#৫ম_তলার_মেয়েটাপর্ব_১৫
ঝিমি কাঁদতেই থাকলো।অনেকটা সময় নওমিকে জড়িয়ে ধরে থেকে কাঁদলো ঝিমি।নওমি ভাবলো কাঁদুক মেয়েটা, ওর মনে জমে থাকা কষ্টটাকে হালকা করুক।
অনেকটা সময় পরে কান্না থামলেও ঝিমির শরীরটা তখনও কেঁপে কেঁপে উঠছিলো।
—এবার বলো তো আমার ছোট্ট আপুটা এমন কি হয়েছে যে এভাবে কাঁদতে হবে?
—আমি আর স্কুলে যাবো না আপু।আজকেও যাইনি।
—আরে,কেন কি হয়েছে?
—আগে বল কাউকে কিছু বলবে না।
—ঠিক আছে বলবো না।
—আমাদের স্কুলে নতুন একজন টিচার এসেছে। ক্লাসে পড়া ধরার সময়,খাতা চেক করার সময় বিভিন্ন সময় মেয়েদের গায়ে হাত দেয়।আমি ভেবেছি আমার মনের ভুল এমন কিছু খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে এ সব করে না। কিন্তু গত পরশুদিন আমাকে বলল ছুটির পর তার কাছ থেকে c w খাতা নিয়ে আসতে।ক্লাসে জমা দেয়া খাতায় নাকি অনেক ভুল।আমাকে ভুল গুলো ধরিয়ে দিবে। আমি গেলাম।টিচার্স রুম খালি না হওয়া পর্যন্ত আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজের কাজ করতে লাগলো।এর পরে কাছে আসতে আসতে একেবারে কাছে, আমার বুকের কাছে চলে এলো।উঃ আপু কি জঘন্য।আমি কোন মতে দৌড়ে চলে এলাম। আমার এখনো কেমন লাগছে,মনে হচ্ছে নিজেকে শেষ করে দেই।
—আরে আরে নিজেকে শেষ করে দিবে মানে কি?তুমি তো কোন অন্যায় করনি।যে অন্যায় করেছে তার শাস্তি হবে।এই ধরনের পশুর উপযুক্ত শাস্তি পেতেই হবে।
—তুমি কি বলে দিবে সবাইকে?আমাকে কিন্তু বলেছ কাউকে কিছু বলবে না।
—শোন না বললে ঐ শয়তানের শাস্তি হবে কি করে?এই ইতরের আরো কোন খারাপ রেকর্ড আছে।আর হয়তো প্রমাণ ও আছে। ভিকটিম সমাজের লজ্জায় কথা বলে না।এতে করে এরা ছাড় পেয়ে যায়। আবার অন্যায় করে ।কোন শাস্তি হয় না তাই বেপরোয়া হয়ে যায়।আজ যদি তুমি আওয়াজ তোল,ভেবে দেখ কত কত মেয়ে বেঁচে যাবে।
—কিভাবে ? কোন প্রমাণ তো নেই।
—টিচার্স রুমে নিশ্চই সি সি ক্যামেরা আছে।
—আছে, তবে নষ্ট।
—কারো না কারো নজরে নিশ্চিই পরেছে এই ঘটনা।
—সেটা জানি না।
—আচ্ছা দেখি আন্টির সাথে কথা বলি।
—মা কিছুতেই বিশ্বাস করবে না।
—করবে, নিজের মেয়েকে বিশ্বাস করবে না?
ঝিমি এই দুইদিন নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছে। বাথরুমে বসে বসে কেঁদেছে।কাকে বলা যায় ভেবেছে।মায়ের মোবাইল নিয়ে দুই বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলেছে, শুধু মুল ঘটনা ছাড়া।তবে ঘটনার আশপাশ দিয়ে গেছে।ওদের কাছেও ভালো লাগে না ঐ স্যারের আচরণ। ওদের মত হলো ,আমেনা ম্যাডামকে অন্তত পক্ষে জানানো দরকার।উনি অনেক ভালো।এই বিষয়গুলো সম্পর্কে ম্যাডাম খোলামেলা আলোচনা মেয়েদের সাথে করেন।উনি প্রধান শিক্ষকের কাছে কথাটা তুলতে পারবেন। ঝামেলা হলো মোবাইলে কথা বলার সময় তার মা আশপাশে ঘুর ঘুর করতে থাকে।কার সাথে কথা বলছে শোনার জন্য।এই জন্য পারু যখন গোসলে ঢুকলো তখন কল করেছে।
অনেক ভেবে ঝিমি আজ নওমিকে বলল।এখন অনেকটা হালকা লাগছে।
পম্পি,রজনীকে জিজ্ঞেস করল-
—কেমন লাগছে খালামনি?
—খুব ভালো লাগছে। অনেকদিন পর রিকশায় উঠলাম।
—আর মুভি কেমন লাগলো?
—এই যে তোমার সাথে মুভি দেখতে এলাম এটাই বড় কথা, আনন্দের কথা ।মুভি কেমন ছিল সেটা কোন বিষয় না। আজকের দিনটা আমার কাছে খুব স্পেশাল হয়ে থাকবে।
—তোমার কোন বোন নেই?একটা ভাই তো আছে এতটুকু জানি।
—আছে।বড় বোন।উনি সিলেট থাকেন।বাবা-মা মরে যাবার পর আমাদের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্নই হয়ে গেছে বলা যায়।আর ভাই,সে যে এত বড় স্বার্থপর হয়ে উঠবে কোনদিন চিন্তাও করিনি। আগে কত ভালোবাসতো আমাকে।এখন আমি হয়েছি তার এটিএম কার্ড। তোমার বাবার কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে।তবে আমি ভেবেছি যেই ভাই আমাকে ফোন করে একটা খবরও নেয় না , আমার জন্য সে আর কোন টাকা পাবে না। তোমার বাবাকে মানা করে দিবো,ভাইয়াকে যেন আর একটা টাকাও না দেয়।
—বাদ দাও তো দুঃখ দুঃখ কথা।দেখ কি সুন্দর আকাশ।সেল্ফি তুলি।
—আগে বান্ধবীদের নিয়ে এভাবে ঘুরে বেড়াতাম।
—তোমার কোন মনের মানুষ ছিল না।
এই কথায় রজনী চোখ নামিয়ে চুপ করে রইলো।
—বলতে না চাইলে সমস্যা নেই।এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।
—শাহেদ ছিল। ভার্সিটি লাইফের প্রথম থেকেই দুজন দুজনকে ভালবাসতাম। এক সময় ওর বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছিল। কিছুদিন আগে দেশে এসে আমার নাম্বার জোগাড় করে যোগাযোগ করেছিল।শাহেদ বলল সব কিছু ভুলে আবার আমরা যেন এক হই।
—তাহলে তো ভালোই।
—না ভালো না।একদম ভালো না। সবচেয়ে বড় কথা সে বিপদের দিনে আমাকে একা ফেলে চলে গেছে এই রকম হিপোক্রেটের সাথে কোন ভাবেই আর সম্পর্কে জড়াবো না।আর..
—আর কি?
—তোমার বাবার সাথে একটা সম্পর্ক হয়েছে সেটা যেভাবেই হোক।হয়েছে তো।আমি তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবো না।
—আব্বু তো এমনিতেও তোমাকে বিশ্বাস করে না। তোমার জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়েছে। অত্যাচার করা যেমন অপরাধ অত্যাচার সহ্য করা আরো বড় অপরাধ।
—তোমার বাবার স্বভাবই এমন।এমনিতে তো আমার অনেক খেয়াল রাখে।কোন কিছুর অভাব রেখেছে আমার?আমি কার কাছে যাবো, কোথায় যাবো ,কোন আশায় যাবো?
—তোমাদের মতো মহিলাদের জন্য পুরুষরা এতটা সাহস পায় মেয়েদের উপর অত্যাচার করার। আমার মা মরে গিয়ে বেঁচে গেছে।ভাইয়া দেশের বাইরে গিয়ে বেঁচে গেছে।আমি কি করবো? এই সব আর সহ্য হয় না।
এমন সময় পম্পির মোবাইল বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই নওমির উত্তেজিত কণ্ঠ।
কিছুটা শুনে পম্পি বলল-
—তোর বাসায় আসছি।
রিকশা ঘুরাতে বলে রজনিকে পম্পি বলল-
—নওমির সঙ্গে একটু কথা বলে যাই।
—অনেক দেরি হয়ে যাবে, তোমার বাবা এসে বাসায় না পেলে কি যে কান্ড করবে?
—ঠিক আছে আমি আব্বুকে কল করে বলে দিচ্ছি।
—হ্যালো আব্বু।আমি রজনি খালামনিকে নিয়ে আমার এক ফ্রেন্ডের বাসায় যাচ্ছি,কোন সমস্যা আছে?
—না না মামনি আমার, কোন সমস্যা নেই।গাড়ি ছেড়ে দিও না।ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলবে।
—আমরা তো গাড়ি নিয়ে যাইনি।
—কেন?এখনই ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে তোমরা যেখানে আছ যেতে বল।
—কেন আব্বু?লাগবে না গাড়ি।
—যা বলছি শোন। ওখানে যেতে বল আসার সময় গাড়িতে আসবে। আমার খুব টেনশন হবে।
—ঠিক আছে।
—লক্ষ্মী মা আমার।
পম্পির আব্বুর খুব ভালো লাগছে,আজ কতদিন পর মেয়েটা তার সাথে কথা বলল। রজনীকে বিয়ে করে নিয়ে আসার পর থেকে আর কথা বলেনি। সেদিন কিছুই বলেনি পম্পি,ওর চোখদুটো শুধু ছল ছল করছিলো।এর পরদিন ও বাসা ছেড়ে চলে যায়।ফোনে হোক তবুও তো কথা বলল।এটা হয়তো সম্ভব হয়েছে রজনীর জন্য। রজনীর মধ্যে কোন কিছু একটা আছে যা মানুষকে খুব টানে।তা না হলে তিনি নিজেই কেন এতটা আকর্ষীত হবেন? স্ত্রীর মৃত্যুর পর যেই মানুষ ভেবেছিলেন কোন দিন আর বিয়ে করবেন না সেই মানুষ রজনীকে দেখে একেবারে পাগল হয়ে গেলেন। তখন তাঁর শুধু মনে হতো যে কোন উপায়ে হোক রজনীকে চাই ই চাই।তাই তো এত কাঠখর পুড়িয়ে তার চাইতে এত বয়সের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও রজনীকে বিয়ে করে আনলেন। ছেলে সম্পর্ক ছিন্ন করলো।মেয়েটাও দুরে সরে গিয়েছিল।এখন সব কিছু ঠিক হবে মনে হচ্ছে।এত দিন তো পম্পি রজনীকে সহ্যই করতে পারতো না।পম্পি অসুস্থ হওয়ার পর রজনী যেভাবে সেবা করেছে এটাও একটা কারণ পম্পির রাগ গলানোর ।
মোবাইল রাখতেই রজনী বলল-
—কি বলল তোমার বাবা?
—ড্রাইভারকে কল দিয়ে গাড়ি আনিয়ে নিতে বলেছে।
এই মামা দাঁড়ান চলে এসেছি।
দরজা খুলে নওমি অবাক রজনীকে দেখে।জরিয়ে ধরলো রজনীকে।কি কথা বলার ছিল ভুলে গেলো। পম্পি বলল-
—এবার বল ঘটনা কি?
ঝিমির সব ঘটনা খুলে বলল ওদের।এটাও বলল,নওমি , ঝিমির মায়ের সাথে এটা আলোচনা করার পরে, উনি কিছুতেই ঐ টিচারের বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করতে রাজি হলেন না।উল্টো ঝিমিকে বকাবকি করতে লাগলেন,কেন আমার কাছে ঝিমি বলল।উনি বললেন এই কয়দিন স্কুলে না গেলে কিছুই হবে না।
—এটা কোন সমাধান হলো, বল পম্পি?ঐ শয়তান আরেক জনকে স্বীকার বানাবে।
—এক দম ঠিক বলেছিস।এখনই চল পাশের বাসায় যাবো।উনাদের বুঝিয়ে বলতে হবে।
শফিক লিভিং রুমেই বসে ছিলেন।ওদের দেখে বুঝতে পারলেন না কেন এসেছে।পারু তাড়াতাড়ি এসে বললেন-
—ভেতরে আস। আমারা রুমে বসে কথা বলি।
পম্পি বলল-
—আপনার সঙ্গে তো নওমির কথা হয়েছেই।এখন আমারা আঙ্কেলের সাথে কথা বলতে চাই।
শফিক নড়েচড়ে বসলেন।
পারু তাড়াতাড়ি বলল-
—এই নওমির কাছে ঝিমিকে পড়তে দেওয়াই ভুল হয়েছে।
শফিক বললেন-
—তোমরা কি বলবে আমাকে কি হয়েছে?
—আঙ্কেল আপনার কোন মেয়ের সাথে কোন পুরুষ অসভ্যতা করলে আপনি সেটা হজম করে ফেলতে বলবেন?নাকি আপনার মেয়েকেই দোষারোপ করবেন?
ঝিমি আড়ালে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগলো।
—কি হয়েছে আমাকে খুলে বল।
পম্পি সব কিছু বলল।
শুনে শফিক রাগে কাঁপতে লাগলেন।পারু ভয় পেয়ে গেলেন।তিনি বললেন-
—এই জন্যই আমি তাকে জানাতে চাইনি।এখন দেখলে কেমন রেগে গেলো।এখন ঝিমিকে মেরেই ফেলবে।
শফিক রেগে বললেন-
—চুপ কর তুমি পারু। আমার মেয়ের সাথে অসভ্যতামী!ঐ জানোয়ারকে আমি শেষ করে ফেলবো।
—আঙ্কেল প্লিজ শান্ত হোন।সব কিছু করতে হবে খুব ঠান্ডা মাথায়।
—এমন একটা জানোয়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মতো একটা পবিত্র জায়গায় কিভাবে থাকে?এর শাস্তি তো পেতেই হবে।
—আঙ্কেল আমি আমার বাবাকে বলে সব কিছু ব্যবস্থা করবো। আগামীকাল আমরা সবাই যাবো ঝিমির স্কুলে।আর আরো এমন ভিকটিম পেয়ে যাবো স্কুলেই। শুধু ওদের একটু অভয় দিতে হবে।
ঝিমিদের আমেনা ম্যাডামের সাথেই প্রথমে কথা বলতে হবে।
রজনী এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। এবার বলল-
—নিজের সন্তানের উপর কোন আচ আসলে বাবা মাকে হিংস্র নেকড়ের চেয়েও হিংস্র হয়ে সন্তানকে রক্ষা করা উচিত।এই সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে অসভ্য গুলো আর দ্বিতীয় বার এই অন্যায় করতে সাহস পাবে না।
দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি হওয়া উচিত এদের।
শফিক মুখ গম্ভীর করে বসে রইলেন।নওমি খুব ভয় পাচ্ছিলো শফিক সব শুনে পারুর মতোই রিয়েক্ট করবে।উনি যে এই অন্যায় মুখ বুঁজে সহ্য করবেন না এটা বোঝাই যায়নি।মনে মনে থ্যাংস জানালো শফিক আঙ্কেলকে, গভীর শ্রদ্ধা অনুভব করলো সে শফিকের প্রতি।
ওরা চলে যাওয়ার সময় শফিক বলল-
—নওমি মা আমার কাছে এসে একটু বস তো।
নওমি বসলো।
— আমাকে ক্ষমা করে দিও মা।
নওমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল শফিকের দিকে।
—রশিদ যে তোমার দরজায় নক করতো,আমি টের পেয়েও কিছু বলিনি।আমি দরজা খুলে বের হলেই ও আর এই সাহস পেতো না।তোমার প্রতি অন্যায় হতে দেখেও চুপ ছিলাম, তোমার পাশে দাঁড়াইনি।
এখন দেখ, প্রকৃতির কি বিচার আমার কর্ম আমার কাছেই ফেরত এলো।
—আঙ্কেল যা হবার হয়ে গেছে।ঝিমির ঘটনায় আপনি নিজেকে দায়ী ভাববেন না। এই সব নিপীড়নের কি যে যন্ত্রনা আমি টের পেয়েছি। সহ্য করা যায় না।নিজেকেই শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে।ঝিমি ছোট মানুষ, ওর এখন মানুষিক সাপোর্ট খুব দরকার।সবাইকে এখন ওর পাশে থাকতে হবে।
—তোমরা চিন্তা করো না।
শফিক ঝিমিকে ডাকলেন-
—আমার কাছে এসে বস মা।যা হয়েছে , তাতে তোমার কোন দোষ নেই।ঐ রাসকেলকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়েই ছাড়বো।তুমি একদম এই সব নিয়ে ভেবো না।মন দিয়ে শুধু পড়াশোনা কর।ঠিক আছে।
ঝিমি কেঁদে কেঁদে বাবার বুকে লুটিয়ে পড়ল ঝিমির এখন আর একটুও ভয় লাগছে না।ওর বাবা ওর পাশে আছে। তার বাবা এত ভালো, আগে কখনো বুঝতে পারেনি।মনে মনে বাবাকে বলল,’বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসি।’
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু