#বাবুইপাখির_অনুভূতিপর্বঃ০৩
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🕊️
—
_________________
জোৎসা ভরা রাতে জানালার কার্নিশ বেয়ে বয়ে আসছে ফুড়ফুড়ে ঠান্ডা বাতাস। বাতাসে জানালার দু’পাশ জুড়ে থাকা সাদা পর্দাগুলো উড়ছে বারংবার। যদিও এই মুগ্ধ করা রাতের সৌন্দর্যের ওপর বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা নেই আহির। সে তো ব্যস্ত এখন জানালার পাশ দিয়েই থাকা পড়া টেবিল বসে প্রেমপত্র লিখতে। খাতায় কিছুক্ষন লিখেই আবার খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলছে টেবিলের পাশ দিয়ে থাকা ডাস্টবিনের ঝুলির মধ্যে। এসবে প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে আহির। চারদিন আগেও এমন হয়েছিল কিন্তু তারপরও লিখেছিল সে। আজ ভেবেছিল একটু নতুনভাবে নিজের অনুভূতিগুলো সাজাবে আহি। কিন্তু বার বার ব্যর্থ সে। প্রচন্ড বিরক্ত নিয়েই নিজের কপালটা খাতার ওপর চেপে ধরে কিছুটা চেঁচিয়ে বললো আহি,
‘ উফ আমার ধারা এসব প্রেমপত্র লেখালেখি হবে না।’
বলেই নিজের মাথার চুল ধরে টানতে লাগলো আহি। সাথে নেকা কান্না জুড়ে দিয়ে বললো,
‘ কেন যে তখন ওই বাচ্চাটার কাছে চিঠিটা দিয়ে ছিলাম,ধুরো ভালো লাগছে না। আমার সাথেই বার বার এমন কেন হয় আমার কপালটাই খারাপ। কালও যদি প্রপোজ করতে না পারি তাইলে শালার আর বলবোই না। কিন্তু না বললে যদি নীরব ভাইয়ার জীবনে অন্য কেউ এসে পড়ে তখন, ওহ নো, না না এখন এসব ভাবা যাবে না আহি? তাড়াতাড়ি চিঠিটা কমপ্লিট করতে হবে।
ভেবেই টেবিলের ওপর থেকে মাথাটা উঠিয়ে আবারো লিখতে শুরু করলো আহি। ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় রাত বারোটার কাছাকাছি। আকাশে তাঁরারা তখন ঝলমল করছিল প্রায়। আর আহি কলমের আবরণ দিয়ে নিজের অনুভূতিগুলো গুছিয়ে না পারলেও অগোছালোভাবে সাজাচ্ছিল খাতায়।’
________
গভীর রাত তখন রক্তের ছাপ ছাপ দাগ পড়ে আছে একটা পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ির ফ্লোরের চারপাশ দিয়ে। বাড়িটা একদমই পুরনো আর ধুলোবালিতে ঘেরা। এসবের মাঝেই একদম গুটিশুটি মেরে হাত পা বাঁধা অবস্থায় ফ্লোরে বসে আছে একটা অল্প বয়সের ছোট বাচ্চা। ভয় হচ্ছে তাঁর খুব ভয় হঠাৎই সেখানে হাতে বন্দুক নিয়ে চলে আসলো একটা মধ্যম বয়স্ক লোক, লোকটাকে দেখেই ভয়ে শরীর কাঁপছে বাচ্চা ছেলেটির। লোকটি বাচ্চাটার মুখের ভিতর বন্দুক ধরতেই আরো ভয় পেল বাচ্চাটি। হঠাৎই সেখানে ঘেউঘেউ করতে করতে উপস্থিত হলো একটা কুকুর এতে আরো ঘাবড়ে যায় বাচ্চাটি। সাথে লোকটাও কিছুটা ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসে বাচ্চাটার কাছ থেকে এমন সময় হঠাৎই গুলির শব্দ আসতেই বাচ্চাটা ঘাবড়ে গিয়ে তাকালো সামনে। তার চোখের সামনেই অচেতন অবস্থায় পড়লো সেই ছোট্ট কুকুরটি যেটা কিছুক্ষন আগেই চেঁচিয়েই তাঁর কাছে আসতে নিচ্ছিল কুকুরের নিথর দেহ দেখে সাথে কুকুরটির ছটফট করা আর্তনাদ করা দেখে
‘শরীর কেঁপে উঠল আদ্রিয়ানের এমন সময় সেখানে আর কিছু দেখার আগেই চোখ খুলে তাকালো আদ্রিয়ান। সাথে সাথে ঘেমে যাওয়া শরীর নিয়ে চটজলদি বিছানা ছেড়ে লাফ মেরে উঠে বসলো সে। চারপাশে তাকাতেই সে বুঝতে পারলো আজ আবার সে একই স্বপ্ন দেখলো যে স্বপ্ন তাকে সেই ছোট বেলা থেকে এখনও ঘুমাতে দিচ্ছে না। আদ্রিয়ান নিজের মাথাটা চেপে ধরে বসে রইলো কতক্ষন তারপর বিছানার পাশে থাকা টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো পানিটা খেয়ে নিলো। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো সে রাত তখন দুটো বেজে পঞ্চান্ন মিনিট প্রায় তিনটের কাছাকাছি। জোরে এক নিশ্বাস ফেলে জানালার দিকে তাকালো সে। রাতের জোৎসা ভরা আলোতে প্রায় সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। আদ্রিয়ান কিছুক্ষন আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
‘ কবে আসবে সেদিন যেদিন আমার এই ভয়ংকর স্বপ্ন ভুলে নিশ্চিতে ঘুম হবে? কবে এই রাতের ছায়া আমার পিছু ছাড়বে…
ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেললো আদ্রিয়ান।’
____
পরেরদিন সকালে তুমুল বেগে দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হলো আহি। কারন আজ তার ভার্সিটি যেতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই সব হয়েছে কাল রাতে দেরি করে ঘুমানোর জন্য। কাল শেষ রাতে লাভ লেটার লিখতে লিখতে টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল আহি আর সেই ঘুম ভেঙেছে সকাল ৯ঃ০০টায়। ভাবতে ভাবতে বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশা করে চললো সে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। হয়তো প্রথম ক্লাস আজ মিস যাবে আহির।
ভার্সিটির ক্লাস শেষে নীরবের ক্লাসের সামনে উঁকি ঝুঁকি মারছে আহি। কিন্তু আশেপাশে কোথাও নীরবকে দেখছে না সে। হঠাৎই তার সামনে এসে বললো মীরা,
‘ তুমি এইভাবে উঁকি মারছো কেন আহি?’
মেয়েলি কন্ঠ শুনতেই হকচকিয়ে উঠল আহি। নিজের মাথাটাকে উপরে উঠাতেই মীরাকে দেখে মেজাজ বিগড়ে গেল তার। তবে তেমন কিছু না ভেবেই বললো আহি,
‘ না মানে?’
‘ জানি নীরবকে খুজতে এসেছো তাই না?’
মীরার কথা শুনে আহি অবাক হয়ে বললো,
‘ তুমি কি বুঝলে?’
‘ না বোঝার কি আছে তুুমি তো বেশিরভাগ সময় নীরবের জন্যই এই ক্লাসে আসো কিন্তু আজ তো নীরব নেই?’
এবারের কথা শুনে আহি আরো অবাক হয়ে বললো,
‘ নেই মানে কোথায় গেছে ভাইয়া?’
‘ তা তো জানি না তবে পিন্সিপালের সাথে বের হতে দেখলাম এইমাত্র।’
নীরবের কথা শুনে আহি মন খারাপ করে বললো,
‘ ওহ।’
‘ হুম।’
‘ ওকে থ্যাংক ইউ আপু।’
‘ ইট’স ওকে।’
উওরে আহি আর কিছুু না বলে মন খারাপ করে বেরিয়ে গেল ভার্সিটি থেকে। আর মীরাও কিছুক্ষন আহির যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে চললো নিজের গন্তব্যের দিকে….
______
হসপিটালে একজন লেডিস ডাক্তারের চেম্বারে চুপচাপ বসে আছে আদ্রিয়ান। একাই এসেছে আজ এমনিতে নিলয় আসে তার সাথে কিন্তু আজ সে একাই এসেছে। আদ্রিয়ানের ভাবনার মাঝেই সেখানে এসে উপস্থিত হলো একজন মধ্যম বয়স্ক লেডিস ডক্টর মিসেস লিনা। আদ্রিয়ানকে দেখেই বললেন উনি,
‘ আজ তুমি একাই এসেছো আদ্রিয়ান?’
ডক্টরের কথা শুনে আদ্রিয়ানও নীরব কন্ঠে বললো,
‘ হুম।’
আদ্রিয়ানের কন্ঠ যেন আজ একটু অন্যরকম লাগলো মিসেস লিনার। উনি ওনার চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
‘ কি হয়েছে আদ্রিয়ান তোমার কি মন খারাপ?’
ডক্টরের কথা শুনে আদ্রিয়ান মাথা নিচু করেই বললো,
‘ না তেমন কিছু নয়।’
আদ্রিয়ানের কথা শুনে মুচকি হেঁসে বললেন মিসেস লিনা,
‘ আমি কি তোমায় আজ থেকে দেখছি আদ্রিয়ান, সেই ছোট বেলা থেকে তুমি আমার কাছে আসছো, তোমাকে একটু হলেও বুঝতে পারি আমি কি হয়েছে বলো আমায়?’
মিসেস লিনার এবারের কথা শুনে আদ্রিয়ান ওনার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আমি কি কখনো ঠিক হবো না আন্টি?’
আজ যেন আদ্রিয়ানকে একটু বেশি আপসেট লাগছে মিসেস লিনার। উনি ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,
‘ তোমার সমস্যাটা তো তোমার শরীরে নয় আদ্রিয়ান, যে ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে। তোমার সমস্যাটা হলো ভয়। সেই ছোট বেলার স্মৃতি যেটা তুমি এখনও তোমার সাথে বয়ে নিয়ে চলছো,এই ভয়টা তোমাকে দূর করতে হবে আদ্রিয়ান।
‘ কিন্তু কি করে করবো? আমি তো চাই এটা আমার কাছ থেকে দূরে চলে যাক কিন্তু কিছুতেই যেতে চায় না।’
‘ একটা জিনিস কি আদ্রিয়ান তুমি তোমার ভয়কে যত আশকারা দিবে সে ততই তোমায় গ্রাস করবে। তখন তুমি খুব ছোট ছিলে তাই আমার কথাগুলো বুঝতে পারো নি কিন্তু এখন তো বড় হয়েছো এবার তো বুঝতে হবে।’
মিসেস লিনার কথা শুনে আদ্রিয়ান মন খারাপ করেই বললো,
‘ আমি তো চাই ডক্টর আমার ভয়টা চলে যাক কিন্তু সেই রাতের দৃশ্য কিছুতেই আমায় ছাড়তে চায় না,আমার মস্তিষ্কে মিশে গেছে একদম কিছুতেই বের হতে চায় না।’
‘ ডোন্ট ওয়ারি আদ্রিয়ান চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে আসলে ছোট বেলার ভয় তো তাই এমন হচ্ছে তবে বেশি ভেবো না সব ঠিক হয়ে যাবে। টেনশন কম নেও,আর নিজেকে সময় দেও দেখবে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
উওরে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মাথা নাড়ালো আদ্রিয়ান। এরই মধ্যে সেখানে একজন নার্স এসে বললো,
‘ ম্যাডাম আপনাকে বড় স্যার ডাকছে?’
উওরে লিনাও বলে উঠল,
‘ ঠিক আছে তুমি যাও আমি আসছি।’
‘ ওকে ম্যাডাম।’
বলেই নার্সটি চলে গেল। নার্সটি যেতেই মিসেস লিনা তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে তারপর বললো,
‘ তুমি কি কিছুক্ষন বসবে আদ্রিয়ান?’
‘ না, আমার কিছু কাজ আছে।’
‘ ওকে আদ্রিয়ান বেশি টেনশন নিও না সব ঠিক হয়ে যাবে।’
উওরে হাল্কা হেঁসে বেরিয়ে গেল আদ্রিয়ান হসপিটালের ভিতর থেকে। মিসেস লিনা হলো আদ্রিয়ানের ছোট বেলার সাথী,আদ্রিয়ানকে একদম ছেলের মতো ভালো বাসেন উনি। আদ্রিয়ানের বাবা মা নেই। সেই ছোট বেলায় নিজের একটা ছোট্ট ভুলের জন্যই আজ সে অনাথ? সব থেকেও যেন কিছু নেই তাঁর।’
____
মন খারাপ করেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল আহি। হাতে তার কাল রাতের লেখা সেই চিঠি। আহির এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে সে কোনোদিন বলতেই পারবে না নীরবকে। যতই বারই ভালোবাসার কথা বলতে গেছে ততবারই কোনো না কোনো সমস্যায় পড়তে হয়েছে তাকে। আহির ইচ্ছে করছে চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দিক রাস্তায়। এই ভেবেই চিঠিটা খাম থেকে বের করে খুলে হাতে নিলো কিন্তু ছিঁড়তে গিয়েও ছিঁড়তে পারলো না।
‘ ধুরো কিছু ভালো লাগছে না।’
হঠাৎ একটা বাতাস আসতেই আহির হাত আলগা থাকায় হাতে থাকা চিঠিটা উঁড়ে গিয়ে পড়লো একটা গাড়ির পিছনে। আহি চিঠিটার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ তুইও যা একটা তো হনুমান নিয়ে চলে গেছে আরেকটা বাতাস তুই নিয়ে যা।’
বলেই আহি এগিয়ে গেল সামনে থাকা গাড়িটার কাছে। তারপর বেশি কিছু না ভেবে চিঠিটা নিচ থেকে উঠিয়ে সামনে তাকাতেই আদ্রিয়ানকে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। শুকনো ঢোক গিলে বললো আহি,
‘ উনি এখানে কি করছে? ওহ সিট এখন কি করবি আহি? তোকে এখানে দেখলে তো আবার রেগে যাবে,, না জানি এবার রেগে গিয়ে সত্যি সত্যি তের গলা চেপে ধরে। কিন্তু আশেপাশে তেমন কিছু নেই ও তো যে তুই লুকাবি।’
এই বলে আশেপাশে তাকিয়ে আহি গাড়িটার কাছে এসে পিছনের দরজাটা খুললো গাড়ি লক না থাকায় খুশি হয়ে আহি গাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লো।’
অন্যদিকে আদ্রিয়ান সেও হেঁটে এসে ওই গাড়িতেই বসলো কারন গাড়িটা আদ্রিয়ানেরই। আদ্রিয়ান ড্রাইভিং সিটে বসে সিট বেল লাগিয়ে ছোট একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
এদিকে আহি পড়লো মহা বিপদে।
‘ একেই বলে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। কি দরকার ছিল এই গাড়িটায় বসার উফ এখন কি করি?’ আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?’ ধুর সবসময় আমার সাথেই এমন কেন হয় খেলমু না যা।’
আদ্রিয়ান মন খারাপ করেই এগিয়ে গেল অনেকদূর হঠাৎই লুকিং গ্লাসে তাকাতেই পিছনে কিছু একটা আছে দেখে পিছন ফিরে আহিকে দেখে মুহূর্তে মেজাজ বিগড়ে গেল তাঁর চটজলদি গাড়িতে ব্রেক কষে রাগী কন্ঠে বললো,
‘ ইউ?’
আদ্রিয়ানের কথা শুনে ভয়ে শুঁকনো ঢোক গিলে হাল্কা হাসলো আহি।’
!
!
!
!
!
#চলবে…..
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। আর গল্প কেমন লাগলো অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবে]
#TanjiL_Mim♥️