সুখপাখি
১২ এবং শেষ পর্ব।
————————-
সন্ধ্যায় আবির অফিস থেকে ফিরে রুমে এসে দেখলো শিমু নেই। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে রান্নাঘর, পড়ারঘর চেক করেও শিমুকে পেলো না। মেনসনের বা পাশের সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে আবির ফিরোজা বেগমের রুমে এসে দেখলো শিমু নেই। তার মাকে জিজ্ঞেস করলো,
— “মা শিমু কই?”
— “এতক্ষণ তো এখানেই ছিলো। একটু আগেই বেরিয়েছে রুম থেকে।”
আবির মেনসনের বা পাশের সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখলো মেনসনের ডান পাশের সিড়ি দিয়ে শিমু দৌড়ে উপরে উঠছে। আবির ডাকলো,
— “এই মেয়ে দাড়াও।”
শিমু দাঁড়িয়ে গেলো। আবির ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
— “লুকোচুরি খেলছো কেন আজ?”
— “আজকে আমি বৃষ্টিতে ভিজেছি। এখন জোর জোর লাগছে। আর আপনি একগাদা বকবেন। তাই পালাচ্ছি।”
আবির ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। শিমুকে বললো,
— “বকবো না। রুমে আসো।”
শিমু আবিরের পাশে এসে দাঁড়ালো। বারান্দা থেকে আকাশ দেখা যাচ্ছে। গুড়ুম গুড়ুম মেঘের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে এখনো। এখনই মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। দুজনে কিছুক্ষণ বৃষ্টি দেখে রুমে আসলো। শেষ রাতে শিমুর গা কাপিয়ে জোর আসলো। আবির মাথায় জলপট্টি দিয়েছে। শিমুকে হালকা কিছু খাইয়ে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে। জোরটা তিনদিন ছিলো। আবির একবারের জন্যেও শিমুকে বকেনি। প্রতিরাতে তাহাজ্জুদ পড়ে শিমুর সুস্থতার জন্য দোয়া চেয়েছে। শিমু একটা ব্যাপার খেয়াল করলো আবির প্রতি রাতে নামাজের আগে শিমুর কপালে ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে তারপর নামাজে দাঁড়ায়। আজকেও এমন করায় শিমু জিজ্ঞেস করলো,
— “আপনি প্রতিদিন নামাজের আগে আমার কপালে চুমু দেন কেনো?”
আবির হালকা হাসলো। নামাজের বিছানায় দাঁড়িয়ে থেকেই বললো,
— “রাসূল (সাঃ) প্রার্থনার আগে আয়েশা (রাঃ) এর কপালে চুমু দিতো। আমিও সুন্নাহ পালন করছি।”
আবির নামাজ পড়া শুরু করে। শিমু অবাক নয়নে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলো আবিরের দিকে। ভাবছে, “এটা সেই লোক যে আগে মদ, ড্রাগ এসব ছাড়া কিছুই বুঝতো না। কত মারধর করেছে। মলম পর্যন্ত লাগিয়ে দেয়নি। যার দ্বীনের প্রতি কোনো আগ্রহই ছিলো না। সেই লোক এখন প্রায় রাতেই তাহাজ্জুদ পড়ে, আমার সুস্থতার জন্য দোয়া করে।” শিমু আবিরকে দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে গেলো।
—————————————-
কলেজ থেকে খুবই ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরলো শিমু। গেইট দিয়ে ঢুকার সময় দারোয়ান চাচা চাবি দিলো শিমুকে। বললো,
— “ম্যাডাম আপনার শ্বাশুড়ি আপনাদের বাসায় গেছেন।”
— “আপনাকে কয়বার বলেছি আমাকে নাম ধরে ডাকবেন। ম্যাডাম ডাকবেন না। আমি আপনার অনেক ছোট। এরপর থেকে ম্যাডাম ডাকলে বেতন কমিয়ে দেবো।”
দুইজনে হেসে দিলো। শিমু দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। রুমে এসে বোরকা খুলে ওয়াশরুম থেকে মুখ ধুয়ে বের হতেই বেল বাজলো। শিমু ভাবলো আবির এসেছে হয়ত কারণ আবির এখন যেকোনো সময় বাসায় চলে আসে। শিমু কলেজ ড্রেস পরে ওড়না ছাড়াই দৌড়ে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলে সামনের ব্যাক্তিকে দেখেই শিমুর হাসি উবে গেলো।
ঘামে একেবারে ভিজে জুবুথুবু হয়ে গেছে আবির। গায়ের শার্ট লেপ্টে গেছে শরীরের সাথে। আজ একটু তাড়াতাড়িই ফিরলো। মনটা কেমন যেনো করছে বাসার জন্য। গেইটের ভেতরে ঢুকতেই একটা বিষম খেলো আবির। দারোয়ান মাটিতে পরে আছে। আবির তাড়াতাড়ি করে দৌড়ে তার কাছে গেলো। কিছুক্ষণ ডাকতেই জ্ঞান ফিরলো। দারোয়ান কান্না করে দেয় আবিরকে ধরে। আহাজারি করতে থাকে। আবিরের মনে এবার কু ডাকতে শুরু করলো। মাথায় শিমুর কথায় ঘুরছে। আবির কোনোরকমে জিজ্ঞেস করলো,
— “কি হয়েছে চাচা?”
দারোয়ান কেঁদে কেঁদে বললো,
— “শিমু! শিমুকে ওরা নিয়ে গেছে বাবা। আমি বাধা দেয়ায় আমাকে অজ্ঞান করে ওরা শিমুকে নিয়ে গেছে। বাবা তাড়াতাড়ি করে শিমুকে খুজে আনো। মেয়েটা অনেক ভালো।”
আবিরের শরীরের হিমশীতল বাতাস বয়ে গেলো। সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে গেলো। স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো দারোয়ানের দিকে। ড্রাইভার এসে বললো,
— “স্যার ঘরের ভেতরে সব জিনিস এলোমেলো হয়ে আছে। স্যার তাড়াতাড়ি করেন শিমু মাকে খুজতে বের হতে হবে।”
আবির রোবটের ন্যায় মাথা নাড়ালো। ড্রাইভার বুদ্ধি করে আরফান আর শাকিলকে ফোন করে সব জানালো। শিমুর বাসায় খবর পৌছাতেই ফিরোজা বেগম আহাজারি করে বললেন,
— “আমার বউমা।”
শিমুর দাদি ফিট হয়ে গেলো। রাবেয়া বেকায়দায় পরে গেলো। শ্বাশুড়িকে সামলাবে নাকি মেয়েটাকে ধরবে বুঝতে পারছে না। তাথই শিমু শিমু বলে কাঁদছে।
আবিরের বন্ধুরা পুলিশে খবর দিয়েছে। পুলিশ প্রথমে আবিরের ঘর তল্লাশি করলো শেষে শিমুর বাসা। মাহিনের ঘরে অনেক ড্রাগ, এলকোহলের বোতল এবং অনেক মেয়েদের ছবি পেলো। পুলিশ কিছু জিজ্ঞেস করায় আগেই রাবেয়া বললো,
— “মাহিন! মাহিনই করেছে এসব আমার যতটুকু ধারণা। ও প্রথম থেকেই মেয়েটাকে নিয়ে ব্যবসায় নেমেছে। আপনারা ওকে পেলে শিমুকেও পেয়ে যাবেন।”
রাবেয়া আর কিছু বললো না। বোবা হয়ে গেলো। আবিরও চুপচাপ হয়ে গেছে। পুলিশ মাহিনের নাম্বার ট্রেস করে একটা গোডাউনে পেলো ঠিকানা। পুলিশের সাথে আবিরও গেলো। আরফান এবং শাকিল এদিকে সামলাতে লাগলো।
—————————————-
পিটপিট করে চোখ খুলতেই নিজেকে একটা বদ্ধ রুমে আবিষ্কার করলো শিমু। ভয়ে তাড়াতাড়ি করে উঠে বসে। চারপাশে অন্ধকার। শুধু একটা কম ভোল্টের বাতি মিটমিট করে জ্বলছে। খটখট শব্দে শিমুর টনক নড়লো। ভয়ে ঘাম ছুটে গেছে। একটা বিদেশি লোক এবং সাথে মাহিন রুমে প্রবেশ করলো। লোকটা শিমুকে পর্যবেক্ষণ করছে বারবার। মাহিন ইংরেজিতে বললো,
— “স্যার আপনার মাল।”
— “একদম টাটকা এনেছো এবার মাহিন। আমি খুব খুশি। তোমাকে ডাবল ডলার দেয়া হবে। আমি এখনই একটু ইনজয় করতে চাই।”
— “ওকে স্যার।”
মাহিন বেরিয়ে যেতে চাইলেই লোকটা মাহিনকে ডেকে ইংরেজিতে বললো,
— “তুমিও বসো। দেখে মজা নাও।”
মাহিন এবং লোকটা বিশ্রী হাসি দিলো। শিমু কাপাকাপা স্বরে বললো,
— “মাহিন ভাইয়া তুমি আমাকে এখানে কেন এনেছো?”
মাহিন বললো,
— “সেদিন আমাকে মেরে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলো না আবির চৌধুরি? আজ তোর এমন হাল করবে আমার বস যা দেখে আবির চৌধুরি পাগল হয়ে রাস্তায় নামবে।”
শিমু কিছু বলার আগেই বিদেশি লোকটা শিমুর উপর ঝাপিয়ে পরে। শিমু বাধা দিচ্ছে আর মাহিনকে বলছে,
— “মাহিন ভাইয়া আমি তোমার ছোট বোন প্লিজ এমন করো না।”
মাহিন সোফায় বসে এসব দেখে হাসছে। লোকটা শিমুর ক্রস বেল খুলে নিলো। শিমুর দুইহাত মাথার কাছে চেপে ধরে। শিমুর দিকে ঝুকতেই শিমু ভয়ে জ্ঞান হারায়। শিমুর দুইগালে থাপ্পড় দিয়ে কয়েকবার ডাকতেই সাড়া না পেয়ে সরে যায় লোকটা। মাহিন বললো,
— “কি হয়েছে স্যার?”
— “মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গেছে। এভাবে মজা নেই। জ্ঞান ফিরুক তারপর।”
দুইজন রুম থেকে বের হয়ে সামনে আসতেই পুলিশরা ভেতরে ঢুকে বন্দুক তাক করে বিদেশি লোকটার দিকে। মাহিন পেছনে ছিলো। পুলিশকে দেখতেই ভেতরে চলে আসে। শিমুর মুখে পানি ঢেলে দিলে শিমুর জ্ঞান ফিরে আসে। শিমুকে চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে বললো,
— “তুই ধর্ষিত হয়েছিস শিমু। ধর্ষিত হয়েছিস। আবির তোকে কোনোদিন মেনে নিবে না। আর যদি মেনেও নেয় তোর উপর দয়া করে মেনে নিবে। একজন ধর্ষিতা হয়ে তুই কি আবিরকে নরক জীবনে ঠেলে দিবি? ওর ভালো চাইলে দূরে চলে যাবি।”
শিমু কিছু বুঝতে পারছে না। শিমুর কানে শুধু “ধর্ষিত হয়েছিস” এই কথাটাই গেলো। আবির হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে এলো। শিমু চুপচাপ বসে আছে। আবির সামনে এগোলেই পেছন থেকে মাহিন আবিরের মাথায় শক্ত কাঠ দিয়ে বারি মারে। আবির সেখানেই লুটিয়ে পরে।
—————————————-
হসপিটালের কেবিনে শুয়ে আছে আবির। মাথাটা ব্যান্ডেজ করা। আবিরের জ্ঞান ফিরলে চোখ মেলে দেখলো একজন পুলিশ অফিসার বসা তার সামনে। পুলিশ অফিসার বললো,
— “এখন কেমন লাগছে আপনার?”
আবির হালকা হেলান দিয়ে বসে বললো,
— “মাচ ব্যাটার।”
— “মাহিন, যে আপনার শালক হয় সে নারী পাচারকারী ছিলো। এই নিয়ে সে ২৬ নারী পাচার করেছে। আপনার ওয়াইফকে চড়া দামে বিক্রি করতে চেয়েছে। আর আপনাকে টার্গেট করেছে আপনার বাড়িটার জন্য। পুরানো আমলের বাড়িতে অনেক সিক্রেট ডোর অথবা রুম থাকে। যার কারণে আপনাকে খাতারনাক ড্রাগটা দিয়ে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছে। মিসেস শিমুকে আপনার সাথে বিয়ে দিয়েছে এই কারণেই। আপনারা দুইজন একটা মোহরা ছিলেন মাত্র। তাদের আসল কাজ ছিলো আপনার বাড়ি, সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে সেখানে নারীদের দেহ ব্যবসা চালানো এবং পাচার করা। মাহিন এখানে একা ছিলো না। বিদেশি আরো অনেক ছিলো। সবাইকে এর্যাস্ট করা হয়েছে। পুলিশের গুলিতে মাহিন নিহত হয়েছে।এবার আর কোনো বিপদ নেই আপনাদের।”
— “আমার ওয়াইফ কোথায়?”
— “উনি আপনাকে হসপিটালে ভর্তি করিয়ে চলে গেছেন। আপনার বালিশের নিচে একটা চিরকুট রেখে গেছেন।”
পুলিশ অফিসার চলে যেতেই আবির চিরকুট বের করলো। চোখে পানি টলমল করছে। চিরকুট খুললো তাতে লেখা ছিলো,
“আমি ধর্ষিত হয়েছি। তাই চলে যাচ্ছি আপনার থেকে অনেক দূরে। আমি চাইনা আমার এই অভিশপ্ত জীবনের ছায়া আপনার জীবনে পড়ুক। আমাকে খোজার চেষ্টা করবেন না। ভালো একজন মেয়ে দেখে বিয়ে করে জীবন পুনরায় শুরু করুন সুন্দরভাবে।
– ইতি
আপনার সুখপাখি।”
আবির চিঠিটা পড়ে গলা ফাটিয়ে শিমু বলে চিৎকার করলো। সাথে সাথেই আবার মাথায় রক্তক্ষরণ শুরু হয়। আবির সেন্সলেস হয়ে পরে।
একসপ্তাহ আবির হসপিটালে ছিলো। তাকে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছে। ঘুম ভাঙলেই শুধু শিমু শিমু বলে চিৎকার করে। আজ আবির সুস্থ কিছুটা। আবির বসে আছে হসপিটালের বেডে। ফিরোজা বেগম আবিরের হাত ধরতেই আবির বললো,
— “মা শিমু আমাকে ফেলে কেনো চলে গেলো? আমাকে বুঝতেই চায়নি। শিমু কেনো বুঝলো না ও ধর্ষিত হলেও আমার কিছু যায় আসেনা। আমার শুধু ওকেই লাগবে। ও কেনো বুঝলো না?”
আবির কাঁদছে। ফিরোজা বেগমের বুকটা ভারি হয়ে গেলো। তিনি ভাবছেন, শিমু চলে যাওয়ায় আবিরের এ অবস্থা। যখন আমি ফেলে চলে গেছিলাম তখন না জানি আমার ছেলেটা কিভাবে দিন পার করেছে। চোখটা ভিজে গেলো ফিরোজা বেগমের। তিনি স্বাভাবিক হয়ে বললেন,
— “আমাকে যেভাবে খুজে বের করেছিস এবার শিমুকেও খুজে বের করবি। আমাকে খুজতে দেরি করেছিস কিন্তু শিমুকে খুজে বের করতে যেনো দেরি না হয়। তারপর আমরা মা,ছেলে মিলে খুব বকে দিবো। কেনো সে আমার ছেলেটাকে রেখে চলে গেলো।”
আবির কান্না থামিয়ে তার মায়ের দিকে তাকালো। চোখ মুখ শক্ত করে নেয়। মনে মনে বললো,
— “ঠিকাছে। হারিয়ে যখন গিয়েছো এবার দেখি কতদিন লুকিয়ে থাকতো পারো। আমার খাচায় তোমাকে বন্দী হতেই হবে আমার সুখপাখি।”
শিমুর বাড়িতে ফোন দিয়ে জানা গেলো শিমু সেখানেও যায়নি। সব জায়গা খোজা হয়েছে। কোথাও পেলো না শিমুকে। আবিরের শ্বাস আটকে আসার উপক্রম।
——————————
জানালার গ্রিল ধরে বাহিরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিমু। সে তার বাড়িতেই আছে। শুধু সবাইকে মানা করে দিয়েছে কেউ যাতে আবিরকে না বলে সে এখানে আছে। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। কিন্তু ভেতরের ঝড় এখনো থামেনি। চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শিমু। সে চায়না তার এই অভিশপ্ত জীবনের ছায়াও আবিরের উপর পড়ুক। সবাই যে তাকে কটাক্ষ করবে সেটা শিমুর সহ্য হবে না তাই দূরে সরে এসেছে। গত দুই সপ্তাহ যাবত ঘরবন্ধী হয়ে পরে রয়েছে৷ চোখ মেলে আবারো বাহিরে তাকালো শিমু। দরজায় খট করে শব্দ হতেই ধ্যান ভাঙলো তার। পেছন ফিরে তাকাতেই শিমু আতকে উঠে। ভয়ে ঢোক গিলে কয়েকটা। এখন যে আরো বড় ঝড় বয়ে যাবে সেটা খুব বুঝতে পারছে শিমু। আবির দরজা লাগিয়ে শিমুর দিকে এগিয়ে আসছে। চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। রাগে শরীরের রক্ত টগবগ করছে আবিরের। আবির শিমুর সামনে এসে দাঁড়ায়। শান্ত কণ্ঠে বললো,
— “তোর সাহস দেখে আমি অবাক হই। কি ভেবে তুই আমার খাচা থেকে পালাতে চাস? এতো সাহস কবে থেকে হলো তোর?”
