#৫ম_তলার_মেয়েটাপর্ব_২৯

0
495

#৫ম_তলার_মেয়েটাপর্ব_২৯

সিমির ফুটফুটে একটা মেয়ে হলো।সমস্ত প্রাণীর বাচ্চাই ফুটফুটে, তুলতুলে আর নিষ্পাপ হয়ে পৃথিবীতে তাদের আগমন ঘটায়।
পরিবারের সবার অপেক্ষার সেই দিন আজ,যেই অপেক্ষার অবসান হয়ে, আনন্দে সবার মন ভেসে যাচ্ছে।
সিমি গতকাল থেকেই অপরিসীম কষ্ট সহ্য করে আজ নিজের অংশকে পৃথিবীর আলো দেখালো। ব্যথায় যখন তার মুখ কুঁচকে উঠছিল ঠোঁট গুলো কালো হয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছিল সেই অবস্থা পারু সহ্য করতে পারছিলেন না। একসময় নিজে এমন কষ্ট সহ্য করে মেয়েকে জন্ম দিলেও, আজ সেই মেয়ের কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারছেন না। কয়েকবার বলেছিলেন,
—নরমাল ডেলিভারির দরকার নেই সিজার করে ফেলুন।
ডাক্তার এই কথা শুনে হেসে বলছিলেন-
—সব কিছু ঠিক আছে।কেন শুধু শুধু অপারেশনের ঝামেলায় যাবেন?সেখানে কি কষ্ট নেই? মেয়ের চাইতে আপনিই বেশি অস্থির হয়ে গেছেন! তাই আপনাকেই বলছি ধৈর্য ধরুন মা।

সিমি নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছিলো তার নিজের এতটা ধৈর্য শক্তি দেখে।
একটা সন্তান নিজের মধ্যে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে, তার বৃদ্ধি তার অনুভূতিকে জানান দিয়ে। কত পছন্দের ত্যাগ করতে হয়, নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। এতটা কষ্ট সহ্য করে তাকে পৃথিবীতে আসার পথ তৈরি করে দিতে হয়।সেই কাঙ্ক্ষিত সন্তানের মুখটা দেখেই সমস্ত কষ্ট ভুলে যায় একজন মা।
সিমির বেলাতেও তাই হলো, দুনিয়ার সবচাইতে অমূল্য সম্পদের মুখটা দেখে কষ্টের চিহ্ন রেখে যাওয়া কালো ঠোঁট গুলোতে জীবনের সবচেয়ে মিষ্টি হাসিটা ফুটে উঠলো। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানির রেখায় আবার পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই পরম নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করলো। আবার আবছা আবছা দেখলো মা আর শাশুড়িকে , সমস্ত রাজ্যের ঘুম যেন চোখের পাতায় ভর করেছে,কিছুতেই আর চোখ মেলতে পারলো না, গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো সে।

যখন সিমির ঘুম ভাঙল,সে নিজেকে কেবিনে আবিষ্কার করলো।কখন কিভাবে এখানে তাকে আনা হয়েছে মনে করতে পারলো না। কিন্তু সবাইকে দেখতে পারছে সে,সবার হাসিমুখ দেখে ভালো লাগছে।সিমির দিকে চোখ পড়তেই পারু বলে উঠলেন-
—এই যে সিমি উঠেছে।
তিনি মেয়ের কপালে চুমু দিলেন।মমতায় হাত বুলাতে লাগলেন।যেন মেয়ের কষ্টটাকে লাঘব করতে চাইছেন।
পরশ কাছে এসে হাতটা ধরে বলল-
—এখন কেমন লাগছে?
—ভালো।
—আমাদের মেয়ে,দেখ।
পরশের মা রোকেয়া কাছে এনে দেখালেন – নরম তুলতুলে শরীর, গোলাপী ঠোঁট,চোখ পিটপিট করা এক সদ্যজাত শিশুকে।

রোকেয়া পরশকে বললেন-
—বাবা,কোলে নাও নিজের সন্তানকে।

পরশ মেয়েকে কোলে নিল ভয়ে ভয়ে হঠাৎ যদি পড়ে যায় হাত ফসকে। ওর অবস্থা দেখে সবাই হেসে উঠল। পরশ এক অপার্থীব অনুভূতি অনুভব করলো। এই অনুভূতি প্রকাশ করার মতো না কাউকে বলে বোঝানোর মত না শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করার মত। তার চোখ ভিজে ভিজে উঠছে।এই অবস্থাটা নাঈম বুঝতে পেরে ছেলের কাঁধে হাত রেখে হালকা চাপ দিলেন,যেন বোঝাতে চাইলেন ‘প্রথম সন্তান হওয়ার অনুভূতি এমনই হয়।’

যদিও খুব একটা প্রয়োজন নেই তারপরেও আজকের দিন টা হসপিটালে থেকে গেলে ভালো হয়, তাই সিদ্ধান্ত হলো আজ থেকে আগামী কাল বাসায় চলে যাবে।

প্রথম বারের মতো দাদা দাদু,নানা-নানু হওয়ার অনুভূতি ও অন্য রকম।তাঁরা নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করতে লাগলেন।

সিমির বাচ্চা হওয়ার খবর পেয়ে ঝিমি দেখার জন্য একেবারে অস্থির হয়ে উঠলো।
নওমিকে সাথে নিয়ে ঝিমি হসপিটালে উপস্থিত হয়ে গেল। এত লোক হয়ে গেছে যে কেবিনে আর জায়গা হচ্ছে না। পারু বললেন, সবাইকে বাসায় চলে যেতে। সবাইকে ফ্রেস হয়ে , খেয়েদেয়ে, রেস্ট নিয়ে পরে আবার আসতে বললেন।
গতকাল থেকে সবার অনেক ধকল গেছে।

নওমি এত ছোট বাচ্চা কখনো কোলে নেয়নি। ঝিমি কোলে নিল বাবুকে। কিছুক্ষণ রেখে , নওমির কোলে বাবুকে দিলো।
ছোট্ট একটা পুতুল যেন।কি আদর যে লাগছে!

নওমির মনে হতে লাগল,তাকে কোলে নিয়ে মায়ের কেমন অনুভূতি হয়েছিল?সে কি আসলেই খুশি হওয়ার মত , মায়ের মনে সুখানুভূতি সৃষ্টি করার মত বাচ্চা ছিল সে?
এই বাচ্চার জন্ম হয়েছে সবাই কত খুশি। বাবা মা পরিবারের সবার আদর ভালোবাসা পেয়ে ও বড় হয়ে উঠবে। সবার ভাগ্য তো আর এমন হয়না। মনে মনে বলল,দোয়া করি ,’ পৃথিবীর কোন দুঃখ যেন তোমাকে স্পর্শ না করে।’

হঠাৎ নওমির অদ্ভুত অনুভূতি হল। একটা বাচ্চার জন্মের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ জার্নিতে বাচ্চাটার তো কোন দোষ থাকে না। সে তো জানেই না কিছু, একটা নিষ্পাপ পবিত্র আত্মা। তাহলে তার নিজের জন্ম নিয়ে নিজেকে এতটা দোষী ভাবার কি হলো? তার তো কোন দোষ নেই। যারা তাকে পৃথিবীতে আনার জন্য দায়ী, সেই দায়ভার তাদেরকেই বহন করতে হবে। একজন তো পৃথিবী থেকে চলে গিয়ে সে দায় ভারমুক্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু আরেকজন তো আছেন তাকে সবকিছু সুদে-আসলে চুকাতে হবে। সে বাঁচবে, সমাজে মাথা উঁচু করেই বাঁচবে।

পারু বললেন-
—এবার আমার কোলে দাও।
এই সিমি বাবুকে খাওয়াতে হবে আবার।এই বলে নওমির কোল থেকে নিয়ে সিমির কোলে দিলেন বাবুকে।
নওমির কাছে মনে হলো , পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্য হচ্ছে মা তার সন্তানকে ব্রেস্ট ফিডিং করাচ্ছে। নওমি যেন চোখ ফেরাতে পারছে না।মনে মনে বলল, মাশাআল্লাহ।

সিমি তার মাকে বলল-
—বাবু মনে হয় খুব বেশি দুধ পাচ্ছে না। ওকে কি ফিটার দেওয়া শুরু করবো, মা?
—একদম না। প্রথম দুই-তিনদিন একটু কমই আসে দুধ। এরপর ঠিকমতোই পাবে। সবকিছুতেই তোমরা এতো অস্থির হয়ে যাও! ধৈর্য ধরতে হয়।

ঝিমি বলল-
—আপু তুই ব্যথা পাচ্ছিস না?
ঝিমির কথায় সবাই হেসে উঠল।
—আমি হাসার মতো কি বললাম?
নওমি বলল-
—হাসার মতো কিছুই বলিস নি। প্রশ্ন তো করতেই পারিস। কিন্তু তুই এমন ভাবে বলেছিস, তোর কথা বলার ধরন দেখেই আমরা সবাই হেসেছি।
পারু বললেন-
—এখন আমাদের সামনে বলেছিস ঠিক আছে। সবার সামনে এমন বোকামির প্রশ্ন করবি না কখনো।
—আচ্ছা ঠিক আছে। আমি চুপ করে বসলাম আর একটা কথা বলবো না ।
—কিছুই বলা যায় না তাকে। যেটা ভুল হয়েছে সেটা শুধরে দিব না? কিছু বললেই রাগ করে ফেলতে হয়?
সিমি বলল-
—এখন কিন্তু তুই খালামণি হয়ে গেছিস। এমন করলে চলবে না। তাহলে বাবু বলবে, খালামনি খুব বোকা।
এবার ঝিমির মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

নওমি বলল-
—সিমি আপু বাবুর নাম ঠিক করেছ?
—ও পেটে থাকতেই আমরা সবাই মিলে লটারি করে ওর নাম ঠিক করে রেখেছি।
—লটারি করে মানে?
—পরিবারের সব সদস্যরা দুইটা করে নাম কাগজে লিখে জমা দিয়েছে। একটা ছেলের নাম আর একটা মেয়ের নাম। এরপর সব কাগজ একসঙ্গে করে লটারি করেছি। লটারিতে উঠেছে ওর দাদার লিখা কাগজটা।সেখানে মেয়ের নাম লিখা ছিল ‘আয়েশা সুবহা।’ এই নামই রাখবো’ এই নামেই আকিকা হবে।
—খুব সুন্দর নাম-আয়েশা সুবহা।আর আপনাদের লটারি করে নাম রাখার পদ্ধতি টা খুব সুন্দর।
—এতে করে কেউ মনে দুঃখ পাবে না। সবাই মনে মনে নাম ঠিক করেছিল। সব নাম তো রাখা সম্ভব না।তাই এই পদ্ধতি।
পারু বললেন-
—আমি লিখে দিয়েছিলাম,সিমরান।যাই হোক আমার লিখাটা উঠলো না।
অবশ্য তাতে কি ?এই নামটাও খুব সুন্দর।

নওমি হসপিটাল থেকে বের হয়ে চিন্তা করলো পম্পিদের বাসায় যাবে।ঝিমি হসপিটালে থেকে গেল। আজ ভার্সিটি বন্ধ।
রিকশা দিয়ে পম্পিদের ওখানে যেতে অনেক দেরি হবে তবুও রিকশা নিল নওমি। অনেকদিন থেকে চারপাশে ভালো করে তাকিয়েও দেখে না সে। আজ দেখতে দেখতে যাবে। অনেক কিছু কেমন যেন নতুন নতুন লাগছে।

পম্পি,নওমিকে দেখে একেবারে অবাক। কিন্তু পম্পিকে দেখে মনে হল সে বাইরে যাচ্ছে।
—কি রে বাইরে যাচ্ছিস?তাহলে আমি বরং চলে যাই।
রজনী এসে বলল-
—আমরা দুজন যাচ্ছিলাম ,এখন তুমি মিলে তিনজন হলো।
—কোথায় যাবেন?
—আমার এক ফ্রেন্ডের আর্ট এক্সিবিশন হচ্ছে। আমরা এইচ. এস. সি পর্যন্ত একসঙ্গে পড়াশোনা করেছিলাম।সেখানেই যাচ্ছি। তোমার ভালো লাগবে।
—আমি বড় বড় শিল্পীদের আর্টের কিছুই বুঝিনা।

হেসে হেসে রজনী বলল-
—আমার ওই ফ্রেন্ড এর এটা প্রথম এক্সিবিশন। এত বড় হয়নি এখনও, কিছুটা হয়তো বুঝতে পারবে। খুব বেশি নাম ডাক হয়ে গেলে তখন আর অত অনুরোধ করে বলতো না যেতে। আরেকটা কারণ অবশ্য আছে। জানে যে, আমার স্বামীর অনেক টাকা। ইচ্ছে হলে একটা ছবি আমি কিনে ফেলতে পারি অনায়াসেই।
এবার হা হা করে হাসতে লাগলো রজনী। তার এই হাসির মধ্যেও যে গভীর দুঃখ লুকিয়ে আছে সেটা বুঝতে পম্পি বা নওমির কারো অসুবিধা হলো না।

—তবে নওমি তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে তুমি এক বিজয়ী সৈনিক।
পরাজিত মানুষকে সবাই আরো পায়ের নিচে ফেলে চটকাতে চায়। সব সময় এমনটাই থেকো।

নওমি একটু হাসলো।
—কিন্তু রজনী মণি আমার যে খুব ক্ষুধা লেগেছে।
নওমি মাঝে মাঝে রজনীকে আদর করে এই নামেই সম্বোধন করে। এমনিতে খালামণি বলে।
—ওরে আমার বাচ্চাটারে কতদিন পর তোর মুখে এই ডাক শুনলাম। আগে বলবে না।
পম্পি কৃত্তিম রাগ দেখিয়ে বলল-
—আহারে তোমাদের ঢং দেখে আর বাঁচি না। আমরা বাইরেই খাবো। এখন খেয়ে ক্ষুধা নষ্ট করিস না নওমি।
—অল্প কিছু খেয়ে নিক। অতিরিক্ত ক্ষুধা লেগে গেলে, তখন যত ভাল খাবারই দাও না কেন ভালো লাগবে না ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যাবে।
—হালকা কিছু দাও।

তিনজন কথা বলতে বলতে, হাসতে হাসতে খুশি মনে সামনে এগিয়ে চলল।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here