#হৃদয়ের_ঠিকানা -১
#রাফিজা_আখতার_সাথী
তার সাথে অভিমান করে ইংল্যান্ডের পথে পাড়ি দিয়েছিলাম সেই সাত বছর আগে। আজকে দেশের মাটিতে পা রাখলাম।
সে আবার তার বাড়িতেই আমার দিন কাটবে। হয়তো নতুন বাধনে হয়তো ভীষণ আবেগে।
এয়ার্পোরটের বাইরে বের হয়ে দেখলাম মামী দাঁড়িয়ে আছে। একটু মন খারাপ হলো, হয়তো ভেবেছিলাম সে আসবে কিন্তু আসেনি।
তাকে না দেখতে পেয়ে মামীকে বললাম,
– মামী কাইফ ভাইয়া আসেনি?
– নারে আসেনি। তবে তোর জন্য একজনকে পাঠিয়েছে।
আমি একটু উৎসাহের সাথে বললাম,
– কে, তাকে দেখাবেনা আমাকে?
মামী পরী বলে ডাক দিতেই গাড়ি থেকে ৩/৪ বছর বয়সী একটা মেয়ে বের হয়ে আসলো। মেয়েটা বের হয়ে এসে আমার সামনে এসে দাড়িয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলো।
আমি ওর দিকে একবার তাকিয়ে আবার মামীর দিকে তাকালাম। মামীকে জিজ্ঞাসা করলাম,
– এই মেয়েটা কে মামী? নামটাও যেমন পরী দেখতেও তেমন পরীর মত।
মামী একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
– কাইফের মেয়ে ওটা।
সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। আসলে আমি বড্ড পাগল। সাত বছরে যে মানুষটার সাথে একটুও কথা বলিনি ফোনে, সে কিভাবে আমার জন্য অপেক্ষা করবে! কাইফ ভাইয়া ঠিকই করেছে, বিয়ে করে।
এখন ওই বাড়িতে আমার যাওয়াটা কি ঠিক হবে!
তার স্ত্রী আমাকে দেখলে হয়তো তাদের মধ্যে ঝামেলা তৈরি হবে।
হঠাৎ সামনে থাকা মেয়েটা বলল,
– আম্মু তুমি কাদছো কেন?
আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম অন্যকাওকে ডাকলো কিনা দেখার জন্য। মেয়েটা তখন আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো কোলে ওঠার জন্য। আমি যেন নিজের অজান্তেই তাকে কোলে তুলে নিলাম।
মেয়েটার আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে আমার গালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
– পাপা বলেছিলো তুমি কাদলে যেন তোমার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে তোমার গালে পাপ্পি দিই। তাই পাপ্পি দিলাম। হিহি।
এবার আমি অবাক হওয়ার চরম পর্যায়ে চলে গেলাম৷ কাইফ ভাইয়ার মেয়ে আমাকেই আম্মু ভেবে নিয়েছে! তাহলে তার নিজের মাকে কি ডাকে!
আমি মেয়েটাকে কোলে নিয়েই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেন ভাবনার জগতে হারিয়ে গেলাম। মামী আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আমার কাধে হাত রেখে বলল,
-এতো ভাবনায় হারিয়ে যাসনা মা। জীবন যুদ্ধের অনেক কিছুই বাকি এখনো।
মামী ঠিকই বলেছে, এখনই ভাবনায় হারিয়ে গেলে চলবে নাকি আমার! এরপর কাইফ ভাইয়াকে আর তাদ বউকে একসাথে দেখবো, সেই ধাক্কাও তো সামলাতে হবে।
মামীর কাছে বড্ড জানতে ইচ্ছা করছে, কাইফ ভাইয়া তার বউকে নিজ হাতে খাইয়ে দেয় কি! আমাকে যে ভাবে দিতো আমি রাগ করলে।
পরী আমার কোলে থাকা অবস্থায় আমাকে বলল,
– আম্মু তুমি এমন চুপচাপ আছো কেন? পাপা তো বলেছিলো তুমি খুব চঞ্চল মানুষ, একদম আমার মত।
মামী আমার কোল থেকে পরীকে নিয়ে নিতে চাইলো, আমি মামীকে বারণ করে বললাম,
– আমার কোলে থাকনা ও। আমার খুব ভালো লাগছে।
মামী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– সেদিন সামান্য কারণে রাগ করে যদি তুই না চলে যেতিস তাহলে হয়তো এমনই একটা মেয়ে হেসে খেলে বেড়াতো তোদের জীবনে।
পরী রাগা মাখানো চোখে মামীর দিকে তাকিয়ে বলল,
– দিদি ভাই, তুমি কিন্তু আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছো! আমি কি আমার পাপা আর আম্মুর মেয়ে না! অন্য একটা মেয়ের কথা কেন বললে।
এতোক্ষণ পর হঠাৎ আমার অন্যকিছু মনে হতে শুরু করলো। এই মেয়েটার মা মারা যায়নি তো এর জন্মের সময়! এটা তো হতেই পারে। হয়তো কাইফ ভাইয়া আমার ছবি দেখিয়েই বলে গেছে যে আমিই তার মা যাতে সে মায়ের অভাব না অনুভব করে।
মামী পরীকে আমার কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে বলল,
