#যে_গল্পের_নাম_ছিলনাপর্ব৩০
-Farhina Jannat
৩০.
পরদিন ভোরে দরজায় ক্রমাগত ধাক্কার শব্দে ঘুম ভাঙল রাইয়্যানের। আমার দরজায় ধাক্কা! নিশ্চয় গুরুতর কিছু হয়েছে, জলদি বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলল রাইয়্যান। কান্নাভেজা চোখ নিয়ে সিদ্রা দাঁড়িয়ে আছে, ওকে দেখেই দুহাতে মুখ ঢেকে ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগল। ভয় পেয়ে গেল রাইয়্যান।
“এই, কি হয়েছে? এভাবে কাঁদছিস কেন?”
কিছু বলতে গিয়েও কান্নার চোটে বলতে পারলনা সিদ্রা। সান্ত্বনার ভঙ্গিতে ওর দু’কাঁধে হাত রাখল রাইয়্যান।
“শান্ত হয়ে বল আগে কি হয়েছে, নাহলে বুঝব কি করে?”
“খালার অনেক জ্বর….কিছুতেই কমছেনা… সব আমার জন্য হয়েছে… আমি ভিজতে না বললে এসব কিছুই হতনা… সব আমার দোষ…. প্লিজ আপনি কিছু করেন…. খালাকে বাঁচান” সিদ্রার কান্নার মাঝে থেকে এই কথাগুলো উদ্ধার করতে সক্ষম হল রাইয়্যান।
“আরে পাগলী! সেজন্য তুই এভাবে কাঁদছিস? জ্বর হলে কি মানুষ মরে যায় নাকি! কান্না থামা। চল দেখি কি হয়েছে”
রাইয়্যানের প্রতিক্রিয়া দেখে অবাক হল সিদ্রা, ব্যাপারটা উনি এত হালকাভাবে নিচ্ছেন কিভাবে? আসলে ও প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগছে। জঙ্গলেও খালার জ্বর হয়েছিল ওর জন্য। আর এখন আবার, সেটাও ওরই পাগলামির জন্য, এটাই ও মানতে পারছেনা। তাও একটু আধটু হলে হয়। কি প্রচণ্ড তাপ! সারারাত ধরে জলপট্টি দিয়ে, মাথায় পানি ঢেলেও কমছেনা। ভয় পাবেনা?
রাইয়্যান ঘরে ঢুকে দেখল খালার কপালে জলপট্টির কাপড়। সেটা সরিয়ে হাত দিতেই চমকে উঠলো, পুরো আগুন! মেয়েটা অহেতুক ভয় পায়নি। চুল ভেজা খালার, নিচে বালতিও দেখা যাচ্ছে। মাথায় পানিও ঢেলেছে দেখছি।
“তুই থাক এখানে, আমি বুবুকে ফোন করে দেখি” মাথা নেড়ে সায় দিল সিদ্রা।
ফোন হাতে নিয়ে ফিরে আসল রাইয়্যান, দেখল সিদ্রা খালার হাতপা মুছে দিচ্ছে। চেয়ারে বসে বলল, “বুবু আসছে এখনি, কখন থেকে এ অবস্থা?”
“মাঝরাত থেকে”
“কি? এখন তো ছয়টা বাজে! কিন্তু…… তুই তো শুয়ে পড়েছিলি, কিভাবে বুঝলি?” হতভম্ব দেখাচ্ছে রাইয়্যানকে।
“শুয়ে পড়ার পর হঠাৎ আমার আগেরবারের কথা মনে পড়ে, সেদিন ওইটুক ভেজাতেই খালার এত জ্বর এসেছিল, আর আজ তো এতক্ষণ ধরে ভিজেছে, তাই দেখতে এসেছিলাম আমি”
“তারপর থেকে একা একা এসব করছিস! আমাকে ডাকিসনি কেন?”
