়ে গেল, আজ সারাদিনের এসব ঘটনার চক্করে সব নামাজ কাযা হয়ে গেছে। আল্লাহ্‌র সামনে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে সিদ্রার। ছি ছি ছি! কিভাবে পারলাম আমি সারাদিন নামাজ না পড়ে থাকতে, আবার এখন কাজা আদায় না করে ঘুমিয়ে গেছি। তড়িঘড়ি করে উঠে যথারীতি জগের পানি দিয়ে অজু করে অশ্রুধোয়া নয়নে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে গেল সিদ্রা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here