#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ১৪
-Farhina Jannat
১৪.
আজ অন্যদিনের মত খালাকে ডাকাডাকি করতে হলনা সিদ্রাকে। ওর আবার জ্বর আসতে পারে ভেবে খালা ওর ঘরেই নিচে বিছানা করে ঘুমিয়েছে। কিন্তু ঘুম ভেঙে পায়ে শিকল আবিষ্কার করল সিদ্রা, যার আরেক প্রান্ত ওর বিছানার সাথে আটকানো। রাগ হতে গিয়েও কি মনে করে আর রাগ করলোনা সিদ্রা, হয়তো এসবে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে ও। খালাকে ডাকল,
“খালা, ও খালা, শিকল খুলে দেন, নামাজ পড়ব”
যথারীতি ধড়মড়িয়ে উঠে বসল খালা। হকচকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে উঠে বাইরে গেল।
“আরে খালা, আমাকে না খুলে কই যাচ্ছেন আপনি?” বলে উঠল সিদ্রা। হাতে চাবি নিয়ে ফিরে আসল খালা। ও, আমি যেন হাতের নাগালে চাবি না পাই, তাই বাইরে রেখেছে। কত্ত সাবধানতা! মনে মনে বলল সিদ্রা।
কিন্তু সমস্যা এটা না। সমস্যা হল, বাথরুম করে এসে দেখল, ড্রামে পানি নাই। ঘরের জগেও যেটুকু পানি আছে, তাতে অজু হবেনা। এখন কি করবে, এ পরিস্থিতিতে তায়াম্মুম হবে কি হবেনা ভাবছিল সিদ্রা।
সমস্যার সমাধান দিল খালা। বালতি আর একটা টর্চলাইট নিয়ে এসে ইশারা করল পানি আনতে যাওয়ার জন্য। “কিন্তু খালা, এই অন্ধকারে……কিভাবে?” প্রশ্ন করল সিদ্রা। খালা ইশারায় বোঝাল, কোন ব্যাপারই না এটা উনার জন্য। হতভম্ব হয়ে খালার পেছন পেছন হাঁটতে লাগল সিদ্রা।
যখন ওরা ঝর্ণার কাছে পৌঁছল, তখন আকাশ সবে ফর্সা হয়ে এসেছে। সিদ্রা তো পুরা অবাক, খালা কিভাবে অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা চিনল!
ঝর্ণার পানিতে নেমে অজু করল সিদ্রা। তাহাজ্জুদ তো গেছেই, এখন আর ফিরে গিয়ে ফজরও পড়ার সময় থাকবেনা, ঘাসের উপরেই পশ্চিমমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে গেল ও। সবথেকে বেশি অবাক হল সালাম ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে। খালাও ওর পেছনে বসে আছে নামাযের আসনে, শাড়ির আঁচল মাথায় পেঁচিয়ে। সিদ্রা তাকাতেই খালা যেন একটু লজ্জা পেল। খুশিতে সিদ্রা দৌড়ে এসে খালাকে জড়িয়ে ধরল।
খালা ওকে ইশারায় বলল, উনি নামাজ পড়তে জানেননা, কিন্তু সিদ্রাকে নামাজ পড়তে দেখে উনারও ইচ্ছে হয়েছে নামাজ শেখার। সিদ্রা একটু ভাবনায় পড়ে গেল। বোবারা তো কথা বলতে পারেনা, সুরাও শিখতে পারবেনা, কোন দোয়াও না। তাহলে বোবাদের নামাজ পড়ার হুকুম কি, জানিনাতো আমি।
ওকে চিন্তা করতে দেখে খালা ইশারায় বালতিতে পানি ভরার কথা মনে করিয়ে দিল। সিদ্রা অনুরোধ করল, “খালা, আমি একটু এখানে থাকি, প্লিজ! কতদিন সূর্যোদয় দেখিনা!! আমি তো বেশি তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারিনা, আপনি বরং এই ফাঁকে এক বালতি পানি রেখে আসেন”
সন্দেহ ফুটে উঠল খালার চোখেমুখে, মাথা নাড়ল সজোরে।
হেসে দিল সিদ্রা, “আপনি ভাবছেন পালাব আমি? পালানোর শক্তি আছে নাকি শরীরে? এটুক এসেই তো হাঁপিয়ে গেছি। আপনি নিশ্চিন্তে পানি রেখে আসেন” সিদ্রার যুক্তি দেখানোতে খালার সন্দেহ আরো বাড়ল, কিছুতেই রাজি হলনা যেতে। একটু মন খারাপ হল সিদ্রার, খালা ওকে এতটুকুও বিশ্বাস করতে পারেছেনা?
একটু পরেই আকাশ পুরোপুরি সাদা হয়ে গেল। পাহাড়ের পাশে ছোট একটা টিলা আছে, ওইদিন পানিতে থাকার সময় খেয়াল করেছিল। দৌড়ে গিয়ে ওইটার উপর উঠল সিদ্রা, ভালভাবে দেখার জন্য। ঠিক এই সময়েই পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে সূর্য উঁকি দিল। শিশির ভেজা ঘাস আর ফুলগুলোর ওপর সূর্যকিরণ পড়ে ঝলমল করতে লাগল, যেন সদ্যস্নান করেছে ওরা। ঝর্ণা আর জলাশয়ের পানিও ঝিকমিক করছে আলো পড়ে।
কি অপরূপ সৃষ্টি আল্লাহ তোমার! নিজের অজান্তেই গুনগুন করে তেলাওয়াত করে উঠল সিদ্রা, “ফাবি আয়্যি আলায়ি রব্বিকুমা তুকাজ্জিবান” (তোমরা আল্লাহ্র কোন কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে?)
