#বাবুইপাখির_অনুভূতি🕊️পর্বঃ৫২
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🕊️
—
_________________
সময়টা যেন এগোতেই চাইছে না আজ! বারবার মনে হচ্ছে আহির আজকের রাতটা খুবই দীর্ঘ তাঁর জন্য। তাই তো মিনিট পাঁচেক আগে ঘুম ভাঙতেই ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকাতেই চোখটা বিষন্ন তাঁর, কারন ঘড়ির কাঁটায় তখন কেবল চারটা বাজে। বাহিরে এখনো অন্ধকার বিদ্যমান। চরম ভাবে বিষন্ন মাখা মুখ নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো আহি। ঘুমে চোখ জ্বলছে তাঁর অথচ ঘুমাতে পারছে না সে। মাথার ভিতর শুধু আদ্রিয়ানের লেখা কথাগুলো ভনভন করছে। জোরে এক নিশ্বাস ফেলে সামনের টেবিলের দিকে তাকালো আহি, আদ্রিয়ানের লেখা চিঠিটা এখনো সেখানেই পড়ে আছে। চিঠির উপরে কালো একটা বলবেন রাখা আহি রেখেছিল কাল যেন বাতাসের তীব্রতায় চিঠিটা উড়ে না যায়। যদিও বাহিরের বাতাসে অল্প স্বল্প নড়ছে সেটা। আহি আনমনেই এগিয়ে গেল চিঠিটার দিকে আদ্রিয়ানের লেখা পুরো কথাগুলো পড়তে ভীষণভাবে ইচ্ছে করছে তাঁর। তাই নিজের ইচ্ছেটাকেই এই মুহূর্তে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে গেল সে টেবিলের দিকে। চেয়ার টেনে বসে পড়লো আবার। টেবিলের উপরে থাকা ল্যাম টাইটটা অন করে আবার মনোযোগ দিলো আদ্রিয়ানের লেখা চিঠিটার দিকে। যেখানে লেখা,
‘ তুমি কি জানো আহি? তুমি আমার জীবনে হুট করে আসা এক দূর্ঘটনা। এমনই এক দূর্ঘটনা যে দূর্ঘটনাকে আমি চাইলেও মুছতে পারছি না আমার মন থেকে, বের করতে পারছি না আমার মাথা থেকে। যার আঘাত এখনো পোয়াতে হচ্ছে আমায়, জানি না এই ক্ষতর আঘাত আধও কখনো কমবে কি না?’
‘ জানো তো কাল আমি সুইজারল্যান্ড চলে যাচ্ছি। জানি না আবার কবে ফিরবো। তবে আনুমানিক ছয় মাস তো লাগবেই আমার। হয়তো এই ছয় মাস তোমার সাথে আমার কোনো দেখা হবে না, কথা হবে না। জানি না আগামী ছয় মাস কিভাবে তোমায় ছেড়ে কাটাবো আমি? ইচ্ছে ছিল তোমাকে আমার অনুভূতিগুলোর কথা নিজ মুখে বলবো কিন্তু সাহস হয়ে উঠলো না আর সময়েও হয়তো কুলাতো না। তাই এই চিঠি।’
অবশেষে এতটুকু বলবো আহি, এই ছয় মাস যদি তোমাকে ক্ষনে ক্ষনে আমাকে মনে করায়, আমার স্মৃতি তোমাকে কাঁদায়, আমার শূন্যতা তোমায় ফিল করায় তাহলে প্লিজ একটি বার আমার কাছে এসে বলো,
‘ ভালোবাসি তোমায়। বিশ্বাস করো কোনো দ্বিধা ছাড়াই তোমায় সেদিন জড়িয়ে ধরবো আমি। আর বললো,
‘ আমিও বড্ড ভালোবাসি তোমায়।’
আর যদি এমনটা না তাহলে আমি তোমায় কথা দিচ্ছি এই আদ্রিয়ান আর কখনোই তোমার সামনে ভালোবাসার আবেদন নিয়ে আসবে না। বিরহ নিয়ে কাটাবে সারাজীবন তারপরও তোমার জীবনের কাটা হয়ে দাঁড়াবে না সে।’
অতঃপর আর দুই লাইন বলতে চাই তোমায়। যদি এই ছয় মাস আমাকে মনে করায় তোমায়।আর বুঝিয়ে দেয় ‘তুমিও ভালোবাসো আমায়’। তবে দেখা হবে নিচের কয় লাইনের কাব্যের তালেতালে ছন্দের মেলায়,
‘ দেখা হয় নি সেথায় আমাদের,
যেথায় আছে এক ঝাঁক শালিকের মাঝে সবুজের মেলা?’
‘ সবুজ পেরোতেই নদীর মালা,
নদীর বুকে টগরের ভিঁড়ে শাপলার ছড়াছড়ি, মুগ্ধ হবে তুমি প্রকৃতির অপলক সৌন্দর্যের মায়ায়।’
‘ উত্তেজিত হয়ে যখন আশেপাশে খুঁজবে আমায়
তখনই ঢেউয়ের ভিড়ে নৌকা মেলে মাঝি বলবে তোমায় ‘যাবে কই?’
‘ তুমি বলবে, দূর সীমানায় সবুজের মাঝে বেঞ্চের পাড়ায়, যেথায় আছে বাবুইপাখির ভয়ংকর উড়াউড়ি।’
যদি পেয়ে যাও সন্ধান,
‘ তবে তীরে এসে খুঁজবে আমায়, আর বলবে এসেছি আমি?’
‘ উতলা হয়ে খুঁজো না খুব, চলে এসো ফুলের ভিঁড়ে পাপড়ির মায়ায়!’
আমিও অপেক্ষায় থাকবো তোমার।’
ইতি,
আদ্রিয়ান!’ ❤️
পুরো চিঠিটা পড়ে যেন হতভাগ আহি, এমন জায়গা কোথায় মিলবে তাঁর? যেথায় প্রকৃতির এতগুলো সৌন্দর্য একসাথে ঘুরপাক খায়।’
কথাগুলো যখন ভাবলো আহি সেই মুহূর্তেই দেয়াল ঘেঁষে থাকা একটা ছোট্ট টিকটিকি বলে উঠল,
‘ ঠিক ঠিক ঠিক।’
আবারও বিষন্ন আহি। নিরালায় তাকিয়ে রইলে সে আকাশের পানে।’
_____
পরন্ত বিকেল বেলা। আনমনেই নিজের খরগোশ ছানাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে আহি। আজ কেবল দু’দিন হলো আদ্রিয়ানের সাথে আহির একদমই যোগাযোগ বন্ধ। না হয় মেসেজে কথা আর নাই হয় ভিডিও কলে দেখা। এই দুইদিনেই পুরো ব্যাকুলতার শীর্ষে আহি। আগামী দিনগুলো কি করে কাটাবে ভাবতেই যেন বুক চিঁড়ে কান্না আসে তাঁর। অত্যাধিক ধারে সে ব্যাকুল হয়ে আছে আদ্রিয়ানের সামনে গিয়ে ভালোবাসি বলবে বলে। সাথে ওই প্রকৃতিও দেখার জন্য। আহি জানে না আদ্রিয়ান যে জায়গার কথা তাঁকে বলেছে সেটা আধও কোথায় আছে। শেষের ছন্দগুলো নিজে অন্য পৃষ্ঠায় লিখে নীরব, অথৈ, রিনি, শুভ এমনকি নিলয়কেও দেখিয়েছে সে৷ কিন্তু কেউই এমন জায়গার হদিস বলতে পারলো না তাঁকে। আধও এমন জায়গা আছে কি না কে জানে। কিন্তু আদ্রিয়ান যখন বলেছে তাহলে নিশ্চয়ই আছে। আশেপাশে না থাকলেও দূরে কোথাও নিশ্চয়ই আছে। সেই না দেখা হওয়া জায়গা, শালিকের ভিঁড়ে সবুজের মাঠ, নদী, নদীর বুকে শাপলা ফুল, নৌকা মাঝি, বাবুইপাখি আর সবশেষে ফুলের পাপড়ি। জোরে নিশ্বাস আহি। মনটা একদমই নির্বিকার তাঁর। হঠাৎই আহির চোখ গেল সামনের সেই ভাঙাচোরা বাড়িটাই দিকে, মনে পড়লো তাঁর সেদিনের কথা যেদিন এই খরগোশ ছানাকে ধরতে গিয়ে আদ্রিয়ানকে দেখেছিল সে। আদ্রিয়ান মাথা ঘুরিয়ে পড়েছিল তাঁর বুকে। ছোট বেলার কথাও মনে পড়লো তাঁর অল্প স্বল্প যদিও বেশি কিছু মনে নেই। আহি বেশি কিছু না ভেবে খরগোশ ছানাকে আদর করতে করতে এগিয়ে গেল সামনে আর বললো,
‘ জানিস জীবনটা হলো গোলকধাঁধা। জীবনে অনেককিছু হারিয়েছি বুঝলি প্রথম ভালোবাসা, বাবুইপাখি, কুকুর ছানা। আরও কত কি? কিন্তু এই মুহূর্তে আদ্রিয়ান আর তোর কথা ভাবলে মনে হয় যা হারিয়েছি তাঁর থেকে ভালোকিছু পেয়েছি। কিন্তু আফসোস হলো আমি ভালো সেই জিনিসটাকে কাছে পাচ্ছি না,তবে আমি জানি খুব তাড়াতাড়ি আমি পেয়ে যাবো তাঁকে। আর যেদিন পাবো সেদিন আর ছাড়বো না বুঝলি একদম তোর মতো যত্ন করে নিজের কাছে রেখে দিবো।’
বলতে বলতে এগিয়ে চললো আহি এভাবেই দিন কাটছিল দুদিন থেকে চারদিন, চারদিন থেকে ছয় দিন, ছয় দিন থেকে বারো, বারো থেকে চব্বিশ আর বলতে না বলতেই কেটে গেল পুরো এক মাস। এবার আহি ধীরে ধীরে ভিতর থেকে ভেঙে পড়ছে, সময় যেন একদম কাটতেই চায় না তাঁর। কষ্ট হয় ভীষণ। রোজ রাতে আদ্রিয়ানের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় তাঁর কিন্তু বলে না। আদ্রিয়ানও তাঁকে ফোন করে না। এতে যেনো আরো বেশি কষ্ট হয় আহির। একবার কি ফোন করা যায় না তাঁকে খুব নাকি ভালোবাসে তাহলে ফোন কেন করে না? একবারও কি ইচ্ছে করে না আহি নামের এই মেয়েটার সাথে কথা বলতে। ভেবে পায় না আহি, বুকের ভিতর অসম্ভব যন্ত্রণা হয় তাঁর। শূন্যতা ফিল করতে করতে যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে। এত যন্ত্রণা কি খুব বেশি পাওয়ার দরকার ছিল। আকাশ পানে তাকিয়ে বললো আহি,
‘ আপনার কি সত্যি আমার সাথে একবারও কথা বলতে ইচ্ছে করে না আদ্রিয়ান, সামনে এক্সাম আসছে আপনার চিন্তায় সেটাও হচ্ছে না?’
মনের মাঝে অনেকটা অভিমান নিয়ে এগিয়ে চললো আহি। কিন্তু সে তো জানে না তাঁর থেকেও বেশি ব্যাকুল হয়ে আছে সুইজারল্যান্ডে থাকা মানুষটি। রোজ রাতেই ভাবে আহিকে একবার কল করবে কিন্তু কোথাও যেন এক সংকোচ এসে ভর করে তাঁকে তাই আর কল করা হয় না। আদ্রিয়ান পণ করেছে আর যা কথা হবে সব সামনাসামনি। যদিও সে জানে না আহির মনে কি চলছে? ও কি আসবে আধও তাঁর বলা সেই জায়গায়? ভেবে পায় না আদ্রিয়ান। জানালার দিকে আনমনেই তাকিয়ে রইলো আদ্রিয়ান, অন্ধকারে টুইটুম্বর চারপাশ। আজ ভীষণই ক্লান্ত আদ্রিয়ান তবে শরীর নয় মন। বুকের হাত রাখলো আদ্রিয়ান, আর বললো,
‘ কবে শেষ হবে এই দুরত্ব, আর আমি জানবো তোমার অবস্থা আহি। তুমি আসবে সেখানে, নাকি অপেক্ষা করাবে আমাকে? কে জানে?’
____
বিকেল সাড়ে পাঁচটার কাছাকাছি।’
সরু রাস্তা পেরিয়ে উঁচু পুলের ইটের তৈরি রেলিং ধরে হাঁটছে আহি।’ এটা হলো সেই জায়গাটা যেখানে আদ্রিয়ান তাঁকে নিয়ে এসেছিল নীরবকে ভোলাতে। চেঁচিয়ে নিজের অনুভূতিগুলোকে বাহিরে বের করেছিল সে। কিন্তু কে জানতো এক অনুভূতি ছাড়াতে আরেক অনুভূতি এসে ভর করবে তাঁকে। আহি আনমনেই হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল পুলের নিচে। ভরা জঙ্গলে ঘেরা চারপাশ। হঠাৎই কিছু একটার টুং টাং শব্দ কানে ভেসে আসলো তাঁর কানে। আহি বেশ অবাক হয়ে এগিয়ে গেল সামনে। কতদূর এগোতেই চোখ পড়লো আহির একজন বৃদ্ধ মানুষের দিকে। লোকটি পড়নে কালো পাঞ্জাবি, সাদা লঙ্গি সাথে মাথায় কালো ওড়না নাকি গামটা প্যাঁচানো ঠিক বুঝতে পারছে না আহি, মুখ ভর্তি সাদা দাঁড়ি। হাতে তার দোতারা। সেটা নিয়েই টুংটাং শব্দ করছে সে। আহি সেটারই শব্দ পেয়েছিল মাত্র। আহি বুঝতে পেরেছে উনি হয়তো একজন বাউল। আহি আনমনেই এগিয়ে গেল সেদিকে। একটা গাছের নিচে চুপটি করে বসে রয়েছে বাউল, চারপাশে গাছপালা ভর্তি সেই গাছ থেকেই আসছে মন মাতাল করা বাতাস। বাতাসের তীব্রতা খুবই। বাতাসে ভীষণভাবে চুল উড়ছে আহির, আনমনেই সে এগিয়ে গেল বাউলের কাছে।’
এদিকে হঠাৎই দোতারা বাজাতে বাজাতে গান ধরলো সেই বাউল,
‘ ঘড় কুটার এক বাসা বাঁধলাম বাবুইপাখির মতো
এই হৃদয়ের ভালোবাসা, দিলাম আছে যত।’
আহি যেন বাউলটির কন্ঠ শুনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো ওখানেই। এত সুন্দর গলা।’
এদিকে বাউল দোতারায় চার পাঁচ বার টুংটাং শব্দ করে আবারো বলতে শুরু করলো,
‘ ঘড় কুটার এক বাসা বাঁধলাম বাবুইপাখির মতো
এই হৃদয়ের ভালোবাসা, দিলাম আছে যত।’
‘ একটা ময়না পাখি সেই বাসা….য়
পুসি কত ভালোবাসায়?”
তারে চোখে চোখে রাখি_
উইড়া যেন না যায় আমার পোষা ময়না পাখি,পাখি চোখে চোখে রাখি
উইড়া যেন না যায় আমার পোষা ময়না পাখি!’
‘ ঘড় কুটার এক বাসা বাঁধলাম বাবুইপাখির মতো
এই হৃদয়ের ভালোবাসা, দিলাম আছে যত।’
এতটুকু বলে আবারো দোতারায় সুর টানলো বাউল। আহি আনমনেই গিয়ে বসলো বাউলের পিছনে গাছের সাথে হেলান দিয়ে কেমন এক অনুভূতিতে চলে গেছে সে। বাউলের গানের তালে তালে যেন আদ্রিয়ানকে ফিল করছে সে। এদিকে বাউল আবারো গাইতে শুরু করলো,
‘ ফাঁক পাইলে সেই ময়না পাখি, যদি গো পালায়?'(২)
সকাল বিকাল তাই পাখিরে পুষি দুধ কলায়।’
পাখির সনে,
আমার সনে,
ভাব হয়েছে মনে মনে!'(২)
‘ তবু ভয়ে থাকি। উইড়া যেন না যায় আমার পোষা ময়না পাখি, পাখি চোখে চোখে রাখি
উইড়া যেন না যায় আমার পোষা ময়না পাখি।’
‘ ঘড় কুটার এক বাসা বাঁধলাম বাবুইপাখির মতো
এই হৃদয়ের ভালোবাসা, দিলাম আছে যত।’
এতটুকু গেয়ে জোরে নিশ্বাস ফেললো বাউল। বাউলকে থেমে যেতে দেখে আহি বেশ নিস্তব্ধ হয়ে তাকালো বাউলের দিকে। এরই মধ্যে বাউল কান্না ভেঁজা কন্ঠ নিয়ে গাইতে শুরু করলো,
‘ কোন ফাঁকে পালাইয়া গেলো পাইলাম নারে টের,
পাখিটা হইলো না আপন কপালেই ফের!'(২) ‘
এবারের লাইনটা শুনে যেন আঁতকে উঠলো আহি, এক মিনিটের জন্য হলেও বুকটা কেঁপে উঠল তাঁর। পলকবিহীন তাকিয়ে রইলো সে বাউলের মুখের দিকে। অশ্রু ভেজা চোখ নিয়েই গাইছে বাউল,
‘ ভাবের বুঝি অভাব ছিল, তাই এমন প্রতিশোধ নিলো!'(২)
কান্দাইলো দুই আঁখি, উইড়া গেছে খাঁচা ছেড়ে আমার পোষা পাখি।’
আমি দুঃখ কোথায় রাখি? উইড়া গেছে খাঁচা ছেড়ে আমার পোষা পাখি।’
‘ ঘড় কুটার এক বাসা বাঁধলাম বাবুইপাখির মতো
এই হৃদয়ের ভালোবাসা, দিলাম আছে যত।'(২)
‘ একটা ময়না পাখি সেই বাসা…য়
পুষে ছিলাম কত আশায়?’
আমি দুঃখ কোথায় রাখি, উইড়া গেছে খাঁচা ছেড়ে আমার পোষা পাখি।
আমি দুঃখ কোথায় রাখি,
উইড়া গেছে খাঁচা ছেড়ে আমার পোষা পাখি
উইড়া গেছে খাঁচা ছেড়ে আমার পোষা পাখি
উইড়া গেছে খাঁচা ছেড়ে আমার পোষা পাখি।’
গান শেষ হলেও যেন গানের রেশ কাটে নি আহির মাঝে। চোখ ভিজে গেছে তাঁর। কি গান গাইলো বাউল, বুকের ভিতর কষ্ট হচ্ছে আহির। আদ্রিয়ানকে হারিয়ে ফেলার ভয় এসে গ্রাস করলো তাঁকে। এদিকে বাউলও জোরে নিশ্বাস ফেললো চোখের পানি মুছে ফেললোও আরো কান্না পাচ্ছে তাঁর। ভালোবাসার মানুষকে হারানো যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা হয়তো উনিই ভালো জানেন।’
কিছুক্ষন ওভাবে কাটানোর পর আহি গিয়ে বসলো বাউলের পাশ দিয়ে তারপর বললো,
‘ আপনি কি ব্যর্থ প্রেমিক বাউল দাদু?’
হুট করে অচেনা কারো কন্ঠ কানে আসতেই হকচকিয়ে উঠলো বাউল। বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে আহির দিকে তাকিয়ে বললেন উনি,
‘ তুমি কে আর এইখানে কি করছো?’
‘ আমি আহি এখান থেকেই যাচ্ছিলাম হঠাৎই আপনার দোতারার শব্দ শুনে এগিয়ে আসলাম আপনি কি সুন্দর গান করেন। আমি মুগ্ধ বাউল দাদু, কিন্তু আপনার গান শুনে খুব কান্না পেল। আপনি কি সত্যি ব্যর্থ প্রেমিক বাউল দাদু?’
আহির হাসি মুখ থেকে যেন বিচলিত বাউল। সে ভাবে নি এখানে কেউ তাঁর গান শুনে তাঁর কাছে আসবে। আহির হাসি মাখা মুখটা দেখেও কেন যেন ভালো লাগলো তাঁর। বাউলকে চুপ থাকতে দেখে আবারো বলে উঠল আহি,
‘ কি হলো বাউল দাদু কথা বলছেন না কেন?’
উওরে বাউল নির্বিকার কন্ঠ নিয়ে বললো,
‘ হুম।’
বাউলের কথা শুনে আহি খুব আগ্রহ নিয়ে বললো বাউলকে,
‘ আমাকে বলবেন আপনার কাহিনী, আমি শুনতে চাই কি হয়েছিল আপনার জীবনে?’
আহির কথা শুনে বাউলেরও যেন বলতে ইচ্ছে হলো তাঁর জীবনের কাহিনি বলতে। এত বছরে কেউই এমন প্রশ্ন করে নি তাঁকে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন বাউল,
‘ এ ছিল আজ থেকে আরো চল্লিশ পয়তাল্লিশ বছর আগের কথা। আমি ঢাকার একদম শেষ প্রান্তে থাকা একটা ছোট্ট গ্রামে থাকতাম। বলতে গেলে যৌবন বয়স ছিল আমার। হয়তো তোমার মতোই বয়স ছিল। সারাদিন গান গাইতাম এখানে সেখানে। বিভিন্ন জায়গায় হেঁটে হেঁটে গান গাওয়াই ছিল আমার জীবনের লক্ষ্য। তখন আমার গ্রামের পাশের গ্রামের জমিদারের মেয়ে আমার গান শুনে খুবই মুগ্ধ হলো। রোজ বিকেলে আমার গান শোনার জন্য ঘাটপাড়ে বসে থাকতো। আমারও ভালো লাগতো। তারপর ধীরে ধীরে ভালোবাসা হয়ে গেল দুজনের মধ্যে। একজন আরেকজনকে ছাড়া যেন চলতো না দু’দন্ড কিন্তু,
এতটুকু বলে দম ছাড়লো বাউল। বাউলকে চুপ হতে দেখে বলে উঠল আহি,
‘ কিন্তু কি হলো বাউল দাদু?’
‘ হঠাৎই একদিন জমিদার মশাই আমাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারলেন। সেদিন প্রচুর মেরেছিল আমায়। এরপর শুরু হলো অবহেলা আমাদের মধ্যে কথা বলা, দেখা হওয়া সব বন্ধ হয়ে গেল। একদিন জানতে পারলাম আমার পার্বতীর নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’
আর বলতে পারছে না বাউল চোখ ভেসে আসছে তাঁর। বাউলের কথা থেমে যাওয়ায় আবারো বললো আহি,
‘ বিয়ে কি হয়ে গিয়েছিল?’
উওরে বাউল আকাশ পথে তাকিয়ে বললো,
‘ না।’
‘ তাহলে কি হয়েছিল?’
‘ আমায় ছেড়ে আমার পার্বতী বহু দূরে চলে গেল এতটাই দূরে চলে গেল আমি চাইলেও কাছে আনতে পারতাম না।’
‘ বিয়ে যখন হয়নি তাহলে কোথায় গিয়েছিলেন উনি?’
আহির কথা শুনে নিস্তব্ধ হয়ে আকাশ পথে হাত দিয়ে দেখিয়ে বললেন বাউল,
‘ ওই যে দূর আকাশের তাঁরা হয়ে মাটির নিচে।’
সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠলো আহি। চোখ ভিজে গিয়েছে তাঁর, বুক চিঁড়ে ভীষণ কান্না পাচ্ছে আহির।’
‘ শুনেছিলাম বিয়ের দিন নাকি বিষ খেয়ে আত্নহত্যা করেছিল ও। আমিও চেয়েছিলাম কিন্তু সাহসে কুলালো না। আর সেই থেকেই আমি এমন পথে পথে ঘুরি আর গান গাই।’
আহি কান্না ভেঁজা কন্ঠ নিয়ে বললো,
‘ আপনি বিয়ে করেন নি কেন?’
‘ ওর পর আর কাউকে মনেই ধরে নি। ধরলে নিশ্চয়ই করতাম, আজ তবে আসি বুঝলে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। তুমিও বাড়ি যাও এই জঙ্গলে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না।’
বলেই উঠে দাঁড়ালো বাউল। বাউলের পাশাপাশি আহিও উঠে দাঁড়ালো। বাউল আর কিছু না বলে এগিয়ে যেতে লাগলো সামনে হঠাৎই আহি বলে উঠল,
‘ আবার কবে আসবেন বাউল দাদু?’
উওরে বাউল খুশি মনে আহির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ তা তো ঠিক নেই। ভালো থেকো আর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেও।’
বলেই এগিয়ে গেল বাউল দোতারায় আওয়াজ করতে করতে। আর আহি নির্বিকার হয়ে তাকিয়ে রইলো বাউলের যাওয়ার পানে। নিঃশব্দে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো আহি,
‘ আদ্রিয়ান এখন প্লিজ চলে আসুন আমার কাছে, আপনিও হারিয়ে গেলে আমি সত্যি শেষ হয়ে যাবো।’
বলেই চোখের পানি মুছে উল্টো দিক ঘুরে হাঁটা শুরু করলো আহি।’
____
হঠাৎই ঘুমের ঘোরে আহিকে কাঁদতে দেখে অস্থির হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো আদ্রিয়ান। আচমকাই বুকটা কেঁপে উঠলো তাঁর। বার বার মনে হচ্ছে আহি ভালো নেই কোনো কারনে?’ একরাশ অস্থিরতা এসে গ্রাস করলো তাঁকে। আনমনেই ভাবলো আদ্রিয়ান,
‘ যে করেই হোক খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরতে হবে তাঁকে?’
!
!
!
!
!
#চলবে…..
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। গল্প কেমন লাগলো অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবে। আজকের পর্বটা খুবই স্পেশাল ভাবে লিখেছি আশা করছি তোমাদের ভালো লেগেছে আর এতটা দেরি হওয়ার জন্য সরি সবাইকে]
#TanjiL_Mim♥️