#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ১৩

0
640

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ১৩
-Farhina Jannat

১৩.
জ্বরের দুটো দিন স্বপ্নের মত কাটল সিদ্রার। কখনো খালার মুখ আবার কখনো ওই শয়তান লোকটার মুখ দেখতে পেল। আকুল হয়ে থাকল একটু মাকে দেখার জন্য।

জ্বরের ঘোরে সারাক্ষণ মা আর বোনকে নিয়ে প্রলাপ বকছে মেয়েটা। আর মাঝেমাঝে আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ করছে। লোকটা আশা করছিল, জ্বরের ঘোরে কোন না কোন প্রেমিকের নাম নিশ্চয় মুখে আনবে মেয়েটা। কিন্তু ওর আশা ভঙ্গ করে কারো নামই মুখে আনেনি সিদ্রা। আস্তে আস্তে লোকটার বিশ্বাস দৃঢ় হল। এ মেয়ে আসলেই একটা খারাপ মেয়ে। মন থেকে কাউকেই ভালবাসেনি, সবার সাথে নাটক করেছে। কোন ভুল করিনি আমি, একদম ঠিক কাজ করেছি, ভাবল সে।

***
তৃতীয় দিনে জ্বর পুরোপুরিভাবে ছাড়ল সিদ্রার। এ কয়দিন জ্বর না থাকলে ঘুমাতো, আর জ্বর থাকলে শুধু ভুল বকত। এ কয়দিনের কথা কিছুই মনে করতে পারছেনা ও। তবে মাঝেমাঝে খালা ওকে বাতাস করেছে, গা মুছিয়ে দিয়েছে, খাইয়ে দিয়েছে, এরকম মনে পড়ছে হালকা হালকা।

আজকে ঘুম ভেঙে দেখল খালা নিচে বিছানা করে শুয়ে আছে। ওর ওড়নার এক কোনা, খালার আচলের সাথে গিট্টু দেয়া। দেখে হাসল সিদ্রা, যাতে পালাতে না পারি তাই এ ব্যবস্থা নাকি। ওড়নাটা নতুন, খেয়াল করতেই গায়ের দিকে তাকাল, একই সেটের একটা জামা পায়জামা ওর গায়ে। খুবই নিম্নমানের কাপড়, তবু খুশি হল সিদ্রা। আর ওই ছেড়া শাড়ি কষ্ট করে পরতে হবেনা। অনেক পিপাসা লেগেছে ওর। বিছানা থেকে নামল পানি খাওয়ার জন্য। শাড়িতে টান পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল খালার।

ধড়মড়িয়ে উঠে বসল মহিলা। হেসে দিল সিদ্রা।

“আপনি সবসময় ঘুম ভাঙলে এত চমকে উঠেন কেন?”

খালা কিছু বললনা, উঠে সিদ্রাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে নিজে পানি ঢেলে দিল ওকে। তারপর জ্বর আছে কিনা দেখল কপালে হাত দিয়ে। খালার মুখটা প্রসন্ন হয়ে উঠতেই সিদ্রা বুঝল যে ওর জ্বর নেই। ইশারা করে সিদ্রাকে এখানেই থাকতে বলল, আর আঁচলের গিটটা খুলে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। খালার কথা না শুনে সিদ্রাও উনার পেছন পেছন বের হয়ে এল।

বিকেলবেলার হালকা আলো ঢুকছে গাছের ফাঁক দিয়ে। মৃদুমন্দ বাতাসে মনটা ভাল হয়ে গেল সিদ্রার। ভাল করে একটু বাতাস খাওয়ার জন্য বারান্দা থেকে নিচে নামল সিদ্রা। ঘরে ফেরা পাখির জোর কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে।

সিদ্রাকে বাইরে দেখে দৌড়ে আসল খালা, চোখে ভয়ের চিহ্ন। “আরে খালা, ভয় পায়েননা। পালাচ্ছিনা আমি” হেসে বলল সিদ্রা। “ঘরের ভেতরে দম বন্ধ লাগছিল, তাই একটু বাতাস খেতে আসলাম আর পালালেওবা। আমার যে গতি, আপনি তো আমাকে ধরেই ফেলবেন!”

খালার মুখ থেকে সন্দেহ দূর হলনা, কিন্তু আর জোর করলনা ওকে ঘরে যাওয়ার জন্য। বারান্দা থেকে চেয়ারটা নিচে এনে দিল বসার জন্য।

“থ্যাংকইউ” বলে চেয়ারে বসল সিদ্রা। একটু পর খালা এসে ওর হাতে একটা তরলপূর্ণ বাটি ধরিয়ে দিল। কিছু একটার স্যুপ হবে হয়তো, জিনিসটা দেখতে তেমন সুস্বাদু লাগছেনা, কেমন যেন ঢ্যালঢেলে। ফু দিয়ে মুখে দিয়ে দেখল, স্বাদ তেমন খারাপ না। চুপচাপ খেয়ে নিল। বাটি নিয়ে গিয়ে গ্লাসে করে পানি আর ওষুধ এনে দিল খালা।

“বন্দী মানুষের জন্য এতকিছু নাইবা করলেন খালা, আমাকে তো আপনারা কষ্টই দিতে চান” গ্লাসটা নিতে নিতে বলল সিদ্রা। খালা কিছু বললনা, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল ওর পাশে।

ওষুধ খেয়ে গ্লাসটা ফিরিয়ে দিল খালাকে। তারপর আরেকবার চেষ্টা করল,
“খালা, অন্তত আপনি আমাকে বলেন, আমার অপরাধটা কি? আমার কি এটুকু জানারও অধিকার নেই?” বরাবরের মত চুপ করে রইল খালা, শুধু আগের মত ঠাণ্ডা দৃষ্টিটা নিক্ষেপ করলনা।

“আপনিও কি ওই লোকটার মত বিশ্বাস করেন, আমি একটা খারাপ মেয়ে? ওই লোকটা আমাকে যেসব অপবাদ দিচ্ছে, সেগুলা সত্যি বলে মনে করেন আপনি?

খালার মুখে একটা ইতস্তত ভাব ফুটে উঠল, যেন ডিসিশন নিতে পারছেনা। মুখে বেদনার হাসি ফুটে উঠল সিদ্রার।

“বুঝেছি খালা, আমিও বড্ড বোকা, আপনার মনিব আপনাকে যা বলবে, আপনি তো সেটাই বিশ্বাস করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক, আমাকে বিশ্বাস করার তো কোন কারণ নেই” গলাটা কেঁপে উঠল সিদ্রার। গাল বেয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।

এসময় ঝপ করে অন্ধকার নেমে এল, সূর্য ডুবে গেছে, বুঝল সিদ্রা। খালা ওকে ঘরে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিল। ঘরে যাওয়ার আগে অযু করতে বসল সিদ্রা। তখন মনে পড়ল ওইদিনের কথা, পানি নিয়ে ফেরার সময় পায়ে কাঁটা বিধল, তারপর কি হয়েছিল! জিজ্ঞেস করল সিদ্রা, “খালা, ওইদিন আপনি আমাকে নিতে গিয়েছিলেন, তারপর…… কিভাবে নিয়ে আসলেন আমাকে?”

না না করে উঠল খালা, তারপর ইশারায় ওকে বুঝিয়ে দিল, ওই লোকটা ওকে অজ্ঞান অবস্থায় বয়ে নিয়ে এসেছে।

“শয়তান লোক একটা, নিজেই আমাকে ওইরকম অবস্থায় ফেলবে, আবার নিজেই তুলে নিয়ে আসবে!” বিড়বিড় করে বলল সিদ্রা। তারপর খালার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিন্তু আপনি প্রতিদিন ঝর্ণা থেকে পানি নিয়ে আসেন?” মাথা ঝাঁকাল খালা।

অবাক হল সিদ্রা। “এতদূর থেকে পানি আনতে হয়! কতবার যাওয়া আসা করেন আপনি, এগুলো ভরতে?”

পুরো হাত উঠিয়ে দেখাল খালা। চোখ কপালে উঠল সিদ্রার, “পাঁচবার!”

“আর কালকে থেকে এই কাজটা তুই করবি” পেছন থেকে লোকটার গলা শুনতে পেল সিদ্রা।

তাড়াহুড়ো করে জামার হাতা দুটো নামিয়ে ফেলল সিদ্রা, ওড়নাটাও ঠিক করে নিল। “অবশ্য তুই যে আধা বালতি করে পানি আনিস, তোকে তো দশ-পনেরো বার যেতে হবে” হেসে উঠল লোকটা। এই হাসি শুনলে সিদ্রার গা পিত্তি একদম জ্বলে যায়।

“আমি যাবনা আনতে, কি করবেন আপনি?”

“এক্ষেত্রে আমাকে কিছুই করতে হবেনা, করবি তো তুই। গাছের পাতা আর ঢেলা দিয়ে বাথরুম করবি, আর খাবার পানি পাবিনা, সিম্পল!” বাঁকা স্বরে বলল লোকটা।

“আপনি একটা……….” রেগে আঙুল তুলে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল সিদ্রা।

“কি? পাগল, সাইকো? ওয়ে………. বেটার দ্যান ইউ!! আর আমাকে পাগল, সাইকো যদি কেউ বানায় তো সেটা তুই!!! সো, জাস্ট শাট আপ।“

এরপর খালার দিকে তাকিয়ে বলল, “কাল থেকে সব কাজ ওকে দিয়ে করাবা, কিভাবে সেটা কালকে তোমাকে বলে দিয়েছি আমি। কিন্তু তুমি যদি ওর প্রতি মায়া দেখাও খালা, আমি কিন্তু টলেরেট করবনা। আই হোপ, তুমি ভুলে যাবানা, ও কার সাথে কি করেছে।“ মাথা ওপর নিচ করল খালা।

“কার সাথে কি করেছি আমি?” বলে উঠল সিদ্রা।

লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি হেনে “খালা, আসছি আমি” বলে আবার ঢুকে গেল বনের মাঝে।

“এই যে, কোথায় যাচ্ছেন, আমার কথার উত্তর দিয়ে যান” বলতে বলতে লোকটার পেছনে এগোল সিদ্রা। কিন্তু খালা ওর হাত ধরে আটকে ফেলল। হাত ইশারা করে না করল। তারপর ওকে ধরে টেনে এনে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। দৌড়ে গেল সিদ্রা জানালার কাছে। “খালা, আপনি বলেন, কার সাথে কি করেছি আমি? খালা, ও খালা” কোন উত্তর দিলনা খালা, সামনেও আসলনা।

এবার জানালার দিকে খেয়াল করল সিদ্রা। দুটো কাঠের টুকরো আড়াআড়ি করে লাগিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় জানালার দিকে তাকিয়ে দেখল, সেখানেও একই অবস্থা। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিদ্রা, আমি কি পালিয়ে না গিয়ে খুব বেশি ভুল করেছি!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here