রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-১০

0
333

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸🥀
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[১০]

রাজকন্যার ঘুম ভাঙে রাতের মধ্যপ্রহরে। একটু নড়েচড়ে উঠে এপাশ ফিরতেই মনে হয় সে কারোর হাতের বাঁধনে আঁটকে আছে। তার মাথাটা স্থান পেয়েছে মানুষটার প্রসস্থ বুকে। রাজকন্যা মুখ উঁচিয়ে দেখার চেষ্টা করে মানুষটাকে। একটু কষ্ট করলে দেখতেও পায় রাজকুমারকে। রাজকুমার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রাজকন্যা চোখ সরাতে পারেনা রাজকুমারের স্নিগ্ধ মুখবিবর থেকে। মায়া যেন উপচে পড়ছে তার মুখ থেকে। রাজকন্যা নিষ্পলক চেয়ে থাকে তার শ্যামের দিকে। যতই সে তাকে দেখে ততই যেন ভালোবাসা বাড়তে তাকে। কিছু সময় এভাবেই পেরিয়ে যায়। নড়ে না কেউই। ক্ষনকাল পেরোতে রাজকুমার খানিক নড়ে উঠতেই ভড়কে যায় রাজকন্যা। তার চেতন ফেরে। সম্ভ্রম ফিরে পেয়ে সে হঠাৎ লজ্জা পেয়ে যায়। একি করছে সে? এমন পাগলিনীর মতো কেন দেখছে রাজকুমারকে? সত্যি পাগল হয়েছে সে। গভীর প্রেমে পড়েছে। মানতেই হবে।

রাজকুমারের হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আনতে বেশ বেগ পেতে হলো রাজকন্যার। কোনো মতে শয্যা ত্যাগ করলো সে। পরনের পোশাক বেশ এলোমেলো। টেনেটুনে কোনো ভাবে ঠিক করে নিলো সব। তারপর হঠাৎ তাকালো রাজকুমারের ঘুমন্ত মুখপানে। মস্তিষ্ক কেমন আজগুবি কথা বলে উঠলো, ‘ভাগ্যিস এই মুহুর্তে রাজকুমার জেগে নেই।’

জেগে থাকলে হয়তো সে আরও বেশি লজ্জায় পড়তো। চোখ তুলে তাকাতে অব্দি পারতো না মানুষটার দিকে। খানিক্ষন পর চোখে মুখে পানি দিলো রাজকন্যা। পোশাক ছেড়ে পড়ে নিলো খুব সাধারন একটা পোশাক। যেমন রোজ রাতে আব্বাজানের সন্ধানে বের হতে পড়ে থাকে। মাথার চুলগুলো পাগড়ির সাহায্যে আঁটকে নিলো। সঙ্গে রাখলো ছোট বড় দু’খানা তলোয়ার। আজ আর বাবার সন্ধানে নয় আজ সে কবিরাজ মশাইয়ের কন্যার সন্ধান করতে বেরোবে। তার নিজের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস আছে। সে পারবে তার খোঁজ বের করতে, অবশ্যই পারবে। কক্ষ ছাড়তে ছাড়তে আরেকবার তাকালো রাজকুমারের ঘুমন্ত মুখপানে। কি পবিত্র। মনেমনে রবের প্রশংসা করতে ভুললো না রাজকন্যা। অতঃপর হাতের তলোয়ারটা শক্ত করে ধরে নিজের ভেতরের কঠিন রূপটাকে সামনে টেনে আনলো। আর এই ঠান্ডা শীতল বিনম্র রূপটাকে ঠেলে দিলো অন্তরের গভীরতায়। আর এক মুহুর্তও দেরী করলো না। ঘোড়াশালে গিয়ে সুফিকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা শুরু করলো।

ক্ষতস্থানে জল পড়তেই আর্তনাদী কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠছে গুপ্তচর। ও গুপ্তচর নয়। ডাকাত সরদারের ডান হাত বলা যায়। ডাকাত সরদার ওকে প্রানের প্রিয় বন্ধু ডাকতেও ভুলে না মাঝেমধ্যে। ডাকবে নাই বা কেন? কারন ওর কাজই এমন যে একজন বিশ্বস্ত বন্ধু ছাড়া কারোর দ্বারা এসব করা সম্ভব নয়। খুব চালাকি করে রয়েসয়ে দান মারে ও। মাঝেমধ্যে ডাকাত সরদারের পিতাও ভড়কে যান ওর কান্ডে। সর্বদা বাহবা লেগেই থাকে ওর নামের সাথে। কিন্তু আজ.. আজ সামান্য এক কন্যার হাতে আহত হয়ে ডেরায় ফিরে আসাতে এক নিমিষে প্রশংসার খাতা থেকে উৎখাত করে ফেলা হয় ওর নাম। এক আঘাতে কাপুরুষের নাম পেয়ে বসেছে ও। রাগে-ক্ষোভে মস্তিষ্কে জট পাকিয়ে আছে সেই অনেক্ক্ষণ। ইচ্ছে করছে এক্ষনি ছুটে গিয়ে ঐ পুঁচকে কন্যাকে বলি দিয়ে আসতে। পারেনা এক কোপে ধর থেকে মাথাটা আলাদা করে দেয়। কিন্তু বাঁধা কেবল ডাকাত সরদার স্বয়ং। তার পিতাও চান ঐ কন্যার মৃত্যু হোক। তবেই যে রাজপ্রাসাদ তাদের দখলে আসবে। বর্ষবাদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটবে।

রাজকন্যার ছুরির আঘাতে ডান পা-টা মাঝখান থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার জো হচ্ছিলো। তৎক্ষণাৎ ছিটকে সরে না পড়লে পঙ্গু হতে সময় লাগতো না।

“আহহ্! জা’নোয়া’রের বাচ্চা সামলে দিতে পারিস না?”

যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠলো পূনরায়। তাকে ঔষধী লাগাতে আসা ভীতু কবিরাজ চমকে উঠল মুহুর্তেই। ওমনি তার মুখশ্রীতে এসে ভর করলো মৃত্যুভয়। কবিরাজ মশাইয়ের মুখের অবস্থা দেখে উল্লাসে মেতে উঠলো তার মন। এটাই তো তাদের ধর্ম। মানুষের মুখে মৃত্যুর ছাপ একে দেওয়া! একদিন নির্ঘাত ঐ পুঁচকে মেয়ের মুখেও এই ছাপটাই দেখতে পাবে তারা।

“ক্ষমা করবেন রেজওয়ান মশাই! আ্ আমি সাবধানে করছি!”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো রেজওয়ান। যন্ত্রণায় হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে ও। নরকীয় যন্ত্রণা অনুভব করছে। এই মুহুর্তে সরদার যদি ওর পাশে থাকতো একটু ভরসা দিতো তবে একটু হলেও মনে বল পেতো। কিন্তু সে তো তার কর্ম নিয়েই ব্যস্ত।

ঘন জঙ্গলের সামনে এসে থামলো সুফি। হঠাৎ পা খিঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ায় নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলো রাজকন্যা। ফের সুফিকে ধরে নিজেকে সামলালো। সে ভেবে ছিলো সুফি এখানে থামবেনা। জঙ্গলের পাশ কাটিয়ে সামনে এগোবে। কিন্তু এগোলো না। রাজকন্যা চিন্তিত মনে সুফির পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ালো। পাশেই বিরাট মাঠ। আকাশে মস্ত বড় পূর্নিমার চাঁদ আর জমিনে সবুজ ঘাস। আলোয় ঝলমলে করছে মাঠটা। যা চোখে পড়তেই কিছু মুহুর্ত লাগলো রাজকন্যার চিন্তা ভুলতে। সে সুফির দিকে তাকিয়ে পিঠ চাপড়ে বলল,

“ভালো চালবাজ হয়েছো দেখছি। ক্ষিদে পেলো আর ওমনি রাজকন্যাকে মাঝপথে নামিয়ে দিলে। পাজি একটা। যাও পেট ভরে খেয়ে এসো। আমি এখানেই আছি।”

সুফি নিশ্চুপ শুনলো। রাজকন্যা ওর গলার বেল্টা দু’বার টান দিয়ে কিছু পথ এগিয়ে দিলো। সুফি এক প্রান্ত থেকে ঘাস খেতে আরম্ভ করলো। মাঝ বরাবর আর গেলো না। রাজকন্যা কয়েক মুহুর্ত নিষ্পলক চেয়ে দেখলো প্রকৃতির এই অসাধারণ সৌন্দর্য্য। তার যে ইচ্ছে করছে ছুট্টে গিয়ে প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও গেলো না। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ঘন জঙ্গলটা কে খতিয়ে খতিয়ে দেখতে লাগলো। বাইরে থেকেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ ভয়ানক। তবুও সে বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে পা বাড়ালো সেদিকে। চাঁদনীর আলোতে ততটাও অন্ধকার বোধ হলো না রাজকন্যার। সে সবটা স্পষ্ট দেখতে দেখতেই পা ফেলতে লাগলো। কিছু পথ অতিক্রম করতেই তার ভড়কে যাওয়ার পালা। এ কি! সামনে তো একটা গ্রাম মনে হচ্ছে। ভেতরটা এতো সুন্দর অথচ বাইরেটা এতো ভয়াবহ কেন? এটা কোনো চাল নয়তো? নিমিষেই বুক কাঁপলো রাজকন্যার। কিন্তু সে এবারও পাত্তা দিলো না নিজের অহেতুক ভয়কে। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রেখে পায়ে পায়ে গিয়ে পৌঁছোলো একটা ঘরের সামনে। অসাধারণ হস্তশিল্পে করা মাটির ঘর। তার গায়ে গায়ে আঁকা রঙবেরঙের হাতের কাজ। কি ভীষণ সুন্দর। রাজকন্যা আনমনেই ছুঁয়ে দিলো ঘরটা। কিন্তু চোখের পলক পড়তেই অদৃশ্য হয়ে গেলো ঘরটা। একই সাথে অন্ধকারে ছেয়ে গেলো পুরো ধরনী। রাজকন্যা ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়লো। হাতের তলোয়ারটা শক্ত করে চেপে ধরে অস্ফুট শব্দে চিৎকার করলো সে। এক নিমিষেই বুঝে ফেললো এখানে জিন্নাত জাতিদের কালো জাদু করে রাখা হয়েছে। যা প্রতি ক্ষনে ক্ষনে চোখের ধোঁকায় পরিনত হবে। সে আরও কিছুক্ষন এখানে থাকতে চাইলেও পারলো না। তার উপস্থিতি টের পেয়ে অনেক জ্বীনই হাজির হয়েছে। রাজকন্যা দেখতে পাচ্ছে তাদের। কিন্তু তারা বুঝতে পারছেনা যে রাজকন্যা তাদের দেখছে। রাজকন্যা আর দাঁড়ালো না৷ দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরলো উল্টো পথে। কিন্তু যেতে পারলো না। আকস্মিক তার পা থমকে গেলো কারোর চিৎকারে। সে দাঁড়িয়ে পড়লো। পেছন মুড়ে তাকাতেই কেবল একটা ঘর দেখতে পেলো। বাকি সব ঘর গুলো এখনও অদৃশ্য। কেবল ঐ একটা ঘরই অদৃশ্য হয়নি। রাজকন্যা পূনরায় মনের বল বাড়ালো। এখানে এমন কিছু আছে যা তাকে উদ্ধার করতেই হবে। সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আশেপাশে একবার তাকিয়ে দেখলো জ্বীন গুলো এখনও দাঁড়িয়ে আছে। সে সবার মুখের দিকে একবার একবার তাকিয়ে কন্ঠে একপ্রকার ভরসা টেনে রাজকীয় ভঙ্গিতে বলল,

“চিন্তা করিওনা। আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করবো না। আমি সিরাজদি নগরের রাজকন্যা হূরিয়া। তোমাদের সাথে আমার জন্মগত সূত্র আছে। সম্পর্ক আছে। আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারিনা। আমি শুধু ঐ ঘরটার কাছে যেতে চাই। আমাকে যেতে দাও।”

রাজকন্যার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলেও কেউ ওর পথ ছাড়লো না। রাজকন্যার দুঃশ্চিন্তা বাড়লো। এরা যদি ওর পথ রোধ করে তবে যে ও কিছুতেই ঐ ঘরের কাছে পৌঁছাতে পারবেনা। এখন উপায় কি? জিন্নাতই একমাত্র উপায় হতে পারে। রাজকন্যা আর সাতপাঁচ না ভেবে মনে মনে স্বরন করলো জিন্নাতকে। জিন্নাত এক ডাকে হাজির হয়ে গেলো। রাজকন্যার ঠিক ডান পাশটাতে অতি নিভৃতে এসে দাঁড়ালো। কিছু বলবে ঠিক সেই মুহুর্তে সম্মুখ পানে এতগুলো জ্বীনকে দেখে চিন্তার ভাজ পড়লো কপালে। তাদের উদ্দেশ্যই বলল,

“পথ রোধ করলে কেন?”

তাদের মধ্যে একজন জবাব দেয়,

“এখানে কারোর আসার অনুমতি নেই। চলে যাও তোমরা।”

রাজকন্যা শুনতে পায় ওদের কথা। তাই জিন্নাতের আগে সেই কথা বলে,

“কার অনুমতির কথা বলছো তোমরা?”

আরেকজন বলে,

“সরদারের।”

“কোন সরদার। কে উনি?”

“আমাদের সরদার। জ্বীনের সরদার। আমরা উনার পালিত জ্বীন। উনি আমাদের নিজের কাছে রেখেছেন একমাত্র তার উপকারের জন্য। আমরা উনার কথা অমান্য করতে পারিনা।”

রাজকন্যা অধৈর্য্য হয়ে ওঠে। এতো কথা বলার সময় তার হাতে নেই। ভেতরে কেউ বন্দী আছে। তাকে উদ্ধার করতে হবে। আর এদের বন্দী না করলে তা কিছুতেই সম্ভব নয়। নয়তো এরা কিছুতেই তাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেবেনা।

রাজকন্যা আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আর উপায় নেই। এদের বন্দী করতেই হবে। পাশ ফিরে জিন্নাতকে একবার দেখে। তারা চোখে চোখে কথা বলে। জিন্নাত এক নিমিষেই বুঝে যায় রাজকন্যার ইশারা। তারা দু’জনে একত্রে দোয়া পড়তে আরম্ভ করে। কয়েক মুহুর্তের মাঝে শেষ করে মুখ গোলাকার করে সামনের দিকে ফু দিতেই সব বন্দী হয়ে যায় মাটির নীচে। রাজকন্যা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। অতঃপর এগিয়ে যায় ঘরটার দিকে। হাতের তলোয়ারটা শক্ত করে ধরে রাখে। সুযোগ বুঝেই আক্রমণ চালাবে।

#চলবে______

[ গঠন মূলক মন্তব্য আশা করছি। আর যারা যারা পড়ছেন কাইন্ডলি রেসপন্স করুন ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here