– সারাজীবন তো পরীকে কোলে নিয়েই কাটাবি। এখন নাহয় একটু আমিই রাখি।
এরপর মামী ড্রাইভারকে বললো আমার লাগেজ গুলো গাড়িতে তুলতে। এদিকে আমরা গাড়িতে উঠলাম। আমি একদম ডান পাশে বসলাম, তারপর পরী বসলো আর বাম দিকে বসলো মামী। ড্রাইভার লাগেজগুলো গাড়ির পিছনে রেখে ড্রাইভিং সিটে এসে বসে গাড়ি চালানো শুরু করলো।
গাড়ি চলা শুরু করতেই পরী আমার কোলে এসে বসবে আবদার করলো। মামীকেও দেখলাম কেমন করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো তার দৃষ্টি বলছে যেন আমি পরীকে নিজের কোলে বসিয়ে নিই। কয়েক মিনিটের পরিচয়ে মেয়েটা কেমন যেন আমার অনেক আপন হয়ে উঠেছে।
মামীর দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে পরীকে নিজের কোলের উপর বসিয়ে নিলাম।
গাড়ি আপন গতিতে চলছে। বাসায় ফিরতে প্রায় ২ ঘন্টা সময় লাগবে, এরমাঝে একটুখানি ঘুম দেবো কিনা ভাবছি। না না, ঘুম আর হবেনা। কোলে পরী রয়েছে যে৷ ও তো আমার সাথে গল্প করে সময় পার করতে চাইবে। হোকনা একটু ঘুম নষ্ট মিষ্টি মেয়েটার সাথে কথা বলেই নাহয় এই সময়টা নষ্ট করি। নষ্ট বললে ভুল হবে, উপভোগ করি। তবে আপাতত ও যতক্ষণ চুপ থাকে আমি বাইরের পরিবেশ দেখতে থাকি।
বড় বড় অট্টালিকাগুলো সব পিছন দিকে চলে যাচ্ছে। চলন্তগাড়িতে বসে মুখ বের করে রাখার কারণে চুলগুলো উড়ে এসে মুখের উপর আঁটকে যাচ্ছে। আমি হাত দিয়ে চুলগুলো কানের পিছনে গুজতে যাবো কিন্তু হঠাৎ কেও যেন বলে উঠলো, থাকনা চুলগুলো এমনই৷ বেশ মানাচ্ছে তোকে।
আমি এটা শুনে যেন কেপে উঠলাম। মামী আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
– কি হয়েছে মা? হঠাৎ এমন চমকে উঠলি যে!
মামীর কথা শুনে বুঝতে পারলাম আনি জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্ন বললে ভুল হবে, অতীত দেখেছি। বড্ড অতীতে ডুব দিতে ইচ্ছা করছে। বাইরে বিল্ডিংগুলো যেমন পিছনে চলে যাচ্ছে আমিও তেমনই স্মৃতির পাতায় প্রায় ১০ বছর পিছনে চলে গেলাম।
এমনই একদিনে কাইফ ভাইয়া গাড়ি চালাচ্ছিলো আর আমি তার পাশে বসে জানালায় হেলান দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বিল্ডিং গুলো পিছন চলে যাওয়া দেখছিলাম আর এলোমেলো চুলগুলো বারবার কানের পিছনে গুজে দিচ্ছিলাম কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবার যা যবর যা, তা যবর তা হয়ে যাচ্ছিলো। কাইফ ভাইয়া এটা খেয়াল করে বলল,
– সাওদা তুই বারবার চুল গুলোকে ডিস্টার্ব কেন করছিস?
আমি চখ মোটামোটা করে কাইফ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,
– তুমি কি কানা হয়ে গেছো? দেখতে পারছোনা যে চুল আমার চোখে মুখে চলে আসছে!
কাইফ ভাইয়া কেমন একটা হাসি দিয়ে বলল,
– তাইলে চোখ মুখ বন্ধ করে রাখ। এভাবে বারবার চুল ঠিক করিস না৷ আমার গাড়ি চালাতে সমস্যা হচ্ছে।
এবার যেন আমার চোখে কোঠরি থেকে বের হয়ে আসবে। আমি অবাক চোখে তাকে বললাম,
– আমি রয়েছি তোমার বাম পাশে, তোমার সামনে না যে তুমি গাড়ি চালাতে পারবেনা।
-তুই বুঝবিনা রে পাগলি। এমন চলতে থাকলে শুধু গাড়ি চালানোয় সমস্যা না। আমার মাথায়ও সমস্যা দেখে দেবে। আমি পাগল হয়ে যাবো তোর জন্য।
– আমি তোমার কথা বুঝতে পারছিনা কাইফ ভাইয়া।
উনি গাড়িয়ে সাইড করে রাখলো এরপর আমার দিকে চেপে আসলো। আমাকে একদম একপাশে চেপে রাখলো। আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– আর কত অবুঝ হওয়ার চেষ্টা করবি তুই? আমার মনের কথা সবই জানিস তাহলে কেন বারবার মজা করিস।
আমি কষ্ট করে কোনোরকমে বললাম,
– আমার নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে কাইফ ভাইয়া। তুমি একটু সরে যাও।
– সরবো সাওদা। আগে বল তুই আমাকে ভালোবাসিস! যতক্ষণ না তুই বলবি আমাকে ভালোবাসিস তখন এমন চেপেচুপে রাখবো। উত্তর না পেলে তোকে একদম আলু ভর্তা বানিয়ে ফেলবো। তাই সোজাসাপটা বলে দে তুই আমাকে ভালোবাসিস।
,
চলবে…
১ম পর্ব