#৫ম_তলার_মেয়েটাশেষ_পর্ব

0
689

#৫ম_তলার_মেয়েটাশেষ_পর্ব

‘রুপাঞ্জেল’ বিউটি পার্লারে সাজানো হচ্ছে নওমিকে বিকেল চারটা থেকে, সন্ধ্যা সাতটায় বিয়ে। পম্পি আর স্বর্ণা সাথে আছে ।অনেক কষ্টে পম্পিকে শাড়ি পড়তে রাজি করিয়েছে নওমি আর স্বর্ণা।নওমির বিয়ের শাড়ির রং এর সাথে মিলিয়ে স্বর্ণা , নিজের এবং পম্পির জন্য শাড়ি কিনেছে,তিন বান্ধবী একই রং এর শাড়ি পড়বে।সবার সাজ দেখে পম্পির অস্থির লাগছে আর নওমির এত ধৈর্য্য দেখে সে ভাবছে -পার্লার থেকে সেজে বের হওয়ার পর সব কনেকে একটা করে রিওয়ার্ড দেয়া উচিত,বাব্বা এটা অসম্ভব এক ধৈর্য্যের পরীক্ষা ।এই পরীক্ষায় সে কোন দিন ও বসতে পারবে না।
কাউকে পছন্দ হলে সোজা কাজি অফিসে বিয়ে করে ফেলবে।

দুই নাম্বার রোড সম্পূর্ণ আলোতে ঝলমল করছে।
হাজেরা সব আত্নীয়দের দাওয়াত করেছেন। মেয়ের বিয়ে বলে কথা!গতকাল নওমির গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছিলো।কেউ কেউ গতকাল এসে রয়ে গেছে। অনেকে আজ এসেছে। বাড়িতে লোকজন গিজগিজ করছে।অনেকে আবার সরাসরি কমিউনিটি সেন্টারে চলে যাবে।

হাজেরা দম ফেলারও সময় পাচ্ছেন না।জানতেন তাঁর ছেলেরা আসবে না তবুও বলেছিলেন আসতে, আসেনি। আত্নীয়রা তাকে উদ্দেশ্য করে বলাবলি করলো, তাঁর অনেক বড় হৃদয় , না হলে একটা এতিম মেয়েকে দত্তক নেন আর ওর বিয়েতে এত টাকা খরচ করেন!
এর আড়ালে অবশ্য কানাঘুষা,ফিসফাস, সমালোচনা চলছেই।এই সব কোন কিছুতেই হাজেরা কান দিচ্ছেন না।যার যা ইচ্ছা বলে বলে, শুনে শুনে মন-প্রাণ ঠাণ্ডা করুক সবার। এই সব ফালতু কাজে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।
তিনি ভালো করেই জানেন, নওমিকে দত্তক নেওয়ার পর নিকটাত্মীয়দের ঘুম হারাম হয়ে গেছে সম্পত্তির ভাগ পাবে না এই চিন্তায়। যদিও নিজের দুই ছেলে ছাড়া তোফাজ্জলের সম্পত্তিতে কারো অধিকার নেই, হাজেরার ক্ষেত্রেও তাই। তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তির ভাগাভাগি অনেক আগেই ভাই-বোন দের মাঝে হয়ে গেছে। কিন্তু তবুও সবাই আশা করে ছিল।

তোফাজ্জলের ছোট বোন শেফা এসেছে মেয়ে তাহিয়াকে নিয়ে।শেফার স্বামী রশিদ আসেনি। আসলে এই মুখ নিয়ে সামনে আসার মতো সাহস রশিদের নেই। তবে শেফা স্বামীর এই দোষকে মন থেকে মেনে না নিলেও ভাই ভাবীর উপর খুব রেগে আছে । বেছে বেছে এই মেয়েকেই কেন দত্তক নিতে হবে -যার সাথে রশিদের এত বড় কথা উঠেছে? সে ভাবছে ভাবী হয়তো ইচ্ছে করে তাকে কষ্ট দিতে এই কাজ করেছে।

জালেরা বেগম মনে হয় মেয়ের মনের কথা বুঝতে পারলেন। তিনি শেফার কাছে এসে বললেন-
—যার যার ভাগ্য সাথে কইরা নিয়াই জন্মায়,কেউ কারোটা নিতে পারে না। তোমার জন্য তোমার ভাই যা কিছু করে, খুব কম ভাইয়েরাই এতটা করে। তাঁর উপর তোমার খুশি থাকা দরকার। ভাই ভাবীর সিদ্ধান্তরে সম্মান জানানো দরকার। তাঁরা তো অনেক চিন্তা ভাবনা কইরাই এই সিদ্ধান্ত নিছে।
—আম্মা আমাকে এই সব কেন বল?আমি কিছু বলছি?
—তুমি আমার পেটের মেয়ে তোমারে আমি বুঝবো না।তোমার মুখ দেইখাই অনেক কিছু বুঝতে পারি।এমনি কইরা মুখ গুমড়া কইরা বইসা থাইকো না।একটা ভালো কাজ হইতেছে খুশি হও, মেয়েটার জন্য দোয়া কর।
চল চল সবাই এইবার রওনা হই কমিউনিটি সেন্টারে।

নওমির মেকআপ শেষ হলো,এবার শাড়ি পড়ানো হচ্ছে।স্বর্ণা মোটামুটি পড়তে পারে নিজেই তবুও একজন হেল্প করছে কিন্তু জীবনে গায়ে শাড়ি না জড়ানো পম্পিকে শাড়ি পড়ানো হলে তার নিজের কাছে একটা অদ্ভুত প্রাণী মনে হচ্ছে আর সে হাঁটতে গেলেই সবার সামনে পড়ে যাবে।সে বলল-
—যদি হঠাৎ করে খুলে যায়?
এই শুনে তাকে শাড়ি পরিয়েছে যে মেয়েটা সে বলল-
—কোন ভাবেই খুলবে না বরং এই শাড়ি খোলার সময় আপনার যথেষ্ট কষ্ট হবে।এত এত সেফটিপিন দিয়ে আটকে দিয়েছি।

পম্পি যেন নিজেকেই নিজে চিনতে পারছে না।
স্বর্ণা বলল-
—আজ কনের বদলে সবাই তোকে দেখবে।
নওমিও এই কথায় সায় দিয়ে হাসলো দুজন। পম্পি বলল-
—আমি যদি পরে যাই না,তখন তোদের মজা বুঝাবো।

তিন বান্ধবী একই রংয়ের শাড়ি পড়ে তিন ভিন্ন আঙ্গিকের সৌন্দর্য নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো। নওমিকে বৌয়ের সাজে অপূর্ব লাগছে,যেন ভুল করে একটা পরী নেমে এসেছে।পরী বলতেই সবার চোখের সামনে ভেসে উঠে অপূর্ব সুন্দর কোন অপ্সরা , তাই হয়তো এই উপমাটাই সবাই জায়গামতো প্রয়োগ করে।প্রতিটা মেয়েকেই বৌয়ের সাজে পরীর মতো লাগে।

বৌ এসেছে এই কথাটা বরের কানেও গেছে আর তখন থেকেই বরের মন আনচান করছে বৌকে দেখার জন্য।

ওদের একটু বেশিই দেরি হয়ে গেলো।বর আগেই চলে এসেছে।এই খবর জেনে নওমির খুব লজ্জা লাগছে।পম্পি বলল-
—সারাজীবন তো হাসব্যান্ডের জন্য অপেক্ষা করে করেই জীবন যাবে আজ না হয় একটু অপেক্ষা করলোই বা।
অনেকে তো হাসাহাসি করছে এই বলে, বরের আর তর সইছে না তাই বৌয়ের আগেই হাজির।

হঠাৎ রজনীকে সামনে দেখে নওমি অবাক।নওমি উঠে জরিয়ে ধরে বলল-
—রজনীমণি তুমি এসেছ?
—আসবো না আবার আমাদের নওমির বিয়ে। আমাকে তো আসতেই হবে। মাশাআল্লাহ কি সুন্দর লাগছে !!!
পম্পিকে দেখে তো আমি একদম চিনতে পারিনি।
—চিনবে কি ভাবে আমাকে তো এক অদ্ভুত জন্তু বানিয়ে দিয়েছে!
—একদম না, খুবই সুন্দর লাগছে।

রজনীর আসার কথা পম্পি আগেই জানতো নওমিকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য ওকে আগে জানানো হয়নি। রজনীর ইন্টারভিউ আছে তাই তাকে ঢাকায় থাকতে হবে। নওমির বাসায় এখন থেকে পম্পি একাই থাকবে। রজনীর যত দিন ঢাকায় থাকবে পম্পির সাথেই থাকবে। নতুন ভাবে রজনীকে পথ চলা শিখতে হবে।

হাজেরা ভাড়াটিয়া সবাইকে দাওয়াত করেছেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে পারু এসেছেন।সিমি তার ছোট্ট মেয়েকেও নিয়ে এসেছে,সবাই আদর করছে। মেয়ের প্রতি সিমি আর পরশের ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ দেখে পারু অনেক খুশি আর নিশ্চিন্ত।ঝিমি সব সমস্যা কাটিয়ে ওঠে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে,তবে মাঝে মাঝে সেই দুঃসহ স্মৃতি তার মনে পড়ে যায়।তাদের ভাই শাওন এখন দায়িত্ব এড়িয়ে যায় না,যতটুকু পারে পরিবারের জন্য করতে চেষ্টা করে।

সবাই একে একে নওমির সাথে দেখা করছে,ছবি তুলছে।তার চোখ খুঁজছে তার মামাকে। পম্পিকে আস্তে বলল-
—মামাকে দেখছি না,একটু খোঁজ করবি?
পম্পি খবর নিয়ে জানতে পারলো মামা এখনো রাস্তায়।হয়তো আর আধা ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন।তাশফির বাবা তাড়া দিচ্ছেন বিয়ে পড়ানো হয়ে যাক।হাজেরা, তোফাজ্জলকে বললেন-
—তুমি গিয়ে বল,নওমির মামা পৌঁছানোর পরেই বিয়ে হবে।উনারা একটু অপেক্ষা করতে পারবেন না?
এই কথা শুনে নওমির ভালো লাগছে, হাজেরা আন্টি তার মনের কথাটাই বলেছেন। কয়েকদিন আগে জালেরা বেগম বলেছিলেন , ‘নওমি এখন থাইকা হাজেরা তোমার মা,তারে মা বইলা ডাইকো।হাজেরা তখন বলেছিলেন,’আম্মা হঠাৎ করে বলা যায়, আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হোক আমি যে ওর মা সেটা আগে আমি আমার কাজের মাধ্যমে ওকে বুঝাই।’
সেদিন নওমির খুব ভালো লাগছিলো হাজেরার কথা শুনে।
আসলে আগে হাজেরা কে দেখলেই নওমির মনে হতো হাজেরা খুব অহংকারী একজন মানুষ। যে নিজেকে নিয়ে থাকতেই ভালোবাসে, তাঁর আশপাশের মানুষকে নিয়ে ভাবার অবকাশ তাঁর নেই। কি আশ্চর্য কত ঘটনাপ্রবাহ মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়, অনেক সময় কতটা বদলে দেয়!!
শুধু মানুষই বদলায়, অমানুষ কখনো বদলায় না।

নওমির মায়ের মুখটা বার বার মনে পড়ছে। বেঁচে থাকলে হয়তো হাজেরার মতোই দায়িত্ব পালন করতো।

হাজেরা চেষ্টা করছেন তাশফির মা তাবাসসুমের সাথে একটু কাছাকাছি হতে কিন্তু তাবাসসুম একটু দুরত্ব রেখে চলছে।হাজেরা চিন্তায় পরে গেলেন ,এই মহিলা নওমিকে না আবার জ্বালাতে শুরু করে। শাশুড়ি ভালো না হলে মেয়েটার জীবনে কষ্ট নেমে আসবে। এই নিয়ে পরে ভাবা যাবে আগে বিয়েটা ভালোভাবে হয়ে যাক।যদি নওমিকে কিছু করে তিনি কি ছেড়ে দিবেন?

হোসেন তাঁর ছেলে -মেয়ে শাপলা, সজিবকে নিয়ে এসেছেন শুধু। তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে আসেননি। তিনি জানেন শাপলার মা আসলে কোন না কোন ঝামেলা বাঁধাতোই। অনেক কষ্টে তাকে পিছু ছাড়ানো গেছে। মামাকে দেখে নওমির যেন প্রাণ ফিরে এলো এতক্ষণ টেনশনে অস্থির হয়ে ছিল। নওমি বার বার মামির কথা বলতে লাগলো।তবে শাপলা, সজিবকে পেয়ে অনেক ভালো লাগছে।

এবার বিয়ের কার্যক্রম শুরু হলো। খুব সুন্দর ভাবে বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলো।জালেরা বেগম কেঁদে ফেললেন,সেটা দেখে হাজেরার চোখেও পানি এলো।পম্পির হঠাৎ মনে হলো নওমি অনেক দূরে চলে যাচ্ছে বুকটা মুচড়ে উঠলো। তার চোখটাও যেন ভিজে উঠতে চাইলো।

বিয়ে কি আসলেই কান্নাকাটি করার মতো বিষয়?
আসলে বিয়ে মানে অনেক দায়িত্ব ,নতুন পরিবেশ,
নতুন মানুষ আর দুটি মানুষের একটু নিজস্বতা। এই জন্যই জীবনে বিভিন্ন ভাবে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর সাথে একটু দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। যেই মানুষটাকে চাইলেই পাশে পাওয়া যেতো বিয়ের পরে তখন আর আগের মতো করে পাওয়া যায় না সেই সময় একটা শূন্যতা অনুভব হয়। যুগ যুগ ধরে সেই শূন্যতার কথা ভেবেই হয়তো কান্নার একটা আবহ তৈরি হয়ে যায় বিয়ে বাড়িতে। আর সংক্রমনের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

বিদায় বেলায় জালেরা বেগম তাশফির হাত ধরে অনেক কিছু বললেন। হাজেরার চোখ তোফাজ্জলকে খুঁজতে লাগলো, দূরে তাকে দেখতে পেয়ে হাতের ইশারায় ডাকলেন।
—মেয়েকে জামাইয়ের হাতে তুলে দাও। হাজেরার এই কথায় তোফাজ্জল আশ্চর্য হলেও খুব খুশি হলেন। নওমির হাত তাশফির হাতের উপর রেখে বললেন-
—আমার মেয়েটাকে কখনো কষ্ট দিও না বাবা।
আর কিছু বলতে পারলেন না,গলাটা যে ধরে এলো।
নওমি এই প্রথম’ বাবা’ বলে তোফাজ্জলকে জড়িয়ে ধরলো।
তোফাজ্জল এক অদ্ভুত শান্তি পাচ্ছেন। নিজের সন্তান আজ তাকে বাবা বলে ডাকছে এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে?
নওমির মনে হলো ‘বাবা আসলেই এক অপার্থিব সুখের নাম।দেরিতে হলেও আমি তা পেয়েছি।’

তাশফিদের বাড়িটাও আলোকিত হয়ে আছে। নতুন এক অজানা অধ্যায়ের সূচনা হলো।বুকের ভিতরে টিপ টিপ করছে নওমির।সে স্বর্ণার হাত ধরে রইলো শক্ত করে।স্বর্ণাও যেন বুঝাতে চাইলো, ‘চিন্তা করিস না,আমি আছি তো।’

নওমির অস্থির মন কেমন করছে, অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। বিভিন্ন ফুলের ঘ্রাণে ভেসে যাচ্ছে ঘর। ভয়,সংকোচ আর লজ্জা ঘিরে ধরলো তাকে।
ঠিক তখন পরম নির্ভরতার হাতটা তার হাতের উপর অনুভব করলো।তাশফি আর একটু কাছে এসে নওমির হাতটাকে মুঠোয় ভরে নিয়ে বলল-
—কত বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে আজ তোমাকে আমার করে পেয়েছি, কথা দাও কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না।যত ঝড় ঝাপটাই আসুক না কেন একসাথে মোকাবেলা করবো।
—আমৃত্যু সাথে থাকবো।কথা দিলাম। তুমিও কথা দাও।
—কথা দিলাম।

সমাপ্ত

(প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যারা এই গল্পের সাথে ছিলেন সবাইকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা)

#ফাহমিদা_লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here