#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা বোনাস পর্ব-১:
-Farhina জান্নাত
লেবার রুম থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে এলো ড. সিদ্রাতুল মুনতাহা। এক পলক তাকিয়ে দেখে নিলো সামনে দাঁড়ানো দাঁড়িওয়ালা ভদ্রলোককে। সুসংবাদটা নার্স আগেই দিয়েছে, কিন্তু লোকটা নাকি স্পেশালি ডাক্তারকে ধন্যবাদ জানাতে চেয়েছে, সেজন্যই এসেছে ও।
“মোবারকবাদ! ফুটফুটে সুন্দর একটা রাজপুত্র হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ্, অপারেশন করতে হয়নি, নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। আপনি ভেতরে গিয়ে বাচ্চাকে দেখতে পারেন” একদমে কথাগুলো বলে ফেলল সিদ্রা।
“থ্যাংকইউ! থ্যাংকইউ সো মাচ, মিস……স্যরি, ডক্টর ….. ড. সিদ্রাতুল মুনতাহা” জবাব দিলো লোকটা।
সমস্ত শরীর শিহরিত হয়ে উঠল সিদ্রার, সেই কণ্ঠ! এক সময় যে কণ্ঠ শুনলে শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের শীতল স্রোত নেমে যেতো, আজ সেই কণ্ঠই যেন কানে মধুবর্ষণ করছে। হাজার বছর পরেও এই কণ্ঠ শুনলে চিনতে পারতো সিদ্রা, কিন্তু…….. আস্তে আস্তে চোখ উপরে তুলে ভালো করে তাকাল ও। হ্যাঁ, সেই লোকটাই তো! হাসিমাখা চোখ দুটো একদম আগের মতই আছে, শুধু মুখভর্তি সুন্দর করে রাখা একমুষ্টি দাঁড়ি আগের থেকে অনেক বেশি নূরানি করে দিয়েছে চেহারাটা। এর জন্যেই প্রথম চাহনিতে বুঝতে পারেনি, এই সেই লোক, যার কথা এই সাতটা দিন প্রতি মুহূর্তে ভেবে চলেছে। শুধু সাতটা দিনের কথাই বা বলছি কেন, বলা ভালো আটটা বছর। যদিও আট বছর ধরে প্রতি মুহূর্ত এই লোকের কথা ভেবেছে বললে ভুল হবে, কিন্তু মনের কোণে যেখানে লোকটা জায়গা করে নিয়েছিল, সেখান থেকে এক ইঞ্চিও নড়েনি, বরং ধীরে ধীরে পুরো মনটাকেই দখলে নিয়ে নিয়েছে। তাই তো যখন থেকে বাধ্যতামূলক প্র্যাক্টিস এর জন্য ওর পোস্টিং শ্রীমঙ্গলে হওয়ার খবর পেয়েছে, তখন থেকেই নানারকম আশা আর স্বপ্নের জাল বুনে চলেছে অবাধ্য মন। এর পেছনে যদি আল্লাহ্র কোন ইচ্ছে নাই থাকবে, তাহলে সারাদেশে এতো উপজেলা থাকতে ওর ভাগ্যে শ্রীমঙ্গলই কেন পড়বে!?
আর যখন সাতদিন আগে সিলেটে পা রাখল, তখন থেকে ভেবে চলেছে, কি করা উচিত। লোকটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে নাকি আদৌ কিছু করবেনা, কিছুতেই ঠিক করতে পারছিল না সিদ্রা। আর আজ আল্লাহ্ উনাকে নিজে থেকেই ওর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, ওকে কিছুই করতে হয়নি। ওর দুচোখ ভরা খুশির অশ্রু স্পষ্ট দেখতে পেল রাইয়্যান। অপলক নেত্রে দুজন তাকিয়ে রইল দুজনের দিকে, পলপল করে বয়ে যাচ্ছে সময়, স্থান কাল পাত্র কিছুই যেন খেয়াল নেই কারও।
কিন্তু প্রথমে সম্বিত সিদ্রারই ফিরল। কানে বেজে উঠলো একটু আগে শোনা দুই নার্সের খেদোক্তি, “হাজবেন্ডের সাথে মেয়েটার বয়সের ডিফারেন্স অনেক বেশি মনে হচ্ছে, তাইনা?” “আমাদের দেশে এ আর নতুন কি! সুন্দর মেয়েগুলার কপালে বুইড়া স্বামী জুটে। যত্তসব!” এক লহমায় সব আনন্দ মুছে গেল, বন্যার তোড়ের মত ধেয়ে আসল অশ্রুধারা, ভাসিয়ে দিতে চাইল সব, ঝট করে চোখদুটো নামিয়ে নিল সিদ্রা। এতবছর পর লোকটার সামনে নিজেকে অপ্রস্তুত করে ফেলার কোন মানে হয়না।
“কেমন আছো?” আই কন্ট্যাক্ট ভেঙে যেতে জিজ্ঞেস করল রাইয়্যান।
“ভালো, আলহামদুলিল্লাহ্” কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার জন্য রীতিমত যুদ্ধ করতে হচ্ছে সিদ্রাকে।
“তোমার সাথে কথা ছিল, সময় হবে একটু?”
“আ…..আমি ডিউটিতে আছি এখন……” কোনমতে বলল সিদ্রা।
“ঠিক আছে, তাহলে অন্য কোথাও দেখা করি? তোমার ডিউটি শেষে?”
“আমার সাথে আবার কি কথা?” সব তো শেষ করে দিয়েছেন আপনি, মনে মনে বলল সিদ্রা।
“কি বলছ তুমি? এতো বছর পর দেখা, কথা থাকবেনা!? আমি বরং তোমাকে এখান থেকে তুলে নিই?”