শান্ত কণ্ঠ অথচ শিমু ভিয়ে রীতিমতো কাপছে। আবির কিছু না বলেই শিমুর ওষ্ঠ দখল করে নেয়। শিমু নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিলো। কিন্তু এখন শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে। ধাক্কা দেয় আবিরকে। কিন্তু আবির ছাড়ছেই না। অনেকক্ষণ পর ছাড়তেই শিমু বুকে হাত দিয়ে চেপে ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। আবির শিমুর দুইবাহু ধরে বললো,
— “শ্বাস আটকে আসছে? কষ্ট হচ্ছে তোর? আমারও কষ্ট হয়েছে। এই দুই সপ্তাহ আমারও ওভাবে শ্বাস আটকে আসতে চাইছিলো। কি ভেবে আমাকে ফেলে চলে এলি? বল, আমার জন্য খারাপ লাগেনি? এভাবে হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যু সজ্জায় ফেলে চলে এলি। যদি মরে যেতাম? খুশি হতি খুব?”
শিমু কেঁদে দেয়। আবির বেডের উপর বসে। শিমু এখনো ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে জানালার পাশে। কিছুক্ষণ পর আবির শিমুর হাত ধরে টেনে আনে কাছে। আবির বললো,
— “কেনো এই সিদ্ধান্ত নিলি? তুই জানিস না আমার তোকে ছাড়া চলে না।”
শিমু আবির থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,
— “আমি ধর্ষিত হয়েছি। একজন ধর্ষিতাকে কেউ মেনে নেয় না সমাজে। বউ হওয়ার অধিকার তার নেই। আমার জন্য আপনাকে লোকে কথা শুনাবে। কটাক্ষ করবে। আমি চাইনা আমার জন্য কেউ অপমানিত হোক। আপনি চলে যান। সুখে থাকুন অন্যকারো সাথে।”
শিমু সরতে চাইলেই আবির শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শিমুকে। শিমুর বুকে মাথা রেখে কোমড় ধরে বললো,
— “আমি এইসব মানি না। আমার শুধু তোকেই চাই।”
— “প্লিজ ছাড়ুন আমাকে। চলে যান আপনি।”
— “শুন আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না। যদি যাই তাহলে তোকেও যেতে হবে আমার সাথে। তুই একবার ধর্ষিত হলেও আমার তোকে চাই, তুই একশবার ধর্ষিত হলেও আমার তোকে চাই, তুই হাজারবার ধর্ষিত হলেও আমার তোকে চাই। তোকে চাই, তোকে চাই, তোকে চাই। আমার শুধু তোকেই লাগবে। বুঝেছিস? আর তুই ধর্ষিত হসনি। নিজেই নিজের উপর ধর্ষিতার ট্যাগ লাগিয়ে লুকিয়ে পালাচ্ছিস। ওই লোক তোর কিছুই করতে পারেনি।”
— “তাহলে মাহিন ভাইয়া যে বললো..।”
— “তোকে আমার এইজন্য থাপড়াতে মন চায়। মানুষ যা বলে তাই বিশ্বাস করে নেস। তোকে বিদ্রান্ত করার জন্য এসব বলা হয়েছে। সমাজে কিছু মানুষ আছে যারা অন্যের সুখ সহ্য করতে পারে না। হুদাই প্যাচ লাগায়। মাহিন হলো তেমন। তুই ধর্ষিত হলে তুই নিজেই বুঝতে পারতি। এবার অন্যের কথায় নাঁচিস না আর প্লিজ।”
শিমু চুপ করে রইলো। আবির শান্তিতে শিমুর বুকে লেপ্টে রইলো। শিমু ভাবছে আসলেই তো এসব ভেবে দেখিনি। আমিতো বুঝতে পারতাম কিছু হলে। শিমুর নিজের উপরই রাগ হলো। কতটা বোকা হলে আরেকজনের বলা কথায় নাঁচতে শুরু করে মানুষ। উফ!
আবির মাথা তুলে বললো,
— “আমার জন্য নাস্তা নিয়ে আয়। এই দুসপ্তাহ ঠিকমতো খাওয়া হয়নি।”
শিমু মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। নাস্তা এনে আবিরকে খাইয়ে দিলো। নাস্তার প্লেট রেখে রুমে আসলেই আবির দরজা লাগিয়ে দেয় আবার। শিমুর কোমড় ধরে টেনে কাছে আনে। বললো,
— “তুই এতো বোকা আর ইনোসেন্ট কেনো বলতো? কেউ বললো ধর্ষিত হয়েছিস। আর অমনি অন্যের কথায় নাঁচতে নাঁচতে নিজেই বলছিস আমি ধর্ষিত। পাগলি তুই।”
আবির হাসলো। শিমু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
— “তখন যে বললেন হাজার বার ধর্ষিত হলেও আমাকে চান। আসলে মানুষ হাজার তো কম, একবার ধর্ষিত হলেই মারা যায়।”
আবির ঘর কাপিয়ে হাসলো। শিমু বোকার মতো চেয়ে রইলো আবিরের দিকে। আবির শিমুর ওষ্ঠে ঠোঁট ছুয়ে বললো,
— “আমিতো কথার কথা বললাম। তুই তো আমাকেই সামলাতে পারিস না।”
শিমু মাথা নামিয়ে নিলো। আবির শিমুকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললো,
— “তোর বয়স কত?”
শিমু আবারো বোকার মতো মুখ করে আবিরের দিকে তাকালো। আবির ঠোঁট কামড়ে হাসছে। শিমু আস্তে করে বললো,
— “আঠারো হয়েছে।”
— “আমার বয়স কতো জানিস? আঠাশ বছর। তুই আঠারো বছরের একটা যুবতী আমার আঠাশ বছরের যুবককে একেবারে কাবু করে ফেলেছিস।”
শিমুর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
— “তুই আমাকে বান মেরেছিস। ভালোবাসার বানে মেরেছিস। আমার আঠাস বছরের যুবকের মনে ভালোবাসার সাগর গড়ে তুলেছিস।”
আবির সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শিমুর মুখের দিকে তাকালো। শিমু কিছু বলতেও পারছে না, তাকাতেও পারছে না। যা দেখে আবিরের আরো বেশি দুষ্টামি জাগলো মনে। কোমড় ধরে টেনে আরো কাছে এনে ফিসফিস করে বললো,
— “চল তোকে আমার ভালোবাসার সাগরে একটু ডুব দিয়ে আনি।”
শিমু ঝাপটে ধরলো আবিরকে। লজ্জায় মুখটা লুকিয়ে ফেললো আবিরের বুকে। আবির শিমুকে কোলে তুলে নিয়ে দুজনে বেডে শুয়ে পরে। ডুব দেয় ভালোবাসায়।
——————————
শিমুর প্র্যাগনেন্সির আট মাস চলছে। আবির শিমুকে রুমের বাহিরে আসতেই দেয়না একা। ঘরে দুইজন মেইড রেখেছে সব কাজ করার জন্য। শিমুর আলট্রা করে ধরা পরলো তিনটা বাবু হবে। পেটটা স্বাভাবিকের চেয়ে খুব উঁচু হয়ে গেছে। সবাই খুশি। আবির সবচেয়ে বেশি খুশি। প্রতিদিন রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে দোয়া করে তার তিনটাই যেনো মেয়ে হয়। আবিরের পাগলি দেখে শিমু এবং ফিরোজা বেগম হেসে লুটপাট হয়ে যায়।
হাসপাতালের করিডোরে বসে আছে আবির। পাশে ফিরোজা বেগম। তারপাশে রাবেয়া এবং তাথই। তাথই এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। শিমুর মতো দ্বীনি হয়েছে। এতটুকু বয়সে বোরকা ছাড়া বের হয়না। বছর এক আগে সৈয়দা খাতুন ইন্তেকাল করেছেন। ডাক্তার এসে জানালো চারজনেই সুস্থ আছে এবং তিনটাই মেয়ে বাবু। আবির খুশিতে কেঁদে দিলো। ড্রাইভার আর আরফানকে দিয়ে মিষ্টির দোকান কিনে এনেছে। পুরো হাসপাতালের রোগী, ডাক্তার, নার্স কেউ বাদ যায়নি মিষ্টি খাওয়া থেকে। আবির নিজের অফিসেও মিষ্টি খাইয়েছে সবাইকে। আবির শিমুর কাছে গেলো। শিমুর কপালে চুমু দিতেই শিমু মুচকি হাসলো। আবির মেয়েদের কপালে চুমু দিয়ে বললো,
— “আমার তিনটা জান্নাত।”
শিমু এবং আবিরের বিয়ের পাঁচ বছর পেরিয়েছে। বাচ্চারা এখন হাটতে পারে। বাচ্চাদের পালতে খুব একটা কষ্ট হয়না শিমুর। শিমু এখনো পড়ছে। কিছুদিন আগে মাস্টার্সে ভর্তি হলো। আবির তাকে এখনো পড়াচ্ছে। শিমু চেয়েছে পড়ালেখা ছেড়ে দিতে কিন্তু আবির ছাড়তে দেয়নি। যখন পড়তে বসে বাচ্চাদের আবিরই রাখে। বাচ্চাদের খাওয়ানো, খেলাধুলা করা, গোসল করানো, বাচ্চাদের কাপড় -চোপড় ধুয়ে দেয়া সব আবির করে বেশিরভাগ সময়। শিমু আগের থেকে একটু মোটা হয়েছে। শিমু প্রায় শুনেছে, বাচ্চা হওয়ার পর আগের মতো ভালোবাসা থাকে না। কিন্তু সে যতই আবিরকে দেখে ততই অবাক হয়। আগের থেকে আরো বেশি ভালোবাসে শিমুকে। আগে যেমন ঘরের কাজ করতো। এখনো শিমুকে ঘরের কাজে সাহায্য করে। শিমু ভার্সিটিত জন্য রেডি হতে গেলে চুল আচড়ে দিবে, নাস্তা খাইয়ে দিবে, ব্যাগ গুছিয়ে দিবে।
আবিরের ব্যবসাটা আগের চেয়ে বড় হয়েছে। আগে আবিরের আন্ডারে পঁচিশজন কাজ করতো। এখন পঞ্চান্নজন কাজ করে। তাথই এখন নবম শ্রেণিতে পড়ে। তাথইদের বাড়ির পুরো এরিয়া বাউন্ডারি দিয়ে একটা গেইট দিয়েছে যাতে বাহিরের কেউ আর উঁকিঝুকি করতে না পারে। তাথইকে কোর’আন শিখিয়ে আবির। আবির এ পর্যন্ত পাঁঁচবার শিমুর কাছেই কোর’আন খতম দিয়েছে। তাথইদের বাড়িতে দুইজন মেইড ঠিক করে দিয়েছে। একজন বিশ্বস্ত দারোয়ান রেখেছে। তাথই এর স্কুলে চলাফেরার জন্য একটা ক্যাব পার্সোনালি রেখে দিয়েছে আবির। শিমুর পরিবারে পুরুষ কেউ নেই তাই আবিরই দেখাশুনা করে সবাইকে।
শিমু বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে বারান্দায় এসে আবিরের পাশে বসলো। আবিরের কাধে মাথা রাখে। দুজনে জোছনা বিলাশ করছে। আবির শিমুর কপালে ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে বললো,
— “আমার জীবনে না এলে হয়ত কোনো এক বারে মদ খেয়ে জীবন পার করতাম আমি। তুমি এসে আমার জীবনটা পরিপূর্ণ করে তুলেছো। অমানুষ থেকে মানুষ বানিয়ে আল্লাহর রাস্তায় এনেছো। শিমু তুমি হলে আমার সুখপাখি। ভালোবাসি শিমু। খুব ভালোবাসি আমার সুখপাখিকে।”
শিমু হাসলো। আবিরের খোচা ঘন দাড়িতে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বললো,
— “সকল প্রশংসা আল্লাহর। মানুষ তো মাত্রই উছিলা।”
–সমাপ্ত।
® নাহার।