#৫ম_তলার_মেয়েটাপর্ব_২৭
জালেরা বেগমের কানেও খবরটা পৌঁছে গেলো। তাঁর একার পক্ষে ৫ম তলায় উঠা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু এই খবর শুনে কোনভাবেই বসেও থাকতে পারলেন না ,উপরে উঠার ব্যবস্থা ঠিকই করলেন তিনি।
সাহায্যকারী মহিলা দুইজনের সহায়তায় অনেক কষ্টে উঠে এলেন ৫ম তলায়। এই জন্য তাঁকে, লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিতে নিতে থেমে থেমে চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিতে হয়েছে কয়েকবার। দারোয়ান চেয়ার নিয়ে পেছনে পেছনে এসেছে।
অনেক পুরোনো বাড়ী তাই লিফট নেই।এই বাড়ী ছাড়াও তাঁদের অনেক সুন্দর আরো দুইটা আধুনিক বাড়ী আছে কিন্তু এই বাড়ীর সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে হাজেরার।তাই কখনো এই বাড়ী ছেড়ে যাননি। কিন্তু এখন হাজেরা কিভাবে একেবারেই এই বাড়ী থেকে চলে গেলো? এত স্মৃতি, এত মমতা দিয়ে গড়া এই সংসার ছেড়ে চলে যেতে পারলেন!
পম্পি দরজা খুলে দেখলো তুষার কন্যার মতো একজন দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছেন। তফাৎ একটাই তিনি বয়ষ্ক বাঙালি তুষার কন্যা।সাথে তিন জন। হাঁপাতে হাঁপাতেই বললেন-
—এই মেয়ে দরজা থাইকা সর।
পম্পি সরে গেলো।আসলে জালেরা বেগমকে দেখে পম্পি এতটাই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল যে দরজা থেকে সরতে বা কিছু জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গিয়েছিলো।
তিনি ডাকতে ডাকতে ভেতরে ঢুকে গেলেন-
—নওমি কই?দাদু কই তুমি?
পম্পি বুঝতে পারলো উনিই রক্তের সম্পর্কে নওমির দাদু হয়, উনিই তোফাজ্জল হোসেনের মা।
জালেরা বেগমের সাথে আসা তিনজনকে বলে দিলেন,চলে যেতে। যাওয়ার সময় হলে তিনি ফোন দিবেন।তার সাথে একটা কাপড়ের পাশব্যাগ ঝোলানো , মোবাইল ব্যাগের চেয়ে একটু বড়।
নওমি একটু চোখ মেলে তাকালো।অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল দাদুর দিকে।সে বুঝতে পারছে না স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যি।আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল।এখন ঘুমিয়ে থাকলেই শুধু স্বপ্ন দেখে। তার মা’কেও, সে স্বপ্ন দেখলো তার মা নিরা এসেছে এই বাসাতেই এসেছে।নওমি তার মাকে দেখে খুব বিরক্ত হলো। কথা বলতে একটুও ইচ্ছে করছিল না। তার মা-ও একটাও কথা বলল না শুধু তার মায়ের চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছিল। একবার খুব ইচ্ছে করছিল মায়ের চোখটা মুছে দিতে। কিন্তু তবুও দিল না, অনেক রেগে বলল চলে যাও তুমি এখান থেকে আর কখনোই আসবেনা। এই কথা বলার একটু পর নওমির খুব খারাপ লাগছিল। মায়ের হাতটা ধরতে খুব ইচ্ছে করছিল, চোখ মেলে যখনই মায়ের হাতটা ধরতে গেল দেখল সত্যি সত্যি তার মা চলে গেছে। ওইভাবে বলা কিছুতেই ঠিক হয়নি তার মা আর কখনোই আসবেনা। অনেক কষ্ট পেয়েছে মনে হয়।
এখন মনে হচ্ছে দাদু এসেছে কিন্তু উনি তো সিঁড়ি ভাঙতে পারে না এই পাঁচ তলায় আসবেন কি করে? নাকি সে নিজেই চলে গিয়েছে দোতলায়?
জালেরা বেগম নওমির পাশে বসলেন।সেই সুন্দর গন্ধটা এসে নাকে লাগলো। এইবার নওমি দেখতে পাচ্ছে দাদুকে নিয়ে সে একটা সরিষা ক্ষেতের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সরিষা ক্ষেতে বাতাস বয়ে চলেছে সেখানে ঢেউয়ের মতো হচ্ছে।মৌমাছিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। সরিষা ক্ষেতটা যেন হঠাৎ করে সূর্যমুখীর ক্ষেত হয়ে গেল। নওমি বলছে-
—দাদু আস্তে হাঁটেন, আমি আর পারছিনা।
স্বপ্নের ঘোরে বলা কথাগুলো দাদু আর পম্পি দুজনেই শুনতে পেলো।
—নওমি খুব কষ্ট হইতেছে?
কোন উত্তর পেলেন না।
পম্পি বলল-
—ও ঘুমের ঘোরে কথা বলছে।
—তুমি নওমির বান্ধবী?
—জ্বী।
—আরেকজন নাকি ছিল?
—স্বর্ণা ছিল।আমাদের আরেক বান্ধবী।ও বাসায় গেছে আজ আবার আসবে।
—হাসপাতালে নেয়া দরকার না নওমিরে?
—এখন খুব একটা জ্বর নেই।স্বর্ণার বাবা-মা ডাক্তার,উনাদের সাথে কথা হচ্ছে। অতিরিক্ত মানুষিক কষ্ট পেয়েছে তাই এমন হয়েছে।একদম ঘুমাচ্ছিলো না,কান্নাকাটি আর পাগলামি করছিলো তাই লো পাওয়ারের একটা ঘুমের ঔষধ দেয়া হয়েছে গতরাতে।
জালেরা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
—নাস্তা করছ?
—পাশের বাসার আন্টি একটু আগে নাস্তা দিয়ে গেছে।এখনো খাইনি।
—এখন আমাগো কি করা উচিৎ কওতো?
এমন সময় দরজায় নক হলো। পম্পি দরজা খুলে দেখলো,স্বর্ণার সঙ্গে তাশফিও দাঁড়িয়ে আছে।
পম্পি আস্তে করে বলল-
—নওমির দাদু বসে আছে নওমির পাশে।নওমি ঘুমাচ্ছে।
তাশফিকে পুরাই আউলাঝাউলা লাগছে পম্পির কাছে। সে যে পুরাই বিধ্বস্ত বোঝাই যাচ্ছে।
গত রাত থেকে একটুও শান্তি পাচ্ছে না তাশফি।বাবা-মা নওমির ব্যপারটা জানার পর কোন মন্তব্য করেনি। এতেই বোঝা যায় এই ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করার দরকার আছে তাদের। খুব সহজ হবে না ব্যাপারটা, সবকিছু খুব সহজে মেনে নিবে না। তাঁরা মানুষের কথার ভয় করবে, সমাজের ভয় করবে। কিন্তু তাশফির কাছে এটা কোন সমস্যাই না। কি হবে নওমির বৈধতা আর অবৈধতা দিয়ে?সে তো নওমিকে ভালোবেসেছে, ওর পরিচয়কে না।তাহলে পরিচয় কেন সম্পর্কের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে? নওমিকে নিয়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যাবে,যেখানে এই সব বিষয়ে বলার কেউ থাকবে না। সব কিছু সে ভেবে রেখেছে।এখন শুধু নওমি সুস্থ হলেই ওর সাথে কথা বলে সব কিছু ফাইনাল করতে হবে।
সামনের স্পেসটাতে শুধু একটা চেয়ার আর ডিভান।তাশফিকে এখানেই বসতে বলল পম্পি।
তাশফি একটু বসে আবার দাঁড়িয়ে গেলো।ঢুকে গেল বেড রুমে।দাদু তাশফিকে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে স্বর্ণা বলল,ও আমার ভাই।চার জনের মনের ভিতরেই বিভিন্ন কথা ঘুরপাক খাচ্ছে।
জালেরা বেগম খুব গভীরভাবে তাশফিকে পর্যবেক্ষণ করলেন। তাঁর তীক্ষ্ণ নজরে সব কিছু ধরা পড়লো।
জালেরা বেগম বললেন-
—এই যে ছেলে তুমি মনে হয় নওমিরে পছন্দ কর।
তাশফি মাথা নাড়িয়ে নিচু করে ফেলল।
জালেরা বেগমের এইটা প্রশ্ন ছিল না। উনি নিশ্চিত হয়েই এই কথা বলেছেন।তাশফির চোখ দেখেই বোঝা যায় ঐ চোখে এক সাগর ভালোবাসা উথালপাথাল করছে।তার অভিজ্ঞ চোখ ভুল হতে পারে না।
—কতটুক পছন্দ কর,এই সমাজ-সংসাররে কাঁচ কলা দেখাইতে পারবা?ওরে পাইতে হইলে একটা বিরাট যুদ্ধ তোমারে করতে হইবো , কাছের- দূরের আপন- পর সবার সাথে,পারবা?
