#৫ম_তলার_মেয়েটাপর্ব_১২

0
562

#৫ম_তলার_মেয়েটাপর্ব_১২

—উনি আমার বাবার স্ত্রী।

নওমি ভাবতে লাগল কি বোকার মত প্রশ্ন করেছি, ‘পম্পি তোর আম্মু উনি?’আর তখনই পম্পি ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিল।
—উনি আমার বাবার স্ত্রী।
নওমি একটু অবাক হলো।উনি হয়তো পম্পির সৎ মা।তাই বলে, এভাবে কেউ বলতে পারে? পম্পি কিছু কিছু ব্যপারে খুব বেশি বাড়াবাড়ি করে।
ভদ্রমহিলা নওমির প্রশ্ন না শুনতে পেলেও পম্পির উত্তর ঠিকই শুনলো।পম্পি ইচ্ছে করেই উত্তরটা জোড়ে দিলো ভদ্রমহিলার কান পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য।

পম্পির এই কথা শুনে ভদ্রমহিলার কোন ভাবান্তর হলো না।বোঝাই যাচ্ছে উনি এই ধরনের কথা শুনে অভ্যস্ত।

ভদ্রমহিলা মুখে জোর করে হাসি টেনে কাছে এসে বললেন-
—টেবিলে খাবার দিচ্ছি হাতমুখ ধুয়ে এসো খেতে।
—আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।খালাই দিতে পারবে।
—তোমার জন্য কষ্ট করছি না। তোমার এই বন্ধুর জন্য।
নওমির দিকে তাকিয়ে বললেন-
—কি নাম তোমার?
—নওমি।
—খুব সুন্দর নাম। পম্পি তো কখনো ওর বন্ধু বান্ধবদের বাসায় নিয়ে আসে না। তুমি নিশ্চয় স্পেশাল কেউ!
নওমি একটু হাসলো শুধু। ভদ্রমহিলার স্লিম ফিগার উজ্জ্বল শ্যামলা , লম্বা, অনেক লম্বা চুল। আলাদা কি যেন একটা আকর্ষণ আছে।কথা বলেন খুব সুন্দর করে। পম্পির বাবার সাথে বয়সের পার্থক্য অনেক।
খালাকে পম্পি জিজ্ঞেস করলো-
—আব্বু কি দেশেই আছেন,নাকি দেশের বাইরে?
ভদ্রমহিলা যিনি পম্পির সৎ মা, উত্তর দিলেন-
—আজ রাতেই ফিরছেন তোমার আব্বু, পনের দিনের বিজনেস ট্রিপ শেষে।
—ও
নওমি ভাবতে লাগল পম্পির বাবার এত টাকা! পম্পিকে দেখে তো কখনো মনে হয়নি।এত আলিশান বাড়ি,এত আরাম আয়েশ রেখে এত কষ্ট করে থাকে!নওমি আস্তে আস্তে খেতে লাগলো, খাবাবের অনেক বেশি আইটেম থাকলে দ্বিধায় পরে যেতে হয় কোনটার পরে কোনটা খাবে। কত মানুষ একটা তরকারি দিয়েও খেতে পায়না আর এখানে টেবিল ভরা খাবার, খাওয়ার মানুষের দেখা নেই।
পম্পির বাবার আসার কথা রাতে কিন্তু তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ এসে উপস্থিত হলেন।

পম্পিকে দেখে আদর মাখা কণ্ঠে বললেন-
— আমার প্রিন্সেস কেমন আছো?
পম্পি এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রইল শুধু।ওর বাবা মনে হলো অস্বস্তি ফিল করতে লাগলেন। তিনি তাড়াতাড়ি ভিতরে চলে গেলন।
পম্পির বাবাকে দেখে ওর সৎমায়ের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। ভদ্রমহিলা ও পেছনে পেছনে রুমে গেলেন।
পম্পির বেডরুমটা বিশাল। এখানে যে ও থাকে না সেটা বুঝাই যায়না, সুন্দর পরিপাটি রুম।
নওমি বলল-
—ভালোই তো আঙ্কেল সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন।
—সারপ্রাইজ না ছাই। ওই মহিলাকে আব্বু সন্দেহ করে তাই তো যখন তখন চলে এসে দেখে তাকে, কি করে মহিলা। আসলে মহিলাটা ভালোই, সমস্যা আমার আব্বুর মধ্যে। আমার মা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তার কলিজাটা ছিড়ে ছিড়ে খেয়েছে।এখন এই মহিলাকে পেয়েছে,সেও মরার আগ পর্যন্ত আমার আব্বুর অত্যাচার সহ্য করে যেতে হবে।
—উনাকে মহিলা মহিলা বলে ডাকিস কেমন শোনা যায়? অন্তত আন্টি তো বলতে পারিস।
—ইচ্ছে করে না।যখনই মনে হয় আমার মায়ের জায়গাটা উনি নিয়েছেন তখনই রাগে আমার গা জ্বলতে থাকে।তবে রজনীর জন্য মায়া লাগে।
—রজনী কে?
—এই যে আমার সৎ মা। উনার নাম রজনী। আমার শরীরটা কেমন যেন লাগছে।মাথাটাও ব্যথা করছে।চল আমরা একটা লম্বা ঘুম দিয়ে পরে চলে যাবো।ঠিক আছে?
—আচ্ছা ঠিক আছে।

পম্পির কোকানোর শব্দে নওমি জেগে গেলো। সম্পূর্ণ রুম অন্ধকার,অনেকটা আগেই হয়তো সন্ধ্যা পার হয়েছে। পম্পির কপালে হাত দিয়ে নওমি চমকে উঠলো,কপালের গরমে হাত পুড়ে যাচ্ছে। নওমি দৌড়ে ডুপ্লেক্স বাসার নিচতলায় নামলো।পুরো বাসা নীরব,কাকে বলবে বুঝতে না পেরে কিচেনের দিকে গেলো। কিচেন লাগোয়া সার্ভেন্ট রুম। সেখানেই পাওয়া গেলো খালাকে। খবরটা জানিয়ে পম্পির কাছে ছুটলো। মাথায় জলপট্টি দিতে লাগলো নওমি।

পম্পির সৎ মা রজনী ছুটে এলেন।বাবা বাইরে চলে গেছেন একটু আগেই।পম্পির বমি শুরু হলো।রজনী অস্থির হয়ে উঠলেন।একটা বাচ্চার মতো নওমির শশ্রূষা করতে লাগলেন।পম্পির বাবাকে পাওয়া গেলো মোবাইলে।ফ্যামেলী ডাক্তার ও হাজির।ডাক্তার ধারণা করলেন ফুড পয়জনিং। পম্পিকে বাথরুমে নেয়া,ঔষধ খাওয়ানো,মাথাটা কোলে নিয়ে বসে থাকা,গা স্পঞ্জিং করা সব কিছু একা হাতে করলেন রজনী।নওমিকে ঘুমাতে বললেন। কিন্তু নওমির চোখে ঘুম নেই।একজন মা হোক না সে সৎ মা,কিভাবে সন্তানের সেবা করে এই দৃশ্য তার চোখে বসিয়ে রাখতে চায় নওমি।এই দৃশ্য পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্যের একটি।এমন একজন মায়ের আদর থেকে পম্পি নিজেই নিজেকে সরিয়ে রেখেছে।কাছে পেয়েও ছুঁয়ে দেখে না।পম্পি জ্বরের ঘোরে কিংবা ঘুমের ঘোরে মা মা বলে ডেকে উঠে। রজনী বলে উঠেন,’এই যে আমি ,এই যে আমি মা।
এই সবের মধ্যে কোন দেখানোর কিছু ছিল না। নির্ভেজাল পবিত্র স্নেহ ভালোবাসা। পম্পির বাবাও এসেছেন কিছুক্ষণ পর পর খবর নিচ্ছেন।

নওমি কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিল টের পায়নি।যখন ঘুম ভাঙ্গল চারদিকে আলো ছড়িয়ে পরেছে। রজনী উঠে গেছে। পম্পি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।নওমি ফ্রেশ হয়ে লাগোয়া বারান্দায় গেল। বারান্দাটা ঠিক বারান্দার মতো না খোলা ছাদের মত। অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ। কিছু ফুলের গাছ নওমি চেনে না, মনে হয় বিদেশি ফুলের গাছ। সকালের শান্ত পরিবেশ খুব ভালো লাগছে।
—কফি খাও।
হঠাৎ রাজনীর কথা শোনে নওমি চমকে গেল। ট্রের মধ্যে বিস্কিট আর কফি।
—সব সময় এত সকালে ঘুম ভাঙ্গে?
—সবসময় না, মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে গেলে সকালে উঠি।
—তোমার সঙ্গে তো ভালো করে পরিচয় হলো না।
—পরিচয় দেওয়ার মতো আসলে কিছু নেই আন্টি আমার। বাবা-মা নেই, মামার কাছে মানুষ। এইতো আছি ভালোই।
—তোমার বাবা মা নেই?
—নাহ।
—আমারও নেই। পম্পি মনে করে ওর বাবাকে আমি বশ করে বিয়ে করেছি। আসলে ঘটনা কিন্তু অন্য। ওর বাবাই আমাকে ট্র্যাপে ফেলে বিয়ে করেছে। অবশ্য ভালোই হয়েছে। অভিভাবক ছাড়া একটা মেয়ে ভাসতে ভাসতে আর কোথায় যেতো? শত জনের হাত থেকে একজনের হাতই ভালো।
পম্পির বাবা বলে,আমাকে প্রথম দেখেই তার ভালো লেগে যায়।আমি গিয়েছিলাম চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। তখন ইন্টারভিউ বোর্ডে তো কিছুই বুঝতে পারিনি। কয়েকদিন পর আমার বড় ভাইয়ের মাধ্যমে এই যাত্রার শুরু।ভাইটাও হলো লোভী।আর অভাবে থেকে থেকে অনেক মানুষের স্বভাব নষ্ট হয় যায়। আমার অভাবী লোভী ভাইকে লোভের জালে আটকানো খুব কঠিন কিছু ছিল না।এখন প্রতিমাসে আমার লোভী ভাই মোটা অংকের টাকা নিয়ে আমোদফুর্তি করে বৌকে নিয়ে। আমার সামনাসামনি হয় না,হয়তো আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস নেই।

তোমাকে এই সব কথা কেন বলছি কে জানে। হয়তো অনেক দিন কারো সাথে মন খুলে কথা বলতে পারি না তাই।তুমি এই সব শুনে বিরক্ত হচ্ছো না তো?
—না না।একদম না।
—যখন কোন কিছুতে বিরক্ত হবে ,সেই বিরক্তি প্রকাশ করবে।তা না হলে অনেক অপ্রিয় জিনিস হজম করতে হবে।আমাকে বিয়ে করে নিয়ে আসার পরে পম্পি বাড়ি ছাড়া।অনেক চেষ্টা করেছি ওর কাছাকাছি হওয়ার।ও আমাকে সহ্যই করতে পারেনা। কিছু মানুষের নিজের দোষ না থাকলেও সারাজীবন দোষী হয়ে থাকতে হয়।আমিও তেমন একজন।
—আস্তে আস্তে হয়তো বুঝবে পম্পি।
—হয়তো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রজনী আবার ভেতরে দেখতে গেলেন।
মানুষের সুখ কিসে সে নিজেই জানে না।এত টাকা এত বিত্তবৈভব কিছুই সুখ দিতে পারে না। আবার একবেলা খেয়ে থাকা মানুষ ভাবে টাকা থাকলেই দুনিয়াতে শুধু সুখ আর সুখ।

আজ একটা ইমপোর্টেন্ট ক্লাস ছিল। পম্পির এই অবস্থায় তো আর যাওয়া হবে না। গতকাল ও জানতো না এখানে পম্পিদের বাসায় থাকবে। কিন্তু নিয়তি বলে একটা কথা আছে। সেটা থেকে কেউ বের হয়ে আসতে পারে না, নিয়তিই টেনে নিয়ে যায়। নওমির হঠাৎ মনে হলো তাশফির ব্যপারটা নিয়তির উপর ছেড়ে দিবে।যা হবার হবে। তার নিয়তিতে কি লিখা আছে আগে থেকে চিন্তা করে লাভ কি? গত রাতে মামার সঙ্গে ও কথা হয় নি।মামার তো কখনো ভুল হয় না কল দিতে, তাহলে কি হলো।ভেতরে গিয়ে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখে অনেকগুলো মিশডকল। নওমি মামাকে তাড়াতাড়ি কল ব্যাক করলো। মামার গলায় অস্থিরতা, আতঙ্ক টের পেলো নওমি।
পম্পির কথা সব বলাতে মামা কিছুটা শান্ত হলেন।

শুভ্রতায় জরানো মহিলা বাসায় পা রাখার পর থেকেই বাসার সবাই টতস্থ হয়ে আছে।পান থেকে যেন চুন খসতে না পারে সেই দিকে সবার খেয়াল। একটু উল্টাপাল্টা হলেই কোন কথা না বলে হয়তো চলে যাবেন উনি। শাশুড়িকে খুব বেশী ভয় পান বাড়িওয়ালা তোফাজ্জলের বৌ হাজেরা। শেষবার যখন শাশুড়ি এসেছিলেন অতি সামান্য একটা ঘটনায় রাগ করে চলে যান,সেই রাগ পানি হতে সময় লেগেছে পাঁচ বছর।এই পাঁচ বছরে তোফাজ্জলের মা একবার ও এই বাসামুখী হননি।
এইবার তাই বাসার সবাই খুব সতর্ক আছে। কিন্তু কিছু একটা নিয়ে তোফাজ্জলের মা খুব চিন্তিত। কেউ জিজ্ঞেস করার ও সাহস পাচ্ছে না কি হয়েছে।যাকে বয়স কাবু করতে পারেনি কি এক চিন্তা যেন তাকে গ্রাস করে রেখেছে।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here