#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব১৬
-Farhina Jannat
১৬.
১ মাস আগের কথাঃ
“ফারহান, ফারহান, আমি এসে গেছি” বাংলোতে প্রবেশ করেই ডাক ছাড়ল রাইয়্যান।
সোফাতে গা এলিয়ে দিতেই বানু খালা ওর জন্য শরবত নিয়ে আসল। এই বানু খালা পরিচারিকা হলেও ওদের দুই ভাইয়ের কাছে মায়ের মত। ওদের বাবা ব্যবসার কাজে সবসময় দেশে-বিদেশে দৌড়ে বেড়াতেন, আর সাথে ওদের মাকেও দৌড়াতে হত। কারণ বাবা মাকে ছাড়া এক গ্লাস পানিও ঢেলে খেতে পারতেননা। এজন্য ছোটবেলা থেকে ওদের দেখাশোনা বানু খালাই করতো। খালা বোবা, অবশ্য কানে শুনতে পায়। জন্ম থেকে বোবা না, ছোটবেলায় কি এক দুর্ঘটনায় বাকশক্তি হারিয়েছে।
“কিগো খালা, ফারহান কই? এতবার ডাকছি সাড়া দিচ্ছেনা”
কালকে থেকে বের হয়নি ঘর থেকে, ইশারায় জানাল খালা।
“কি! আবার!! এই ছেলেটা আর বদলালোনা। দাঁড়ান, আমি বের করে আনছি গুহামানব কে” এই বলে সিঁড়ির দিকে এগোল রাইয়্যান।
মু’তাসিম বিল্লাহ রাইয়্যান, খান গ্রুপের কর্ণধার, বর্তমানে দেশের লিডিং ইয়াং বিজনেসম্যানদের মধ্যে অন্যতম। সেরা বললেও অত্যুক্তি হবেনা, তবে ক্যামেরার সামনে থাকতে পছন্দ করেনা বলে সাধারণ মানুষের কাছে তেমন পরিচিত নয় নামটা।
খান গ্রুপের গোড়াপত্তন করেছিলেন মরহুম বাবা আফসার উদ্দীন খান। তিনিও ছিলেন সেসময়ের সেরা একজন ব্যবসায়ী। এখনো সৎ এবং সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তার নাম ব্যবসায়ী মহলে প্রশংসা এবং সম্মানের উচ্চারিত হয়।
বারো বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় সস্ত্রীক মৃত্যুর পর যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে খান গ্রুপকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে তাঁর বড় ছেলে রাইয়্যান। এত কম বয়সে সফলতার সাথে এতবড় ব্যবসা সাম্রাজ্য পরিচালনা করা হয়ত কঠিন, কিন্তু সেটা যে অসম্ভব না, সেটাই প্রমাণ করেছে সে এই বারো বছরে।
মা-বাবাকে একসাথে হারিয়ে এতটা শক্ত থাকা হয়ত সম্ভব ছিলনা। কিন্তু ৮ বছর বয়সী ছোট ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সেই ১৬ বছর বয়সেই বড় হতে হয়েছে রাইয়্যানকে। কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে বিশাল দায়িত্ব।
তবে আনন্দের কথা হল, ব্যবসার প্রতি ওর আগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকেই। স্কুল থেকে সোজা বাবার অফিসে চলে আসতো রাইয়্যান। দেখতো বাবা কেমন দক্ষতার সাথে একের পর এক বিজনেস এবং প্রবলেম ডিল করে। এ সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত সম্রাট হিসেবে সবসময়ই নিজেকে কল্পনা করতো ও। তাই কল্পনাটা সময়ের অনেক আগেই সত্যি হয়ে গেলেও সমস্যা হয়নি ওর। একই সাথে যেমন পড়ালেখা করেছে, তেমনি পরিচালনা করেছে ব্যবসা, আবার দেখাশোনা করেছে ভাইয়েরও।
এই বিশাল দুনিয়ায় ওরা রচনা করেছে দুই ভাইয়ের ছোট্ট একটা পৃথিবী, যেখানে একজন আরেকজনকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। এত আদর দিয়েছে রাইয়্যান ভাইকে, যেন ছেলেটা কোনদিন বাবা-মার অভাব বুঝতে না পারে। বেশি আদরে বাঁদর না হলেও বেশ লাই পেয়ে গেছে ছেলেটা। সব চাওয়া মুহূর্তেই পেয়ে গিয়ে হয়ে উঠেছে প্রচণ্ড ইমোশনাল আর জেদি। আর ওর রাগ আর জিদের কাছে অসহায় রাইয়্যান।
ফারহানের সবথেকে পছন্দের কাজ হচ্ছে, একা থাকা। নিজের ঘরে কারো সাথে কথা না বলে ল্যাপটপ আর ফোন নিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারে ছেলেটা। বাইরে থেকে শতবার ডাকলেও নিজের ইচ্ছে না হলে বের হয়না ও। ঘরে থাকা ছোট ফ্রিজ আর কাবার্ড সবসময় খাবার জিনিস ভর্তি থাকা লাগে ওর। কারো সাথে কথা না বলে, শুধু ফ্রিজের খাবার আর চিপ্স-চকলেটে-বিস্কিট খেয়ে মানুষ কিভাবে বাঁচতে পারে বুঝে আসেনা রাইয়্যনের। তাই ও ফারহানের নাম দিয়েছে গুহামানব।
অবশ্য এর পেছনের রাইয়্যানেরও দোষ কম নেই। এদিক ওদিক ব্যবসার কাজে রাতদিন ছোটাছুটি করতে হয় ওকে। ভাইয়ার থেকে আলাদা থাকতে গিয়েই এই অদ্ভুত অভ্যাস তৈরি হয়েছে ফারহানের। কিন্তু সুখের কথা হল, রাইয়্যান ফিরে আসলে সাথে সাথেই ঘর থেকে বের হয়ে আসে ও। এজন্য এয়ারপোর্টে নেমেই আগে ফারহানকে কল দেয় রাইয়্যান, নিচে এসে ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করে ছেলেটা।
কিন্তু আজকে গাড়িতে ওঠার পর থেকে এতবার কল দিল, রিসিভ করেনি ফারহান। মনে হয় এবার একটু বেশিই রেগে আছে, যাই সামনাসামনি গিয়েই রাগ ভাঙাই, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভাবছিল রাইয়্যান।
খান টি এম্পায়ার, খান গ্রুপের টি এস্টেট। এখানকার বাংলোতেই কেটেছে দুই ভাইয়ের শৈশব-কৈশোর। তাই বড় হয়েও এখানকার মায়া কাটাতে পারেনি কেউই। ঢাকাতে নিজেদের অনেকগুলো বাড়ি এবং ফ্ল্যাট থাকলেও ফারহানকে এখান থেকে নড়ানো যায়নি। এ বছর এইচ এস সি দেয়ার পর অনেক চেষ্টা করে শাবিপ্রবিতেই ভর্তি হয়েছে ছেলেটা। কিন্তু এই গুহাপ্রীতির জন্য ক্লাস করানো যাচ্ছেনা ছেলেটাকে দিয়ে, সেটা নিয়ে চিন্তিত রাইয়্যান। এবার সময় নিয়ে ওর সাথে কথা বলবে, এই চিন্তা করে এসেছে রাইয়্যান।
বিশাল একটা ডুপ্লেক্স বাংলো ওদের। উপরতলায় তিনটা বিশাল ঘর আর মাঝখানে একটা ফ্যামিলি গ্যাদারিং এর স্পেস। নিচতলায় ছোট ছোট কয়েকটা রুম, কিচেন আর ড্রয়িংরুম। এর মধ্যে একটা ঘরকে আবার পারিবারিক লাইব্রেরী বানিয়েছিলেন আফসার উদ্দীন খান। বছর বছর রাইয়্যান শুধু সেটাকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। দুই ভাইয়ের কারোই বইয়ের প্রতি তেমন নেশা নেই। ফারহান তাও মাঝে মাঝে একটা দুইটা বই নিয়ে নাড়াচাড়া করে, কিন্তু রাইয়্যান ধারেকাছেও যায়না। ওর ব্যবসাই নেশা, আর সেটাই পেয়েছে পেশা হিসেবে, আর কি লাগে!
উপরতলার দুই ঘর এখন দুই ভাইয়ের, আরকটা তালাবন্ধ থাকে। ফারহানের ঘরটা পড়ে সবার শেষে, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে টোকা দিল রাইয়্যান।
“ফারহান, দরজা খোল ভাই, আমার ওপর রাগ করে থাকিসনা প্লিজ!”
“স্যরি বলছি, কান ধরছি, এরপর আর জীবনেও এতদিন তোকে ছেড়ে থাকবোনা, ডাকলেই ছুটে চলে আসব, ভাই আমার, প্লিজ দরজা খোল” এবার পুরো এক সপ্তাহ হয়ে গেছে, আসলেই বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি, ভাবল রাইয়্যান।
“কিরে, বিশ্বাস করলিনা আমার কথা? সত্যি বলছি, প্রমিস করছি তোকে, আমি তোর কথা শুনবো, শুনতে পাচ্ছিস তুই? ফারহান, এই ফারহান!”
এতকিছু বলার পরেও দরজা না খোলায় খারাপ আশংকা উঁকি দিল রাইয়্যানের মনে। একা একা থাকে, কত কিছুই তো হতে পারে। আরো জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগল। তাও কোন সাড়া না পেয়ে মনে হল দরজা ভাঙতে হবে। খালাকে পাঠাল ম্যানেজারকে ডেকে আনতে। আর নিজে কাঁধ দিয়ে দরজা ভাঙার চেষ্টা করতে লাগল। একা একা সম্ভব হলনা। ম্যানেজার আসার পর দুইজন মিলে বেশ কয়েকবার জোর ধাক্কা মেরে ভেঙে ফেলল দরজা।
ভেতরে বিছানায় চোখ পড়তেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রাইয়্যান। কম্বল জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে ফারহান। ম্যানেজারকে বলল, “আপনি যান”। তারপর নিজে এগোল ভাইয়ের দিকে।
ম্যানেজার সিঁড়ির মুখে পৌঁছাতেই পারেনি, রাইয়্যানের চিৎকার শুনতে পেল, ঘুরে দৌড় দিল ফারহানের ঘরের দিকে। গিয়ে দেখল রাইয়্যান ফারহানকে বুকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত চিৎকার করছে।
“ভাই, চোখ খোল ভাই, আমার উপর এত অভিমান করছিস কেন? আমি তো এসেছি, কিরে, এই ফারহান, চোখ খোলনা” এগুলা বলে হাত দিয়ে ফারহানের মুখে বাড়ি দিচ্ছে রাইয়্যান, কিন্তু ফারহান কোন সাড়া দিচ্ছেনা।
ম্যানেজার তাড়াতাড়ি ফারহানের গায়ে হাত দিতেই দেখল, বরফের মত ঠাণ্ডা। মুহূর্তেই যা বোঝার বুঝে গেল।
“স্যার, এক্ষনি ছোট সাহেবকে হসপিটালে নিতে হবে” উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল ম্যানেজার, যদিও সে বুঝে গেছে, আর কিছুই করার নেই।
“এ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছো, জলদি গাড়ি বের করতে বল ড্রাইভারকে” এতবড় ভাইকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটল রাইয়্যান।
***
ডাক্তার যখন জানাল যে, আত্মঘাতী পরিমাণে ঘুমের ঔষধ খেয়েছে ফারহান এন্ড হি ইজ নো মোর…. রাইয়্যান নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলনা। ও চিন্তাই করতে পারছিলোনা, ফারহানের এমন কি দুঃখ কষ্ট থাকতে পারে যে ও আত্মহত্যা করবে! ডাক্তার ওকে মিথ্যা বলছে, অন্য হসপিটালে নিবে ও ফারহানকে, ওর কিছু হতেই পারেনা….. এইসব বলে হাসপাতালে বিশাল একটা হাঙ্গামা করেছে রাইয়্যান। শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে কোনভাবে বুঝিয়ে শান্ত করেছে ওকে।
ফারহানকে ওর আরেক প্রিয় স্থান পাহাড়ের ঝর্ণার পাশে কবর দেয় রাইয়্যান। সপ্তাহে অন্তত একবার এই ঝর্ণায় গোসল করতে আসতো ও। রাইয়্যান এখানে থাকলে দুই ভাই মিলেই আসতো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটতো দুজনে। ফারহানের আবদারে এই পাহাড়ের উপরে বনের মধ্যে একটা চালাঘর তৈরি করে দিয়েছে রাইয়্যান। গুহাপ্রীতি চরমে উঠলে এই ঘরে এসে বাস করতো ও। বর্ষাকালে তো পুরো বাসস্থান বানিয়ে ফেলতো। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনতে নাকি ওর খুব ভাল লাগে। কিন্তু রাইয়্যানের এ কাজটা একদম পছন্দ ছিলনা। কারণ এই জায়গায় নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়না, কোন খোঁজ নিতে পারতোনা ও ফারহানের।
কবর দেয়ার পর সেই চালাঘরে এসে পুরো দুইদিন পড়ে ছিল রাইয়্যান। সারাটাক্ষণ শুধু নিজেকে দোষারোপ করেছে। আমার অবহেলার জন্যই এমন হয়েছে, আমি আমার ভাইকে সময় দিইনি বলে জানতে পারিনি ওর মনে এত কষ্ট জমে ছিল, আমি ব্যবসার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ভাইকে অবহেলা করেছি, আমি একজন অযোগ্য বড় ভাই, এসব ভেবে ভেবেই চোখের পানি ফেলছিল রাইয়্যান। কিন্তু আসল ঘটনা জানার পর চোখের পানি শুকিয়ে সেখানে স্থান করে নেয় অপরিসীম ক্রোধ।