“না, দরকার নেই” চোখের পানি আর কণ্ঠ সামলাতে গিয়ে আসল কথাটা বলতে পারছেনা সিদ্রা।
“আচ্ছা, তাহলে নিজেই যেতে পারবে?”
“না”
“তাহলে?” কনফিউজড শোনাল রাইয়্যানের কণ্ঠ।
“আমার সঙ্গে আপনার তো আলাদা করে কোন কথা থাকতে পারেনা। সেসব তো আট বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু আমি ডক্টর আর আপনি আমার রোগীর গার্ডিয়ান, দ্যাটস ইট!” অবশেষে শক্ত হতে পারল সিদ্রা, বুকে পাথর চেপে অবলীলায় বলে ফেলল কথাগুলো।
“সিদ্রা!” অস্ফুট কণ্ঠে অবিশ্বাস ঝরে পড়ল রাইয়্যানের।
“আপাতত পেশেন্ট এর কোন কমপ্লিকেশন নেই। কোন অসুবিধা হলে জানাবেন। আমাকে অন্য পেশেন্ট এর কাছে যেতে হবে। এক্সকিউজ মি, প্লিজ” হতভম্ব রাইয়্যানকে পেছনে ফেলে দ্রুত হাঁটা দিল সিদ্রা।
বাথরুমের দরজাটা আটকে দিতেই এতক্ষণ ধরে প্রাণপণে আটকে রাখা বাঁধটা খুলে গেল, হু হু করে চোখ দিয়ে বেরিয়ে এল কষ্টগুলো। দরজার গায়ে শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়ে নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ল সিদ্রা। কিন্তু একটু পরেই কান্নাটা আর নিঃশব্দ রইলনা। কেউ শুনে ফেলার ভয়ে তাড়াতাড়ি বালতিটা টেনে পানির কলটা খুলে দিল। এত কষ্ট যে ওর বুকের ভেতর জমে ছিল, ও নিজেও জানতনা।
ও আল্লাহ্! এতো কষ্ট হচ্ছে কেন আমার, কেন? তুমি কি এজন্যই আমাকে এখানে এনেছো? চোখে আঙুল দিয়ে সত্যিটা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য? এতোগুলো বছর কি তবে আমি মিথ্যে আশার জাল বুনে গেছি!? অলীক কল্পনায় নিজেকে ভাসিয়ে রেখেছি!?
কিন্তু আমি তো এসব ভাবতে চাইনি। সব তো ভুলে যেতে চেয়েছিলাম আমি, ওই তিনমাসের শিক্ষাগুলো ছাড়া বাকি সবকিছু! কিন্তু সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো সেদিন, যেদিন আমি জানতে পারলাম উনার মনের কথা। সাত বছর আগের সেইদিনটা যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে সিদ্রা।
সেদিন মুনিরা মোবাইলে সিদ্রাকে একটা ভিডিও দেখাচ্ছিল। ওদের ক্লাসের একটা ছেলে নাকি ওদেরই ক্লাসের একটা মেয়েকে বিশাল আয়োজন করে নিজে গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে প্রপোজ করেছে। সেটা দেখতে গিয়ে চমকে যায় সিদ্রা, এতো সেই গান, যেটা ওই লোকটা ওইদিন নৌকা চালানোর সময় গেয়েছিল। কিন্তু এই গান ওইরকম একটা জায়গায় উনি কেন গাইলেন! উনি বলেছিলেন পরিবেশের সাথে মানানসই, মানে কি তার? মুনিরাকে তখনি ও গানটার অর্থ জিজ্ঞেস করে। ইউটিউবে সার্চ করে গানটার লিরিকস এন্ড মিনিং বের করে দেয় মুনিরা ওকে। আর তখনই সিদ্রা আবিষ্কার করে আশ্চর্য সত্যিটা, লোকটা সেদিন গানের মাধ্যমেই ওকে নিজের মনের কথা বলতে চেয়েছিল। আর সেজন্যই ও হিন্দি বোঝেনা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। গানটার প্রতিটা শব্দ, আর লোকটার অন্তরের অনুভূতি অনুভব করতে পেরে নিজেকে সামলাতে পারেনি সিদ্রা, কান্নায় ভেঙে পড়ে। তারপর মুনিরাকে রাতারগুলে যাওয়ার দিনের পুরো ঘটনা ফার্স্ট টু লাস্ট খুলে বলে ও। এর আগে সবাইকে সবকিছু বলার সময় এ ঘটনাগুলো স্কিপ করে গেছিল। কেন যেন মনে হয়েছিল ওর, সবকিছু সবাইকে বলার দরকার নেই, কিছু কথা নিজের জন্যেও বাঁচিয়ে রাখতে হয়।
মুনিরা হা হয়ে শুনেছিল পুরোটা, সিদ্রা থামতে ওর মাথায় একটা জোরে চাটি মেরে বলেছিল, “তুই আমার বোন হয়ে এতো গাধী কেমনে হলি, বলতো! গান তো বাদই দে, তোর সাথে উনার ব্যবহার দেখেই তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে লোকটা তোকে কতটা ভালোবাসে! আমি জাস্ট শুনেই বুঝতে পারছি, আর তুই উনার সাথে থেকে চোখের সামনে দেখেও বুঝতে পারিসনি! উজবুক একটা!”
তারপর মুনিরা মাঠে নামে লোকটার গাওয়া দ্বিতীয় গানটাও খুঁজে বের করার জন্য। কিভাবে কিভাবে যেন অনেকগুলো গানের একটা লিস্ট করে ফেলে। তারপর সেখান থেকে প্রতিটা গান এক কলি কলি এক করে গেয়ে শোনায় সিদ্রাকে। প্রচুর গান শোনার কল্যাণে মুনিরার গলার সুর ভালই, ঠিকঠাকই গাইতে পারে। এভাবেই মুনিরার প্রচেষ্টায় সিদ্রা পেয়ে যায় লোকটার গাওয়া দ্বিতীয় গান “ম্যায় ফির ভি তুমকো চাহুঙ্গা”। এরপর মুনিরা সিদ্রার ফোনে এ দুটো গান ডাউনলোড করে দিয়েছে, কিন্তু কখনো শুনেনি সিদ্রা। ও জানে, সেদিনের মতো ভালো লাগা সম্ভব না, সেদিন প্রতিটা কথা, সুর, তাল যে শুধুই সিদ্রার জন্য ছিল। তবে গান দুটার প্রতিটা লাইন ওর মুখস্থ, কতবার যে লিরিক্সগুলো পড়েছে, তার হিসেব নেই। গানদুটোর প্রতিটা শব্দ যেন মনের ভেতরে আনন্দের স্রোত বইয়ে দেয়। কেউ ভালবাসে জানলে যে এতো আনন্দ লাগতে পারে, আগে জানা ছিলনা ওর।
এরপর কি আর রাইয়্যানকে ভোলা সম্ভব ওর পক্ষে!? যে মানুষটা ওকে মনে রেখে জীবন পার করে দিতে চেয়েছে, তাকে ও কিভাবে নিজের মনে জায়গা না দিয়ে পারতো! কিন্তু আজ যে সব মিথ্যে হয়ে গেল। প্রমাণ হয়ে গেল, উনি আমাকে ভালোবাসেননি। আরেক দমক কান্না যেন ভাসিয়ে দিল সিদ্রাকে, দুহাতে শক্ত করে বেসিন আঁকড়ে ধরল সিদ্রা।
কিন্তু সেটাই কি স্বাভাবিক না? সময় মানুষকে বদলে দেয়, ভুলিয়ে দেয় অনেক কিছু। উনি একসময় হয়ত আমাকে ভালবেসেছিলেন, কিংবা বলা ভালো, উনার মনে হয়েছিল সেটা। পরে তো আর সেটা মনে নাও হতে পারে তাইনা?
হুম, ওইটা উনার মোহ ছিল। বলা ভালো অপরাধবোধ থেকে তৈরি হওয়া অনুভূতি! কথায়ই তো আছে, আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড। উনি বলেছিলেন, আমার কথা ভেবেই জীবন পার করে দিবেন। কিন্তু আসলেই কি আর কোন মানুষের পক্ষে সেটা করা সম্ভব!? তিনমাসের পরিচয়ে একটা মেয়ের জন্য হওয়া ক্ষণিকের গিল্টি ফিলিং থেকে উনি আবেগতাড়িত হয়ে গানদুটো গেয়েছিলেন! তার জন্য সারাজীবন নষ্ট করার তো কোন মানে হয়না তাইনা। উনি তো ঠিক কাজই করেছেন। আর আমি এতো দুঃখ কেন পাচ্ছি? আমিই তো উনাকে পরিষ্কার বলে দিয়েছিলাম, আমাদের পথ সম্পূর্ণ আলাদা, কোনদিন এক হওয়ার না, উনার প্রস্তাব আমিই তো ফিরিয়ে দিয়েছিলাম বোকার মত ভুল বুঝে। তাহলে এখন এতো গুলো বছর পর আমি উনাকে কিভাবে দোষ দিচ্ছি!? কেন? একটা গানের জন্য? যে গানের সব কথা উনার নিজের মনের নাও হতে পারে! হা হা হা। আসলেই মুনিরা ঠিকই বলে, আমার মতো বোকা কেউ নেই। সারাজীবন বোকার স্বর্গেই বাস করে গেলাম। চোখ মুছল সিদ্রা, ভালো করে মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে।
মুখ তো ধুয়ে ফেলল, কিন্তু তাতে কষ্ট কি আর ধুয়ে গেল? সেতো ক্ষণে ক্ষণে জানান দিয়ে ভিজিয়ে চলল চোখের কোণ। কিন্তু সিদ্রা বুঝতে পারছেনা ওর সাথে লোকটা দেখা কেন করতে চাইছিলো। সে আর ভেবে কি হবে, মানা করে ভালোই হয়েছে, নতুন ক্ষতে আরো কষ্ট দেয়ার কি দরকার? উনার ওয়াইফকে দেখতে গেলেই সেটা যথেষ্ট পাওয়া যাবে। আর তাছাড়া এর আগে উনার সাথে বাইরে গিয়েছিলাম বাধ্য হয়ে, কিন্তু এখন একজন গাইরে মাহরামের সাথে বাইরে দেখা করাটা তো কোনভাবেই উচিত নয়। কিন্তু আরো দেড়টা বছর এই কষ্ট নিয়ে আমি এখানে থাকবো কিভাবে?
নাহ! কষ্ট নিয়ে কেন থাকতে যাবো? আল্লাহ্ যখন আমাকে এতোবড় সত্যের মুখোমুখি করেই দিলেন, তখন আমারও উচিত সেটা মেনে নিয়ে জীবনে এগিয়ে যাওয়া। মিছে আশায় জীবন বরবাদ করার কোন মানে হয়না আর। গতকাল রাতেই তো আব্বু একটা নতুন প্রস্তাবের কথা বলেছেন। আর আমি আমার মিথ্যে সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে আব্বুর কথা শুনিইনি, টায়ার্ড হওয়ার অজুহাত দিয়ে ফোন রেখে দিয়েছি। আল্লাহ্ আমাকে যখন সঠিক পথের সন্ধান দিয়েই দিয়েছেন, তখন সেটা ধরেই এগোন উচিত।
সিদ্রা ফোন বের করে ডায়াল করল আব্বুর নাম্বারে। সালাম এবং কুশল বিনিময়ের পর বলল,
“আব্বু, তুমি কালকে একটা ছেলের কথা বলছিলে…..”
“হ্যাঁ মা, আমি চাই তুই একবার শুনে দেখ…..”
“না আব্বু, আমার শোনার প্রয়োজন নেই। তোমার আর আম্মুর যদি পছন্দ হয়, আর আমার রিকোয়ারমেন্টস তো তুমি জানোই……….. ছেলে যদি আমার ব্যাপারে সবকিছু জেনে রাজি থাকে, আমার কোন আপত্তি নেই”
“কি বলছিস মা? হঠাৎ করে এমন কথা বলছিস! কিছু হয়েছে?”
“না আব্বু, এমনিই মনে হল, তোমাদের আর কতদিন টেনশনে ফেলে রাখব”
“কিন্তু তাই বলে কিছু না শুনেই…….”
“বললাম তো আব্বু, তোমরা রাজি থাকলে আমিও রাজি, তোমাদের উপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে”
“কিন্তু তাও…..”
“আচ্ছা আব্বু, আমাকে ডাকছে, আমি রাখি এখন, হ্যাঁ, আল্লাহ্ হাফেজ” আব্বুকে আর কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কলটা কেটে দিলো সিদ্রা। কেমন যেন একটা পৈশাচিক আনন্দ অনুভূত হচ্ছে, লোকটাকে ওর বিয়ের সংবাদ শোনালে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে ভেবে। কিন্তু লোকটার কি আদৌ কিছু যাবে আসবে?
***
সাতরঙ রেস্টুরেন্টের দ্বিতীয় তলায় কোণার দিকের একটা টেবিলে বসে আছে সিদ্রা আর ওর এক সহকর্মী মুনমুন। সেম ব্যাচ, দুজনে একসাথেই জয়েন করেছে, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হতে তাই সময় লাগেনি। গত দুইদিন থেকে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার জন্য ধরেছে মেয়েটা। সিদ্রা রাজি হয়নি এ কয়দিন, কিন্তু আজকের ওই ঘটনাটার পর থেকে মন এতো বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তাই ভাবলো, একটু যদি মন অন্যদিকে সরানো যায়!
কিন্তু রেস্টুরেন্টের সামনে এসেই দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়েছে ওকে, অতীত এতো সহজে ওর পিছু ছাড়বেনা। এটা সেই রেস্টুরেন্ট, যেটাতে সেই স্মরণীয় দিনটায় সকালের নাস্তা করেছিল ও আর ওই লোকটা। আট বছরে অনেক উন্নত হয়েছে রেস্টুরেন্টটা। আগে সাধারণ একটা হোটেল ছিল, আর এখন সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। দ্বিতীয় তলাটা আগে আবাসিক হোটেলের অংশ ছিল, এখন সেটাকে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে পরিণত করা হয়েছে। পরিবর্তন তো আমারও আমূল হয়েছে, সেদিন ছিলাম সাধারণ একজন বন্দিনী, আর আজ একজন স্বাধীন মানুষ শুধু না, সমাজের চোখে যথেষ্ট সম্মানিত একজন মানুষ। এদিকওদিক তাকিয়ে রেস্টুরেন্ট এর সাজসজ্জা দেখতে দেখতে এসবই ভাবছিল সিদ্রা। আর মুনমুন মনোযোগ দিয়ে মেনু দেখছিল আর কিছু অর্ডার দেয়া যায় কিনা। ঠিক তখনি মুনমুনের ফোনটা বেজে উঠল। ওপাশের কথা শুনেই মুখটা কালো হয়ে গেল ওর।
“আচ্ছা, আমি আসছি” ফোনটা কেটে কান্নার মতো একটা আওয়াজ করল মুনমুন। “আমার সাথেই কেন এগুলা হয়! তুমি আজকেই রাজি হলা আর আজকেই আমার দরকার পড়ল ইমার্জেন্সি পেশেন্ট এর জন্য!”
“আরে পাগলী, এভাবে বলে নাকি! আমরা তো এজন্যই ডাক্তার হয়েছি নাকি? নিজের থেকে আগে রোগীর প্রায়োরিটি। তুমি, আমি, রেস্টুরেন্ট কোনটাই তো আর পালিয়ে যাচ্ছেনা। আমরা ইন শা আল্লাহ আবার আসব।”
“ঠিক বলেছো। কিন্তু খাবারের অর্ডার তো দিয়ে ফেলেছি, এখন?”
“আমি ওইসব ম্যানেজ করে নিচ্ছি, তোমাকে টেনশন করতে হবেনা। তুমি দৌড় দাও। আমি পরে তোমাকে ফোনে জানিয়ে দিব”
“ওকে, টা টা, সাবধানে যেও তুমি” ব্যাগ তুলে সত্যি সত্যিই দৌড় দিল মুনমুন।
“আল্লাহ হাফেজ” পেছন থেকে বলল সিদ্রা, যদিও মুনমুনের কানে সেটা পৌঁছল বলে মনে হলোনা।
সিদ্রা হাত ইশারা করে ওয়েটারকে ডাকল। অর্ডারটা ক্যান্সেল করা গেলে ভালো, নাইলে প্যাক করে নিয়ে নিবে আর মুনমুন কে ওর বাসায় চলে আসতে বলবে। কিন্তু বিধি বাম, ওয়েটার কাউন্টারে বলে দেখতে বলল, ওর পক্ষে কিছু করা সম্ভব না। উঠে দাঁড়াল ও।
কিন্তু ওখানে ওর জন্য আরও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। কাউন্টারের লোকটার সাথে কথা বলার মাঝখানে পাশ থেকে চেনা কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
“এনি প্রব্লেম?”
চমকে উঠল সিদ্রা। আশ্চর্য! ওয়াইফ আর সদ্যপ্রসূত ছেলেকে হাসপাতালে রেখে উনি রেস্টুরেন্টে কি করছেন! তাকাতেই থমকে গেল আবার। দাঁড়িওয়ালা চেহারাটা যেন এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছেনা ওর। ওমা, প্যান্টও তো অনেকটা উপরে পরেছে, ইচ্ছে করে টাখনুর উপরে পরেছে নাকি? সুবহানাআল্লাহ! এই লোকের এতোটা পরিবর্তন কিভাবে হল!?
“এনি প্রব্লেম?” উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞাসা করল রাইয়্যান।
“আ-হ্যাঁ, বান্ধবীর সাথে এসেছিলাম। কিন্তু ওকে ইমার্জেন্সি চলে যেতে হয়েছে। তাই আর কি অর্ডারটা ক্যান্সেল করতে চাচ্ছি”
“কারো সর্বনাশ আর কারো পৌষমাস!” মুচকি হেসে বিড়বিড় করল রাইয়্যান।
“কিছু বললেন?” ভ্রুকুটি করল সিদ্রা।
“না, কিছুনা। ম্যাডাম যখন ক্যান্সেল করতে চাইছেন তখন ক্যান্সেল করে দাও” কাউন্টারের লোকটাকে বলল রাইয়্যান।
“ওকে স্যার” টেলিফোন তুলল লোকটা।
“আচ্ছা, দেখা যখন হয়েই গেল তখন আমি কি একটু সময় পেতে পারি? রোগীর গার্ডিয়ান হিসেবেই নাহয়” সিদ্রার দিকে ফিরে বলল রাইয়্যান।
“আচ্ছা ঠিক আছে, বলুন কি বলবেন” কেন যেন আর না করতে পারলনা সিদ্রা। কারণটা কৃতজ্ঞতাবোধ হোক আর লোকটা কি বলতে চায় সেই কৌতূহলই হোক।
“বসে কথা বলি?”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল সিদ্রা।
“কেমন আছো, সিদ্রা?” কাউন্টার থেকে খানিকটা দূরের টেবিলে চেয়ার টেনে বসে নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো রাইয়্যান।
“আলহামদুলিল্লাহ্! আল্লাহ্ যেমন রেখেছেন” আপনি তো ভালই আছেন, জিজ্ঞেস করে আর কি হবে, মনে মনে বলল সিদ্রা।
ওয়েটারকে হাত নাড়ল রাইয়্যান।
“স্যরি, আমি হয়তো বেশিই চেয়ে ফেলছি, কিন্তু কিছু কি খাওয়া যাবে?” স্পষ্ট হেজিটেশন রাইয়্যানের কণ্ঠে।
“ঠিক আছে, আমার জন্য একটা স্যান্ডউইচ আর কফি” রেস্টুরেন্টে খাবে বলে লাঞ্চ স্কিপ করেছিল দুজনেই। পরে মুনমুন চলে গেলে ভেবেছিল বাসায় গিয়ে চা মুড়ি খেয়ে এখনকার মত সামলে নিবে। কিন্তু লোকটা এখন কতক্ষণ ওয়েট করাবে কে জানে। ক্ষুধা আর সহ্য করা যাচ্ছেনা।
“কোল্ড কফি না হট কফি, ম্যাম?” জিজ্ঞেস করলো ওয়েটার।
“হট” উত্তর দিল সিদ্রা।
“ওকে, তাহলে আমার জন্যেও তাই” বলল রাইয়্যান, “কিন্তু হট কেন? রেস্টুরেন্ট এ এসে সবাই তো কোল্ড কফি খেতে পছন্দ করে”
“আমিও করি, কিন্তু একটু ঠাণ্ডা লেগে গেছে”
“ও, নতুন জায়গা তো! তারপর, কেমন লাগছে এখানে এসে?”
“হুম, ভালোই” কাটাকাটা উত্তর দিচ্ছে সিদ্রা।
“আমি কিন্তু ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছো। কিন্তু আসলে আমি যা করেছি তাতে এটাই আমার প্রাপ্য, আমি বোধহয় একটু বেশিই আশা করে ফেলেছিলাম” মাথা নিচু করে কথাগুলো বলছিল রাইয়্যান।
চমকে উঠল সিদ্রা। তাইতো, আমি তো উনাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। ভবিষ্যতে দেখা হলে অপরিচিতের ভান করব, এমন তো কথা দিইনি। উনি নিজের জীবনে মুভ অন করেছেন, তাতে আমার এমন ব্যবহার কি খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছেনা?
“স্যরি, আপনার খারাপ লেগেছে। আমার ব্যবহারের জন্য দুঃখিত” ইতস্তত করে বলেই ফেলল সিদ্রা।
“ডোন্ট বি, আই ডিজার্ভ ইট” একইরকম নরম স্বরে বলল রাইয়্যান।
“বুবু কেমন আছে?” প্রসঙ্গ পালটানোই শ্রেয়, ভাবল সিদ্রা।
“বুবুর খবর শুনলে না পুরো চমকে যাবে” চোখজোড়া উজ্জ্বল হয়ে উঠল রাইয়্যানের।
“তাই নাকি?” এক্সাইটেড হয়ে গেল সিদ্রা, কি এমন খবর!
“বুবু এখন সুইজারল্যান্ড এ, তাও আবার মেবি সেভেন্থ কি এইটথ হানিমুনে”
“হানিমুন!?” আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল যেন সিদ্রা, কন্ঠের খুশিটা লুকানোর চেষ্টাও করলনা, “বুবু বিয়ে করেছে? কবে? কাকে?” মনে ক্ষীণ আশা, হয়ত ফিরে এসেছে বুবুর সেই ভালবাসা।
“এইতো, দুবছর হল। সে এক দারুণ কাহিনী, সিনেমাকেও হার মানায়। আসলে বুবু যখন এফসিপিএস করছিল, তখন ভাইয়া বুবুকে প্রপোজ করেছিল আর এজ ইউজুয়াল বুবু তাকে রিজেক্ট করে। বেচারা দুঃখে কষ্টে এতোদিন ধরে আর বিয়েই করেনি। এই দুবছর আগে আবার যখন দেখা হল বুবুর সাথে আর বুবু জানতে পারল যে তার জন্যেই হত্যে দিয়ে বসে আছে লোকটা, আর দেরী না করে বিয়ে করে নিয়েছে। বুবু কি বলেছিল জানো, একবার ভালবাসা হারিয়েছি, আবার যখন আল্লাহ্ আমাকে আরেকজনের ভালবাসা পাবার সুযোগ করে দিয়েছেন, তখন সেই ভালবাসা পায়ে ঠেলে দেয়ার ক্ষমতা আমার নাই”
“ওয়াও! গ্রেট! আই মিন জাস্ট দারুণ! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিনা। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ বুবুকে উত্তম জীবনসঙ্গী মিলিয়ে দিয়েছেন” মুখে একথা বললেও মনে মনে বলল, কই আপনি তো পারলেননা আপনার ভালবাসার প্রমাণ দিতে, আমার জন্য অপেক্ষা করতে, অথচ আপনি কথা দিয়েছিলেন!
এসময় খাবার সার্ভ করে গেল ওয়েটার। সিদ্রা কফিতে ১ চা চামচ চিনি মিশিয়ে রাইয়্যানের দিকে এগিয়ে দিয়ে আরেকটা কাপ নিজের দিকে টেনে নিল। আর কাজটা করেই লজ্জায় পড়ে গেল। ধুর, কেন যে আগ বাড়িয়ে করতে গেলাম। রাইয়্যান মুচকি হেসে বলল,
“জাযাকিল্লাহু খইরন”
এবার সিদ্রা পুরো শকড হয়ে গেল, লোকটা থ্যাংক ইউ না বলে জাযাকিল্লাহ বলছে, তাও আবার জেন্ডার ঠিক করে! (ছেলেদেরকে জাযাকাল্লাহ আর মেয়েদের জাযাকিল্লাহ বলা হয়, অর্থ একই)
“ওয়া ইয়্যাকা আইদন” সিদ্রা নিজের কফিটা নাড়তে নাড়তে বলল,”আপনি কি কথা যেন বলতে চেয়েছেন?” বলল ও।
“হুম! বুবু না, বিয়ের পর পুরো ট্রাভেল ফ্রিক হয়ে গেছে। শশুরবাড়ি যাওয়া তো আছেই, তার সাথে শুরু করেছে একের পর এক ঘোরাঘুরি! এতোদিনে ডাক্তারি করে কম টাকা তো আর জমায়নি দুজন মিলে। ওয়ার্ল্ড ট্যুর দিচ্ছে এখন!”
“এভাবে বলছেন কেন? বুবু কত বছর পর নিজের জীবনটা একটু এনজয় করার সুযোগ পেয়েছে, করবেনা!?”
“হুম, সেতো ঠিক আছে, কিন্তু কপাল তো আমার পুড়েছে, না!? আমার চা বাগানের শ্রমিকদের তো অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে ডাক্তার ছাড়া। তাই বুবুর অনুপস্থিতিতে ওদের জন্য একজন ডাক্তারের খুব দরকার হয়ে পড়েছে”
ও, আমি এখন যেন আপনার চা বাগানে গিয়ে ডাক্তারি করি, আপনি আমাকে সেই কথা বলতে ডেকেছেন! ছিঃ আপনি এটা ভাবতে পারলেন!? যেখানে আমাকে সবার সামনে নিজের ওয়াইফ পরিচয় দিয়ে রেখেছিলেন, সেখানে এখন একথা ভাবতে আপনার বাধল না। নাকি যারা আমাকে চিনতো, তারা আর কেউ কাজ করেনা এখন! আপনার কাছে থেকে প্রস্তাবটা শুনতেও তো আমার জঘন্য লাগবে।
“খালা কেমন আছে?” আবারও কথা ঘোরাল সিদ্রা।
“ভালো, আলহামদুলিল্লাহ। তোমার কথা সবসময় বলে। আমি তোমাকে কেন যেতে দিলাম, তার জন্য আমাকে আজও ক্ষমা করতে পারেনি”
আচ্ছা, তা আপনার বউয়ের সামনে বলে না পেছনে? মনে মনে টিটকিরি না দিয়ে পারলনা সিদ্রা।
“ভাগ্যিস, এখানে তেমন থাকিনা, নাহলে মনে হয় খালার অত্যাচারে কবেই পাগল হয়ে যেতাম!” হাসল রাইয়্যান।
“এখানে তেমন থাকেননা মানে?”
“হুম, দরকার পড়লে আসি, কাজ শেষে চলে যাই। রাতে পারতপক্ষে থাকিনা”
“ও, আপনার ওয়াইফ বুঝি এখানে থাকতে পছন্দ করেননা, ঢাকায় থাকতে প্রিফার করেন?”
রাইয়্যান কফিতে প্রথম চুমুক দিয়েছিল, সিদ্রার কথা শুনে এমন বিষম খেলো, মুখ থেকে কফি ছলকে পুরো টেবিল ভিজে গেল, ছিটেফোঁটা সিদ্রার গায়েও পড়ল গিয়ে।
“ওয়াইফ! কার ওয়াইফ!? কিসের ওয়াইফ!? আমি তো বিয়েই করিনি” শকড কণ্ঠ রাইয়্যানের।
“তাহলে আজ সকালে যে ডেলিভারি করালাম” এবার অপ্রস্তুত হয়ে গেল সিদ্রা, এমন রিএকশন এক্সপেক্ট করেনি।
হা হা করে হেসে উঠল রাইয়্যান, হাসতে হাসতে টিস্যু নিয়ে মুখ আর নিজের জামায় পড়া কফি মুছতে লাগল। কোনমতে হাসি থামিয়ে ওয়েটারকে ডাক দিল টেবিল পরিষ্কার করার জন্য। তারপর সিদ্রার দিকে তাকিয়ে বলল, “ও তো তানজিয়া, বুবুর ননদ। ভাইয়ের অমতে প্রেম করে বিয়ে করেছে, কিন্তু তার ভাবী, মানে বুবু মেনে নিয়েছে। প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর এখানে এসেছে ফ্রেশ আলোবাতাসের জন্য। ছেলেটা বেকার বলে আমিও সুযোগ বুঝে চা বাগানের কাজে লাগিয়ে দিলাম। গতকালকে একটা কাজে ওকে ঢাকা পাঠিয়েছি। আমি কি আর জানি, ওর বৌ এর আজকেই পেইন উঠবে! বাধ্য হয়ে আমাকেই হাসপাতালে নিয়ে আসতে হল। আর তুমি ভেবে নিলা ও আমার ওয়াইফ! হা হা হা। আমার অর্ধেক বয়সের একটা মেয়ে, হা হা হা” কোনভাবেই হাসি থামাতে পারছেনা রাইয়্যান।
ফিক করে হেসে দিল সিদ্রা, সারাশরীরে যেন আনন্দের বান ডাকল। সেই আনন্দ প্রকাশ পেল ওর চোখেও, নেচে উঠল সেগুলো। আর সেটা দেখে রাইয়্যানের খুশি তো আর ধরেনা। তানজিয়া আমার ওয়াইফ না শুনে যখন ও খুশি হয়েছে, তার মানে আমার জন্য ওর মনে একটু হলেও জায়গা আছে।
“আমি এখানে থাকিনা না, থাকতে পারিনা। ফারহান চলে যাওয়ার পরই খালি বাংলোটা আমাকে গিলে খেতে আসতো। তারপর সেখানে তোমাকে আনলাম, প্রতিশোধের নেশায় একাকিত্ব অনুভব করার সুযোগই হয়নি। কিন্তু তুমি চলে যাওয়ার পর সেটা মারাত্মকভাবে ফিরে আসে। যেদিকে তাকাই, সেদিকে শুধু তোমার স্মৃতি, ইট ওয়াজ জাস্ট ঠু পেইনফুল! তুমি বুঝবেনা! তাই এখানে আসা কমিয়ে দিয়েছি। খালাও বুবুর কাছে থাকে তখন থেকে, মাঝেমাঝে কাজের লোক এনে শুধু পরিষ্কার করে রাখে” রাইয়্যানের কণ্ঠের বেদনা একদম অন্তরে গিয়ে লাগল সিদ্রার, মনে আর কোন সন্দেহই থাকল না। ও যে এতোদিন ধরে মিথ্যে আশায় দিন কাটায়নি, উনি যে ওকে দেয়া কথা ঠিকমতোই রেখেছেন, তা আর বলতে! নিজে বোকার মতো এতো কিছু ভেবে নিয়ে লোকটাকে অবিশ্বাস করার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে এখন।
একেবারে বাকহারা হয়ে গেল সিদ্রা, কি বলবে বুঝতে পারছেনা। অস্বস্তিকর নিরবতা বিরাজ করছে, দুজনেই চুপচাপ যার যার স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। অবশেষে নিরবতা ভাঙল সিদ্রাই,
“খালার যখন নিউমোনিয়া হয়েছিল, খালাকে কি এখানেই নিয়ে এসেছিলেন?” এত বড়লোক মানুষ হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ আনাটা বেমানান ঠেকছে ওর কাছে।
“আরে না, খালাকে তো মেডিকেয়ারে নিয়ে গিয়েছিলাম, চিনো নিশ্চয় এখন?”
“হুম শুনেছি ওইটার কথা। তাহলে আজকে…..?”
“ও, আর বইলো না। খালা ওকে এতো করে বোঝাল যে কোন সমস্যা নেই, হাসপাতালে নেয়া লাগবেনা, বাসাতেই হয়ে যাবে। সে মেয়ে কিছুতেই মানবেনা, বাসায় ডেলিভারি করবেনা তো করবেইনা। তাই আমি সিরিয়াস না বুঝেই এখানে কাছে নিয়ে এসেছি। আর তাছাড়া……..” সিদ্রার দিকে তাকাল রাইয়্যান “এখানে তুমি আছো, এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে”
বহুদিন পর গালদুটো লাল হয়ে গেল সিদ্রার। ভাগ্যিস, নেকাব পরে আছি, মনে মনে বলল ও।
“মুনিরা কেমন আছে এখন?” জিজ্ঞেস করল রাইয়্যান।
“ভালো, আলহামদুলিল্লাহ্। ওর বিয়ে হয়েছে, মিষ্টি একট মেয়ে আছে। কিন্তু…… এখন মানে?” অবাক হল সিদ্রা।
“হুম, ওর তো কিছু প্রব্লেমস হয়েছিল, তোমরা মানসিক ডাক্তার দেখিয়েছিলে ওকে। এখন ঠিক আছে কিনা সেটাই জানতে চাইছি” সিদ্রা বাসায় ফিরে আসার পর যখন মুনিরা জানতে পারে, ওর জন্য ফারহান আত্মহত্যা করেছে, ব্যাপারটা শুরু হয় তখনি। তারপর আস্তে আস্তে সিদ্রার সাথে ঘটতে থাকা একের পর এক ঘটনা আর মানুষের অপবাদ, মিথ্যে রটনা দেখে দেখে নিজের ভেতরে অপরাধবোধে ছোট হতে থাকে ওর মন। এক পর্যায়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে ও। তারপর একজন বড় মানসিক ডাক্তার এর কাছে ছয়মাস ধরে নিয়মিত কাউন্সিলিং করে আলহামদুলিল্লাহ্ সুস্থ হয়েছে মেয়েটা। কিন্তু এসব উনি কি করে…..!? ভাবল সিদ্রা।
“আপনি এসব কি করে জানেন?”
“জানব না বলছো? যাদের এতো বড় ক্ষতি আমি করেছি, তাদের কোন উপকারে না আসতে পারি, তারা কেমন আছে, কি করছে, সে খবরটুকুও রাখবনা?”
রাইয়্যানের ফোন বেজে উঠল এসময়, স্ক্রিনের দিকে চাইতেই মুখের এক্সপ্রেশন চেঞ্জ হয়ে গেল। সিদ্রার দিকে তাকাল রাইয়্যান, “স্যরি, আমি একটু কথা বলে আসি?”
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল সিদ্রা। রাইয়্যান চলে গেলে সিদ্রা চেয়ারে হেলান দিল। এখনও সবটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে ওর কাছে। উনি যা বলে গেলেন, এসব কিছু সত্যি! উনি আমাদের সব খবর রাখেন। তার মানে আমি ভুল ভাবিনি, উনি সত্যিই…….. আর ভাবতে পারছেনা সিদ্রা। এতো খুশি, এতো আনন্দ যেন একসাথে হজম করার ক্ষমতা ওর নেই। রাইয়্যান ফিরে এল, ওর মুখটা আনন্দে চকচক করছে। এমন কি খুশির খবর পেলেন উনি? তবে জিজ্ঞেস করতে কেমন জানি লাগল, অপেক্ষা করতে লাগল হয়ত নিজে থেকেই বলবে। কিন্তু ওকে নিরাশ করে কিছুই বললনা রাইয়্যান। আর তেমন বিশেষ কোন কথা হলনা দুজনের মধ্যে, তবে বাকি সময়টা খুশিখুশি ভাবটা বজায় থাকল রাইয়্যানের চেহারায়।
“বিলটা প্লিজ আমি পে করি?” খাওয়া শেষে বলল সিদ্রা।
“ইম্পসিবল! তুমি আমার গেস্ট। তুমি কেন পে করবে?”
“ইশ! কে কার গেস্ট? এর আগে আপনি আমাকে খাইয়েছেন। সেদিন তো আমার সামর্থ্য ছিলনা, কিন্তু আজ আছে। তাই আজ বিলটা পে করতে পারলে আমার খুব ভালো লাগবে”
“ওকে, বাট শুধু আজকেই, এরপর কিন্তু আর কোনদিন না”
আবার গালদুটো লাল হয়ে গেল সিদ্রার, আর কোনদিন না! তার মানে উনি বোঝাতে চাচ্ছেন, আমরা আরও অনেকবার এখানে আসব!
“সেটা নাহয় তখন দেখা যাবে” মুচকি হেসে বলল ও।
***
গভীর রাত। শ্রীমঙ্গলের আকাশে আজ চাঁদ নেই, আছে ঠান্ডা বাতাস আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি। ঘুমানোর জন্য একেবারে উপযুক্ত আবহাওয়া, কিন্তু সিদ্রার চোখে ঘুম নেই, বিছানায় শুয়ে এপাশওপাশ করছে ও। নিজের পাছায় কষে একটা লাত্থি মারতে ইচ্ছে করছে। কোন বুদ্ধিতে যে সকালে বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেলাম, এখন কি করব?
একটু আগে ফোন দিয়েছিল আম্মুর কাছে, নিজের পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য। ও বাবা, ওকে কিছু বলার সুযোগই দেয়নি জাহানারা বেগম, খুশির চোটে মুখে যেন তুবড়ি ছুটছে। সাথে সাথে বুঝে গেছে মহা ভজঘট পাকিয়ে ফেলেছে।
সবাই এতো এতো খুশি, আমি ফাইনালি বিয়েতে রাজি হয়েছি বলে। এখন না করলে কতটা কষ্ট পাবে! আর না করবই বা কোন যুক্তিতে? আর উনি এতদিন বিয়ে করেননি ঠিক আছে, কিন্তু তাই বলে এখন আমাকে বিয়ে করতে চান কিনা আমি কি করে বুঝব!? বেহায়ার মতো তো আর আম্মু আব্বুকে বলতে পারব না, যেই লোকের জন্য এতো কিছু হয়েছে, এখন আমি তাকে বিয়ে করতে চাই বলে এ বিয়ে করতে পারব না। ওরে বাপরে, কথাটা শুনলে আম্মুর যে এক্সপ্রেশন হবেনা, ভাবতেই তো ভয় করছে! আম্মু তো উনাকে সহ্যই করতে পারেনা। উনার দেয়া জামা, জুতো, বোরকা সবকিছু পুড়িয়ে ফেলেছিল আম্মু। উনার স্মৃতি বলতে শুধু ওই বোরকার বোতামটাই আছে। উঠে গিয়ে ব্যাগ থেকে বোতামটা বের করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো সিদ্রা। বৃষ্টির ছাঁট এসে ছুয়ে দিল ওকে, আর সিদ্রা হারিয়ে গেল স্মৃতির ভূবনে। ভাগ্যিস, ওইদিন উনি যাওয়ার সময় বোতামটা দিয়েছিলেন, নাহলে তো কিছুই থাকতো না আমার কাছে। এতগুলো বছর ধরে যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছি বোতামটা। কিন্তু আদৌ কি কোন লাভ আছে! নিজের বোকামিতে তো নিজের কপাল অলরেডি পোড়াতে বসেছি।
কিন্তু উনি কিছু বললেন না কেন?