#অপরিণত_ভালোবাসার_পরিণতি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব : ১
_______
ছোট্ট খুপরির মতো দেখতে টিনের ঘর। ভ্যাপসা গরম তাও আবার একটি মাত্র জানলা। খোলাও যায় না এমন অবস্থা। চৌকি পাতা তাতেও হয় না, তদুপরি নিচে মাদুরও বিছাতে হয়। সবচেয়ে করুণ দৃশ্য তা হলো ঘরটার মধ্যে বাস করে মোট সাতজন পুরুষ। তন্মধ্যে চারজন ত্রিশের কোঠায় আর তিনজন চব্বিশের উর্ধ্বে ওঠা বয়সের, সবাই-ই তাগড়া যুবা পুরুষ। সে তিনজনের মধ্যে একজন নিরব। নামের মতোই সে চুপচাপ, শান্ত হয়ে থাকা শান্তিপ্রিয় মানুষ। লেখাপড়া তার বেশি একটা করা নেই, কাজও করে কোনোরকমের পান্তা ভাত ধরনের। আজ এই তো কাল ওই, কাজের কোনো ঠিক নেই। অথচ ঢাকায়ই আসা মোটা অংকের টাকার কাজের সন্ধানে। তার মতো অলসপ্রিয় হলে আর মাটির কাটার কাজও পাওয়া যাবে না। মাত্রই বসত ঠিকানায় ফিরল সে, ‘হাহ্ ছোট্ট খুপরি! যাকে বলে কি না কবুতরের খোপ!’ মনের কোণ থেকে বলে উঠল।
ঢাকার মতো রাজধানীতে টিকে থাকা বা পছন্দ মতো ঘর পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার-স্যাপার; ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভিতরে ঢুকলো নিরব। ভেতরে গিয়েই সেই আগের দৃশ্য দেখতে পেল। বিছানায় দু’জন শুয়ে, নিচে মাদুরে শুয়ে তিনজন। আরেকজন আসেনি এখনও। সে গিয়ে ঘরের এককোনায় থাকা আলনা থেকে তার রাখা লুঙ্গি আর সেন্টু গেঞ্জি নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালো। লুঙ্গিটা ঠিকই পেল কিন্তু তার গেঞ্জিটা পেল না। সেটা সে বুঝতে পেরে চিৎকার-চ্যাঁচামেচির ধার দিয়ে না গিয়ে চুপচাপ বাইরের গোসলখানায় ঢুকে পড়ল। গোসলখানা থেকে ফ্রেশ হয়ে ঘরে এসে দেখল রাত সাড়ে বারোটা বাজে। বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে, একটা কলা আর পাউরুটি। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মেঝেতে, কেননা একে তো এতো গরম ঘরে আবার একেকজন গায়ের সাথে চেপে চেপে শুয়ে রয়েছে। তাতে গরমকে যেন আরও চৌদ্দ ডিগ্রি বাড়ানো। উপরন্তু যে সিলিং ফ্যানটা আছে সেটার ঘটরঘটর শব্দে মাথা ঠান্ডা তো হয়নি না উলটো উত্তাপ বেড়ে যায় মন-মেজাজের। নাহ, শেষমেষ না পেরে বাইরে বের হয়ে এলো নিরব। আর দেখতে পেল বসতিস্থলের চিপাগলি দিয়ে কবির আসছে, যে কি না তাদের সাথের একজন। কবির এগিয়ে এসে সামনে নিরবকে দেখতে পেল এবং জিজ্ঞেস করল,
“কী ব্যাপার মহাশয়? এমন খালি গায়ে বডি দেখানো হচ্ছে যে!”
“ফাইজলামি বন্ধ কর। তুই জানোস না খালি গায়ে ক্যান? রোজ রোজ আর এমন ভাল্লাগে না, মন চায় অন্য কোনহানে যাইতে গা। ধুর বালের ঢাকা শহর!”