“ওইদিন তো শুধু জলপট্টি দিয়ে আর গা মুছিয়েই কমে গিয়েছিল জ্বর, আজ তো মাথায় পানিও ঢেলেছি। আমি ভেবেছিলাম কমে যাবে”
“ঔষধ খাইয়েছিস?” উপর নিচে মাথা ঝাঁকাল সিদ্রা।
“চিন্তা করিসনা। খালার বৃষ্টির জল কোনকালেই সহ্য হয়না। কিচ্ছু হবেনা, ভাল হয়ে যাবে। এর আগেও হয়েছে এমন” যদিও আজকেরটা যে সামান্য না, ভালভাবেই বুঝতে পারছে রাইয়্যান। কিন্তু সেটা এখন এই মেয়েকে বলা যাবেনা, এমনিতেই তো কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে।
কথার ফাঁকে ফাঁকে আবার জলপট্টি দেয়া শুরু করেছে সিদ্রা। আবার ওকে চোখ মুছতে দেখল রাইয়্যান। ওর মন এত নরম যে ওর জন্য খালার সামান্য জ্বর হয়েছে, সেটাই ও মানতে পারছেনা। অথচ একটা ছেলে ওর জন্য মারা গেছে, সেটা তাহলে কিভাবে এত সহজে মেনে নিচ্ছে!? এই পরিস্থিতিতেও আরেকটা অদ্ভুত চিন্তা আসলো ওর মাথায়। আচ্ছা, যদি আমি কোন কারণে অসুস্থ হই, সিদ্রা কি আমারও এভাবে সেবা করবে?
কলিংবেলের আওয়াজে চিন্তার জাল ছিন্ন হল রাইয়্যানের। দরজা খুলতে গেল ও, ফিরে এল বুবুকে নিয়ে।
“জ্বর মেপেছিস?” ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল বুবু।
“না, থার্মোমিটার খুঁজে পাইনি” উত্তর দিল সিদ্রা।
আর কিছু না বলে বুবু থার্মোমিটার বের করে খালার মুখে ঢুকাল।
চোখ কপালে উঠলো বুবুর, “১০৪! শিগগির গাড়ি বের কর ভাইটু, হসপিটালে নিতে হবে” খালার কথা শেষ হওয়ার আগেই রাইয়্যান বের হয়ে গেছে ঘর থেকে।
খালাকে পাঁজাকোলা করে গাড়িতে তুলল রাইয়্যান। সিদ্রাকে তো লক করে যেতে পারবেনা বুবুর সামনে, তাহলে এখন কি করবে, সেটা ভাবতে গিয়েই ও দরজায় দাঁড়ানো সিদ্রার দিকে তাকালো। আগে বুঝতে পারেনি, কিন্তু এখন বাইরের আলোয় সিদ্রার মুখটা একটু অস্বাভাবিক লাগল ওর কাছে। কি মনে করে এগিয়ে এসে ওর কপালে হাত রাখতেই চমকে উঠলো রাইয়্যান। বুবুকে ডাক দিল, “বুবু, ওরওতো জ্বর এসেছে, যদিও খালার মত এত বেশি না। কি করি বলোতো?”
“না না, আমার কিচ্ছু হয়নি, আমি ঠিক আছি, আপনারা খালাকে নিয়ে যান” প্রতিবাদ করল সিদ্রা।
“নারে, জ্বর অবস্থায় তোকে একা রেখে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা, শেষে আরেকটা বিপদ বাঁধবে। ভাইটু, আমিই খালাকে ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছি। আর দরকার পড়লে আমি ফোন করে নিব, তুই সিদ্রার খেয়াল রাখ” কথাগুলো বলে চাবি নিয়ে ড্রাইভারের সিটে উঠে বসল বুবু।
“সাবধানে চালিও বুবু” চিৎকার করে বলল রাইয়্যান।
সিদ্রাকে কিছু খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিতে বলল রাইয়্যান কিন্তু কথা কানে তুললনা সিদ্রা, সোফায় গিয়ে বসে রইল। বাধ্য হয়ে রাইয়্যান নিজেই ঢুকল রান্নাঘরে। দেখল ইন্ডাকশনের উপর একটা সসপ্যানে স্যুপ। খালার জন্য করেছিল সিদ্রা, বুঝল ও। সেটাকেই গরম করে নিয়ে গেল সিদ্রার কাছে।
সিদ্রা সোফায় হেলান দিয়ে আছে, চোখ বোজা। ঘুমিয়ে গেল নাকি! আবার কপালে হাত দিল রাইয়্যান। চোখ খুলল সিদ্রা, দুর্বল কন্ঠে বলল, “আমার কিছু হয়নি, আপনি খালার কাছে যান প্লিজ”
কোন উত্তর দিলনা রাইয়্যান। তাপ আগের থেকে বেশি মনে হচ্ছে, জ্বর বাড়ছে নাকি? তাড়াতাড়ি করে খালার ঘরে গেল ও থার্মোমিটার আনতে। থার্মোমিটার এর সাথে প্যারাসিটামলের পাতাটাও নিয়ে এল।
জ্বর মেপে দেখল, একশোর একটু বেশি। যাক, এত বেশি না, হাঁফ ছাড়ল রাইয়্যান। স্যুপ খাওয়ার জন্য উঠে বসতে বলল সিদ্রাকে। “আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা, নরমাল জ্বর, এমনিই কমে যাবে, আমার জন্য এত ব্যস্ত নাইবা হলেন! আপনি বুবুকে ফোন দিয়ে দেখুন খালার কি খবর”
“বুবু ওখানে আছে, খালাকে নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবেনা। আচ্ছা বেশ, তুই স্যুপ খেয়ে ঔষধ খেলে আমি বুবুকে ফোন দিব”
একথায় চট করে সোজা হয়ে বসল সিদ্রা। রাইয়্যান খাইয়ে দিতে যাচ্ছিল ওকে, বাধা দিল সিদ্রা। নিজেই বাটি নিয়ে আস্তে আস্তে খেয়ে নিল স্যুপটুকু। তারপর ঔষধ খেয়েই বলল, “এবার ফোন করেন”
হাসল রাইয়্যান, ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করল। কথা বলার পর সিদ্রাকে বলল, “টেনশনের কিছু নাই, ওরা এডমিট করে নিয়েছে। জ্বর কমার জন্য সাপোজিটরি দিয়েছে আর টেস্ট করার জন্য ব্লাড নিয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর, ইন শা আল্লাহ্ টেস্ট রিপোর্ট ভালই আসবে” সিদ্রার দিকে এগিয়ে আসল রাইয়্যান, “সারারাত ঘুমাসনি, এখন ঘরে গিয়ে একটা ঘুম দে। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নে কিছুক্ষণ। দেখবি, ঘুম থেকে উঠে শুনবি যে খালার জ্বর ভাল হয়ে গেছে”
“ইন শা আল্লাহ্” বলে উঠে পড়ল সিদ্রা। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে যেন টলে উঠলো একটু, রাইয়্যান ছুটল ওকে ধরার জন্য। কিন্তু সিদ্রা হাতের ইশারায় নিষেধ করলো ওকে, নিজেই রেলিঙ ধরে সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠে গেলো। আর মনে মনে বলল, বললেই হল নিশ্চিন্তে ঘুমা, গোটা বাড়িতে আপনি আর আমি একা, জীবনেও ঘুম আসবেনা আমার। কিন্তু ওই বলা পর্যন্তই, শরীর এত ক্লান্ত হয়ে ছিল, বিছানায় শুয়ে চোখ বুজতেই সিদ্রা হারিয়ে গেল ঘুমের জগতে।
***
এক ঘুমে দুপুর পার করে দিল সিদ্রা। রাইয়্যান মাঝে মাঝে এসে চেক করে গিয়েছে। ঔষধ খাওয়ার পর জ্বর ছেড়ে গিয়েছে, আর আসেনি।
ঘুম ভেঙে সিদ্রা বুঝলো যে ওর জ্বর নেই, সকালের ভারী মাথাটা এখন অনেক হালকা লাগছে। জানালার দিকে চোখ পড়তেই বুঝলো যোহরের ওয়াক্ত যাই যাই করছে। তড়াক করে উঠে বসলো ও। এদিকে জ্বর ছাড়ার সময় ঘামে ভিজে জামা টামা সব চ্যাটচেটে হয়ে আছে। শুধু অজু করে নামাজ পড়া সম্ভব না। যত দ্রুত সম্ভব ফ্রেশ হয়ে শরীর মুছে ড্রেস চেঞ্জ করে নিল, গোসল করার ঝুঁকি আর নিলনা। বের হয়েই দেখল, লোকটা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়াতেই সকালবেলার অস্বস্তিটা আবার ফিরে এল। বাসায় আর কেউ নেই, ভাবতেই ভয় লাগছে সিদ্রার। লোকটা মানুষের সামনে তো খালি বউ বউ করে, এখন ফাঁকা বাড়িতে যদি কিছু করে বসে, কি করব আমি? নাহ! আল্লাহ্ আছেন, তিনিই রক্ষা করবেন, মনে মনে ভরসা পেল সিদ্রা।
“খালা কেমন আছে?” সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করল সিদ্রা।
“জ্বর কমেছে, ডাক্তাররা বলেছে, চিন্তার কিছু নাই” হাসিমুখে উত্তর দিল রাইয়্যান।
লোকটা অকারণে হাসছে কেন? কোন খারাপ উদ্দেশ্য নেইতো? একি, আমার দিকে এগিয়ে আসছে কেন?