#৫ম_তলার_মেয়েটাপর্ব_১১
কখনো কখনো অপূর্ব সুন্দর কিছুও অসুন্দর মনে হয়, তখন শান্ত মনে ঝড় উঠে সব কিছু চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে চায়।তেমনি এক ঝড় চলছে নওমির মনে। পম্পি কি বলে যাচ্ছে নওমির কানে সে সব কিছুই ঢুকছে না।কোন ভাবেই তাশফিকে মন থেকে সরাতে পারছে না নওমি।এটাকেই কি ভালোবাসা বলে?যখন পৃথিবীর সব যুক্তি সব বাস্তবতা নশ্বর মনে হয়।
নওমি কথা বলছে না দেখে পম্পি ধাক্কা দিলো নওমিকে।কোন প্রতিউত্তর নেই দেখে হাত দিয়ে গাল টেনে ধরলো নওমির। পম্পির হাতে ভেজা ভেজা লাগলো।
—কি রে নওমি কি হলো তোর? কাঁদছিস কেন? অন্ধকারে ভুতের মত বসে কান্না করার কি হলো?
এবার নওমি পম্পিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
পম্পি ভাবতে লাগল এত নরম একটা মেয়ে দুনিয়ায় কিভাবে যে চলবে?কি আবার হলো কে জানে। কিছু হলেই কেঁদে কেটে অস্থির!
নওমি কিছুটা শান্ত হলে পম্পি আবার জিজ্ঞেস করলো-
— কি হয়েছে বল?
—তোকে বললে আমাকে কিছু বলবি না বল,হাসি তামাশা ও করবি না বল।
—আমি সব সময় তাই করি?তবে ঠিক আছে আমাকে কিছু বলার দরকার নেই।
—রাগ করিস না।বলছি।তাশফি..
—তাশফি,কি হয়েছে তাশফি ভাইয়ার?
—কিছু না।
—আমি মনে হয় তাকে ভালোবেসে ফেলেছি।
—কি? ঠিক আছে।তবে এতে কান্নাকাটির কি আছে?
—ওদের পরিবার কখনোই আমাকে মেনে নিবে না।
—তোকে কে বলল?
—এটা তো স্বাভাবিক বিষয়।
—তো,তুই যখন এত বড় ভবিষ্যতদ্রষ্টা, সব কিছু যখন তোর ক্যালকুলেট করাই আছে ,তাহলে আর কান্নাকাটি করে কি লাভ?
এই কথা শুনে নওমি আবার কাঁদতে লাগলো।
পম্পি রাগে গজগজ করতে করতে চলে যেতে যেতে বলতে লাগল-
—এমনিতেই ছিল একটা গাঁধা এখন প্রেমে পরে হয়েছে আস্ত একটা রাম গাঁধা।
নওমি কাঁদো কাঁদো গলাতেই বলল-
—রাম গাধা বলতে কিছু আছে?
—থাকবে না কেন?তুই।আস্ত একটা মাস্টার পিস।
আগামীকাল কিন্তু ক্লাস শেষে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাবো তোকে।এখন কান্নাকাটির পর্ব শেষ করে ঘুমিয়ে পড়।
পম্পি এই কথা বলে চলে গেলেও একটু পরেই দুই মগ কফি নিয়ে হাজির হলো।
—এমনিতেও আর ঘুম আসবে না।চোখে তন্দ্রা না রেখে ঘুমকে একেবারে বিদায় করে দে। ফ্ল্যাস্কে গরম পানি করা ছিল ইনস্ট্যান্ট কফি বানিয়ে ফেললাম। বাইরে অথৈ জ্যোৎস্না, জানালার পাশে বসে দুই বন্ধু কফি খাচ্ছি মাঝ রাতে বসে বসে এই কথাটা আজ থেকে অনেক বছর পরে খুব সুন্দর স্মৃতি হিসেবে মনে রোমাঞ্চ জাগাবে ।
—ঠিক তাই।তবে এমন জ্যোৎস্নায় আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের স্মৃতিটার কথা মনে পরে যায়।ঐ স্মৃতি আমাকে তছনছও করে দেয়।এমনই জ্যোৎস্না ছিল সেই দিন।উঠানে বসে ছিলাম মায়ের সাথে।মা আমাকে জড়িয়ে রেখেছিল। আমরা সেদিন সকালে দাদার বাড়ি গিয়েছিলাম। ওখানে সবাই মাকে কি নিয়ে যেন খুব বকাবকি করলো।মা শুধু কাঁদলো,একটা কথাও বলল না। মামার বাড়ি আসতে একটু রাত হয়ে গিয়েছিল। অনেক ডাকাডাকির পর ও মামি দরজা খুলল না।মামা সেদিন বাড়ি ছিল না।আমরা সারা রাত উঠানে লম্বা ব্রেঞ্চটাতে বসে ছিলাম। প্রকৃতির সৌন্দর্য বোঝার মতো বয়সও হয়নি।কখন যে মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গিয়েছিল।সকালে পাখির কলকাকলিতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল।মা আমাকে জড়িয়ে ছিল না।মা মাটিতে পরে ছিল। ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে আছে,আসলে ঘুমিয়েই গিয়েছিল সারাজীবনের জন্য। অনেক কষ্টেও মায়ের হাসি মাখা মুখ আমি কল্পনা করতে পারি না।কারণ মাকে কোনদিন আমি হাসতেই দিখিনি।
পম্পি এসে নওমিকে জড়িয়ে ধরলো।
এত বড় ঘরে আছে সিমি এটা দেখে অসম্ভব খুশি হয়েছিলেন পারু।বাসায় এসে কয়েকজনকে ফোন করে জানিয়েছেও সিমির রাজ কপালের কথা। গিয়েছিলেন সিমুর বাসায়,প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব কিছু বলেছেন।এত ভালো কপাল এটা তারা চিন্তাই করতে পারেননি।এ যেন আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাওয়ার মতো।
কিন্তু সিমি ফোন করার পর থেকেই পারুকে দুশ্চিন্তা গ্রাস করে ফেলেছে-
—তোমরা ঠিক মতো পৌঁছেছ কি না এই জন্য ফোন করলাম।
—পৌঁছেছি।তোর শ্বশুরের গাড়ি দিয়েই পৌঁছে দিল।তুই রাজ কপাল করে এসেছিস।ওরা সবাই এত ভালো মানুষ!তুই কিন্তু কোন উল্টাপাল্টা করবি না। তোর কথা যা শুনলাম লজ্জায় মাথা কেটে গেছে আমাদের। আর যেন এই ধরনের কোন কমপ্লেইন তোর বিরুদ্ধে না শুনি। ওরা ভালো মানুষ ওদের সাথে মিলেমিশে থাকলে তরই ভালো হবে। এর মাঝে কোন উল্টাপাল্টা কিছু যদি তোর বাবা শুনতে পায় একেবারে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিবে। নিজের কপালে নিজেই লাথি দিস না।
—লেকচার বন্ধ করো মা। কথা বলতে শুরু করেছে তো বলছই। আমাকে কথা বলার সুযোগই দিচ্ছনা। তুমি তো খুব ভালো ছিলে, শ্বশুর বাড়ির লোকদের সুখের জন্য নিজের জীবনে কত কষ্ট সহ্য করেছো বিনিময়ে কি পেয়েছো?তোমাকে না দিয়েছে শান্তি না দিয়েছে সম্মান। দিন শেষে তোমাকে সেই কাঁদতেই দেখেছি। আমার এত ভালো হয়ে কাজ নেই।
—ওরা এই রকম মানুষ না। ওরা আসলেই ভদ্রলোক, ভালো মানুষ। তা না হলে কামাই করে না স্টুডেন্ট ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে হাজির হয়েছে জেনে বাবা মা ঝাঁটা দিয়ে বিদায় করে দিতো। আর তুই যে পদের মেয়ে আমি হয়তো এমন ছেলের বউকে কবেই লাথি দিয়ে বের করে দিতাম বাড়ি থেকে সেটা তো ভালো করেই জানিস। এইসব জেনে শুনে বুঝতে পেরেও কেন এমন করছিস ওদের সাথে?
—ওদের এত ভালো মানুষী আমার ভালো লাগেনা বারবার মনে হয় নিশ্চয়ই কোন প্যাঁচ আছে।
—প্যাঁচ তোর রক্তে ঢুকে গেছে ছোটবেলা থেকে গোষ্ঠীর প্যাঁচ দেখতে দেখতে নিজেই একটা প্যাঁচুকে পরিণত হয়েছিস। মা আমার এমন করিস না বোঝার চেষ্টা কর ওরা ওরা তোকে এখানে পাঠিয়ে দিলে আমাদের কিছুই করার থাকবেনা। তোর বাবার যাও একটু ছিটেফোঁটা সম্মান আছে সবটাই চলে যাবে। তোর জন্য ঝিমির ও বিয়ে দিতে পারব না।
—মা , ঝিমি কোথায় দাও তো একটু কথা বলি।
ঝিমি কে ডাকতে হলোনা,সে মায়ের কাছে বসে বসে ফোনের কথোপকথন শুনছিল। তার বোনের এত সুখের কথা শুনে কল্পনায় এক রাজপ্রাসাদে দাঁড়িয়ে আছে সিমি এমনটাই দেখছিল। আর সেসব বাস্তবে দেখার জন্য তার চোখ আনচান করছিল।
এরপর দুই বোনের টক-ঝাল-মিষ্টি অনেক ধরনের কথা হল।
পারু রুমে ঢুকে দেখেন শফিক চুপচাপ খাটে বসে আছেন, কোন কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। পারু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
—কি হয়েছে?
—শাওন কোথায়?
—রুমেই আছ।
—ডাকো তো ওকে।
এত নরম গলায় কথা শুনে পারু চমকে উঠলেন। কি ব্যাপার বুঝতে পারছেন না। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন ছেলেকে ডেকে আনতে।
—বাবা ডেকেছ আমাকে?
—সামনের শুক্রবার তোর কোন কাজ আছে?
—একটা কাজ আছে?
—শুক্রবার আবার কিসের কাজ?
তোকে নিয়ে বাড়িতে যেতে চাচ্ছি। বাড়ির জমিগুলো থেকে কোনটা বিক্রি করা যায় দেখতে হবে, সিমির বিয়ের অনুষ্ঠান করতে হলে কত টাকা খরচ হতে পারে একটা ধারণা কর তো।
শাওন ও খুব অবাক হয়ে যাচ্ছে বাবার ব্যবহারে।কোন দিন তো এমন মধুর কন্ঠে কথা বলেনি বাবা। আজ তাহলে কি হলো? মা আর ছেলের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো।
—বাবা আমি কিভাবে বলবো? এই সম্বন্ধে আমার কোনো ধারনাই নেই।
—আচ্ছা ঠিক আছে। আমি অন্য কারো সাথে আলাপ করে নেব। শুক্রবার আমি আর তুই তাহলে বাড়ি যাচ্ছি।
—বাবা আমার একটা কাজ আছে, আমি যেতে পারব না।
—কাজটা কী বলো।
—মানে,আমি টিউশনি করি। শুক্রবার পড়াতে হবে।
—তুমি টিউশনি কর?
—আমার খরচ চালানোর জন্য করতে হয়। তুমি যা দাও তাতে হয় না। শুধু আমার কেন কারো হাত খরচ চলে না।আপুর ও চলতো না, আমার কাছ থেকে মাঝেমধ্যেই কিছু নিতো। টিউশনি করছি কোন অন্যায় কাজ তো করছি না।এতে আমার পড়ার কোন ক্ষতি হয় না।
—ঠিক আছে।তবে একদিন ছাত্র না পড়ালে সমস্যা হবে না।জানিয়ে দিও শুক্রবার জরুরি কাজ আছে তুমি পড়াতে যেতে পারবে না।
—ঠিক আছে।
অনেক চেষ্টা করেও ক্যানসেল করতে পারল না বাবার সাথে যাওয়াটা। একদম ইচ্ছে করছে না বাবার সাথে যেতে কিন্তু কি আর করা যেতেই হবে।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় একজন বয়স্ক মানুষ আস্তে আস্তে উঠছেন। তাঁর সাথেই লেগে আছেন বাড়িওয়ালি। বৃদ্ধাকে হয়তো ধরতে চাইছেন হয়তো মানা করাতে ধরতে পারছেন না আবার একেবারে ছেড়েও দিতে পারছেন না।তাঁদের দেখে নওমি দাঁড়িয়ে গেলো, পম্পি পেছন থেকে বলল,
—নওমি দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? আমাদের ক্লাসের দেরি হয়ে যাবে তো।
এই কথা শুনে শুভ্র শাড়ি, শুভ্র চুল আর শুভ্র গায়ের রঙে একাকার হয়ে যাওয়া মহিলা মুখতুলে তাকালেন। তিনি যেন একটু কেঁপে উঠলেন সিঁড়ির ঐ প্রান্তে দাঁড়ানো দুই তরুণীকে দেখে। আসলে তিনি দুইজনকে দেখছেন না, তাঁর চোখ আটকে আছে একজনে।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু