#৫ম_তলার_মেয়েটাপর্ব_১
#ফাহমিদা_লাইজু
নওমি তাড়াহুড়া করে নেমে যাচ্ছিলো। তখন তার কানে গিয়ে বিঁধলো কথাটা, পেছন থেকে পারু বলছে-
—দেখলে সুমি কেমন মেয়েরে বাবা,এত সকালে এত সেজে কোথায় যায়?
এ সব কথা গায়ে মাখবেনা ভেবেও মনটা খারাপ হয়ে যায় নওমির।সাজগোজ বলতে শুধু একটা পরিপাটি থ্রিপিস পরে আর একটু পারফিউম লাগিয়েছে আর কোন কসমেটিকস ও লাগায় নি,তাহলে তারা কি দেখতে পায়?
বাবা-মা না থাকার খেশারত নওমিকে যেন প্রতি পদে পদেই দিতে হচ্ছে।যে কেউ কথা শুনিয়ে দিতে পারে।আর তার সব চেয়ে বড় দোষ তার একা থাকা নিয়ে। আশ্চর্য ব্যপার একটা মেয়ে একা একটা বাসা নিয়ে থাকতে পারবে না এটা কোথায় লিখা আছে? শুধু কি এই মহিলাদের কটু কথা?আরো কত কিছু তাকে সহ্য করে চলতে হয়।
নওমির কাছে জীবনটাকে মনে হয় নর্দমায় পথ চলার মত যেখানে অদৃশ্য কাঁটা দিয়ে পরিপূর্ণ।
পারু আর সুমি সকালে হেঁটে এসে ৩য় তলায় সুমির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে তখনই নওমি নেমে যাচ্ছে দেখে কথাটা ছুড়ে দিল পারু। নওমি কারো সাথে কথা বলে না,আসলে এই বিল্ডিংয়ের কেউ তার সাথে কাথাও বলতে চায় না।সে কারো সাথে সহজ হতে পারে না,একটা জড়তা তাকে ঘিরে ধরে।বরং এই বিল্ডিংয়ের বাইরে বের হলেই সে অনেকটা সহজ হতে পারে।আর এই অবস্থাটাকেই পারু অহংকার ভাবে, তার ভাষায় ,’দেমাগের চোটে মাটিতে পা পরে না মেয়ের,সালামটা পর্যন্ত দেয় না।’
নওমি চলে যেতেই সুমি বলল-
—ও তো প্রতিদিনই এমনভাবেই বাইরে যায়। শুনেছিলাম ও নাকি ভার্সিটিতে পড়ে।বলেন আন্টি হাই হিল পরে এত সাজগুজ করে কেউ ভার্সিটিতে যায়?মনে হয় অনেক টাকা ওয়ালার মেয়ে,তাই তো এত অহংকার।
—একা থাকে, কি না,কি করে বেড়ায় ঠিক আছে কিছুর।সে দিন দেখলাম একটা ছেলে এসেছে ওর বাসায়।বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলা দরকার। এমন ভাড়াটিয়া থাকলে বাসার পরিবেশ নষ্ট হয়।আমাদের ও ছেলে মেয়ে আছে।এমন তো না।
—ঠিকই বলেছেন আন্টি।আমরা সবাই মিলে যাবো, বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলবো।
আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে বাজারের ব্যাগ নিয়ে উঠছিলেন জাহান। ওদের দেখে তিন তলায় দাঁড়িয়ে গেলেন, হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন-
—কি ব্যপার আপা কিছু হয়েছে।
—আরে না,হয় নি,তবে হতে কতক্ষণ। আমার পাশের ফ্লাটের মেয়েটা আছে না,ওর কথা আলাপ করছিলাম।
আগের কথোপকথন শুনে জাহান বললেন-
—আমাদের নাক না গলানোই ভালো পারু আপা।ও তো কারো কোন সমস্যা করছে না।আমি এই বাসার সবচেয়ে পুরনো ভাড়াটিয়া।আপনারা তো এসেছেন বেশিদিন হয়নি।সুমি তো আরো পরে এসেছ। আপনাদের আগে থেকেই ওকে দেখছি আমি।নওমি কারো সাতে পাঁচে নেই। নিজের মত থাকে।ওকে নিয়ে কথা বলার কি আছে?
— বলছি যে একা থাকলে এত বড় বাসার দরকার কি বলেন?মেসে বা হলেও থাকতে পারে।
—মানুষকে দেখে কি বোঝা যায় কার প্রয়োজন কি?এত দিন থেকে কখনো আপত্তি জনক কিছু চোখে পরেনি।কিছু মনে করবেন না আপা একটা কথা বলি, কারো সম্পর্কে ভালো ভাবে না জেনে কোন মন্তব্য করা ঠিক না।
পারু আপা আমার এখন যেতে হবে। নাস্তা রেডি করতে হবে।সুমি বাসায় এসো,আপা আপনিও আসবেন।
এই বলে জাহান উঠে গেলেন।মনে মনে ভাবতে লাগলেন,’ এদের খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই, অহেতুক মানুষের পেছনে লেগে থাকে।এখনই আমার সম্পর্কে ও কিছু মন্তব্য করবে।’
আসলেই তাই জাহানের ধারনাই ঠিক।জাহান উঠে যেতেই পারু বলল-
—নিজেকে অনেক জ্ঞানী ভাবে সে।আরে আমরা বুঝি না কিছু।ঐ মেয়ের চালচলনের ঠিক নাই দেখেই বোঝা যায়।আরো কয়েকজনকে নিয়ে বাড়িওয়ালার বাসায় যাই চল।ওকে উঠিয়ে দিতে হবে এই বাসা থেকে।চল কালকেই যাই।
—ঠিক আছে খালাম্মা।
এর পরে তাদের খেয়াল হলো তাদের ও কাজ আছে। অবশ্য পারুর বাসায় একটা বাধা কাজের মেয়ে আছে, মর্জিনা। মোটামুটি সব কাজই ভালোভাবে করতে পারে।
পাঁচ তলায় পারুদের ফ্লাটের পাশে দেড় রুমের একটা ফ্ল্যাট। ছোট্ট একটা বাথরুম,একটা কর্নারে রান্নার ব্যবস্থা।এখানেই নওমি আপন ভুবন গড়ে তুলেছে। এক টুকরো বারান্দা,এক চিলতে আকাশ দেখা যায় বারান্দায় গেলে।তবে কয়েকমাস খুব একটা যাওয়া হয় না।এই বিল্ডিং লাগোয়া আরেকটা বিল্ডিং উঠছে সারাক্ষণ সেখানে মিস্ত্রিরা কাজ করছে।অনেকে তাদের কাজে ব্যস্ত থাকলেও একটা ছেলে শিস দেয়,গান গায় আরো কত কি!নওমির মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে,ডেকে জিজ্ঞেস করতে ,’এ সব করে কি মজা পাস?’জিজ্ঞেস করা হয় না।আরো কত শত ইচ্ছের মতো এটাও অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।
আজ কিছুতেই রান্না করতে ইচ্ছে করছে না। আসার সময় কিছু নিয়ে আসলেও হতো। কিন্তু এখনও মাসের ছয় দিন বাকি আছে।হাতে যেই পরিমাণ টাকা আছে তা দিয়ে একটু কষ্ট করে চলতে হবে।বাধ্য হয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে তুলে একটু চাল চুলায় চাপিয়ে দিল।নাস্তা করলে আরো বাড়তি একটা খরচ,একবারে ভাত খেয়ে ফেললেই হবে।ফ্রিজে পুরোনো তরকারি খুঁজতে লাগলো নওমি।এমন সময় কল এলো।ফোনটা হাতে নিয়েই এক চিলতে হাসি মুখে ভেসে উঠলো নওমির।মামা-
—মামা কেমন আছ তুমি?
—আমি ভালো আছি,তুই কেমন আছস মা?
—ভালো আছি মামা।
—তোর হাতে টাকা পয়সা আছে?লাগলে সংকোচ করিস না।জানাইস।
—আছে মামা ,চলে যাবে।শাপলা,সজিব কেমন আছে?
—ভালো।তোর কথা খুব বলে ওরা।তোর মামির কথা জিজ্ঞাসা করলি না?
—কেমন আছেন মামি?
—ভালো।মামির উপর রাগ রাখিস না মনে।সে যেইটা বলে ,আসলে মন থাইকা বলে নারে মা।
—মামা আমিও তোমাকে বার বার জিজ্ঞেস করি আমার খরচ কে দেয়,তুমি বল না।মামি যা বলেন ঠিকই তো বলেন, আমার জন্য কার এত দরদ ,মাসে মাসে এতগুলো টাকা দেয়, নিশ্চিয় কোন স্বার্থ আছে।স্বার্থ না থাকলে শাপলা, সজিবের পড়ার খরচের জন্য দেয় না কেন?
—ওরা তো তোর মত ভালো ছাত্র না।
—আমি কি আর ভালো ছাত্রী? ভালো হলে তো ডাক্তারিতেই চান্স পেতাম, পাবলিক কোন ভার্সিটিতে ও চান্স হলো না,তাহলে ভালো ছাত্রী হলাম কিভাবে?
—আবারো তোর মামির কথাটাই বলছস?
—মামি যা বলেন ঠিকই তো বলেন।
—সবার কি সব জায়গায় চান্স হয়?এখন ভালো বিষয় নিয়া পড়তেছস এইটাই কম কি?মনে আফসোস রাখিস না মা, আল্লাহ তাআলা নারাজ হবেন?
নওমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। তার কষ্ট বুঝতে দিয়ে মামার কষ্ট বাড়াতে চায় না সে। এমনিতেই তার জন্য মামির কাছে অনেক কথা শুনতে হয় মামাকে।
—মামা রাখি তাহলে,ভাত পুড়ে যাবে। তুমি ভালো থেকো।দোয়া করো আমার জন্য।
—দোয়া করি , অনেক দোয়া করি তোর জন্য। ভালো থাক মা।
নওমি ভাবে সে এতিম ,তাই হয়তো কেউ দয়া করে সাহায্য করছে ।নিজেকে এতিম বললে তার মামা বলেন,’কখনো এই কথা যেন না শুনি ,আমি আছি না,তোর মামা মরলে তখন তুই কইস তুই এতিম।’
বাসা ভাড়া আর পড়ার খরচ দেয় সেই দয়াবান মানুষ,যিনি নিজের পরিচয়টাও গোপনে রাখতে চান।নওমির মামার কাছে টাকা পাঠান পরে মামা নওমিকে পাঠান।নওমি ক্লাস টেনের একটা ছাত্রকে পড়ায় আর সপ্তাহে একদিন একটা কোচিংয়ে ক্লাস নেয়।কোনমতে চলে যায়। ছাত্রটাকে গত বছর থেকেই পড়াচ্ছে। কিন্তু কিছু দিন থেকে মনে হচ্ছে তার ছাত্র নিবিরকে পড়াতে পারবে না এই কথা ওর মাকে জানিয়ে দিবে।এই জন্য আরেকটা টিউশনি ও খুঁজছে সে।নিবিরের মাকে কি বলবে?না পড়াতে পাড়ার কারণ কি বলবে সেটাও ঠিক করতে হবে।নিবিরকে না পড়ানোর সত্যিকারের কারণ তো আর ওর মা’কে বলতে পারবে না।
হঠাৎ নওমির চোখ বেয়ে পানির ধারা নামতে লাগলো এই ভেবে,’ কেন আমার সাথেই এমন হয়?’
পারুর মন কেমন করছে। সন্ধ্যা হতে থাকে আর মেয়েরা তখনো ঘরে না ফিরলে অস্থির লাগা শুরু হয়।সিমি এখনো ফেরেনি।ঝিমির রুমে গিয়ে ঘুমন্ত মেয়েকে ডেকে তুললেন পারু-
—সিমি তো এখনো এলো না।এখনো উঠিস না কেন?
—আমি উঠে কি করবো মা?হয়তো রাস্তায় জ্যামে আটকে পরেছে আপু,চলে আসবে। চিন্তা করো না তো মা।
এই বলে ঝিমি আবার শুয়ে পড়লো।
পারু তাগাদা দিতে শুরু করলেন উঠার জন্য,’উঠ ,উঠে নামাজ পড়।
কে শোনে কার কথা?
পারু সবার কাছে ছেলে মেয়েদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও ,প্রকৃত সত্য হলো তার সন্তানরা তার কথা শুনতেই চায় না।তবে ওদের বাবাকে খুব ভয় পায়।তবে এটা তার নিজস্ব ধারণা, ওরা কখনো খারাপ কিছু করবে না।
মাগরিবের নামাজেও ভালোভাবে মন পড়ছিলো না পারুর।সিমির এই সময় কোন কাজ নেই বাইরে তাহলে কেন এত দেরি হচ্ছে? নামাজ আদায় করে উঠার পরেই শফিক চলে এলেন।
চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন-
— ছেলেমেয়েরা কোথায়?
—ঝিমি ঘুমাচ্ছে।
কথা শেষ না করতেই শফিক বলে উঠলেন-
—এখনো কেন ঘুমায়?এই সব কি ?কেন মেয়েকে সন্ধ্যার আগেই উঠাওনি।কি কর বসে বসে। বাকিরা কই?
—শাওন এখনো ফেরেনি।
সিমির কথা বলতে গিয়ে পারুর গলা শুকিয়ে গেল।
—সিমি কোথায়?
—মনে হয় রাস্তায় জ্যামে আটকে গেছে।
—কি?জ্যামে আটকে গেছে মানে কি?এখনো বাসায় আসেনি?কতবড় সাহস?ফোন দাও।এখনি ফোন দাও।
—ফোন বন্ধ।আগেও কয়েকবার চেষ্টা করেছি।
—আমি বুঝতে পারছি না তুমি বাসায় বসে করটা কি? ছেলে-মেয়েদের ঠিক মত দেখে রাখতেও পার না?মেয়ের আবার মোবাইল বন্ধ।
শফিক পায়চারি করছেন আর একটু পর পর হুঙ্কার ছেড়ে চিৎকার চেঁচামেচি করছেন।
রাত নয়টার দিকে সিমির কল এলো শফিকের নাম্বারে-
—বাবা আমি বিয়ে করে ফেলেছি।আমাকে ক্ষমা
করে দিও।
চলবে…