“কী আর করবি বল? একে তো তারা আমাদের রুমমেট, সাথে আবার বয়সের দিক দিয়েও বড়ো। তাঁরা যদি আমাদের কিছু ব্যবহার করে, আমরা তো আর তাঁদের মুখের উপর কিছু বলতে পারব না। তাই চুপ থাকাই বেটার অপশন।”
“তাই বলে কি বারবার? মাত্রই কয়েকদিন হলো দুইটা গেঞ্জি, একটা লুঙ্গি নিছিল। এখন আবারও কার ভালো লাগে এমন নিত্যনতুন যন্ত্রণা?”
“আচ্ছা, তুই বল কী করবি এখন তুই? গ্রামে বাবা ছাড়া বৃদ্ধ মা, বিবাহযোগ্য বোন তারা কার আশায় পথ চেয়ে আছে? তোর তাই না? তুই-ই যদি এতটুকু কারণে মাথা গরম করোস তাইলে কীভাবে কী হবে? ঢাকার মতো শহরে কিন্তু টিকে থাকা অনেক কষ্টের। আর একবার টিকতে পারলে তার জন্য ওই কথাটা প্রযোজ্য ‘ঢাকায় টাকা ওড়ে’, বুঝছো মনু?”
“ভাল্লাগতাছে না রে দোস্ত। মনডারে একটু শান্ত করতে চাই। যা তুই ঘরে যা।”
কবির বুঝতে পারল, কিছু একটা হয়েছে যার দরুন নিরবের মনটা বেশ অশান্ত হয়ে আছে। থাক পরে ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করা যাবে। তাই নিঃশব্দে সে ঘরে চলে গেল।
______
ভোরের সকাল হয় স্নিগ্ধতা স্বরূপ, শান্তির প্রতিরূপ। কিন্তু নাহ ঢাকা শহর হয় হট্টগোল, বিতৃষ্ণাময়। যেখানে বাস করা প্রতিটি জিনিস হয় যান্ত্রিকের মতো। এখানে গ্রামের মতো সজীবতার চিত্র হয় বিরল, সহজে তা দেখা মিলে না। যার যার কাজে সকাল হতে না হতেই বেরিয়ে গেছে। শুধু নিরবকে বসে থাকতে দেখে কবির এগিয়ে গেল তার সামনে। কবির এতোক্ষণ কাজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল।
“কী হইছে এমন মুর্তির মতো বইসা রইছস কে? কামে যাবি না?”
“কাম নাই, হেল্লেগা এমন বইয়া রইছি।”
“কয়দিন আগেই না তরে কামডা জোগাড় কইরা দিছি। এরমধ্যেই কামডা খাইয়া ফালাইলি! তরে লইয়া কী যে করমু বুঝি না বাপু। দিন দিন বাদাইম্মা হইতাছোস।”
নিরবের কোন হেলদোল নেই, সে নির্বিকার, নিশ্চিন্ত। এমনটা যে প্রায়ই হয় তার সাথে। মন মতো কোন কাজ না পেলে, সে এমনই করে।
“শোন আপাতত আমার হাতে কোনো কাজ নাই। তাই এখন তরে কোনো কাজ জোগাড় কইরা দিতে পারমু না।”
তবুও নিরব চুপচাপ হয়ে আছে, তা দেখে কবির তার কাজে চলে গেল। ভালো লাগে না এসব দৃশ্য দেখতে তার। নিরবকে তো বুঝতে হবে, টাকা ছাড়া দুনিয়া অচল। উপরন্তু কর্মজীবনই তো ছেলেদের জন্য। সেখানে বর্তমানে মেয়েরাও পিছিয়ে নেই, অথচ সেদিক দিয়ে ছেলে হয়ে তার কোনো কাজই গছে না। হাহ্! নিরবের এখানে সবার চেয়ে কবিরের সাথে সখ্যতা বেশি। দু’জন দু’জনের জন্য যথেষ্ট করে। কিন্তু সবার করার মধ্যে একটা সীমাবদ্ধতা তো থাকে।
রাতে কবির যখন ফিরে দেখল নিরব ঘরে নেই। অগত্যা সে ফ্রেশ হয়ে বাইরে গেল সিগারেট খাওয়ার জন্য। গলির মোড়েই দোকান, সবাই-ই এখান থেকে যা প্রয়োজন কিনে থাকে। সেখানে গিয়ে দেখল নিরব-ও সিগারেট জন্য এসেছে এবং কিনে ধরিয়েও ফেলেছে। তার পোশাক-আশাক দেখেই বুঝা যাচ্ছে কোথাও থেকে সে মাত্র ফিরল। কবির এগিয়ে গিয়ে একটা সিগারেট কিনতে লাগল। এদিকে তাকে দেখে নিরব কিছু বলল না।দু’জনই বসতি গলির ভিতরে চুপচাপ হেঁটে যেতে লাগল। কেউ কিছু বলছে না দেখে শেষে না পেরে কবিরই বলল,
“কিরে ঘরে আইয়া দেখলাম তুই নাই। কই গেছিলি?”
“কাম খুঁজতে।”
“কইলাম তো আমি খুঁইজা দিমুনে। আপাতত তুই একটু সময় দে।”
“সময়-ই তো হইব না রে। মা’য় বারবার ফোন দিতাছে টাকা পাঠানের কথা কইতাছে। আমার নিজেরই একবেলা খাওনের মতো টাকা নাই। তাগো কই থেকে টাকা দিমু? তাই বাইর হইছি দেখি কোন কাম পাইনি। কিন্তু নাহ পাই নাই।”
দীর্ঘশ্বাস হয়ে বের হলো কথাগুলো। তা দেখে বড্ড মায়া হলো কবিরের। শ্যামলা বর্ণের গায়ের রঙের ছেলেটাকে দেখে যে কারোরই মায়া হবে, তার মুখে যেন মায়ায় ভরা হয়তো করুণ কোনো দুঃখ সুরের ঢেউ খেলে যায় ওই মুখচ্ছবিতে। যে কারোরই মন খুব সহজেই কেঁড়ে নিতে পারার ক্ষমতা আছে। শরীর হ্যাংলা-পাতলা গড়নের নয়, মোটামুটি স্বাস্থ্যের। দু’জনেই ঘরে গেলে সিগারেট খাওয়া শেষ করে। এরমধ্যে কবিরের মোবাইলে ফোন আসল বাড়ি থেকে। তার মা বাড়ি যেতে, তার বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে। সে যেন বাড়িতে চলে আসে সপ্তাহ খানিকের মধ্যে। আসবে বলে ফোন রেখে নিরবকে খুবই আনন্দের সাথে খবরটা দিলো। আনন্দ ভাগাভাগি করা বলে আরকি। কিন্তু নিরব, সে তার নামের মতোই বরাবর নির্বিকার, আনন্দহীন। মন ভালো করার উদ্দেশ্য স্বান্তনার সাথে কবির তার উদ্দেশে বলল,
“মন খারাপ করিস না দোস্ত। কাজ মিলে যাবে তো বললাম। এখন তুই-ও আমার সাথে গ্রামে যাওয়ার প্রস্তুতি নে। ওখানে কয়েকদিন থেকে মনটা ফ্রেশ করে নিবি। তারপর এখানে এসে কাজে মন দিতে পারবি। এতো টেনশনে কি টিকোন যায়!”
কবিরের কথাটা নিরবের পছন্দ হলো সে-ও মনে মনে ভাবল বিষয়টা এবং তার কাছে সঠিকই মনে হলো। এখানে থেকে মনটা তো বিষিয়ে উঠছেই সাথে আরো নানা ধরনের চিন্তারা ভিড় করছে। তারচেয়ে ভালো কিছুদিন কবিরদের বাড়িতে ঘুরে মন ভালো করা যাবে, সাথে আছে বিয়ে বাড়ি হিসেবে ফ্রিতে খাবার-দাবারের ব্যবস্থা। এখানে একা থেকে সে না কাজ জোগাড় করতে পারবে আর না খাবার খরচ আবার আছে ঘাড়ে ঘর ভাড়া। অগত্যা সে রাজি হয়ে জানিয়ে দিলো যে, সে যাবে।
চলবে…
কেমন হয়েছে জানাবেন প্লিজ।