অপরিণত ভালোবাসার পরিণতি পর্ব:২

0
396

#অপরিণত_ভালোবাসার_পরিণতি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব : ২
__________

কী নির্মল বাতাস! শুদ্ধতায় ভরা গ্রাম। বাতাসে যখন গায়ের শার্ট ভেদ করে চামড়ায় স্পর্শ করে। বলে বুঝানো দায় কেমন যে অনুভূতি হয়! ভালোলাগা তখন তীব্রতার সহিত হানা দেয়। অথচ শহরাঞ্চল অবস্থা তা আর বলার বাকি রাখে না। কতবছর হবে গ্রামে পদার্পণ হয় না কবিরের! গ্রামের নাম নিয়ামতপুর, নওগাঁ জেলা। কবির তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, বাড়িটা বেশ পুরোনো এবং টিন শেডের পাকা বাড়ি। ভেতরে রুম তিনটা, বারান্দাওয়ালা বড় রুম খালি থাকে তার জন্য সবসময়। বাড়ির সমুখের বড়সড় উঠান, পাশেই একটা মোটা আমগাছ যেখানে বসার ব্যবস্থাও আছে। বড়ো ভাই কবির আর ছোটো দুবোন। মেজো বোনেরই বিয়ের জন্য আসা। ভেতর থেকে কবিরের মা বেড়িয়ে আসলেন ছেলের গলার চেনা স্বরে। এসে সামনে নাড়ি ছেঁড়া সন্তানকে পেয়ে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ছেলের গায়ের গন্ধ নিলেন। মায়েরা এমনই হয়, ছেলেরা যেন মায়ের প্রাণ। হঠাৎ খেয়াল করলেন পাশে অচেনা আরেকটা ছেলেকে। শুধালেন মায়ের মায়াভরা ডাকেই।

“কে গো তুমি বাবা?”

তার প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে নিরব উত্তর শূন্য, কেননা সে এখানে এই প্রথম এসেছে। এমনতর আচমকা প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে জবাব আসছে না তার মুখে। অগত্যা কবিরই পরিচয় করিয়ে দিলো। তারপর বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করতে করতে কবির তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করল। তখন কবিরের মা রেবেকা বেগম জানালেন, কবিরের বাবা বাড়িতে নেই, বিয়ের সদাই-পাতি কিনতে হাঁটে গেছেন। এতদূর জার্নি করে কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে এলো তারা অ্যাটাচ-বাথরুমে হতে। আরেকটা আছে রান্নাঘরের পাশে বাকিদের জন্য। সেই সকালের এক ঘুমে পুরো বিকেলে গিয়ে ঠেকল। দুপুরের খাবারটাও দু’জনের খাওয়া হয়নি। রেবেকা বেগম অবশ্য এক-আধবার ডেকে গিয়েছিলেন। বিকেলে নাস্তা খাওয়ার সময় আবার পরিচয় হলো কবিরের বাবা আনিসুর মিয়ার সাথে। অমায়িক ব্যবহার তাঁদের, এজন্য বোধহয় কবিরও একই ব্যক্তিত্বের পরোপকারী, পরহিতসাধক। সামনের শুক্রবার বিয়ে, আর বাকি আছে দুদিন। হাতে হাতে কাজ করলে আগেভাগেই কাজ শেষ হয়ে যাবে। তাদেরকে কাজ বুঝিয়ে দিলেন আনিসুর মিয়া। যেহেতু গ্রামে নতুন এসেছে নিরব, তাই তাকে দেওয়া হলো বাড়ির ভেতরের কাজ। আর বাইরের যতো কাজ সব করবে কবির। বলা বাহুল্য, এতোক্ষণে এলো এ বাড়িতে অথচ কবিরের একজনও বোনের সাথে দেখা হলো না। কাল থেকে কাজ নামবে বিধায় আজকের সময়টুকু বাইরে ঘুরে-ফিরে গ্রামটাকে দেখে কাটাতে চাইল নিরব। এখানে শহরের মতো এতো হট্টগোল নেই, দোকানপাট বেশি একটা নেই কাছাকাছি। একটু দূর বাজারে যেতে হয়, যেটা গ্রামেরই ছোট্ট একটা বাজার। সেখানে পৌঁছে দোকানের কাছে এসে কবির দুটো সিগারেট কিনলো। অতঃপর দু’জনে বাজার থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে মনের সুখে সিগারেট টানলো, সাথে কিছু কথোপকথনও হলো। দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাওয়ার কারণ ছিল আনিসুর নিয়া। বাজারে কখন না কখন এসে ছেলেকে এভাবে সিগারেট টানতে দেখে ফেলেন সেই ভয়ের কাজ করছিল কবিরের মনে। হালকা-পাতলা বাজারের আশপাশটা দেখে দু-জনেই বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ির উঠানে দাঁড়াতেই দেখতে পেল পরিবারের সবাই বাইরে। কারণ লোডশেডিং, বিদ্যুৎ নেই। গ্রাম-অঞ্চলে এমন প্রায়ই দেখা যায়। বাইরে দেখা যাচ্ছে কবিরের বাবা-মাকে, সাথে একটি মেয়ে কবিরের বোন হয়তো। ঘরের ভেতর থেকে আরেকটি মেয়ে বেরিয়ে এলো। মুখের সামনে হারিকেনের টিমটিমে আলোতে নিরবের চক্ষু শীতল হলো মেয়েটার অপরূপ সৌন্দর্য্যের সুধা পানে। ইস কী রুপবতী!সম্ভবত এটাও কবিরের বোন; মনে মনে ভাবল নিরব। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলো, হারিকেনের আলোতে মেয়েটাকে কোনো আবেদনময়ী মনে হচ্ছে। গায়ের রং কাঁচা হলুদ, মুখাবয়বের গঠন মায়াময়। যা তার শরীরে শিহরণ জাগায়। এটা ঠিক না দেখে তার চোখ সরিয়ে নেওয়া। কিন্তু তা আর হলো কোথায়? শরীরের কোনো অঙ্গের সাথে জোড় করলেও কি মনের সাথে জোড় করা যায়? সে-তো চলে নিজের মতো করে। তাই তো না চাইতেও চোখ চলে যাচ্ছে নিষিদ্ধ জিনিসের উপর, এটাই একটা রোগ আমাদের নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আগ্রহ বেশি থাকে। সেটা নিরবের ক্ষেত্রেও ঘটছে, কিন্তু নিষিদ্ধ জিনিস যে জীবনে কখনো কল্যাণ বয়ে আনে না তা কেবলই ধ্বংস করতে জানে। যেটা থেকে নিরব ছিলো বেখেয়ালি, বেখবর, অজানা।
______

সারারাত আর নিরবের ঘুম হলো না, সুন্দরী ললনার অলোক সৌন্দর্য্যের দৃশ্য কল্পনা করতে করতে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে সকাল হলো। সকালে ওঠে সবকিছু মাথা থেকে ঝেরে সে বিয়ের কাজে নেমে পড়ল।যেহেতু বাড়ির ভেতরের কাজে সে, সেহেতু এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রায়ই চেষ্টা করে মেয়েটিকে দেখার জন্য। ওহ, মেয়েটির নাম তো রাতেই শুনলো সে, কবিরের ছোটো বোন কবিতা। আহা কী সুন্দর নাম কবিতা চেহারার মতোই সুন্দর!

তবে সমস্যা হলো, মেয়েটিকে দেখাই যায় না। বিয়ে বাড়ি বিধায় আশেপাশেরসহ কবিরদের আত্মীয়রা-ও ভিড় করেছে। অবশ্য এখানে থাকছে না। এক গ্রামেই বাড়ি তো তাই। এজন্যই কবিতাকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সারাক্ষণ ছটফট করে মেয়েটা ঘরেই বাচ্চা পার্টি নিয়ে চিল্লাফাল্লা করছে। নিরব বাইরে কাজ করছে বিধায় শুধু চ্যাঁচামেচিই শুনতে পারছে, দেখার আর সুযোগ হলো না। অগত্যা হতাশার নিশ্বাস ফেলে বাড়ি ডেকোরেশনের জিনিসপত্র উঠানে রাখলো।

দুপুর দিকে খাওয়ার সময় ছোটো ডাইনিং টেবিলে কবিতা খেতে বসল। সকলেই ব্যস্ত খাওয়ার সময়ই পায় না। সেজন্যে রেবেকা বেগম নিরবকে এখনই বসে পড়তে বললেন নাহলে দেখা যাবে পরে আর সে খাওয়ার সময় পাবে না। নিরব এই সুযোগ হাতে পেয়ে যেন চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো আনন্দিত হলো তবে সেটা কেবল মনে মনে রাখল, উৎসাহটা বাইরে দেখাল না। খাওয়ার সময় কবিতার সাথে একটু কথা বলার জন্য উশখুশ করতে লাগল। ডালের বাটিটা কবিতার দিকে। সেটা চাওয়ার জন্য বলে উঠল,

“কবিতা ডালের বাটিটা একটু এদিক দেও তো।”

নিঃশব্দে কবিতা সেটা তার সামনে বসে থাকা নিরবের দিকে ঠেলে দিলো। কোনো শব্দই উচ্চারণ করল না! তার আশেপাশে যেন কোনো প্রাণীর অস্তিত্বই নেই এমন ভাব। অথচ এই মেয়ে বাচ্চাদের সাথে মিশে বাড়ি তুলে ফেলেছিল কিছুক্ষণ আগে! অতঃপর খাবার শেষে চলে গেল সেই নীরবতা পালন করে। পুরোটাই বেশ নিখুঁতভাবে খেয়াল করে দেখল নিরব। মেয়েটার হাঁটার তালটাও নিখুঁত বিধায় তার মনে ঝড় তুলে যায়।
_______

দুপুরের খাবার শেষে একটু ভাতঘুমের জন্য বিছানায় শুয়েছিল। ধপ করে বিছানায় কারো শুয়ে পড়ার শব্দে সচকিত হয়ে উঠল।

“আরে ব্যাটা এমনে শুয় কেউ? জানোস না দুর্বল হার্টের মানুষ আমি?”

এটুকু বলে পড়ে আবার নিজ মনে স্বগোতক্তি করল, ‘এজন্যই তো তোর বোনের প্রেমে দুর্বল হার্টটা আরো দুর্বল হয়ে পড়ল।’

“তুই ঘুমাছ ক্যা? আর আমি এইদিকে একলা কাম কইরা মরতাছি।”

কবিরের কষ্টেভরা কথায় মজা করে তাচ্ছিল্য হেসে নিরব বলল,

“বুঝো না? তোমার বিয়ার লেগা এনার্জি বাঁচায় রাখতাছি।”

“আমার বিয়া কই দেখলি মামা?”

কবিরের বিস্ময়মাখা কথা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,

“ক্যান মামা, কেমন আছেন বিয়ান সাব জিগাইবা না? তখন তো বিয়ান সাব-রা বুক ব্যথার ডাক্তার বানাইব তোমারে?”

“ইস! সত্যিই তো। তবে বুক ব্যথার জ্বালা আমরা ধরামু আসা মাত্রই।”

কবিরও বাঁকা হাসি দিলো নিরবের পানে। তবে নিরবের মন তখন বলছিল, ‘অন্যদেরটা ধরানোর আমার প্রয়োজন নেই। তোর বোনেট মনের তৃষ্ণা যেন আমি হই।”
_____

“কীরে ভাই তর ছোটো বইনটা এমন ক্যা?”

ভ্রু কুঁচকে এলো কবিরের কথাটা শুনে। কবিতার কথা বলছে নিরব সেটা ভালোভাবেই বুঝেছে সে। তবে কারণটা কী এমন বলার? আর এমন বলতে কী বুঝালো সে? প্রশ্নটা করেই ফেলল,

“এমন বলতে কেমন? কী করছে ও?”

“আরে অস্থির হইস না। ওর কাছে কিছু চাইলে চুপচাপ হাতে ধরায় দিয়া চইলা যায়। উ, আ কোনো শব্দই করে না। অবাক লাগে মনে হয় কোনো বোবা মানুষ।”

“ও’য় একটু অমনই। অচেনা মানুষ তারউপর ছেলে মানুষ দেখলে তো আরো চুপচাপ হয়ে যায়। এমনে আপন, পরিচিত হয়ে গেলে কথার তখন তুবড়ি ছুটে।”

হাসতে হাসতে কথাগুলো বলল কবির। সায় জানিয়ে নিরব বলল,

“হুম, তবে দিতি আবার অমন না। বিয়ের কনে হয়েও কী সুন্দর কথা বলেছে আমার সাথে? ভাইয়া ভাইয়া বলে ডেকেছে।”

“তা ঠিক দিতি আবার বেশ চটপটে। আমার বাবা-মা লেখাপড়ার দিক দিয়ে কিন্তু উৎসাহী টাইপের জানিস। গ্রামের মানুষ বলে যে লেখাপড়াকে হেলায় ফেলে দেবেন তেমন না আবার। আমাকে ইন্টার পর্যন্ত পড়ালেন, আরো চেষ্টা করছেন পড়াতে কিন্তু দুটো বোনকেও তো মানুষ করতে হবে। মেজোটাকে ইন্টার শেষ করার পরেই বিয়ের পিড়িতে বসালেন। কারণ গ্রামীণ পরিবেশের মানুষেরা মেয়েদের বেশি পড়ায় না। তাই যা পড়িয়েছেন তা-ই যথেষ্ট তার জন্য, বাকিটা শ্বশুর বাড়ি গিয়ে।”

কথাগুলো বলতে বলতে কবিরের চোখে জলের রেখা প্রদর্শিত হলো। বোনেরা যে ভাইদের স্নেহের একাংশ। কেননা বাবার পরেই ভাইদের ভালোবাসার ভাগিদার তারা হয়। নিরব কথা ঘুরাতে বলল,

“তা তোর এই ছোট্ট অহংকারী বোন কোন ক্লাসে পড়ে রে?”

“এই তুই কিন্তু আবার কবিতার পিছনে লাগতে যাস না। রাগলে কিন্তু ঠিক থাকে না। দেখতে এমন চুপচাপ হলে কী হবে, রাগের জন্য আমরা কেউ তার ধারে কাছে যেতে পারি না। এমনিতে সে সবে মাত্র এসএসসি দিলো আর ষোলো পড়ল।”

নিরব সব শুনে মনে মনে ভাবল, মেয়েটি তার অনেক ছোটো! অথচ দেখ ভাব ধরে এমন যেন সে ভার্সিটি লেভেলের ছাত্রী হাহ্!

এদিকে ছেলেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা খেয়াল করল না। সে বয়সে বড়ো বলে কি মেয়েটার মনে জায়গা করতে পারবে নিজের? মেয়েটি তার অনিশ্চিত জীবনে জড়াতে রাজি হবে? নাকি ভালোবাসাটা একতরফা রয়ে যাবে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here