—পারবো।
একটা কথাতে এত দৃঢ়তা ,জালেরা বেগম মনে মনে খুশি হলেন, যেন একটা আশার আলো দেখতে পেলেন।
তোফাজ্জলের স্ত্রী হাজেরা হাসপাতাল থেকে ওর ভাইয়ের বাসায় চলে গেছে। তোফাজ্জল কোথায় ডুব দিয়েছে কেউ জানে না। তিনি তো মা , তোফাজ্জলের চিন্তায় ঘুমের মধ্যেও দুঃস্বপ্ন দেখেন। সন্তান যাই কিছু করুক তার জন্য মায়ের মনের ভালোবাসা কমে যায় না কখনো।তিনি ভাবেন মানুষের একটা ভুলের জন্য কতগুলো জীবন এলোমেলো হয়ে যায়। যেই সময়ের ভুল, সেই সময় কিছু না হলেও, কিংবা সেই সময় সেটাকে ভুল মনে না হলেও, সেই ভুল জীবনে কখনো না কখনো এসে পাহাড়ের মত সামনে দাঁড়ায়। আর তখনই মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। এখন যেমন অবস্থা হয়েছে তোফাজ্জলের।
জালেরা বেগমের সাথে হাজেরার কথা হয়েছে।সে বলেছে,’আর সম্ভব না এই সংসারে আসা।কোন দিন যদি সব কিছু ভুলতে পারি তাহলেই আসব।’ হাজেরার জন্য কষ্ট হয় জালেরা বেগমের।তার কোন দোষ না থাকলেও সে কষ্ট পাচ্ছে।
যাই হোক এত কিছুর মধ্যে নওমির একটা কিনারা হলেই যেন শান্তি।
হঠাৎ নওমি উঠে বসলো।সবার দিকে তাকিয়ে বলল-
—আবার স্বপ্ন দেখছি,দাদু আসছে আবার তাশফি ও আসছে।
একটু হেসে আবার শুয়ে পড়তে চাইলে, দাদু বললেন-
—আসলেই আমরা আসছি, তুমি স্বপ্ন দেখতেছনা।
নওমি বলল-
—কেন আসছেন?সবাই চলে যান।
জালেরা বেগম নওমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন-
—দাদু এমন করে না।দুনিয়াতে যেমন সমস্যা আছে তেমনি সমাধানও আছে। আমরা সবাই তোমারে ভালবাসি। আমরা সবাই চাই তুমি ভালো থাকো।
নওমি উঠে বাথরুমে চলে গেলো। অনেকক্ষণ সে বসেই রইল। ইচ্ছে করছে না কারো সামনে যেতে।
পম্পি দরজায় নক করতে লাগলো।শেষে নওমি বেরিয়ে এলো। পম্পি ওকে ধরে সামনের ডিভানে নিয়ে বসালো।সেখানে আগেই তাশফি বসে আছে। পম্পি চলে গেলো বেড রুমে।
তাশফি আরো কাছে এসে বসলো ,এত কাছে যে তাশফির নিঃশ্বাস নওমির গালে এসে পড়ছে।দুই হাত দিয়ে নওমির মুখটা তুলে বলল-
—তোমাকে ভালোবাসি, শুধু তোমাকেই। তোমার পরিচয় দিয়ে আমি কি করবো? পৃথিবীতে যত দিন আমার শ্বাস থাকবে ,প্রতিটা নিঃশ্বাসে তোমাকে চাই। তুমি যে কষ্ট পাচ্ছ সেই কষ্টের আঁচড় আমার বুকে এসে লাগছে।কারণ আমার মনটা যে তোমার কাছে।
নওমির হাত দুটো ধরে বলল-
—আমরা অনেক দূরে কোথাও চলে যাবো।তুমি যেখানে বলবে সেখানে।তুমি কোন দোষ না করেও কেন দোষী হবে?নিজেকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছ?
নওমির চোখ থেকে পানি পড়ছে তাশফির হাতের উপর।তাশফি চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলল-
—তুমি এমন করলে আমি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো। আমাকে আর খুঁজে পাবে না।
এবার নওমি চোখ তুলে বলল-
—অনেক হারিয়েছি আর হারাতে চাই না।আমি চেষ্টা করবো আমার মনকে বোঝাতে।
তাশফি এক চিলতে হাসি দিয়ে নওমির গালে হাত রাখলো।এবার নওমি একটা স্পর্শ অনুভব করলো যেটাতে ভালোবাসা মিশানো আছে,আছে আস্থা আর বিশ্বাস। চোখ বুজে শুধু অনুভবে মিশে গেলো নওমি।একটা স্পর্শ কত কিছু বুঝিয়ে দিতে পারে।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু