#অপরিণত_ভালোবাসার_পরিণতি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব : ৮
__________
ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহে হেলেদুলে কাঠের দরজা ঠেলে প্রবেশ করে নিরব। দু’দিন ধরে গমের বস্তা টানার কাজ করছে। কোনো সময় দুপুরে বা বিকাল-সন্ধ্যাতে আবার রাতেও ফিরে বাড়িতে। তেমনই আজ বাড়িতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। বাইরের পোশাক ছেড়ে একটা লুঙ্গি নিয়ে গোসলখানায় ঢুকলো৷ রাতের বেলা খালিই পাওয়া যায়, দিনের বেলা তো সিরিয়াল লেগে থাকে। গোসল করে ফিরে কবিতার কাছে রাতের খাবার চাইল। অথচ মেয়েটা কোনো রা করল না। সারাদিন কাজকর্ম করে মেজাজ তুঙ্গে থাকে এখন রাতের সময়টুকুতেও মেয়েটার নিশ্চুপতা মন-মেজাজ খিঁচড়ে দিচ্ছে। তবুও ধৈর্য ধরে ফ্লোরে থাকা হাঁড়ি-পাতিলের ঢাকনা খুলে দেখল, রান্না করার কোনো চিহ্নই নেই। রাগ তরতরিয়ে মাথায় চড়ে বসল। আসার পর থেকে কবিতাকে নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাকতে দেখেছে সে৷ একটুও আগ বাড়িয়ে খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করল না মেয়েটা! উপরন্তু কবিতাও যে না খেয়ে বুঝতে পারল। কোনো কথা না বলে বাইরে বেরিয়ে গেল সে।
খাবার হাতে ফিরে আসার সময় পাশের ঘর থেকে নিলুফার নামের মহিলা বের হয়ে এসে কপাল কুঁচকে নিরবকে ডাক দিয়ে বললেন,
“তোমার বউ আউজকা দুপুরবেলা মাথা ঘুইরা পইড়া গেছিল গা। আমরা মাথায় পানিটানি ডাইলা ঘরে নিয়া দিয়াইছি। বয়স এক্কেরে অল্প, হুগনা শইল। খাওনদাওন করে না নাকি ঠিকমতো? দেইখা রাখো না ক্যান?”
নিলুফার উত্তরের আশায় না থেকে যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই চলে গেলেন। নিরব আলগোছে নিজেদের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে কবিতাকে ডাকল খাবার খাওয়ার জন্য। পাশেই হোটেল আছে, সেখান থেকেই পরোটা আর ডালভাজি এনেছে গরম-গরম। মেয়েটা এবারও উঠল না। অগত্যা পরাস্ত হয়ে নিজেই খেয়ে নিলো একা একা।
সুতির শাড়ি পরা কবিতার গায়ে। আলতো হাতের স্পর্শে কাছে আসার আহ্বান জানায় নিরব তাকে। কিছুটা রাগ ভাঙানো, কিছুটা নিজের দৈহিক চাহিদার কারণে কাছে যাওয়া। অথচ বুঝল না মেয়েটার মনের অভিপ্রায় কী! অসুস্থতারও বাঁধা মানল না, ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনীয়তাও মনে করল না। কবিতা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে সায় দেওয়া ছাড়া কিছুই করার খুঁজে পেল না। প্রথম দিকে মাঝেমধ্যে ভালো না লাগলে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলেই জোর করত। তাই এখন আর জোর করে ব্যথিত হওয়ার চেয়ে সয়ে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তবুও এখন ব্যথাহত হয় মনের ব্যথাই বা কম কীসে?
রোজা না হলেও রোজার মতো না খেয়ে দিন কাটছে কবিতার। সেই আগের মতো সৌন্দর্য এখন আর নেই। শুকিয়ে কাঠ হওয়া শরীরে হাড় গোনা যায় যেন অনায়াসে। অন্তরঙ্গতার মূহুর্তে তো ফট করে নিরবের মুখ দিয়ে বেরই হয়ে গিয়েছে,
“শইল ধরলে খালি হাড্ডি আর হাড্ডি।”
কবিতার তখন কেমন অনুভব হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বহু কষ্টে কোনোরকমে সংসারে সে টিকে আছে, বলা যায় নেহাতই ঠেকায় পড়ে। যাওয়ার যে কোনো জায়গা নেই। তাই বলে সবসময় ধৈর্যের বাঁধ ধরে রাখা কঠিন তাও আবার এমনতর মূহুর্তে এই কথা… কবিতার রাগ সর্বকালেই বেশি ছিল অথচ এই রাগী মেয়েটা কি না এমন পুরুষের সংসার করছে এখনো বিস্ময়ের ব্যাপার। সে-ই কি না তাকে এসব বলে অপমানিত করছে। এখন না প্রতিনিয়তই তো করে। আর এই শরীর হাড্ডি হাড্ডি করার কারণও তো সে-ই। বাপের বাড়ি থেকে শরীরে মাংসল ছিল, তার সংসারে না এসে খেঁটেখেঁটে না খেয়ে এমন হাড্ডিসার হয়েছে। দোষ কেন তবে তাকে দেওয়া হচ্ছে? রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে নিরবের গালে সপাটে চড় দিয়ে বসল। এমন মূহুর্তে যেমন কবিতা কথাটা শুনে মূঢ় বনে গিয়েছিল তেমনই নিরবকেও থাপ্পড়টা স্তব্ধ বানিয়ে দিলো৷ রাতের খাবার নিয়ে করা রাগ তো মাথায় ছিলই এখনের রাগ সেটা মনে করিয়ে দিলো যেন। আগেপিছে না ভেবে এলোপাথাড়ি মারা শুরু করে দিলো মেয়েটাকে শোয়াবস্থায়। গলা দিয়ে চিৎকার দেওয়ার মতো শক্তিও অবশিষ্ট নেই। তবে মারের সাথে নিরবের গাল-মন্দই সেটার ব্যবস্থা করে দিলো বিধায় পাশের ঘরের মানুষরা জেগে গেল মধ্যরাতের নিরবের ভয়াল গর্জনে।
“আরে নিরইব্বা দরজা খোল। মাইয়াডারে মাইরা লাইছ না৷ দরজা খোল।”
কাঠের দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলছেন নিলুফার ও তাঁর স্বামী। পেছনে অবশ্য আরো লোকজন আছে বাড়ির।
মারের শেষে শরীর ক্লান্ত হয়ে এলেই ছাড়ে কবিতাকে। মেয়েটার মুখ দিয়ে লালা পড়ছে এতোই খারাপ অবস্থা সাথে বিছানারও। ঘরের দরজা খোলে বেরিয়ে যায় নিরব। নিলুফার নিজের স্বামীকে ছেলেটার পিছনে যেতে বলে কবিতাদের ঘরে ঢুকে যায়। এ বাড়ির দেখাশোনা বাড়িওয়ালা তাঁর হাতেই দিয়েছেন। তাই বর্তমানে বাড়ির কর্তৃত্ব তাঁর-ই। বয়সও কম নয় পঞ্চাশের কাছাকাছি। এগিয়ে গিয়ে বিধ্বস্ত বাণে জর্জরিত উন্মোচিত দেহের কবিতার গায়ে শাড়ি জড়িয়ে দিলেন। পানি পান করিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। কবিতার বিষয়ে জানেন তিনি। মেয়েটর শরীরে কালশিটে দাগের দিকে তাকিয়ে তাঁর বুকটা হুহু করে উঠল। কােন বাপ-মা’র সন্তান কই এসে পড়ে রয় মার খেয়ে! ভালোবেসে যার হাত ধরল ঘর ছাড়ল আজ সে-ই পৃথিবী ছাড়াতে উঠেপড়ে লেগেছে। এটাই কপাল সাথে পিতামাতার অভিশাপও নিহিত।
সারারাত আর নিরব ঘরে ফিরল না। ভোরের দিকে কবিতার পাশ থেকে উঠে বসলেন নিলুফা। রাতভর মেয়েটার শিয়রের কাছেই বসে ছিলেন। গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিল। এখন হাত দিয়ে দেখলেন তাপ আগের তুলনায় অল্পের দিকে তবুও একশ ডিগ্রি তো হবেই। নাহ, পেটে চাপ পড়ছে বসে থাকা যাচ্ছে না, টয়লেটে যাওয়াই লাগবে। দরজা ভিজিয়ে বাইরে চলে গেলেন প্রাকৃতিক কাজ সারতে। ফিরে এসে দেখলেন দরজা ভেতর থেকে আটকানো। কপালে ভাঁজ পড়ল। ঘুমের ঘোরে হলেও মনে আছে দরজা বাইরে দিয়ে লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। এরইমধ্যে ভেতর থেকে দরজা আটকে গেল কী করে? নিজের মনেই খানিক ভেবে উপায় না পেয়ে পাশের আরো লেকজন ডেকে জড়ো করতে লাগলেন। নিরব-ও এলো সাথে নিলুফাদের রুম থেকে বেরিয়ে। সকলে মিলে দরজা ভেঙে যায় দেখল পাশে ধপ করে পড়ে যাওয়ার আওয়াজ হলো শুধু।
পরিশিষ্ট : জেলখানায় নিরব বসে আছে ঘোর অন্ধকার নীরবতার মাঝে। আর ভাবছে একটা মিথ্যার জন্য আজ তার ভালোবাসা কেমন বিলীন হয়ে গেল। একটা মিথ্যে কি না তো একের অধিক নিহিত সেখানে। শুধু কি তাই? রাগে অন্ধ হয়ে বন্ধ ঘরে মেয়েটাকে কীভাবে মারল সেটাও এখন চোখে ভাসে…
সেদিন নিলুফারের চিৎকারে ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে গিয়ে দেখে কবিতার শরীর ফ্যানের সাথে ঝুলছে। তা দেখে স্তব্ধ হয়ে নিচে ধপ করে পড়ে। তারপর হুঁশ আসলে চিৎকার করে উঠে। কিন্তু এখন তার হাজারো চিৎকারে কবিতা উঠবে না। সে যে বড্ড রাগী মেয়ে। কবির তো বলেছিল, মেয়েটাকে না রাগাতে। কিন্তু সে কী করল মেয়েটাকে রাগীয়ে দিলো। তার সাথে রাগ করে তাকে একা ফেলে চলে গেল। উচিত হয়নি, উচিত হয়নি, দোষ সব তার। ভালোবাসাকে মৃত্যুরমুখে সে-ই তো ঠেলে দিয়েছে। মেয়েটাকে সে বোধহয় ভালোবাসতে পারেনি, নাহলে এত রাগী মেয়েটার সংযমের সাথে করা সংসারের বাঁধ অসুরের শক্তিতে সে কেন ভেঙে দিলো।
আজ জেলখানায় পুরানো কথা মনে করে আবারো চিৎকার দিয়ে উঠল নিরব। সেদিন নির্যাতনের কারণে কবিতার আত্মহত্যার দায় মনে করে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয় সকলে। পুলিশও মেয়েটার শরীরে মারের দাগ সনাক্ত করে নিরবকে হাতকড়া পরায়।
সমাপ্ত।
কাহিনিটা আমাদের বাড়ির পাশেই ঘটেছে। ভোর সকালে পুলিশের গাড়ি এসে মেয়েটার লাশ নিয়ে যাচ্ছিল। হলদে ফকফকা নুপুর পরা পা দুটো বের হয়েছিল, দেখে গা শিউরে উঠছিল। সবচেয়ে করুণ বিষয় কী ছিল জানেন? মেয়েটা তখন মাত্র ক্লাস নাইনের। যা গল্পে আমি বদলে দিয়েছি। অল্প বয়সের আবেগ!