১.
তুমি মিষ্টি করে দুষ্টু বলো, শুনতে ভালো লাগে!
আমার এই মন ভরে যায়, মধুর অনুরাগে..
মধুর অনুরাগে, মধুর অনুরাগে ~
তুমি মিষ্টি করে দুষ্টু বলো…
তুমি যখন আলতো করে আমায় ছুঁয়ে দাও!
মনে হয় তুমি আমার দুঃখ মুছে দাও।
তোমার সাথে লক্ষ্য বছর বাঁচার সাধ জাগে।
আমার এই মন ভরে যায়, মধুর অনুরাগে!
মধুর অনুরাগে।
তুমি মিষ্টি করে দুষ্টু বলো.. ও ও ও
রাজপ্রাসাদের সবচেয়ে সজ্জাপূর্ন কক্ষ থেকে এমন কাতর কন্ঠের গান ভেসে এলো ঝোপঝাড় ভেঙে। যুবকটির আগুনের তেজে ছুটে চলা অশ্বটি হঠাৎ পা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। যুকবটি অবাক বনে গেলো! সে তো তার অশ্বকে থামবার জন্য আদেশ করেনি বা বাধ্যও করেনি। তবে?
যুবকটি আর ভাবার সুযোগ পেলো না। তৎক্ষনাৎ তার বুকে উথাল-পাথাল ঢেউ তুলে কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো ঐ সুরেলা গলা। যুবকটি তৃষ্ণার্ত নয়ন মেলে তাকালো রাজপ্রাসাদের দিকে। এতো মধুর গলা কার? কে গাচ্ছে এই গান? গানের কথা গুলো তীরের মতো বিঁধল যুবকটির হৃদযন্ত্রে। কি নেশালো সুর! সইলো না যুবকের হৃদপিণ্ডে। অশ্বের পিঠে চাবুকের করাঘাত করতেই দাঁত খিঁচিয়ে দু-পায়ের উপর ভর দিয়ে কাতর গলায় চেঁচাল অশ্বটি। অতঃপর পূনরায় পাগলের মতো ছুটলো। আগুনের তেজে। নিজের গন্তব্যে।
“রাজকন্যে, কাঁদছ যে বড়?”
জিন্নাতের আশংকিত গলায় রাজকন্যার হুঁশ এলো। গান গাইতে গাইতে কখন যে নেত্রকোন ভিজে জল গড়ায়! টেরই পায়না। রোজকারের মতো হুঁশ ফেরে জিন্নাতের ডাকে। রাজকন্যা হাসে। কোমল স্নিগ্ধ হাসি। জিন্নাত সংকুঠিত মনে আবার বলে,
“কিসের এতো দুঃখ তোমার?”
রাজকন্যা জবাব দেয়না। উঠে দাঁড়ায় ওর ভারী পোশাকটা ধরে। হেঁটে যায় সোজা, দরজা পেরিয়ে খোলা বারান্দায়। বাইরে ফুরফুরে বাতাস। বাতাসে বসন্তের গন্ধ। রাজকন্যা ওর ভারী পোশাকটি ছেড়ে দেয়। ওমনি সঙ্গে সঙ্গে বিছিয়ে পড়ে মেঝেতে। প্রায় অর্ধেক জায়গা ঢেকে যায় গোল পোশাকটায়। রাজকন্যা দেখেনা ওদিকে। তার দৃষ্টি সামনের বিশাল জংলী গাছ পেড়িয়ে দূর বহুদূর। খুব ছোট বেলায় শুনতো এই জংলী গাছপালার পরে ছিলো আরও কয়েকটা জঙ্গল। বড় বড় অশ্বত্থ গাছ, বট গাছ। সেখানে নাকি রাক্ষসদের বাস ছিলো। দাদাজানের পূর্বপুরুষরা নাকি তাদের তাড়িয়েছে। তারা নাকি জাদুকর ছিলেন। মন্ত্রবলে,জাদুবলে রাক্ষসদের নিপিড়ন করেছেন। অতঃপর ওরা ঐ যাতনা সইতে না পেরে ওদের বাস উঠিয়ে পালিয়েছে। হারিয়ে গেছে বহুদূর। বহুদূর।
জিন্নাত খুব সন্তর্পণে রাজন্যার পাশে এসে দাঁড়ায়। রাজকন্যা টের পায় জিন্নাতের অস্তিত্ব। তবুও সে নির্বিকার, ভাবলেশহীন। কি যেন ভাবছে ও একান্ত মনে।
“ও রাজকন্যে? আজ তোমার হলো কি?”
শুধালো জিন্নাত। রাজকন্যা স্থীর থেকে জবাব আওড়ালো,
“কিছু না জিন্নাত।”
“কিছু তো বটে। তুমি ওমন অন্যমনস্ক তো নও।”
“আব্বাজানকে খুব মনে পড়ছে।”
“হঠাৎ কেন?”
“আম্মাজান বড় কাঁদে যে! সইতে পারিনা আমি।”
“রানী মা’র জন্য কি তুমি নেই?”
“সঙ্গী ছাড়া মানুষ বেশিদিন বাঁচে না জিন্নাত।”
“রানী মা কি বলে ও কথা?”
“আমি বুঝি।”
“তুমি ভুল বোঝো।”
“আব্বাজান কি আর কখনও ফিরবে না জিন্নাত? তার রাজপ্রাসাদ যে বড় কাঁদে তার জন্যে!”
“ঠিক আসবে।”
“কবে?”
জিন্নাত থামে। মহারাজ গায়েব হয়েছেন বারো বর্ষ পেরোলো। শত্রুরা তাকে তুলে নিয়েছেন নাকি মেরে ফেলেছেন আজও খোঁজ পায়নি তার। রানী মা সঙ্গীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়েছেন। মোটে কথা পাড়েন না মুখে। আর এদিকে তাদের একমাত্র রাজকন্যা। সেও যে ভালো নেই। কষ্ট হয় তারও খুব। আব্বাজান নেই,আম্মাজান নেই। বড় একলা হয়ে গেলো বেচারী। সঙ্গী বলতে কেবল জিন্নাত। তার নিঃসঙ্গ সময়ের সঙ্গী। জ্বীনের রাজ্যে বাস তার। সেও বড় আভাগা। ঠিক রাজকন্যার মতো।
“কাঁদলে দুঃখ চলে যায়?”
জিন্নাত সুধালো।
“যায় না বুঝি?”
বলল রাজকন্যা। জিন্নাত আগুনের মতো সুন্দর। যদিও ওদের কোনো নিজস্ব রূপ হয়না। সবটাই ধোয়াশা। তবে রাজকন্যা বড় ভালোবেসে ওকে এই রূপ দিয়েছে। জিন্নাতও সেটা ভালোবেসে গ্রহন করেছে।
“তুমি এতো সুন্দর কেন জিন্নাত?”
জিন্নাত লজ্জা পায়। হাসে। হাসে রাজকন্যাও। চোখের জল মুছে আলতো করে ছোঁয় জিন্নাতের কপাল। কি মোলায়েম।
“আমি সুন্দর নই রাজকন্যে। এটা তোমার মন। সেটা তুমি আমায় উপহার দিয়েছো। তোমার মনটাই এতো সুন্দর রাজকন্যে।”
রাজকন্যা আবারও হাসে। হাসলে তার উপরের ঠোঁটের আড়ালে গজদাঁত দৃশ্যমান হয়। বড় চমৎকার লাগে। জিন্নাত চোখ জুড়িয়ে দেখে ওকে। মাঝে মাঝে ভাবে বিধাতা সব রং ঢেলে সৃষ্টি করেছে রাজকন্যাকে। এতো মনোহর আর তাক লাগানো রূপ এ জীবনে কারোর দেখেনি জিন্নাত। টানাটানা চোখে জলজল করা মনি। মনে হয় মুক্ত বসিয়ে দেওয়া হয়েছে চোখের মনিতে। এই চোখ যে পুরুষ একবার দেখেছে সে আর বেঁচে থাকতে পারেনি। মরমেও মরেছে আর পীড়াতেও মরেছে। রাজকন্যার চাচাজানের আদেশে মৃত্যু অনিবার্য হয়েছে তার। বড় অদ্ভুত শিকলে আটক হয়েছে রাজকন্যা। না পারে সইতে না পারে বলতে। এই জীবন বড্ড তাড়না দিয়ে মারে ওকে। বড্ড তাড়না। জিন্নাত আবিস্কার করে রাজকন্যার নেত্রের ভারী পল্লব। টকটকে লাল অধর। বড্ড মনোহর এই রূপ। সহজে তার মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়না কোনো পুরুষের। যারা এই মুখ দেখার দুঃসাহস করে তারা আর টিকে থাকতে পারেনা এই পৃথিবীতে। একবারই হয় এই দুর্ভাগ্য।
“আমার কি রাজপ্রাসাদের সমস্ত ভার নেওয়া উচিৎ জিন্নাত?”
“নিশ্চয়ই নেওয়া উচিৎ রাজকন্যে। তা আবার শুধায় কেউ?”
“চাচাজান যে বারন করেছে?”
“চাচাজান তোমার ক্ষতি চায় রাজকন্যে।”
“জিন্নাত!”
ক্রোধ নিয়ে নাম উচ্চারণ করলো রাজকন্যা। জিন্নাত অদৃশ্য হয়ে গেলো। অদৃশ্য হলেও রাজকন্যা ঠিকই ওর অস্তিত্ব ধরতে পারলো।
“দোষ নিওনা রাজকন্যে। আমি কি ভুল বলি?”
জিন্নাতের গলা স্পষ্টই পেলো রাজকন্যা। হাত মুঠো করলো। জিন্নাত ভয় পাচ্ছে। ভয় পেলে ওকে আর দেখা যায়না। রাগ করে আসেনা আর। তাই নিজের রাগে জল ঢেলে রাজকন্যা আওড়ালো,
“সামনে এসো।”
“তুমি ক্রোধে যে?”
“তুমি ভুলভাল বলো যে?”
“একদিন মিলবে!”
“মিললে কষ্ট পাবোনা। চাচাজান আমার আরেক আব্বাজান জিন্নাত। ছোট বেলায় উনার কাছেই আমি মানুষ হয়েছি। অস্ত্রবিদ্যা,জাদুবিদ্যা সবই উনিই শেখালেন আমায়। উনি গুরু আমার। আর গুরু সম্মন্ধে এসব কথা শোনাও পাপ।”
“সাবধানে থাকতে হবে তোমায়।”
“থাকবো।”
জিন্নাত আর কথা বলেনা। রাজকন্যার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে। রাজন্যাও আর কথা বাড়ায় না। একদম নিরিবিলি চেয়ে থাকে জঙ্গলের দিকে। আজ যদি ঐকুলের রাক্ষসগুলো বেঁচে থাকতো তবে কি সেও একবার যুদ্ধ ঘোষনা করতো ওদের বিরুদ্ধে? নাকি মানবতার খাতিরে ওদেরও স্বাধীন ভাবে বাঁচার সুযোগ দিতো। ঠিক দিতো। ও তো পুরুষ নয়,তাই নিষ্টুরও নয়। পুরুষ মানেই নিষ্ঠুর। যেমন আব্বাজান। সে জানে আব্বাজান বেঁচে আছে। তাও কেমন নিষ্ঠুর হয়ে পড়ে আছে বহুদূরে। আম্মাজান কে নিয়ে কি একটুও ভাবেন না তিনি?
“ছোট রাজা আপনাকে স্বরন করেছেন রাজকন্যা।”
দরজায় ঠিক তিনবার কড়া নাড়লো দাসী। অতঃপর মুখস্থ গলায় বার্তা প্রেরন করলো।
” বলো গিয়ে রাজকন্যা এক্ষনি আসছে।”
আদেশ পেয়ে চলে গেলো দাসী। রাজকন্যা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। উল্টো ঘুরে ভারী পোশাক তুলে এক এক করে এগোলো।
“আমি কি আসতে পারিনা তোমার সঙ্গে?”
“কেন আসতে চাও তুমি?”
“চাচাজান যদি তোমায় দুঃখ দেন?”
“ফের ঐ কথা?”
জিন্নাত ওর সামনে এসে দৃশ্যমান হলো। বড় অসহায় গলায় বলল,
“আমি যাবো।”
“বেশ চলো। চাচাজান তোমায় ধরে ফেললে আমি তোমায় মুক্ত করবো না বলে দিলাম।”
“চাচাজান আমায় বন্ধী করবেন?”
“করবেন। কারন চাচাজান জিন্নাতদের পছন্দ করেন না।”
“তুমি আমায় মুক্ত করবেনা রাজকন্যে?”
“না। কারন আমি তোমায় আমার সাথে নিতে চাইনা। ওখানে অনেক কথাই হতে পারে। এমনও হতে পারে চাচাজান তোমার বংশ উৎখাত করার জন্য আমার থেকে পরামর্শ চাইছেন।”
“ও মা!”
“হু। সইতে পারবে শুনে?”
“তুমি বড় খারাপ রাজকন্যে। দয়ামায়া নেই।”
রাজকন্যা হাসলো।
“মজা করেছি। চলো যাই।”
“যাবোনা। তুমি একাই যাও। আর যুদ্ধ ঘোষনা করো জিন্নাতদের বিরুদ্ধে।”
“রেগো না বাবা। মজাই তো করেছি।”
“রাগবো না? তোমার মায়াদয়া নেই।”
“বেশ। যাই তবে।”
“দাঁড়াও। আমিও যাবো তোমার সঙ্গে। তবে দৃশ্যমান হবোনা।”
“আচ্ছা।”
রাজকন্যা চলে গেলো চাচাজানের ঘরের দিকে। পিছে পিছে গেলো জিন্নাত। চাচাজানের ঘরের সামনে হাজির হতেই দাসী তাকে ভেতরে প্রবেশ করার জন্য দরজা খুলে দিলো। রাজকন্যা ভেতরে প্রবেশ করল। চাচাজান বিছানায় শুয়ে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে তিনি বেশ পীড়িত। পাশেই চাচীজান। তার চোখ মুখ শুঁকিয়ে। কাঁদছেন তিনি। রাজকন্যা বিচলিত হয়ে উঠল। ছুটে গেলো চাচাজানের কাছে। কাতর কন্ঠে শুধালো,
“সে কি! আপনার কি হয়েছে চাচাজান?”
“তোমার চাচাজান বোধহয় আর বেশিদিন বাঁচবে না রাজকন্যা। উনার সময় ঘনিয়ে এসেছে।”
এই বলেই হুহু করে কাঁদতে লাগলেন চাচীজান। রাজকন্যার মুখ খানা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। চাচাজানের হাত জোড়া শক্ত করে ধরলো। কান্না জড়ানো কন্ঠে আওড়ালো,
“ও কথা বলিয়েন না চাচীজান। চাচাজানের কিচ্ছু হবেনা।”
“চলে যাবার আগে আমি আমার শেষ কর্তব্য টুকু করে যেতে চাই মা।”
আর্তনাদী গলায় আওড়ালো চাচাজান। রাজকন্যা কেঁদে ফেললো। কপাল ঠেকালো চাচাজানের হাতে। তার চোখের কয়েক ফোঁটা জল গিয়ে পড়লো চাচাজানের হাতে। চাচাজান মুষড়ে পড়া চোখে তাকালো। রাজকন্যা আদেশ করে বলল,
“কে আছো কবিরাজ মশাইকে খবর পাঠাও!”
দু’জন পেয়াদা দৌড়ে গেলো। চাচাজান রাজকন্যার হাত ধরে বললেন,
“আমার শেষ কার্য করিতে আমায় সাহায্য করিবে তুমি?”
রাজকন্যা চোখ মুছলো। কর্তব্য বোধ নিয়ে বলল,
“আমি আপনার জন্য সব করবো চাচাজান। আপনি আমায় আদেশ করুন।”
“খবরদার রাজকন্যে। না জেনে কথা দিওনা!”
রাজকন্যা কথাটা বলতে না বলতেই কর্নকুহরে প্রবেশ করলো জিন্নাতের আশংকা বানী। রাজকন্যা নড়লো না। অনড় রইলো তার বানীতে। চাচাজান স্বস্তি মনে আওড়ালেন,
“কাল তোমার বিবাহের ব্যবস্থা করিবো। ভাইজানের শেষ ইচ্ছে ছিলো কোনো সুপুত্রের সঙ্গে তোমার বিবাহ দিতে। আমি নিজের জীবনের ভরসা দিতে পারছিনা। তাই আমি নিশ্চিন্তে মরতে চাই।”
রাজকন্যা থমকে গেলো। সে যে পন করেছিলো আব্বাজানকে যতদিন খুঁজে না পাবে ততদিন সে একা থাকবে। জীবনে কোনো দ্বিতীয় ব্যাক্তির প্রবেশ হতে দিবেনা। চাচাজান এ কোন কঠিন ধাঁধায় ফেলল তাকে।
#রাজকন্যা_হূরিয়া
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
চলবে___
[নতুন গল্প। দুইটাই চলবে।❤️]