#অপরিণত_ভালোবাসার_পরিণতি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব : ৪
__________
বিয়ের দিন, শুক্রবার। কনে সাজে দিতিকে খুবই সুন্দর লাগছে দেখতে যদিও পার্লারের সাজ নয়। বাড়িতেই সাধারণ সাজে সে বধূ সেজেছে, তাতেই রূপবতী দেখতে। কিন্তু মেয়েটির মন খারাপ। কারণ একে তো আপনজনদের ছেড়ে যাবে দ্বিতীয় কবিতা। মেয়েটা কাল রাতের ঘটনার পর থেকে মনমরা হয়ে আছে। অনুষ্ঠানে পরেছেও সাধারণ পোশাক। বরপক্ষের লোকেরা আসবে শুনে ঘরে খিল দিয়ে বসে আছে। মেয়েটা একটু বেশিই জেদি, একরোখা, আত্মসম্মানবোধ। একে নিয়ে যে কী করবে!
বিয়ে পড়ানো শেষে খাওয়ার সময় নিরব বেশ ব্যস্ত। সবকিছুর তদারকিতে তার ও কবিরের খাওয়ার সময় হয়ে উঠল না। এরমাঝে নিরবের মন ম্লানতায় ছেয়ে আছে এর কারণও কবিতা মেয়েটা। আজ দেখাই পেল না তার। সাধারণ একটা বিষয় নিয়ে মেয়েটা এত মন খারাপ করতে পারে! বিস্ময়কর ঠেকছে নিরবের কাছে। তাদের যখন বিয়ে হবে তখন এত রাগ করে থাকলে হবে? আহা! বিয়ের কথা আসায় মনে পড়ে গেল গতরাতের স্বপ্নটা। যেখানে কবিতা তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিল। আদৌও সেটা সত্যি নাকি মিথ্যে হয়ে কবিতাকে সে নিজের করে পাবে?
দিতির বিদায় পালা। কবিতাকে তো এবার বের হতে হবে। এরমধ্যে কনের সাথে যাওয়ার জন্য বরপক্ষের বোন ও বন্ধুরা কয়েকবার কবিতার নাম নিয়েছিল। কিন্তু দিতির নিষেধাজ্ঞায় সেটা ভাঁটা পড়েছে। গতদিনের কাণ্ড মেয়েটা এখনও গোমড়ামুখে হয়ে আছে আবার এসব বলে ক্ষ্যাপানোর কোনো মানে হয় না। মেয়েটা তো মজা বুঝে না, উলটো এসবকে অপমান হিসেবে ধরে নেয় তার সাথে মজা করা সাজে না। তথাপি পরে দেখা গেল বোনের বিদায় মুহুর্তে কবিতা এসে দাঁড়িয়ে বোনকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে আলিঙ্গন করে কেঁদে উঠল। কেউ একজন তখন মজার ছলে বলল,
“বেয়ান সাহেবা আপনি-ও চলেন, তারপর দু-বোন একসাথে থেকেন।”
সরে এলো কবিতা আলিঙ্গন মুক্ত করে কথাটা শুনে। এদিকে দিতি তার হাত ধরে কানে কানে কিছু একটা বলে গাড়িতে ওঠে বসল। চলে গেল মুহূর্তের মাঝে অন্য কারো ঘরের আলো জ্বলাতে।
_____
বারান্দা থেকে আজকে আবারও দেখা গেল কবিতাকে একই স্থানে বসে থাকতে। সময়টা দেখেনি মোবাইলটা ঘরে বিধায়। আবার ঘরে গিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে সময়টা দেখে নিলো। রাত বারোটার উপরে। সকলেই ঘুমে বিভোর। হবেই বা না কেন যা ধকল গেল না। আস্তে করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। নিশ্চুপে মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কোনোবাক্য ব্যয় করল না কেউই। কিন্তু দু’জনেই বুঝল, জানলো একে-অপরের নিঃশ্বাসের শব্দের মাধ্যমে।
“ঘুমনানি যে?”
নিঃসঙ্কোচভাবে কবিতাকে শুধাতে দেখে ভারি অবাক হলো বেচারা নিরব। আগ বাড়িয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে মেয়েটা যে বড্ড কৃপণ সাথে একটু লাজুকলতাও। নিরবকে থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুখ তুলে তাকায় নিরবের দিকে কবিতা। নিরবের মোহনীয় চাহনি দেখে একটুও ভড়কায় না। সে বুঝে সে-ই চাহনির মানে। চোখ ফিরিয়ে নেয়। উত্তরের আর অপেক্ষা করে না।
“তুমি কেন ঘুমাওনি?”
প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন করায় বিরক্তবোধ কাজ করার কথা মেয়েটার। অথচ মেয়েটা নির্বিকার, নিশ্চুপতার নিমিত্তে অদূরে ফিরে তাকিয়ে রয়েছে। নিরব বুঝে না মেয়েটার হঠাৎ হঠাৎ করা অমন উদাসীন রূপের কারণ। গতকালের কাহিনির রেশ এখন পর্যন্ত ধরে রাখার কোন মানে হয়? বিরক্তিতে মুখ তেঁতো হয়ে আসে নিরবের। আলগোছে কবিতার পাশে বসে। সাথের মেয়েটা বুঝে ফিরেও তাকায় না। নিরব নিজ শব্দে বলে উঠে,
“বয়সই বা কত তোমার! ছোট্ট একটা বিষয় মাথায় গেঁথে রাখতে নেই। অমন মজা বিয়েতে হরহামেশাই হয়ে থাকে। মুড ঠিক করো।”
বুঝানোর উদ্দেশে মেয়েটাকে তো বলল তবে কথা হলো সে আদৌও তার কথাগুলোকে বুঝবে তো, মান্য করবে? কে জানে মেয়েটার এভাবে বিষণ্ণমুখো হয়ে থাকাটা শেলের মতো বিঁধে তার বুকে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিঁড়ে। কবিতাকে সে কখনো বলতে পারবে, বুকের মধ্যে গোপন করা ভালোবাসার কথা? ভারি হওয়া পরিবেশটাকে সহজ করার জন্য নিরব ফের বলে উঠল,
“আচ্ছা, শোনো তোমাদের গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখালে না যে?”
কথাটায় কাজ হলো। মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে পাশ ফিরল তাকালো। নিরব ভয় পাওয়ার ভঙ্গি করে বলল,
“এভাবে তাকিয়ো না ললনা। ভয় তো পাবোই না উলটো প্রেমে পড়ে যাওয়ার ভয় করবে তুমি।”
বলেই বত্রিশ পাটির দাঁত বের করে হাসলো। ছেলেটার জন্য শান্তি মতো একা বসে থাকাও দায়, তিরিক্ষি মেজাজে বসা থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরল কবিতা। একটুখানি এগিয়ে পিছনে না তাকিয়ে শুধু বলল,
“ভোরে তৈরি থেকেন।”
চলে গেল তবে রেখে গেল সীমাহীন বিস্মায়াবিষ্ট আনন্দিত মূর্তিমান নিরবকে।
______
ভোরে বললেও একটু দেরি হয়ে গেল উঠতে নিরবের। গত কয়েকদিনের কাজের ধকলটা বোধ করি বেচারা রাতে ভীষণভাবে টের পেয়েছে, সারা শরীর ব্যথায় টনটন অবস্থা। তবুও দ্রুততার সহিত হাত-পা চালিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো, কেউ যে তার অপেক্ষায়।
কী শীতল পানি! ঠান্ডা বাতাসে পানিতে ঢেউের এক সুন্দর তরঙ্গের সৃষ্টি হচ্ছে, মন ছুঁয়ে যাওয়া। গ্রাম্য-অঞ্চলের এমন বৈরি দৃশ্য শহরে মেলে না। নিরব আর কবিতা বাড়ির মাটির রাস্তা ধরে বেশকিছু দূরে অবস্থানরত পুকুরের পাড়ে এসেছে। পাকা করে দেওয়া সিঁড়ির একদম নিচেরটাতে বসে পা ভিজিয়ে দিলো কবিতা। উপর থেকে নিরব দৃশ্যটি দেখে থমকে গেল একেবারে। বুকের ভেতর ভয়ংকর ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে, নিষিদ্ধ কিছু জিনিস মস্তিষ্কে কুটকুট করছে। দ্রত চোখ ফিরিয়ে নিলো। কিন্তু বেশিক্ষণ হলো না আবারও চোখটা সেদিকেই ভিড়লো। এদিকে নিরবের উপস্থিতি টের না পেয়ে ঘুরে তাকালো কবিতা। পিছনে নিরবে অন্যরকম চাহনি দিয়ে থাকতে দেখে সোজা হয়ে বসলো। নিরব মেয়েটার ফিরে তাকানোতে তখন ঢোক গিলল ভাবল, এখানে আর থাকা যাবে না। তাই হড়বড়িয়ে কবিতাকে উঠে আসার কথা বলল। বাকিটা সময় এদিক-সেদিক করে ঘুরার মধ্যে আর মন টিকলো না। তাই কেউ আর কোনো কথা না বলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরল।
চলবে…