#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ২৪
-Farhina Jannat
২৪.
শৈশবের এক বন্ধুর বিয়েতে যাচ্ছে রাইয়্যান। কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে পকেটে গাড়ির চাবি ঢুকাতে গিয়ে খেয়াল করল ঘরের চাবিটা নেই। কি হল? স্পষ্ট মনে আছে, চাবি ঢুকালাম পকেটে, কোথায় পড়লো? গাড়ির ভেতরে আতিপাতি করে খুঁজল, নেই। বাইচান্স যদি বাসার ভেতরে পড়ে থাকে আর মেয়েটা পেয়ে যায়, তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। ঘরে টেলিফোন আছে, কম্পিউটারে ইন্টারনেট কানেকশন আছে, যদি কোথাও খবর পাঠিয়ে দেয়!
তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘুরিয়ে বাংলোয় ফিরল রাইয়্যান। দুই তিন সিঁড়ি একসাথে বেয়ে উপরে উঠতেই দেখল সিদ্রা ঢুকছে নিজের ঘরে, গতিটা কেমন যেন মন্থর। নিজের ঘরের সামনে এসে হাঁফ ছাড়ল, যাক! ভাগ্যিস মেয়েটা খেয়াল করেনি। তাও একবার চেক করে দেখি সব ঠিক আছে কিনা, ভাবল রাইয়্যান। ঘরে ঢুকার একটু পরেই সিদ্রার কান্নার আওয়াজ শুনে ছুটে ঘর থেকে বের হল ও।
দরজাটা ভেজানো ছিল, কারণ রাইয়্যান ভেতর থেকে দরজা লাগানোর সিস্টেমই নষ্ট করে দিয়েছে, এখন শুধু বাইরে থেকে লাগানো যায়। ফারহানের কান্ড দেখে শিক্ষা হয়েছে ওর, ওর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আবার এই মেয়েও একই কাজ করবে, তার রিস্কই রাখেনি। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল, সিদ্রা বালিশ আকড়ে ধরে কান্না করছে। এতদিনে ওকে অনেকবার কাঁদতে দেখেছে রাইয়্যান। কিন্তু আজকের কান্নাটা যেন একদম আলাদা। মেয়েটার কান্নাতে এত বিষাদ আগে তো ছিলনা, মনে হচ্ছে যেন ওর সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। কি হল ওর? আমি তো কিছু করিনি, ভাবল রাইয়্যান।
ভাবতে ভাবতেই ঢুকে গেল ঘরে, “এই, এমন পাগলের মত কাঁদছিস কেন? হঠাৎ করে কি হল তোর?” উদ্বেগের সাথেই জিজ্ঞেস করল রাইয়্যান।
“কেন? আমাকে আটকে রেখেছেন বলে কি আমি নিজের ইচ্ছামতো কাঁদতেও পারবোনা? সেজন্যেও আপনার অনুমতি নিতে হবে?” সিদ্রার অশ্রুভেজা চেহারা দেখে আর এমন জবাব শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেল রাইয়্যান।
“না মানে, আমি সেটা বলিনি…………” থেমে গেল রাইয়্যান। আশ্চর্য তো, আমি এত কনসার্ন হচ্ছি কেন? আমি তো চেয়েইছিলাম ও কষ্ট পাক, কিন্তু এভাবে ওকে কাঁদতে দেখে আমার এত খারাপ লাগছে কেন?
ওর মনের কথা যেন পড়ে ফেলল সিদ্রা। বলল,
“আপনি তো আমাকে কষ্ট পেতে দেখতে চেয়েছিলেন, দেখুন, দুচোখ ভরে দেখুন। নিজের কান্নায় নিজের না হোক, অন্য কারো কষ্টই নাহয় কমুক” দুহাতে মুখ ঢেকে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল সিদ্রা।
এসময় খালা কোথা থেকে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল সিদ্রাকে। সিদ্রা অন্যদিনের মত ধরলনা উনাকে, শুধু ওর কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেল। ইশারায় জানতে চাইল রাইয়্যান, খালা কিছু জানে কিনা। মাথা নাড়ল খালা, আরো চিন্তায় পড়ে গেল ও। এসময় ওর বন্ধু আবার ফোন করতেই মনে পড়ল বিয়ের কথা, সিদ্রার চিন্তা মাথায় নিয়েই এগোল ও সিঁড়ির দিকে।
***
সিদ্রার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাইয়্যান। এইমাত্র ফিরেছে ও, বুঝতে পারছেনা, ভেতরে ঢুকবে কিনা। নিজের ব্যবহারে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে রাইয়্যান, আগে তো কখনো ওর ঘরে ঢুকতে হেজিটেট করিনি, তাহলে আজকে কেন!
অনুষ্ঠানে একটুও মনোনিবেশ করতে পারছিলনা রাইয়্যান। বারে বারে সিদ্রার কান্নাভেজা মুখটা ভেসে উঠছিলো চোখের সামনে। শেষমেশ আগেভাগে খেয়ে নিয়ে বন্ধুর কাছে ক্ষমা চেয়ে ফেরার রাস্তা ধরেছে।
সাবধানতার সাথে নিঃশব্দে দরজাটা ঠেলল রাইয়্যান। অন্ধকারে বুঝার চেষ্টা করল, সিদ্রা কোথায় কি করছে। বুঝতে না পেরে আলো জ্বালল, অবাক হয়ে গেল ও। ঘরে ফ্যান চলছেনা, এসি চলছেনা, আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে মেয়েটা। এত শীত তো এখনো পড়েনি, জ্বর আসল নাকি? দেখবো হাত দিয়ে? না থাক! যেই মেয়ে, ঘুম ভেঙে গেলে পরে আমাকেই চরিত্রহীন বানিয়ে দিবে! ওর ঘুমন্ত চেহারাটা কখনো দেখতে পেলামনা, কিভাবে যে এই গরমেও সবসময় মাথা মুখ সব ঢেকে ঘুমিয়ে থাকে, আল্লাহ্ মালুম!! হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালাগুলো আর বারান্দার দরজাটা খুলে দিল। আলো নিভিয়ে বেরিয়ে এল আগের মতই নিঃশব্দে।
কম্বলে মোড়া শরীরটা উঠে বসল বিছানায়। সিদ্রা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুখ থেকে কম্বল সরিয়ে, এতক্ষণ কাঠ হয়ে পড়ে থেকে ঘামছিল কম্বলের ভেতরে। অবাক হয়ে খেয়াল করল, ঘরটা এরই মধ্যে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
***
সকালবেলা সিদ্রাকে নাস্তার টেবিলে দেখতে পেলনা রাইয়্যান। খালাকে দিয়ে ডেকে আনাল ওকে, দেখল চোখদুটো ফোলাফোলা, মুখটা এখনো থমথমে হয়ে আছে। চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে নাস্তা করতে বসতে বলল ওর সাথে।
“আমি রোজা রেখেছি” না বসে উত্তর দিল সিদ্রা।
“কি? রোজা? আজ তো শনিবার”
“তাতে কি হয়েছে? শনিবারে কি রোজা রাখা নিষেধ?”
“তুই তো সোমবার আর বৃহস্পতিবার রোজা রাখিস, খালার কাছে শুনেছি। তাহলে আজকে কেন হঠাৎ?”
“এটা আইয়্যামে বিজের রোজা”
“কিসের রোজা?”
“আইয়্যামে বিজের”
“মানে কি এর?”
“শুভ্র দিবসগুলী”
“তো এর সাথে রোজা রাখার কি সম্পর্ক!?”
উফ! রোজা রেখেছি তো রেখেছি, তা নিয়ে এত কথার কি আছে। মন মেজাজ ভাল নেই আর এই লোকটা শুধু শুধু প্যাঁচাল পাড়ছে!! মনে মনে বলল সিদ্রা। পরক্ষণেই ভাবলো, থাক দ্বীনের একটা বিষয় হলেও তো জানানো হচ্ছে। বলল,
“আরবি মাসের ১৩, ১৪ আর ১৫ এই তিনদিন চাঁদের আলো সবথেকে বেশি থাকে, তাই এই তিনদিনকে আইয়্যামে বিজ বলে। রাসূল (স) এই তিনদিন রোজা রাখতেন, এটাকেই আইয়্যামে বিজের রোজা বলে। তিনি জীবনে কখনো এই রোজা বাদ দেননি। বছরভর প্রতি মাসে এই তিনদিন রোজা করলে সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব পাওয়া যায়”
“তার মানে পরপর তিনদিন রোজা রাখবি তুই?”
ঘাড় নেড়ে সায় দিল সিদ্রা।
“নিজের শরীরের দশা দেখেছিস? শুকিয়ে তো এমন অবস্থা হয়েছে জোরে বাতাস লাগলে পড়ে যাবি। এসব রোজা টোজা করতে হবেনা, খেতে বস”
“আপনার কথায় নাকি? যা কিছু বলছেন মেনে নিচ্ছি বলে মনে করবেননা আমার নামাজ রোজার উপরেও আপনি খবরদারি করবেন। ভুলেও সে চেষ্টা করবেননা! আমার নামাজ রোজায় বিন্দুমাত্র ব্যাঘাতও আমি মেনে নিবোনা” শক্ত কণ্ঠে বলল সিদ্রা। সিদ্রা যখন এভাবে কোন কথা বলে, রাইয়্যান তখন কোন উত্তর খুঁজে পায়না, আজও সেটাই হল। কিছুক্ষণ পরে আবার জিজ্ঞেস করল,
“সেহরিতে কি খেয়েছিস?”
“কি আবার খাবো? পানি খেয়েছি”
“কি? পানি খেয়ে রোজা রাখে মানুষ? তুই কি মরে গিয়ে আমাকে খুনি বানাতে চাচ্ছিস?”
“আস্তাগফিরুল্লাহ! মরতে যাবো কেন?”
“এভাবে না খেয়ে খেয়ে শরীর দুর্বল হবে, নানান অসুখ করবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যাবে, তারপর বড় কোন অসুখ হবে আর বড় অসুখ করলে তো মরেই যাবি, নাকি?” লোকটার বিশ্লেষণ শুনে হা করে তাকিয়ে রইলো সিদ্রা।
“কপালে মরণ থাকলে মরবো, এত চিন্তার কি আছে” কিছুক্ষণ পর বলল ও। এমনিতেও বেঁচে থেকে আর কি হবে, এ জীবনের সবকিছুই তো শেষ হয়ে গেছে আমার, এখন শুধু আখিরাত নিয়েই ভাবনা, মনে মনে বলল ও।
“তোর না থাকলেও আমার আছে, নিজের গায়ে খুনির তকমা লাগানোর শখ লাগেনি আমার। খালা, ও যে ঠিকঠাক সেহরি খায়না, তুমি সেটা দেখোনা?”
খালা জানাল অন্যদিনগুলোতে উনি খাবার রাখেন, কিন্তু সিদ্রা আজকে রোজা রাখবে সেটা ও আগে বলেনি, সেজন্য এমনটা হয়েছে।
“এরপর যেন এর পুনরাবৃত্তি না হয়” দুজনকেই উদ্দেশ্য করে বলল রাইয়্যান।
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো খালা।
এহ! খুনির তকমা লাগানোর শখ লাগেনি! কিডন্যাপার হয়ে বসে আছে, সেটা কিছু না, যতসব হাস্যকর কথাবার্তা!! রাইয়্যান খাওয়া শেষ করে উঠে গেলে বিড়বিড় করে বলল সিদ্রা।
***
দিন কেটে যাচ্ছে নিজস্ব গতিতে। সিদ্রা পুরো রোবট হয়ে গেছে, ওর ওপর দেয়া কাজগুলো নিঃশব্দে করে যায় প্রতিদিন। প্রথম প্রথম মুনিরার ওপর খুব রাগ হয়েছিল ওর, কিন্তু আস্তে আস্তে নিজেকে বুঝিয়েছে। মুনিরা তো আর জানতোনা, ছেলেটা এমন একটা কাজ করবে। ও নিশ্চয় ছেলেটার পাগলামি আঁচ করতে পেরেছিল, সেজন্যই সরে গেছে, ওর লাস্ট মেসেজটা দেখে এমনটাই মনে হয়েছে ওর। আর বাকি রইল ওর নাম বলা, সেটা কেন করেছে যদিও জানেনা ও। কিন্তু মুনিরা যদি জানতো ও এমন বিপদে পড়বে, তাহলে যে ওর নামটা বলতোনা, এটুকু বিশ্বাস বোনকে করে সিদ্রা। পুরোটাই তাই নিজের ভাগ্য আর আল্লাহর পরীক্ষা বলে মেনে নিয়েছে।
আর মুনিরা যদি নিজের নাম বলতো, তাহলে আজ আমার যায়গায় ও এখানে এই অবস্থায় থাকতো! না না, আল্লাহ্ আমাকে ওর থেকে অনেক বেশি সহ্যশক্তি দিয়েছেন। ও এসব কিছুতেই সহ্য করতে পারতোনা, আর তার উপরে নিজের অপরাধবোধে দুমড়ে চুমড়ে অনেক আগেই শেষ হয়ে যেতো। তার থেকে এই অনেক ভাল হয়েছে। আল্লাহ্ যা করেন সব ভালোর জন্য করেন।
কাজ শেষ করে বাকি সময়টা রাইয়্যান এখানে না থাকলে বাগানে বা নিচে ড্রয়িংরুমে কাটায় সিদ্রা আর রাইয়্যান থাকলে নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখে। রাইয়্যান নিজে থেকে না ডাকলে ওর চেহারা দেখা তো দূরের কথা, ওর অস্তিত্বের জানানটাও পায়না। খালার কাছে শুনেছে, খাওয়া দাওয়া এত কমিয়ে দিয়েছে, খালা জোর করলেও খেতে চায়না। এজন্য ও এখানে থাকলে প্রতিবেলায় নিজের সাথে বসিয়ে জোর করে ইচ্ছেমত খাওয়ায় ওকে, মাঝেমাঝে কান্নাও করে দেয় সিদ্রা, গুরুত্ব দেয়না রাইয়্যান।
সেদিন সকালবেলা নাস্তার পরে রান্নাঘরে চা বানাচ্ছে সিদ্রা। আগেরদিন রাতে ফিরেছে রাইয়্যান। লোকটা এখানেও সবসময় থাকেনা, টি এস্টেট ছাড়াও মনে হয় আরো বিজনেস আছে উনার। থাকলেও বা, আমার কি? আনমনে এসব ভাবছিল সিদ্রা।
এদিকে টি এস্টেটের ম্যানেজার বাসায় এসেছে রাইয়্যানের কাছে কি একটা জরুরি কাগজে সাইন করাতে। সিদ্রাকে এখানে নিয়ে আসার পর থেকে সব কাজ টি এস্টেটের অফিসেই করে রাইয়্যান, বাসায় কাউকে আসার স্কোপই দেয়না। কিন্তু আজকে ম্যানেজার নিজে থেকে চলে আসায় কিছু বলতে পারেনি। রাইয়্যান ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলছিল, ওর ধারণা খালা আছে রান্নাঘরে, উনি সিদ্রাকে এখানে আসতে দিবেননা, কিন্তু আসলে খালা রান্নাঘরে ছিলইনা।
ম্যানেজার যখন আসে, রাইয়্যান দরজার বাইরেই ছিল, ওর সাথেই বাসায় ঢুকেছে। কলিংবেলও বাজেনি, সিদ্রা জানেওনা কেউ এসেছে। ও নিশ্চিন্তে চা নিয়ে যাচ্ছে রাইয়্যানকে দিতে, ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই দেখল সোফায় অন্য লোক বসে আছে। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসল ও।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সিদ্রা। দোয়া করছে প্রাণপণে, ওই নতুন লোকটা যেন ওকে দেখে না ফেলে। তাহলে ইনি যে ওকে কি করবেন, আর মুনিরার কি করবেন, সেটা ভেবেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে ওর। কান পেতে দুজনের কথা শুনছিল সিদ্রা, যখন শুনল লোকটা বলছে, “আচ্ছা স্যার, আমি তাহলে আসি” হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সিদ্রা।
কিন্তু একটু পরেই আবার ওই নতুন লোকের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। শুনতে পেল সিদ্রা, ম্যানেজার বলছে, “স্যার উনি কে ছিলেন?” হাত পা কাঁপতে শুরু করল সিদ্রার।