#৫ম_তলার_মেয়েটাপর্ব_৩২
নাম্বার ব্লক করার সঙ্গে সঙ্গেই তাশফি বুঝতে পারলো কোন সমস্যা নিশ্চয়ই হয়েছে। তার আম্মু ফিরে আসার আগেই সব কিছুর উত্তর পেয়ে গেলো সে।আম্মু নিশ্চয়ই এমন কিছু বলেছে, নওমি আর সম্পর্ক রাখতে চাইছে না। নিজের আত্মসম্মান বোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে নওমির মতো মেয়ে সুখের সাগরে ভাসতে পারে না । ওহ্ আর ভাবতে পারছে না তাশফি।
নওমিকে কল করার আগে তাশফি তার আম্মুকে কল দিয়েছিল। তাবাসসুম কল রিসিভ করেননি। পরে স্বর্ণার সাথে কথা বলে জানতে পেরেছিল, ওরা নওমির বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। এর পরেই নওমির সাথে কথা বলার জন্য অস্থির লাগছিলো।বিয়ের ব্যপার নিয়ে আলোচনা করার জন্যই কল করেছিলো সে।সে ভেবেছিল সব কিছু ঠিক ঠাক মতোই এগিয়েছে।আব্বু মন থেকে রাজি না হলেও আম্মু নিশ্চয়ই খুশি মনেই গিয়েছে নওমির সাথে কথা বলতে। অনন্ত তাই মনে হয়েছিল যাওয়ার আগে।
এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই।স্বর্ণা সব কিছু বলবে তাকে।আম্মুর কারণে কিছু গন্ডগোল হলে,তাশফি কি করবে বুঝতে পারছে না।কি এক উভয় সংকটে পড়ে গেলো সে। আব্বু-আম্মুকে কষ্ট দিতে চায় না আবার নওমিকেও কিছুতেই হারাতে পারবে না সে। প্রথমে নওমিকে শুধু পছন্দ ছিল,পরে ভালোবাসা আর এখন নিজের অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে আছে নওমি।
তাশফিকে দেখেও আম্মু কথা না বলে ভেতরে চলে গেলেন। স্বর্ণাকে জিজ্ঞেস করলেও কোন কথা বলল না, শুধু চোখ দিয়ে ইশারা করলো পরে কথা বলবে।
হসপিটাল থেকে ইমারজেন্সি কল আসলে তাবাসসুম তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।স্বর্ণার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তাশফি।
—ভাইয়া তোকে আগেই বলেছিলাম পালিয়ে বিয়ে করে ফেল।তখন হয়তো নওমি রাজি হতো।এখন আর কোন ভাবেই ও রাজি হবে না।
—আমাকে খুলে বল,ওখানে কি হয়েছিল?
—খুলে বলার মতো কিছু নেই।আম্মু এমন ভাবে কথা বলেছে যে,নওমি মানা করে দিবে এটাই স্বাভাবিক।ওর মাথায় সামান্য পরিমাণ ঘিলু হলেও আছে। কোন খারাপ ল্যাংগুয়েজ ইউজ না করলেও বলার ধরণ খুব খারাপ ছিল।আম্মু ভেবেছিল, আম্মুর প্রস্তাব শুনে নওমি খুশিতে টগবগ করতে করতে রাজি হয়ে যাবে।
—নওমি আমার নাম্বার ব্লক করে দিয়েছে।
—সেটাই তো স্বাভাবিক।ও সরাসরি আম্মুর প্রস্তাব নাকোচ করে দিয়েছে।
তাশফি কিছুই বলতে পারছে না।কষ্ট যেন গলা চেপে ধরেছে।বুকটা এতটা ভার লাগছে যে মনে হচ্ছে একটা পাথর কেউ বুকে চাপিয়ে অথৈ পানিতে ডুবিয়ে দিচ্ছে তাকে। চোখের সামনে শুধুই অন্ধকার দেখছে সে।সব রাস্তাই যেন বন্ধ হয়ে গেছে।দম বন্ধ লাগছে তার।
দ্রুত পা ফেলে ছাদে চলে গেল তাশফি ।আজ আকাশে এত মেঘ জমেছে কেন?বাতাস কি বন্ধ হয়ে গেছে?প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস টুকু নিতে পারছে না সে।
নওমির কথা শুনেই পম্পি বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে। পম্পিকে কল করে যখন আসতে বলল,পম্পির মনে হলো যেন নওমির প্রাণ নেই দেহে ও কথা বলছে যন্ত্রের মতো। সঙ্গে সঙ্গেই রওনা হয়ে গেল সে। মেয়েটার জীবনে কি আর শান্তি পাবে না?নওমিকে সে আত্মার খুব কাছের ভাবতে শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই।তাই ওর কষ্ট পাওয়া মানে নিজের কষ্ট পাওয়া। এতো ভালো একটা মেয়ের কপালে কেন শুধু দুঃখই থাকবে?
পম্পিকে দেখে নওমি কাঁদলো না একটুও।কেমন যেন ফ্যাকাশে লাগছিলো ওকে, মনে হচ্ছিল শরীরের সমস্ত রক্ত কোন ড্রাকুলা চুষে নিয়েছে। পম্পির চোখের দিকে না তাকিয়ে খুব সহজেই বলে গেলো সব কিছু।সব শুনে পম্পি একেবারে রেগে আগুন। কিভাবে তাশফির আম্মু এভাবে কথা বলতে পারল সে ভেবে পেল না। এমনিতে দেখা হলে সব সময় কত সুন্দর করে আদর করে কথা বলেন। ওই রূপের সাথে এইরূপ কিছুতেই মেলাতে পারছে না। সে বলল এই ব্যাপারে অবশ্যই তাশফিকে জানানো উচিত। নওমি যুক্তি দিয়ে বোঝালো, তার জন্য কেন আরেক জন পরিবার ছাড়া হবে? তার নিজের ভাগ্যের সাথে কিছুতেই তাশফিকে জড়াতে চায় না।পম্পি প্রশ্ন করলো,
—এইসব করলেই কি তাশফিকে ভুলে থাকতে পারবি? নিজের জীবন কাটিয়ে দিতে পারবি ভালোবাসাহীন ভাবে?
—জানিনা, কিছুই জানিনা। এখন একটা মাত্রই চিন্তা অপমানিত হয়ে ওদের ফ্যামিলিতে কিছুতেই যেতে পারবো না। তাশফির সঙ্গে বিয়ে হলে ওরা সব সময় আমাকে করুনার চোখে দেখবে। মনে হবে যেন আমি একটা ঘৃণ্য বস্তু সবাই আমার থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে চাইবে। সেই সব অপমান কোনোভাবেই সহ্য করতে পারবো না। তাই আন্টির প্রস্তাব কোনভাবে আমার পক্ষে মানা সম্ভব না।
—সবকিছুই ঠিক আছে বুঝলাম। কিন্তু তাশফি তোকে ভালবাসে। ওর নিজের মুখ থেকে শোনা উচিত সবকিছু। আন্টির মুখের কথার সাথে তার কথার মিল নাও থাকতে পারে। সিনেমা-নাটকে দেখিসনা কিভাবে মা-বাবারা ভিলেন হয়ে আসে সম্পর্কের মাঝখানে। যে কোনো উপায়ে সম্পর্ক ভেঙে দিতে চায়। সেরকম কিছুও হতে পারে।
আমি কি স্বর্ণাকে একটা কল করব?
—না। স্বর্ণাকে দেখেই বুঝেছি ও আন্টির কথা হজম করছে খুব কষ্ট করে। ও এই সবের মধ্যে হয়তো নেই। মায়ের মতামতের সমর্থন করতে পারছে না আবার সরাসরি বিরোধিতাও করতে পারছে না। ওকে দেখে খুব কষ্ট লাগছিল আমার।
—তাহলে বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা? তাশফি আর স্বর্ণা চাইছে তোদের সম্পর্কটা সুন্দরভাবে সমাধান হোক। আর আঙ্কেল আন্টি চাইছেন সম্পর্কটা ভেঙে যাক। এইজন্যই তাশফির সাথে তোর কথা বলা দরকার।
—তাশফির সাথে কথা বললে কি হবে? সে হয়তো তার বাবা-মার অমতে আমাকে বিয়ে করবে, আমার জন্য তাদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে সেটা আমি কিছুতেই হতে দিতে পারিনা।
—তোর সাথে বিয়েতে তারা মত না দিলেও কি বাবা মায়ের সাথে ছেলের সম্পর্ক আগের মত থাকবে ভেবেছিস?
—সেটা তাদের ব্যাপার তখন আমি আর মাঝখানে থাকবো না। এসব কথা বাদ দে, আমার একটা অনেক বড় উপকার করে দিতে হবে তোকে। বলতে পারিস আমাকে সাহায্য করতে হবে।
এই বলে নওমি হাত চেপে ধরলো পম্পির।
—এইসব কি করছিস নওমি। এভাবে কেন বলছিস?
—তুই আমাকে কোথাও লুকিয়ে ফেল।কেউ যেন আমাকে খুঁজে না পায়।
—এটার মানে কি? কাউকে লুকিয়ে ফেলা যায় নাকি?
—তাহলে এক কাজ কর,তোর আব্বুর কত জানাশোনা,উনাকে বলে দূরে কোথাও একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দে আমাকে।
—তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? কেন পালিয়ে যেতে চাইছিস?
—তাশফি এসে সামনে দাঁড়ালে আমি নিজেকে শক্ত রাখতে পারবো না।ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ওকে ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য আমার নেই।
ওকে বড্ড ভালোবাসি রে।
পম্পি তাকিয়ে রইল নওমির দিকে ওর হাত দুটো তার হাতের মুঠোয়।এই এক অভিজ্ঞতা পম্পির জীবনে কখনো হলো না।কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারলো না সে।তার জন্যেও তো কেউ এমন অস্থির হয়নি।তাকে সবাই টমবয় বলে এই জন্য ছেলেরা কাছেও আসেনি আর সেও এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে রেখেছিলো নিজের মনে,সেই দেয়ার ভেদ করে প্রেম ভালোবাসা প্রবেশ করতে পারেনি।এখন নওমিকে দেখে তার এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো তার জীবনেও এমন ভালোবাসা আসুক। ভালোবাসার উষ্ণতা, অভিমান,বিরহ যন্ত্রনা সব কিছু বুঝতে চায় সে।এটা এক মধুর যন্ত্রনা।নিজের অজান্তেই লাজুক এক চিলতে হাসি বেরিয়ে গেলো ঠোঁটের ফাঁক গলে।
—কি রে পম্পি হাসছিস কেন?
—তুই পালিয়ে গেলে তাশফি পাগল হয়ে পাবনা চলে যাবে।কিংবা সুইসাইড করবে।
—কি বলছিস এইসব অলক্ষুণে কথা।ওর কোন ক্ষতি হোক কখনো চাই না।
নওমির চোখ বড় বড় হয় গেলো।
—দুষ্টুমিও বুঝিস না?আসল কথা হলো তুই যেই প্রান্তেই থাকিস তাশফি তোকে খুঁজে বের করে ফেলবে।
—তাহলে আমাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দে। আমি আস্তে আস্তে পরে তোর টাকা শোধ করে দেবো।
—দেশের বাইরে কি বললেই চলে যাওয়া যায় নাকি? সেইসবের ব্যবস্থা করতে সময় লাগে।
—তাহলে আমি কি করবো বলে দে।
—তাশফি কি বলে আগে শোন।ও যদি তোকে সত্যিই ভালোবাসে তাহলে তাকে ফিরিয়ে দিস না।
যা পেয়েছিস তা হেলায় নষ্ট করিস না।
সেদিন রজনীকে ,সিরাতের সাথে কথা বলতে দেখে পম্পির বাবার মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল।
শুধু মাত্র পম্পির দিকে তাকিয়ে সেখানে কিছু বলেননি।ওরা বাসায় আসার পর ও স্বাভাবিক ছিলেন কিন্তু রাত নিস্তব্ধ হওয়ার সাথে সাথে তাঁর মধ্যে হিংস্রতা জেগে উঠেছিল।তখন রজনী কে একা পেয়ে মুখে কিছু না বললেও নিজের পুরুষত্ত্ব ভালোভাবেই দেখিয়েছিলেন। যদিও তার বয়স হয়েছে, হাঁপিয়ে ওঠেন।একদিনের ধকল সইতে হয় কয়েকদিন। রজনী এই পর্যন্তই পম্পির বাবাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। যতটা না তার বয়সে কারণে তার চাইতে বেশি তার পশুসুলভ ব্যবহারের কারণে। প্রভু-ভৃত্যের মতোই তাদের সম্পর্ক। পম্পির বাবাই নিজেকে প্রভু মনে করাতে থাকেন প্রতিটা আচরণে।জোর করে রজনীর শরীরটাকে ভোগ করার আইনত ও সামাজিক ভাবে স্বীকৃত হলেও , রজনীর শরীর,মন ঘিনঘিনিয়ে ওঠে, তার শরীরের কাছাকাছি এলেই ।বাকি রাতটুকু রজনী বারান্দায় বসেই কাটিয়েছিল। তার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা পানিও পড়েনি।এত দিনে হয়তো চোখের পানি শেষ হয়ে গেছে।
HSC পড়ার সময় সিরাত ক্লাসমেট ছিল রজনীর।
রজনী বুঝতে পারতো সিরাত তাকে পছন্দ করে কিন্তু বলতে পারছে না।সব কিছু বুঝেও না বুঝার ভান করতো সে। খুব যে এক সাথে চলাফেরা হতো,তাও না। ক্লাসের ভেতর, কোচিং এর সময় কিংবা যাওয়া-আসার পথে দেখা অতটুকুই।
রজনীর মনে কখনো সিরাতের জন্য ভালোবাসার উদয় হয়নি।এর পরে কলেজ পাশ করে জগন্নাথে ভর্তি হলো সে।সিরাতের আর কোন খবর কানে আসেনি বা জানার ইচ্ছেও হয়নি।
আর তখন তার জীবনে ভালোবাসা এলো,যাকে ছাড়া বেঁচে থাকার কথাও চিন্তা করতে পারতো না রজনী ,সেই তাকে ধোঁকা দিলো।সেই প্রতারক ফিরে এসে আবার রজনীকে স্বপ্ন দেখাতে চাইছে।এই সব আর মনে করতে চায় না রজনী।
নতুন করে আর কাউকে নিয়ে ভাবতে চায় না সে। সেটা সিরাতই হোক কিংবা সেই প্রতারকই হোক। কাউকে ভালোবাসার মতো কিংবা ঘৃণা করার মতো মন কোনটাই নেই তার। দুঃখগুলো এখন তাকে খুব বেশি গ্রাস করে না। সবাই দেখছে সে ভালো আছে এটাই ভালো।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু