#৫ম_তলার_মেয়েটাপর্ব_৬
খবরটা শুনে সুমি দুটো করে সিঁড়ি টপকে হাঁপাতে হাঁপাতে পারুদের বাসায় উপস্থিত হলো। তার ইচ্ছে করছিলো এক লাফে উঠে যেতে।
পারু রান্না ঘরে ছিলেন। তার শরীর কিছুদিন থেকে খুব খারাপ যাচ্ছে।সুমি রান্না ঘরে এসে উপস্থিত।সুমিকে দেখেই পারুর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।সেটা বুঝতে না দিয়ে লিভিং রুমে বসতে বললেন।
গলার স্বর নামিয়ে সুমি বলল-
—আন্টি খবরটা শুনে বিশ্বাসই হয়নি। আমাদের সিমি এমন একটা কাজ করতে পারে?তাই তো দৌড়ে এলাম আপনার সাথে কথা বলতে। মানুষের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই,তিলকে তাল বানায়।সিমি হয়তো কোথাও বেড়াতে গেছে, আর সবাই বলে বেড়াচ্ছে এক ছেলের সাথে নাকি ভেগে গেছে সুমি।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে সুমি তাকিয়ে রইল পারুর দিকে,পারু কি বলে শোনার জন্য।মনে মনে বলতে লাগল, এমনিতে তো মানুষের হাঁড়ির খবর নিয়ে ব্যস্ত থাকে আন্টি,আজ দেখি নিজের হাঁড়ির খবর নিজেই কিভাবে বলে।
পারুর ভেতরটা দুমড়ে যাচ্ছিলো।কি বলবেন ভাবতে লাগলেন।এত অপমানের মধ্যে ফেলে গেল মেয়েটা! ঘরের লোকের কাছ থেকে উঠতে বসতে কথা শুনতে হয়।এখন বিল্ডিংয়েও ছড়িয়ে গেল।এখন কত জনের থেকে কত অপমান সহ্য করতে হবে মুখ বুজে!
আহত হরিণের মত পারু বললেন-
আমরাও ভালো করে জানি না কোথায় গেছে,কার সাথে গেছে?
—বিয়ে করে ফেলেছে শুনলাম।
—শুধু এত টুকুই জানি।ফোনে ওর বাবাকে বলেছে।
—হায় হায় কি আফসোসের কথা।ভদ্র ফ্যামেলির মেয়ে এমন করে?কি আর করবেন আন্টি,সবই কপালের দোষ!
পারু মর্জিনাকে চুলার তরকারিটা দেখার জন্য বললেন।কথা অন্যদিকে ঘোরাতে চাইলেন কিন্তু সুমির মনযোগ একচুলও সরলো না।
—আন্টি কয়েকদিন থেকে হাঁটতে ও যাচ্ছেন না।
—শরীরটা ভালো না।
—এমন তো হওয়ার কথাই আন্টি।মা হয়ে এ সব কি সহ্য করা যায়?তবে কি আন্টি ছোটবেলা থেকেই এ সব শিক্ষা দিতে হয় সন্তানদের।ভালো সংস্কার পেলে এই সব করে না।
এই কথা শুনে পারু ভাবতে লাগলেন তাহলে কি সুমি বোঝাতে চাইছে উনি সন্তানদের শিক্ষা দিতে পারেননি,ভালো সংস্কার দিতে পারেননি।সবসময় সিমির বাবা যা বলে সেটাই কি সত্যি?তিনি একজন ব্যর্থ মা?
—সুমি তোমার ও তো মেয়ে আছে।এখন থেকেই সাবধান হয়ে যাও।ওকে কিন্তু ভালো সংস্কার দিও।বলা তো যায় না কার কপালে কি আছে!
পারু কথা বলছিলেন খুব শান্ত ভাবে কিন্তু কথাগুলোর সাথে পারুর দুঃখ ঝরে ঝরে পড়ছিলো। সুমির মনে হলো এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। আর বসতে পারলো না সে।
কিছু মানুষের কাজই হলো কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়া।এত দিন এই কাজটা করে গিয়েছেন পারু। আজ বুঝতে পারছেন অপ্রিয় কথা শুনতে কেমন লাগে।কোন মানুষকে লজ্জায় পড়তে হবে জেনেও ঠিক সেই বিষয়ে কথা শোনানো , শরীরে কাঁটা ফোটানোর মত । এই মুহূর্তে পারুর ঠিক এমন অনুভূতি হচ্ছে। তাঁর মাথাটা কেমন করতে লাগলো। তাড়াতাড়ি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন।কারো দূর্বল জায়গায় আঘাত এত জঘন্য কাজ এটার মাসুল তো কিছু পেতেই হবে।
সিমির সাথে দুলির ঝগড়া লেগে গেলো। দুজনের মনে দুইজনের প্রতি আগে থেকেই অনেক রাগ জমে ছিল।যখন দুলি দেখলো তার রাখা আইসক্রিম ফ্রিজে নেই তখন সবাইকে জিজ্ঞেস করা শুরু করলো তার আইসক্রিম কে খেয়েছে? সিমি কে জিজ্ঞেস না করলেও সে বলল,সে খেয়েছে।
এই নিয়ে দুলি রাগারাগি শুরু করলো।কেন তার আইসক্রিমে হাত দিল সিমি ? সাথে সাথে সিমিও কথা বলতে লাগলো উচ্চ স্বরে।ব্যপারটা এক সময় অনেক ঘোলা হয়ে গেলো।
সিমি পরশকে হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে গেল। সরাসরি পরশকে বলল, আলাদা বাসা নেয়ার কথা।পরশের পক্ষে কোন ভাবেই এটা সম্ভব না জেনেও যখন সিমি বার বার এই কথা বলতে লাগলো ,তখন পরশ বলল-
—আমার পক্ষে এই মুহূর্তে এটা সম্ভব না এটা তুমি ভালো করেই জান।
—তাহলে বিয়ে করলে কেন?
—আমি অনেক বুঝিয়ে ছিলাম তোমাকে পড়াশোনা শেষ হয়নি এখন কিছুতেই বিয়ে করা ঠিক হবে না,তুমি কোনভাবেই মানলে না।এখন আমাকে দোষ দিচ্ছ?
—তোমার বাবার কাছ থেকে খরচ নিবে।
পরশ কিছুক্ষণ সিমির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল-
—আমার অবাক লাগছে এই কথা তুমি বল কি করে? তাঁরা নিজেরা আমাদের বিয়ে দিয়ে এনেছেন,যে আমাদের আলাদা বাসা ভাড়া করে সম্পূর্ণ খরচ বহন করবেন? তাদের খুব ঠেকা পরে গেছে না? এমনিতেই এখন তোমার সব খরচ তো বাবাই দিচ্ছেন।
—আমি কিছুই শুনতে চাই না। আমি আলাদা সংসার চাই আমার, তোমার তাই করতে হবে।
—তোমার যে মাথায় সমস্যা আছে আগে বুঝতে পারিনি।এখন দেখছি তোমার ট্রিটমেন্ট দরকার।
—কি আমি পাগল?
রোকেয়া একটা কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। তিনি থাকলে হয়তো এই ঝগড়াই হতো না।সব কিছু শুনে রোকেয়া দুলিকে খুব বকাবকি করলেন।
—তুমি জীবনে আইসক্রিম খাও নি?একটা আইসক্রিম নিয়ে ঝগড়া করতে হয়?
—আমি স্কুল থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছিলাম।একটু গলে গিয়েছিল তাই ভেবেছি ফ্রিজে রেখে দিয়ে,একটু পরে খাবো।সে যদি বলতো, তার খুব ইচ্ছে করছিলো তাই খেয়ে ফেলেছে তাহলে রাগ করতাম না।সে বলল,’আইসক্রিমে কি নাম লিখা আছে,খেয়েছি তো কি হয়েছে?’ এই কথা শুনে আমার রাগ উঠে গেলো।
—তবুও তোমার এমন করা ঠিক হয় নি।সিমিকে সরি বলবে।
দুলি চুপ করে আছে দেখে রোকেয়া বললেন-
—সরি বললে কেউ ছোট হয়ে যায় না,বরং তার মহৎ হৃদয়ের পরিচয় মিলে।
রুমির দিকে তাকিয়ে রোকেয়া বললেন-
—তুমি কিছু বললে না দুলিকে?
—আমি দুলিকেই বকা দিচ্ছিলাম।সিমির কথা বলার ধরণ দেখে আমি রুমে চলে গেছি। আমি থাকলে আমারো রাগ উঠে যেতো, কিছু না কিছু বলে ফেলতাম সিমিকে।
এমন সময় চিৎকার শুনে পরশের রুমে গিয়ে দেখেন সিমি পাগলের মতো আচরণ করছে।মুখে যা আসছে তাই বলছে।
রোকেয়া কঠিন গলায় ধমক দিয়ে বললেন-
—একদম চুপ কর,এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।
সিমি রোকেয়ার দিকে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল।
সবার কাছে সিমিকে অপ্রকৃতিস্থ লাগছে।
রোকেয়া বললেন-
—রাতে এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। তোমার বাবার সাথে খুব তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করতে হবে।
—কেন বাবার সাথে যোগাযোগ করতে হবে ? সে কি বিয়ে করেছে?
—একদম বেয়াদবি করবে না সিমি।
—তাহলে কি করবেন?মারবেন?মারবেন আমাকে?মারেন।
রোকেয়া আর দাঁড়ালেন না।নাঈমের কথা শুনে ভেবেছিলেন , তাদের সম্পর্কটা শুধু বৌ-শাশুড়ীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বন্ধুত্বের দিকে গড়াবেন কিন্তু সেটা হয়তো সম্ভব হবে না। পরশের জন্য কষ্টেবুক ফেটে যেতে লাগল।কেন ছেলেটা এমন করলো,ওর কপালে এমন একটা মেয়ে জুটলো!
রাতে সবাইকে নিয়ে লিভিং রুমে বসলেন নাঈম।
প্রথমে সিমিকে কথা বলতে বললেন।
—আমি এখানে থাকতে চাই না।
—তোমার বাবার বাড়ি যেতে চাও?
—না। আমার আলাদা সংসার চাই।
—খরচ কে দিবে?
—আপনি দিবেন?
—যদি না দেই?
—আমি যে কোন কিছু করে ফেলবো,পরে আপনারা ফেঁসে যাবেন।
সিমির কথা শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল।নাঈম আর রোকেয়া একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে কিছুই বলতে পারলেন না।
পরশ একেবারে গর্জে উঠলো।এই সব কি বল তুমি?বাবার সাথে বেয়াদবি কর?
নাঈম চুপ করতে বললেন পরশকে।
নাঈম বলতে শুরু করলেন-
—আজ সিমি যা বলল,সেটা সবাই শুনেছ। আমরা ওর সাথে কোন খারাপ আচরণ করিনি কিন্তু সে তার ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করতে যে কোন কিছু করে আমাদের ফাঁদে ফেলতে পারে,এটাও সবাই শুনলে।
তোমাকে আলাদা বাসায় রেখে সমস্ত খরচ আমি চালাতে পারবো না।বিয়ের পর স্বামীকে কিংবা স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে খরচ বহন করতে হয়। তোমাদের তো আর আমরা বিয়ে দেইনি।তুমি কেন ক্লাসমেট বেকার ছেলেকে বিয়ে করেছ? সেটার দায়ভার কি আমরা নিব?
—পরশকে আপনারা জন্ম দিয়েছেন তো , আপনাদেরই দায়ভার।
—যদি খরচ না দেই তবে কি করবে?
—সবার নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ করবো, আপনারা আমাকে যৌতুকের জন্য অত্যাচার করেন।আর জানেন তো নারী নির্যাতনের আইন কত মারাত্মক।
এ সব শুনে রোকেয়ার শরীর কেমন করতে লাগলো,মনে হচ্ছে মাথা ঘুরিয়ে পরে যাবেন। নাঈমের হাত চেপে ধরলেন।নাঈম তাড়াতাড়ি রোকেয়া কে ধরে বেডরুমে নিয়ে শুইয়ে দিলেন। সবাই রোকেয়া কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও দুলি বসেই রইল।সে সিমির খুব কাছেই বসে আছে।সিমির মধ্যে ও কোন ভাবান্তর হলো না।
দুলি বলল-
—তোমার তো খুব বুদ্ধি। কিভাবে শিখলে এ সব বুদ্ধি?
—তোমাকে এই সব বলার কোন প্রয়োজন নাই। তবে এতই যখন জানার ইচ্ছা তাহলে বলি-আমার এক কাজিনের বিয়ের পর থেকেই শ্বশুরবাড়ির সবাই মিলে অত্যাচার শুরু করলো।উঠতে বসতে খোঁটা, স্বামীর মাইর।সে চলে গেল বাবার বাড়ি, কেইস ফাইল হলো এখন গোষ্ঠী সহ কারাগারে।
—আমরা তো তোমার সাথে তেমন কিছু করিনি বরং মা-বাবা আমাদের মতোই তোমাকে আদর করে তাহলে এই সব করবে কেন?
—একা থাকলে স্বাধীন ভাবে থাকা যাবে। তোমাদের সাথেও ঝগড়া হবে না।
—এটাকে ঝগড়া বল?বোনেরা বোনেরাও তো ঝামেলা হয় এই জন্য আলাদা বাসায় চলে যেতে হবে?
—সেটা তুমি বুঝবে না।
একটা বাঁকা হাসি হেসে সিমি রুমে চলে গেলো।
এর পর দুলি একটা তৃপ্তির হাসি দিয়ে সেও উঠে দাঁড়ালো,মনে মনে বলল-‘এত সহজ না আমাদেরকে বিপদে ফেলা।’
এই কয় দিন নওমির ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কেটেছে।দিন রাতের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না।যখন ক্ষুধা লাগছে উঠে কিছু খেয়ে আবার বিছানায়। মামার কল ছাড়া আর কারো কল রিসিভ করেনি।স্বর্ণা অনেকবার কল দিয়েছে।এখন আবার রিং হচ্ছে।
রিসিভ করতেই স্বর্ণা চেঁচিয়ে উঠলো-
—কিরে ফোন ধরিস না কেন?কত বার কল করলাম।
—ইচ্ছে করেনি।
—কি? আমার সাথে তোর কথা বলতে ইচ্ছে করে না?
—এই সব তুচ্ছ কারণে রাগ করিস না তো। এমনিতেই অনেক ঝামেলায় আছি।
এবার নরম হয়ে জিজ্ঞেস করলো স্বর্ণা-
—কি হয়েছে বলতো?
—পরে বলছি,তুই আগে বল এত জরুরি কেন?বার বার কল দিচ্ছিস?
—তুই যে বলেছিলি কোন মেয়ে তোর সাথে শেয়ারে থাকতে চাইলে তোকে যেন জানাই।
এবার শোয়া থেকে উঠে বসলো নওমি-
—পেয়েছিস?
—ঐ যে পম্পি আছে না?ও থাকতে চাইছে।
—পম্পি?কেন ওরা তো চারজন এক বাসায় থাকতো।এখন কি হলো?
—কি নাকি ঝামেলা হয়েছে।
কিছুদিন আগে হলেও কিছুতেই পম্পির সাথে রুম শেয়ার করতো না নওমি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ও থাকলে খুব ভালো হবে।একটু উত্তেজিত হয়ে নওমি বলল-
—পম্পি কবে আসতে চায়?যত তারাতাড়ি সম্ভব নিয়ে আয়।
—কি হয়েছে বল তো?পম্পির কথা শুনে তুই খুব খুশি হয়েছিস মনে হয়?
এর পর সব কিছু খুলে বলল স্বর্ণাকে।নওমি এখন বাসা থেকে বের হতেই ভয় পাচ্ছে।
সব কিছু শুনে স্বর্ণা খুব আশ্চর্য হয়ে গেল।অনেক সান্তনা দিল নওমিকে,সাহস জোগালো আর বলল-
—পম্পির সাথে যোগাযোগ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়ে আসছি।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু