অপরিণত ভালোবাসার পরিণতি পর্ব:৩

0
278

#অপরিণত_ভালোবাসার_পরিণতি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব : ৩
__________

আকাশের মাঝে যখন সাদা তুলোর মেঘ ওড়ে যাচ্ছিল কিংবা লাল ও হলুদ রঙে মিশ্রিত রংতুলির আঁকায় সূর্যের আলোটা সন্ধ্যের ঘনিয়ে আসার কারণে ম্লান হচ্ছিল; তখন উঠানে কবিতার পদধূলি পড়ে উঠানের মাটির বুকে। শুভ্র মুখশ্রীতে আনন্দে ঢেউ খেলানো হাসির ছটা। তার বান্ধবীরা বাড়ির ভেতরে তখন কবিতার নাম নিয়ে ঢুকছিল। সেই শব্দ শুনেই কবিতা বাইরে বেরিয়ে আসে।

বিয়েকে উপলক্ষে তাদের আগমন। উঠানে দাঁড়িয়েই কবিতা তার বান্ধবীদের সাথে হাসিঠাট্টায় মশগুল তখনই অন্যকেউ তার হাস্যরসাত্মক মুখচ্ছবি মনের ক্যামেরা দিয়ে বন্দি করতে ব্যস্ত। আর মনে মনে স্বীকারোক্তি দিতে; যেমন তার নাম, মুখশ্রী তেমনই সুশ্রী হাসিরছটা! হৃদয়ে কাঁপন তুলিতে বাধ্য।

হঠাৎই কবিতার এক বান্ধবীর নজর পড়ল তখন নিরবের ওপর। ওভাবে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে কবিতাকে উদ্দেশ্য জিজ্ঞেস করল মেয়েটি,

“ছেলেটি কে রে, কবিতা?”

“কার কথা বলছিস?”

কবিতা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল বান্ধবীকে। ফের আশে-পাশে তাকিয়ে দেখল নিরবের বিষয়ে জিজ্ঞেস করছে। ততক্ষণে নিরব নিজের কাজে মনযোগে ব্যস্ত। ভয়ে তার বুক দুরুদুরু করছে, বান্দর মেয়েগুলো তাকে কবিতার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফেলল।

“ভাইয়ের বন্ধু, নাম মনে হয় নিরব। ভাইয়া তো এটাই বলল।”

“শালি, বাড়ির ভিতরে এত হ্যান্ডসাম পোলা থাকতে তুই এখনও সিঙ্গেল! আমার এই নিরব রাতের সাথে প্রেম করতে মন চাইছে রে বইন।”

সহসা বান্ধবীর গদগদ কণ্ঠে বলা কথাটা শুনে কবিতা মনে মনে বলল, ‘ইস কী নাম নিরব রাত!’ তাই সে-ও তার উদ্দেশে মজা করে বলল,

“দেখিস সে আবার না তোর জন্য নিরব রাতের কান্না না হয়ে দাঁড়ায়।”

কবিতার মুখের কথা শুনে তাদের মাঝে আবার উচ্চস্বরে হাসির রোল পড়ল। কিন্তু সে কি জানত তার বলা কথাটি তারই উপর ফলবে।
______

রাতের আঁধারের একটা আলো আছে আর সেটা হলো অন্ধকার। সবাই মনে করে অন্ধকার আবার কীসের আলো? অন্ধকারের আঁধারই তার আলো। যাইহোক এই নিকোষ অন্ধকারের গায়ে চাঁদের আলো মাখাচ্ছে কবিতা। উঠানের আমগাছের দিকটায় সে বসে আছে আপন খেয়ালে।বান্ধবীরা এশার আজান দেওয়ার পরই চলে যায়। নিরব বারান্দায় এসে দাঁড়ায় তখন, সেখান থেকে আবার আমগাছের জায়গাটা ভালো দেখা যায়। কবিতাকে আমগাছের নিচে বাঁশের তৈরি বেঞ্চে বসে থাকতে দেখে ভাবল; এটাই উত্তম সময় কবিতার সাথে কিছু কথা বলার, সময় কাটানোর। রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় দেখল কবির নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে, বেচারার ওপর অনেক চাপ পড়ছে। আলগোছে বাইরে বেরিয়ে আনমনে হয়ে থাকা কবিতাকে শুধালো,

“আনমনা ছোট্ট মেয়ে কী ভাবছে?”

কারো কথায় ঝুঁকে থাকা মস্তক উঠিয়ে সমুখ পানে তাকাতেই নিরবকে নীল টি-শার্ট গায়ে জড়ানো দেখতে পেল। প্রত্যুত্তর করল রোষানলে ভরা তেজস্ক্রিয় গলার স্বরে,

“কে ছোটো মেয়ে?”

কবিতার রাগার কথা জানে কবিরই তো বলেছিল তাই বলে এত অল্পতে! ক্রোধান্বিতা কবিতার চোখে চোখ রেখে বলল,

“কেন আমার সামনে কি অনিন্দ্য সুন্দরী ললনা ছলনা করা পেত্নী নাকি?”

“কত বড়ে সাহস আপনি আমাকে পেত্নী বললেন!”

“তারমানে স্বীকার যাও যে তুমি নিজেকে অনিন্দ্য সুন্দরী মনে করো?”

“আহামরি সুন্দর তো নই।”

“আহ্! সত্যি নাকি মেয়ে?”

“আপনার মুখেই তো স্বীকারোক্তি দিলেন।”

আঁড়চোখে তাকিয়ে কবিতা বলল। অথচ মাথা নিচু করে স্মিত মিষ্টি হেসে নিরব বলল,

“পেত্নীও বলেছি কিন্তু।”

“উফ! আবার সেই কথা।”

“যাও বললাম না কিছু আর।”

বিড়বিড় করে তখন কবিতা বলল, ‘কতকিছুই বলল এখন বলে আরকিছু বললাম না। হুহ্!’

বেশকিছু সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে পার করল কবিতা আর নিরব পার করল তার সামনে বসা চাঁদের দিকে তাকিয়ে। মেয়েটা এভাবে চুপচাপ বসে কী দেখছে আকাশে? তার কী নিয়ে এমন মন খারাপ?

“আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি।”

কবিতা বিরক্তবোধ করল এবার। এতক্ষণ তাহলে ব্যাটা কী করল? মনের কথা মনেই দাবিয়ে রাখল। মাথা নেড়ে সায় জানালে নিরব শুধালো,

“তোমার কী মন খারাপ?”

“এমনটা ভাবার কারণ?”

“বেশ চুপচাপ, মনমরা দেখাচ্ছে হঠাৎ।”

ফের চুপ হয়ে গিয়ে আনমনা দেখালো কবিতাকে। যেটা ক্রমশই উদগ্রীব করে তুলছে নিরবকে জানার জন্য কারণটা।

“দিতি আপুর জন্য।”

স্বস্তির শ্বাস ফেলল ছেলেটা। কী না কী ভেবে রেখেছিল সে। ভেবেছিল, হয়তো কবিতার প্রেমিক পুরুষ রয়েছে। তাই কোন দ্বন্দ্ব নিয়ে মেয়েটার মন খারাপ। অথচ বিষয়টা অন্যকিছুই।
_______

বৃহস্পতিবার আজ। উঠানে গায়ে হলুদের ব্যবস্থা করে ডিজাইন করা রঙিন কাপড়ে শামিয়ানা টানানো। সেটার ভেতরে চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা করা। স্টেজ তৈরি বর-কনের বসার জন্য। সেই স্টেজে লেখা জ্বলজ্বলে হয়ে, ‘আজ দিতির গায়ে হলুদ’।

আকাশে সন্ধ্যার অবতারণার যখন ভাব শুরু তখন থেকেই মানুষজনের আগমন। আর আশপাশের বাড়ির বাচ্চাপার্টি তো সেই বিকেল থেকেই ঘুরঘুর করছে প্যান্ডেলের সামনে। গ্রাম্য এলাকার হলুদ সন্ধ্যার সময়কালেই আরম্ভ হয়ে যায়, শহরের মতো না সারারাত গান-বাজনা, নাচ, হৈ-হুল্লোড় চলতে থাকে। তবে এখানে নাচ-গানের উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা গেল। গায়ে হলুদের সাজে দিতিকে নিয়ে স্টেজে বসলো কবিতা। মেয়েটার গায়ের কাঁচা হলুদ রঙে বাসন্তি রঙের শাড়িটি যেন মিলেমিশে একাকার। অন্যরকমই রূপ ধারণ করেছে। বিমুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকা নিরবের বেখেয়ালে হাতের ধরা গাঁদাফুলের ডালাটা ফসকে পড়ে যেতে নিয়েছিল। তার কোনো হুঁশ নেই সেদিকে।

“আরে ভাই দেখে কাজ কর না।”

কবিরের ধাক্কা ও কথাতে বেচারার হুঁশ এলো যেনতেন। তবে মন পড়ে রইল অপার্থিব সৌন্দর্যের অধিকার হরণকারীর মাঝে। যে হাসিঠাট্টায় মশগুল, অবগতহীন কারো হৃদয়ের মর্মান্তিক কাতরানিতে।
______

দিতিকে হলুদ ছুঁয়ানোর পাঠ চুকে গেলে বরপক্ষ থেকে আগত হলুদ দিয়ে। নাচের পালা চলছে স্টেজের খালি জায়গাতে। কবিতাকে ঝেঁকে ধরে রাজি করাতে মেতে উঠেছে বরপক্ষ থেকে হলুদ নিয়ে আগত কয়েকজন তরুণ-তরুণী। কাজের মাঝেও নিরব চোরাচাহনিতে খেয়াল রাখছে হৃদয় হরণকারীর দিকে। মেয়েটাকে বারংবার সাধতে দেখে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল, ‘ক্যান রে ভাইবইনরা আমার ভালোবাসাকে নিয়েই তোদের ঝাপটাঝাপটি করতে হয়? উফ অসহ্য, অসহনীয়!’

বাংলা গানে কবিতার নৃত্যরত অবস্থার মাঝেই ফাজলামি করে অন্য হিন্দি আইটেম গান চালিয়ে দেয় বরপক্ষের এক ছেলে। শাড়ির আঁচল মুঠোয় পুরে খিঁচে নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকে কবিতা। এমনতর আচরণের কারণ এখনো বোধগম্য হচ্ছে না। তার সাথে মজা করতেই পারে তাই বলে এভাবে? অশ্রুকণা চোখের কোণ বেয়ে বেরিয়ে আসতে দিলো না সে। দৌড়ে স্টেজ থেকে নেমে চলে গেল। বাংলা গানটা অতটা মন্দ ছিল না যতোটা না হিন্দি আইটেম গানটা ছিল। কাজটা তার কাছে অপমানকর মনে হলো। অপমান্যা রুমে ঢুকে দোর দিয়ে ভেতরে রইল আর বের হলো না। এমনিতে পরে কয়েকবার সকলে কথা বলার চেষ্টায় দুঃখিত জ্ঞাপন করতে দরজা টোকা দিয়েছিল। কিন্তু সে আর খুলেনি।
_______

“কেন ডেকেছেন?”

“প্রেম করতে।”

“রাত করে প্রেম করার শখ জাগার কারণ?”

“শখ তো অনেক আগেই জেগেছিল সখী। তুমিই তো রাজি হচ্ছো না।”

“বাজে বকবেন না।”

“ভালোবাসা তোমার কাছে বাজে বকা লাগছে?”

উপচে পড়া বিস্ময় ভঙ্গিতে বেচারার ভান করার রূপ দুমিনিটও লাগল না সমুখের মেয়েটার বুঝতে।

“নাটক কম করবেন। আপনাদের মতো ছেলেদের এসব ছেলেমানুষি কেবল।”

সামনের রমণীর কাছে তার ভালোবাসা বালকোচিত আচরণ মনে হলো! ব্যথিত ও করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপে সমুখের মেয়েটার কঠোর, পাষণ্ডী হৃদয় বোধহয় পরাস্ত হলো কিছুটা। নিভে যাওয়া গলায় বলল,

“পাগলামি করেন না ফিরে যান। আমার আপনার মধ্যকার কিছু হওয়ার নয়, অসম্ভবনীয় তা।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here