খেয়াল হতেই মনে হল, পুরো সূরাই তেলাওয়াত করে ফেলি। প্রথমে অনুচ্চ কন্ঠে শুরু করে আস্তে আস্তে আওয়াজ বাড়াতে লাগাল সিদ্রা। মধুর কন্ঠে সূরা রহমান তেলাওয়াত করতে থাকল। ওর সুমধুর তেলাওয়াত পাহাড়ের গায়ে লেগে পুরো বনে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। সিদ্রা বিমুগ্ধ নয়নে কুরআন তেলাওয়াত করতে করতে ওর জীবনের সবথেকে সুন্দর সূর্যোদয় উপভোগ করল।
তেলাওয়াত শেষ করে টিলার চারপাশ ভাল করে দেখার জন্য পেছন দিকে তাকাল সিদ্রা। সেখানে আরেকটা ছোট টিলা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সাইজটা একটু অদ্ভুত। কেমন লম্বাটে, আর উপরের মাটিগুলো কেমন ঝুরা ঝুরা, নতুন করে দেয়া হয়েছে মনে হচ্ছে কেন, ভাবল সিদ্রা। ভাল করে তাকাতেই বুঝে ফেলল ওটা কি! উত্তর দক্ষিণে লম্বা, তার মানে ওটা একটা কবর!!
উপরের মাটি আর ঘাসের সাইজ দেখে বোঝা যাচ্ছে কবরটা একদম নতুন। চারপাশে লাগানো ফুলগাছগুলোও বেশি বড় হয়নি, তার মানে কবরটা খুব বেশি হলে একমাসের পুরনো হবে। মাথায় ভয়ঙ্কর একটা চিন্তা আসল সিদ্রার। কবরটা আমারই মত একটা মেয়ের!
ওই মেয়েটাকে মেরে ফেলে লোকটা আমাকে ধরে এনেছে। আমি ঠিকই ধরেছিলাম। এই লোকটা মানসিক রোগী, ঠাণ্ডা মাথার খুনি! আমার নাম আর পরিচয় ছাড়া যা যা বলেছে, সব তো মিথ্যা, এসব তার মনগড়া। সে নিশ্চয় এভাবেই মেয়েদের ধরে এনে অত্যাচার করে খুন করে। আমাকেও একইভাবে মেরে ফেলে এমনি করে কবর দিয়ে দিবে! সিদ্রার এসব চিন্তার পেছনে রিসেন্টলি পড়া সাইকো থ্রিলারগুলোর অবদান কম ছিলনা!
ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেল সিদ্রার। না না করে মাথা নাড়তে নাড়তে পিছু হটতে লাগল, খেয়ালও করলনা যে কিনারে চলে এসেছে। যা হবার তাই হল, ব্যালেন্স হারিয়ে উলটে পড়ে গেল সিদ্রা। ভয়ে চিৎকার দিল সিদ্রা, কিন্তু মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগেই কেউ একটা শক্ত হাতে ধরে ফেলল ওকে।
***
খালা আর সিদ্রা পানি আনতে চলে যাবার কিছুক্ষণ পর চালাঘরে এসে পৌঁছল লোকটা। দুইজনের কাউকেই কোথাও দেখতে না পেয়ে তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার। অস্থির হয়ে পায়চারি করতে করতে ভাবছিল কোথায় যেতে পারে ওরা। পানির ড্রামের দিকে চোখ পড়তেই দেখল ঢাকনা খোলা। কাছে গিয়ে দেখল, খালি। পানি আনার বালতিটা কোথাও চোখে পড়ছেনা। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাল, দুজন মিলে পানি আনতে গেছে। বুঝতে পেরেই ঝর্ণার উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল লোকটা।
প্রায় ঝর্ণার কাছাকাছি এসে গেছে, এমন সময় কানে আসল সিদ্রার সুমধুর তেলাওয়াত। আপনা থেকেই কান খাড়া হয়ে গেল লোকটার। আস্তে আস্তে যত এগোচ্ছে, তেলাওয়াত তত স্পষ্ট হচ্ছে। এত সুন্দর কন্ঠ, আর এত সুন্দর তেলাওয়াত, মুগ্ধ আবেশে সামনে এগিয়ে গেল লোকটা। গাছের আড়াল থেকেই দেখা যাচ্ছে সিদ্রাকে। দাঁড়িয়ে গেল লোকটা, ওর সামনে গিয়ে ওকে থামিয়ে দিতে চাচ্ছেনা।
টিলার উপর দাঁড়িয়ে প্রসন্ন মুখে কুরআন তেলাওয়াত করছে মেয়েটা। সূর্যের মিষ্টি কিরণ ওর ফর্সা মুখে পড়ে যেন ওকে আরো সুন্দরী করে দিয়েছে আর নতুন কিনে দেয়া হলদে রঙের জামা ওড়নায় ওকে যেন ঠিক একটা সদ্যফোটা ফুলের মত লাগছে। সিদ্রার অপরূপ সৌন্দর্য আর সুললিত কন্ঠের তেলাওয়াতের আবেশে যেন হারিয়ে গেল লোকটা। ভুলে গেল সব রাগ, সব প্রতিশোধের কথা। সিদ্রা আর ওর তেলাওয়াত ছাড়া আর কোন কিছুই খেয়াল রইলোনা তার।
তেলাওয়াত থেমে যেতেই চমক ভাঙ্গল লোকটার। কিন্তু আবেশ এখনো কাটেনি, নড়েনি নিজের জায়গা থেকে। হঠাৎ খেয়াল করল, পিছাচ্ছে সিদ্রা। আরে! পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙবে তো!! নিজের অজান্তেই ছুটল ওকে ধরতে। কোনমতে শেষ মুহূর্তে দুহাত দিয়ে ধরে পতনের হাত থেকে বাঁচাল ওকে।