#৫ম_তলার_মেয়েটাপর্ব_২৫
নওমির মামা হোসেনের ঢাকায় পৌঁছাতে প্রায় দুপুর হয়ে গেলো। রাস্তায় বাসের চাকা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।সেটা ঠিক করতে সময় লেগেছে অনেকক্ষণ।এর মাঝে নওমিকে কয়েকবার কল করেও কথা বলতে পারেননি। নওমির মোবাইল বন্ধ।এর পরে গাজীপুর থেকে শুরু হলো আরেক ,যন্ত্রণা,যেমন রাস্তা খারাপ তেমনি জ্যাম। হালুয়াঘাট টু ঢাকা ‘রূপসী’ নামের বাসে উঠেছেন। হোসেনের খুব বেশি ঢাকায় আসা যাওয়া হয় না।যতবার এসেছেন ততবার রাস্তার এই বেহাল দশা। জীবনেও কি এই রাস্তা ঠিক হবে না?দুনিয়ার জ্যামের মধ্যে বসে থেকে থেকে কোমড় ধরে যায়।
নওমি সবসময় বলে,যখন সে বড় চাকরি করবে তখন ঢাকায় বড় বাসা নিয়ে তাঁদের সবাইকে ঢাকায় নিয়ে আসবে। হোসেন শুনে হাসেন কিছু বলেন না। হোসেনের মতে,ঢাকায় মানুষ থাকে কিভাবে?
কয়েকদিনেই তাঁর তো দম বন্ধ হয়ে যাবে।
হোসেনের মনটা সারা রাস্তাতায় নওমির চিন্তা করতে করতে ভারী হয়ে ছিল।
অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কানোর পরে যখন নওমি দরজা খুলল,নওমিকে দেখে তিনি চমকে উঠলেন।এই কি চেহারা হয়েছে মেয়ের!অন্য সময় হোসেনকে দেখেই জড়িয়ে ধরে নওমি কিন্তু আজ দরজা খুলে দিয়ে একবার শুধু হোসেনের দিকে তাকিয়ে অলস ভঙ্গিতে ভেতরে চলে গেল।
তিনি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে রাস্তার কাহিনী বলতে লাগলেন।একা একাই কথা বলতে লাগলেন।ফ্রেশ হয়ে নওমির পাশে গিয়ে বসলেন। অন্য পাশে মুখ করে শুয়ে আছে সে। হোসেন বললেন-
—কিছু খাইতে দিবি না?যে ক্ষিদা লাগছে।তোর মামি তো উঠলোই না। বিস্কুট খাইয়া রওনা দিসি। তোর মামি তো কোন দিন আমার খেয়াল রাখলো না।আরে তোরে তো বলা হয় নাই ,কালা ছাগলটা চারটা বাচ্চা দিতে।কি ফুটফুইট্টা বাচ্চা।তোর ভাইবোনেরা তো সারাদিন ঐ বাচ্চা কোলে নিয়ে বইসা থাকে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই হোসেন এইসব বলছেন কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না।নওমি কথা না বলে পাউরুটি আর কলা এনে সামনে দিলো হোসেনের। হোসেন বুঝতে পারলেন আঘাতটা একেবারে বুকের গভীরে লেগেছে।সেটাই তো স্বাভাবিক।নিরা যখন তাকে বলেছিল সেটা হজম করতে অনেক সময় লেগেছিল। হোসেন প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি।নিরার দিকে তাকালেই ঐ কথা মনে পরে যেতো।আর বেশি দিন নিরার চেহারা দেখতেও হয়নি নিঃশব্দেই মরে গেলো নিরা, তাঁর আদরের বোন।নওমির প্রতি এমন মনোভাব কখনো ভুলেও আসেনি হোসেনের।যে স্নেহ ভালোবাসা মায়া-মমতা দিয়ে নওমিকে বড় করে তুলেছেন, সেই সবের নিচে চাপা পরে গিয়েছে ওর জন্ম পরিচয়।
মেয়েটা মনে হয় খাওয়া দাওয়াও বন্ধ করে রেখেছে।
হোসেন, নওমির মাথায় হাত রেখে বললেন-
—মা আমার সাথে কথা বলবি না?
—আমার নিজের উপরেই ঘেন্না লাগছে।কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
—এই সব বলিছ না।
—তো কি বলবো? খুব খুশি হয়ে বলবো আমি একটা অবৈধ সন্তান। আমি একটা অবৈধ গভীর প্রণয়ের ফসল।
—এইটা একটা দুর্ঘটনা।
—তো আমি দুর্ঘটনায় জন্ম নেয়া একটা আস্ত দুর্ঘটনা।
নওমির বুকের আগুন চোখ দিয়ে যেন ছিটকে বের হচ্ছে।
—তুই একটু শান্ত হইয়া বস আমি সব কিছু তোরে খুইলা কইতেছি।
—তুমি প্রথম থেকেই সব কিছু জানতে?
—না।তোর মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন আগে আমারে সব বলছে।নিরা হয়তো বুঝতে পারছিলো সে খুব তাড়াতাড়ি মইরা যাইবো।
এর পর হোসেন সব কিছু বললেন। শুধু নওমির জন্মদাতার নাম ছাড়া।নওমি ব্যঙ্গাত্মক ভাবে বলল-
—তুমি তোমার বোনের পক্ষ নিয়ে কথা বলছ?
—আমি কারো পক্ষ নিয়া কথা বলতেছি না।যা কিছু আমি নিরার কাছ থাইকা শুনছি তাই বললাম,একটু বেশিও না একটু কমও না।তুই আমারে বিশ্বাস করছ না?
হোসেনের শেষের কথাটায় খুব অভিমান মেশানো ছিল।
—লোকটার নাম তো বললে না?
হোসেন চুপ করে রইলেন।
—আমি নিশ্চয়ই তাকে চিনি? সেই লোক নয় তো যে এত দয়ালু আমার পড়াশোনার খরচ সে দিচ্ছে? আর এই ঘটনা হাজেরা আন্টির ভাই কিভাবে জানে?দাদুর কথাতেও বুঝেছি, হাজেরা আন্টি সে দিন যেভাবে কথা বলল,কেন?আমি সব কিছুর উত্তর জানতে চাই।সব কিছু বল মামা।
নওমির তপ্ত কণ্ঠে হোসেন ভেতর থেকে কেঁপে উঠলেন।
—তোফাজ্জল হোসেন তোর বাবা।
কথাটা শুনে নওমির মাথাটা ঘুরে গেল। এত কিছু ভাবলেও একবারের জন্যও মনে হয়নি তোফাজ্জল হোসেন তার বাবা হতে পারে।
এবারে সব কিছু যেন মিলে গেল।
—নওমি মা তোর কোন দোষ নাই। একটা মানব শিশুর জন্ম হওয়াতে তার নিজের কি দোষ থাকতে পারে?
—তুমি সেটা বললে কি হবে। এই সমাজ আমাকে একটা আলাদা নাম দেবে। আলাদা চোখে দেখবে। যারা জন্ম দিলো তাদের কিছুই হবে না এই কলঙ্ক আমাকেই বয়ে বেড়াতে হবে সারা জীবন। আমার নামের পাশে একটা বিশেষ শব্দ যোগ হয়ে যাবে। উহ্ মামা আর ভাবতে পারছি না।
আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাব।
—মা আমার এমন করিস না। শান্ত হো।
নওমির হঠাৎ তাশফির কথা মনে হলো-
—তাশফিও আমাকে আর পছন্দ করবে না। ওর মা-বাবা আমাকে ঘৃণা করবে । পম্পি, স্বর্ণা ওরা কেউ আমার সঙ্গে মিশবে না কথা বলবেনা।
এই কথাগুলো বলতে বলতে এবার নওমি ডুকরে কেঁদে উঠল। বিছানায় আছড়ে পড়ল সে। হোসেন নওমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন,তাঁর নিজের চোখেও পানি আছড়ে পড়তে লাগলো। অনেকটা সময় এভাবে কেটে গেলো।
নওমি এবার উঠে বলল-
—আমি দাদুর কাছে যাবো।তাকে কিছু জিজ্ঞেস করবো।
চোখে মুখে পানি দিয়ে নওমি বেরিয়ে গেলো।
জালেরা বেগম নওমি কে দেখেই বুঝতে পারলেন ঝড়ে বিধ্বস্ত একটা প্রাণ তাঁর সামনে বসে আছে।
—তুমি কি সব কিছু জানতে পারছ?
—জ্বী দাদু। সবাই সব কিছু জানতো শুধু আমি জানতাম না।
—কি ভাবে জানতে পারলা?
নওমি সব কিছু খুলে বলল। মোবাইলের মেসেজ থেকে শুরু করে আজকে ওর মামার মুখে শোনা সব ঘটনা। গাড়িতে হাজেরার বলা কথা হাজেরার ভাইয়ের ধমকি সব কিছু বলল, কোন কিছু বাদ দিলো না।
—আমি এইটাই ভয় পাইছিলাম। হাজেরার ভাই হাফিজ যখন জানতে পারছে এখন কোনো না কোনোভাবে তোমার ক্ষতি করতে চাইবো সে। খুব ভালো কইরা চিনি ওরে।ফোনে সেই তোমারে জানাইছে এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
—দাদু এখন আমি কি করব? সবাই আমাকে ঘৃণা করবে।
—তুমি কিছুই করবা না।যা করার এখন আমিই করমু।আর তোমারে কেন ঘৃণা করবো? অবশ্য মানুষের খাইয়া দাইয়া কাজ নাই হুদাই মাইনষের পিছনে লাইগা থাকে। ঐসবে কান দিবা না। আমিও প্রথমে অনেক কিছুই ভাবছিলাম। তোমারে প্রথম দিন সিঁড়িতে দেইখা আমি চমকাইয়া গেছিলাম। এরপর তোমার সাথে কথা বইলা দেখি যার সাথে তোমার এমন মিল শুধু চেহারাতেই না আচার-আচরণ কথাবার্তা সব কিছুতেই মিল।উনারে আমি গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতাম। এখনও করি। উনি তেমন মানুষই ছিলেন শ্রদ্ধা পাওনের মত।
—কে উনি?
—আমার শাশুড়ি। তোফাজ্জলের দাদু।
এই কথা শুনে নওমি খুব অবাক হয়ে গেলো। এমন হয় নাকি?
—কিন্তু আমাকে আপনাদের পরিবারের অন্য কেউ দেখে চিনতে পারেনি কেন?
—তোফাজ্জল আমার সবচাইতে বড় সন্তান।ও ছোট থাকতেই আমার শাশুড়ি মারা যান। উনার তো কোন ছবি নাই চিনবো কেমনে সবাই?উনি অসম্ভব সুন্দরী মহিলা ছিলেন।গায়ের রং অসম্ভব ফর্সা ছিলো, চুল ছিল লালচে, কোমরের নিচে। মেম সাহেবের মতো লাগতো দেখতে।
—আমি তো এমন না।
—উনি তো ঘর থাইকা বেশি বাইর হইতেন না তাই উনি বেশি ফর্সা ছিলেন আর তুমি তো চুল কাইটা রাখ।আর সব কিছুতে মিল আছে।
—উনি মারা গেলেন কিভাবে?
—সাপের কামড়ে।আগে তো আর ঘরের ভিতরে বাথরুম ছিলো না,আলাদা কইরা দুরে থাকতো বাথরুম।উনি ফজরের আগে বাথরুম করতে গেছিলেন। অন্ধকারে সাপ দেখেন নাই।সাপের উপরে পারা দিতেই কামড় দিলো।উঝা,কবিরাজ কেউ কিছু করতে পারলো না।উনার সাদা শরীর কেমুন জানি নীল নীল হইয়া গেছিলো।
নওমির মনে হচ্ছে সে যেন দেখতে পাচ্ছে ঐ ঘটনা।তার মনে হচ্ছে সেও সাপের বিষের যন্ত্রনায় ছটফট করছে ,বিষে নীল হয়ে গেছে মন।দাদুকে কিছু না বলে সে উঠে গেলো। বাসায় গেল। এর মধ্যে মামা বের হয়ে খাবার কিনে নিয়ে এসেছে। নওমিকে বসিয়ে তেহারি দিলেন প্লেটে।নিজেও নিলেন।নওমি শান্ত মেয়ের মতো খাওয়া শেষ করলো। এর পরে বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। খাওয়া পেটে পড়তেই ক্লান্ত শরীর বিছানায় পড়তেই ঘুমে তলিয়ে গেলো। পৃথিবীতে না খেয়ে তো আর বাঁচা যায় না। বাঁচলেও আর কয় দিন বাঁচা যায়?
নওমির ঘুম ভাঙ্গলো রাত একটার দিকে।এখন সে আগের মতো আর বিস্ফোরিত অবস্থায় নেই, আগ্নেয়গিরি যেন কিছুটা দমে এসেছে। সামনের স্পেসে এসে দেখে তার মামা ডিভানে ঘুমাচ্ছে। এর আগে মামাকে কখনো নিচে ঘুমাতে দেয়নি।জোর করে বেড রুমের খাটে ঘুমাতে বলেছে। সে নিজে ডিভানে ঘুমিয়েছে। তার মামারই বা দোষ কি? সে আর কি করবে?মামা লাইটটাও অফ করেনি। মামার হয়তো ঠাণ্ডা লাগছে, হাত পা গুটিয়ে শুয়ে আছে।নওমি ফ্যান কমিয়ে দিয়ে একটা কাঁথা মামার গায়ে সাবধানে জড়িয়ে দিল যেন মামার ঘুম না ভাঙ্গে।মামার দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো মামা তাকে বাবার আদর দিয়ে বড় করেছে।
বাবারা কেমন আদর করে নওমি জানে না তবে তার মনে হয় বাবার আদর যদি সে পেতোই, সেই কপাল যদি তার থাকতোই সেই আদরও মামার আদরের চেয়ে বেশি হতো না।মামা তার সব কিছু।
মামাকে আর কষ্ট দিবে না সে।
মামা এখানে বসে থাকলে বাড়িতে দোকান বন্ধ থাকবে আর দোকান বন্ধ থাকা মানে আয় বন্ধ। মামাকে কালকেই চলে যেতে বলবে নওমি।এর জন্য তাকে নর্মাল থাকতে হবে। ঠিক যেন মুখোশ পড়ার মতো। মুখোশের আড়ালে যেমন সত্যিকারের চেহারা দেখা যায় সেই রকম।
নিজের কষ্টের জন্য অন্যকে কেন কষ্ট দিবে?এই কষ্ট একান্ত তার নিজের। সারাজীবন তাকেই বয়ে বেড়াতে হবে। অবশ্য বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা যদি বেঁচে থাকে। মানুষের মনে যতটা কষ্ট লাগলে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা নষ্ট হয়ে যায়,এই সুন্দর পৃথিবীর সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে অজানার পথে পা বাড়ায় নওমির মনে ঠিক ততটাই কষ্ট লেগেছে।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু