#৫ম_তলার_মেয়েটাপর্ব_২৬

0
464

#৫ম_তলার_মেয়েটাপর্ব_২৬

দরজার বাইরে কারা অপেক্ষা করছে,বার বার দরজায় নক করছে নওমি তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে। ওদের কথাবার্তা সব শুনতে পাচ্ছে ভেতর থেকে তবুও নওমি চুপ করে রইলো। দরজা খুলল না। নওমি কিছুতেই দরজা খুলতে চাচ্ছে না।
পম্পি প্রায় চিৎকার করে বলল-
—খুব ভালো করে জানি তুই ভেতরে আছিস নওমি।দারোয়ানের কাছ থেকে খবর নিয়েই এসেছি।আমাকে বাধ্য করিস না দরজায় লাথি মারতে। শব্দ শুনে বিল্ডিয়ের সবাই জড়ো হয়ে যাবে তখন।ভালোয় ভালোয় বলছি দরজা খোল।

পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বের হলেন পারু।অবাক হয়ে বললেন,
—কি হয়েছে?
—কিছু না আন্টি।ভেতরে বসে থেকে নওমি দরজা খুলছে না।
—আমি তো গতকাল নক করেছিলাম।দরজা খুলেনি,ভেতরে কোন সাড়াশব্দ নেই দেখে ভাবলাম নওমি হয়তো বাসায় নেই।
—ও বাসাতেই আছে,আমি খবর নিয়েছি। দারোয়ান বলেছে নওমিকে বের হতে দেখেনি আজ।
—ও আল্লাহ কিছু হয়ে যায়নি তো?
—আমরাও খুব টেনশন করছি,স্বর্ণা বলল।

আর তখনই নওমি দরজা খুলল।নওমিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো পম্পি।স্বর্ণা পেছনে পেছনে ঢুকলো। পারু, নওমিকে দেখে বললেন-
—আরে! কি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার, অসুস্থ মনে হচ্ছে।
কপালে হাত দিয়ে বললেন,
—আরে নওমির তো গায়ে জ্বর।আমাকে কেন জানাও নি মা।যেতে পারনি, একটা কল দিতে। নিশ্চয়ই রান্নাও করতে পারছ না,খেতে পারছ না।
পম্পিদের বললেন-
—তোমরা ওর খেয়াল রাখো।আমি একটু স্যুপ করে আনি। কিছু খাইয়ে ঔষধ খাওয়াতে হবে।
আমি এখনি আসছি।

পারু চলে যেতেই পম্পি হাত উপরে তুলে বলল-
—চড় দিয়ে মাথার ভুত ছাড়িয়ে দিবো।কি হয়েছে মোবাইল বন্ধ,ক্লাস বন্ধ,মরে যেতে চাস? অসুস্থ হয়েছিস এই কথাটা জানাবি না? আস্ত হারামি একটা।
স্বর্ণা বলল-
—পম্পি থাম তো। এমনিতেই ও অসুস্থ।নওমি তুই শুয়ে থাক।তোর মাথায় পানি দিয়ে দেই। থার্মোমিটার আছে? জ্বর মাপা দরকার।
নওমি কঠিন গলায় বলল-
—তোরা এখনই চলে যা। আমার সেবা যত্নের দরকার নেই।
—ফাজলামো করিস আমাদের সাথে?এই পম্পির সাথে ফাজলামি?পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলবো।

এইবার নওমি দুইপা ছড়িয়ে সেখানেই বসে পড়লো।বিরবির করে বলতে লাগল,
—সব কিছু জানতে পারলে তোরা আর আমার সাথে মিশবি না। আমি আমি আমি একটা..
নওমি কথা শেষ করলো না, কান্নায় ভেঙে পড়ল। স্বর্ণায় বসে পড়লো ওর পাশে।
—কি হয়েছে বল আমাদের।কি হয়েছে তোর?
পম্পি বসে একটানে বুকে জড়িয়ে নিলো নওমিকে আর বলতে লাগলো-
—কিচ্ছু হয়নি লক্ষী আমার ,শান্ত হো ,এমন করে না।
পম্পি,স্বর্ণা দুজনেই কাঁদতে লাগলো নওমির সঙ্গে।আসলে এমন হৃদয় ফাটানো কান্না দেখে পাথরের চোখ থেকেও পানি ঝরবে।আর নওমি তো ওদের প্রিয় বন্ধু।
এমন সময় পারু নক করলো।
ওদের এই অবস্থা দেখে ধমক দিলেন।নওমি না হয় অসুস্থ ,ওর সাথে তোমরাও কেঁদে কেটে অস্থির?
তিনজনে নওমিকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো।
পারু থার্মোমিটার,ঔষধ, খাবার নিয়ে এসেছেন। জ্বর মাপলেন। একশো দুই ডিগ্রী।সবার আগে স্যুপ খাইয়ে নাপা ট্যাবলেট খাওয়ালেন।খাওয়াতে খাওয়াতে বললেন-
—ইনস্ট্যান্ট খাবারগুলো তাড়াতাড়ির সময় খুব কাজে দেয়।

মাথায় পানি ঢেলে হাত,পা,মুখ মুছে দিলেন।
এবার ওদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
—তোমরা দুপুরে কিছু খেয়েছ?
স্বর্ণা বলল-
—খাওয়ার কথা ভুলে গেছি।
—আমিও তাই ভেবেছিলাম।ভাত বসিয়ে দিয়ে এসেছি এখনই হয়ে যাবে।হলেই আমি নিয়ে আসছি।আর শোন ওর সামনে এভাবে কান্নাকাটি করো না। অসুখ কি মানুষের হয়না? চিন্তা করো না সুস্থ হয়ে যাবে।

নওমির মামা হোসেন যেতে চাননি। নাওমি বুঝিয়েছে সে স্বাভাবিক আছে, তাকে নিয়ে যেন কোনো দুশ্চিন্তা না করে। কিন্তু মামা যাওয়ার পরেই নওমি নিজের বাসাটার মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ করে ফেললো। দুইদিন কারো সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ নেই। তাশফি প্রতিদিন কথা বলে। মোবাইলে না পেয়ে স্বর্ণাকে জিজ্ঞেস করলো নওমির কথা। স্বর্ণা কিছুই জানেনা, কেন নওমি ক্লাসে আসছেনা সেটাও জানেনা। এই কথা শুনে তাশফি স্বর্ণাকে বলে যে,এই তোদের বন্ধুত্ব? দুইদিন ‘মেয়েটার কোন খবর নেই আর তারা জানেই না কি হয়েছে।’
তাশফির কোন কিছুতেই শান্তি লাগছিলো না। নওমির বাসা সে চিনে না।এ ছাড়া ওর খোঁজ নেয়ার আর কোন উপায়ই নেই।
স্বর্ণা দুষ্টুমি করে বলেছিল,’যার বেশি দরকার সেই খোঁজ নিক।’
কিন্তু ভেতরে ভেতরে আসলেই চিন্তা লাগছিলো। সে পম্পিকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলো। পম্পি বলল’ সরাসরি গিয়ে দেখি কি হয়েছে ওর।’

বাড়ী যাওয়ার পর থেকেই হোসেনের মনে হচ্ছে, নওমিকে একা ফেলে তার যাওয়া একদমই উচিত হয়নি। বাড়ী যাওয়ার পর থেকে নওমি কে কল করে আর পাননি। তোফাজ্জলের নাম্বারে কল করেও তাকে পাননি। দারোয়ানের নাম্বার ছিল তাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলে,সে বলে ,যে নওমি ভালোই আছে,আজকেও বাইরে থেকে ফিরতে দেখেছে নওমিকে। দারোয়ান কাকে না কাকে দেখে নওমি ভেবেছে কে জানে।
এটা শুনে হোসেন ভাবলেন, সবকিছু ঠিক আছে হয়তো নওমি হততো ক্লাস করছে । কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না দেখেই হয়তো মোবাইলটা বন্ধ করে রেখেছে।

হোসেনের মনে পড়লো নওমির বান্ধবী পম্পি আর স্বর্ণার নাম্বার আছে তার কাছে। স্বর্ণাকে কল করলে ধরলো না। এরপর কল দিলেন পম্পিকে।
পম্পি ,হোসেনকে নওমির অবস্থা সম্পর্কে সব কিছু বলল। হোসেন চিন্তায় পড়ে গেলেন। কেন তিনি নওমিকে সাথে করে নিয়ে গেলেন না আফসোস হতে লাগল। নওমি বাড়ি যেতে চায় না ওর মামির জন্য। সরাসরি কিছু না বললেও, কিভাবে নওমির মনের ভেতরে কষ্ট আরো বাড়িয়ে দেয়া যায় সেই কাজ গুলো সফলতার সাথে করতে পারে তার মামি।পুরো এক বছর থেকে নওমি বাড়ী যায় না।দুইটা ঈদ একা একা নিরানন্দ ভাবে কেটেছে। সেমাই বানিয়ে খেয়েছে। যাতে ঈদ মনে হয় অন্তত নিজের কাছে।কোন বান্ধবীদের বাসাতেও যায়নি। ওরা বারবার বললেও যায়নি। কারণ ওরা ওদের পরিবার নিয়ে আনন্দ করছে আর ওতো ওদের কেউ হয়না তাহলে কেন যাবে ওদের আনন্দের মধ্যে। দুইবারই স্বর্ণা বিকেলে এসে টিফিন ক্যারিয়ার ভরে খাবার দিয়ে গেছে। আর জোর করে ওকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছে।

ওদেরকে হোসেন অনুরোধ করলেন নওমির খেয়াল রাখার জন্য।এই অনুরোধের আসলে দরকার ছিল না।ওরা এমনিতেই নওমির দেখাশোনা করতো।

পারু ওদের জন্য খাবার নিয়ে এলেন।নওমির ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো।এখন অনেকটা ভালো লাগছে শরীর, কিন্তু মনের একই অবস্থা।পারু , নওমির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন-
—আমাকে এত পর কেন ভাবো? আমি তোমার মায়ের মত। আমিতো তোমাকে আমার মেয়ের মতই ভাবি। আমার দুইটা মেয়ে না,ঝিমি গেছে ওর খালার বাড়ীতে।ও থাকলে তোমার খবর আরো আগেই পেয়ে যেতাম। আমিও যে কেন ভালোভাবে খবর নিলাম না? এখন থেকে এমন ভুল আর হবে না। আর তুমি যতদিন পর্যন্ত সুস্থ না হবে , তোমার রান্না করতে হবে না। এখন আমি যাই একটু পরে আবার আসবো।

পারু চলে যেতেই স্বর্ণা বলল –
—ভাইয়া অনেকক্ষণ থেকে কল দিচ্ছে। মোবাইল কিভাবে যেন সাইলেন্ট হয়ে গেছে একদম টের পাইনি।নওমি তোর চিন্তায় আমার ভাইটা মরেই যাচ্ছে।এই পম্পি জানিস—নওমি আর ভাইয়ার সেটিং হয়ে গেছে।আমাদের কিছুই বলেনি।দেখলি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখাও করে।
—তাই নাকি?
—হু
তাশফি আবার কল করলে স্বর্ণা এবার রিসিভ করে নওমির অসুস্থতার খবর জানালো তাকে। নওমির সঙ্গে কথা বলতে চাইলে-সে তাশফির কথাটা রিপিট করলো-
‘নওমির সাথে কথা বলতে চাস ভাইয়া?’
নওমির দিকে তাকাতেই নওমি বলল-
—আমি এখন কারো সাথে কথা বলবো না।

এই কথা তাশফিকে বলার পর তাশফি ভাবলো নওমি হয়তো ওদের সামনে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে। তবে নওমির খবর জেনে তাশফির নিজেরই যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো,এখন খুব রিলাক্স ফিল হচ্ছে।

স্বর্ণা দুষ্টুমি করতে লাগল এই নিয়ে।
এবার নওমি রেগে গেলো-
—আমার কিছুই নেই তোর ভাইয়ার সাথে। তোদের সাথেও আমি কোন সম্পর্ক রাখবো না। আমি কারো সাথে সম্পর্ক রাখার যোগ্য না।
পম্পি আর স্বর্ণা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।ওরা দুজন দুই পাশে বসলো নওমির।
স্বর্ণা বলল-
—সত্যি করে বলতো তোর কি হয়েছে? নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। কিছু না হলে তুই আমাদের সঙ্গে এমন করতি না।
—আসলেই জানতে চাস আমার কি হয়েছে? ঠিক আছে জেনে নে, এরপর তো আর আমার সঙ্গে তোরা মিশতে চাইবি না। আমি একটা অবৈধ সন্তান। সমাজে আমার কোন স্বীকৃতি নেই। এই কথা জানার পর থেকে আমি নিতে পারছিনা। একদম সহ্য করতে পারছি না।আমার মাকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করি। আর এই যে বাড়িতে আছি আমি এ বাড়ির মালিক আমার জন্মদাতা। এই লোকই আমার সব খরচ দেয়। এতদিন মনে করতাম কত উদার মনের মহৎপ্রাণ মানুষ, আমার মত এতিমকে সাহায্য করছে!এই উদার মানুষটা কে জানতে পারলে তাঁকে সালাম করবো। আর দেখ, কেন সাহায্য করছে আমাকে? আসল কথা হলো নিজের পাপকে ঢাকতেই এমন করছে সে। এই লোকের টাকায় আমি আর কিছুই করবো না।আর বাঁচতে চাই না আমি।
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল নওমি।

পম্পি আর স্বর্ণা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলো। ওরা কখনো স্বপ্নেও এই কথা চিন্তা করে নি।

নওমি আবার বলল-
—তোর ভাইয়াকে গিয়ে এই খবরটা জানাস। তখন দেখবো এই ভালোবাসা কোথায় থাকে। আমার জন্ম পরিচয়টাই সবকিছুতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। এ জীবন আমি আর রাখতে চাই না। ছি ছি আমি এই মুখ আর কিভাবে দেখাবো মানুষকে?

ওরা যে কি বলবে বুঝতে পারছে না।তবে পম্পিকে এমনটা না হলেও অনেকটা এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই যেতে হয়েছে যখন তার বাবা রজনীকে বিয়ে করে নিয়ে আসে।কিছুতেই সে এটা মানতে পারছিলো না। নিজের মায়ের জায়গাটায় অন্য কাউকে কিছুতেই দেখতে পারছিলো না।এই জন্য নিজের বাড়ী পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলো।বাবার সাথে কথা বলা বন্ধ করেছিলো। কত রাত কেঁদে কেঁদে ভাসিয়েছে।তাই পম্পি জানে কষ্ট আসলে কাকে বলে।একেক মানুষের কষ্ট একেক কারণে হলেও, কষ্টের রং কিন্তু একই।

পম্পি বলল-
—তাহলে এখন তুই বাঁচতে চাস না?কিভাবে মরতে চাস মারার চিন্তা করছিস?

নওমি অবাক হয় তাকায়।স্বার্ণাও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পম্পির দিকে।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here