রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-১৩

0
321

#রাজকন্যা_হূরিয়া 🌸❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[১৩]

রাজকুমারকে পাওয়া গেলো আহত অবস্থায়! তখন তার জ্ঞান একেবারে ছিলো না বললেই চলে। রাজকন্যার বারান্দায় দাঁড়ালে যে ঘন জঙ্গলটা পড়ে, তার খানিকটা দূরেই আহত অবস্থায় পড়েছিলো সে। খোঁজ পেলো আদিম। দ্রুত তাকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এসে কবিরাজ কে খবর দেওয়া হলো। রাজকন্যার কক্ষে জড়ো হলো প্রাসাদের প্রায় অনেকেই। কেবল দেখা মিলল না চাচাজানের। রাজকন্যা যেন এই ঘটনায় চাচাজানকেই খুঁজছিল। যেন বারবার সন্দেহের তীরটা চাচাজানের উপরে না পরে। কিন্তু না,সেই তো বরাবরের মতোই চাচাজান সন্দেহের তালিকায় নিজের নামটা সবার আগে লেখালেন।

“একি দশা হলো জামাতার! কে করলো এই দুঃসাহস?”

প্রথমে কন্ঠে তাড়না থাকলেও পরক্ষণেই ক্ষুব্ধ হয়ে আওড়ালেন ফুপুআম্মা। রাজকন্যা বসে আছে রাজকুমারের মাথার কাছে। মাথায় হাত বোলাচ্ছিলো। হঠাৎ কানে বাজলো ফুপুআম্মার কথাটা। মুখ উঁচিয়ে দেখলো মানুষটাকে। অতঃপর ভীষণ শান্ত ভঙ্গিতে বলল,

“খুব জলদিই সামনে চলে আসবে ফুপুআম্মা। এতো বড় স্পর্ধা যখন হয়েছে, তখন নিশ্চয়ই আড়ালে লুকিয়ে থাকবে না। সম্মুখে তো তাকে আসতেই হবে।”

চাচীজান মুখ খুললেন। খানিক নাকি সুরেই আওড়ালেন,

“জামাতাকে একলা ফেলে কোথায় থাকো তুমি! দু’জনকে একসাথে দেখা তো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে বাপু। উনি তো তোমার সোয়ামি নাকি। তাকে এমন হেলায়ফেলায় রেখো নাকো।”

এমন মুহুর্তে কক্ষে প্রবেশ করলো আরহাম। দ্রুত পায়ে এসে দাঁড়ালো রাজকুমারের সামনে। বিচলিত দৃষ্টিতে একবার দেখলো ঘুমন্ত রাজকুমারকে। অতঃপর বলল,

“এ দশা কেমন করে হলো রাজকুমারের সঙ্গে?”

“তুমি কোথা থেকে উদয় হলে বাছা?”

ঠেস মারা গলায় বললেন চাচীজান। তোয়াক্কা করলো না আরহাম। ছুটে গেলো রাজকন্যার সামনে। নতশির করে অপরাধী গলায় বলল,

“ক্ষমা করবেন রাজকন্যা! আব্বাজানের শারীরিক অবস্থা যে মোটেও ঠিক ছিলো না। তাই আমাকে যেতো হয়েছিলো।”

“তোমার আব্বাজান এখন কেমন আছেন?”

পাল্টা প্রশ্ন করলো রাজকন্যা। যেন সন্দেহ করছে আরহাম কে। আরহাম ঢোক গিললো। নতশির রেখেই জবাব আওড়ালো,

“আজ্ঞে রাজকন্যা, আব্বাজান এখন ভালো আছেন।”

কবিরাশ মশাই রাজকুমারের হাতের ঘা স্থানে পট্টি লাগিয়ে দিলেন। কপালেও লাগালেন বেশ খানিকটা সময় নিয়ে। বেশ সময় লাগিয়ে মনোযোগের সহিত খতিয়ে খতিয়ে দেখলেন রাজকুমারের শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন। শরীরে আগুন জ্বর। ধারণা করে জানা যায় রাজকুমারকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই অজ্ঞান হওয়ার কোনো ঔষধি দেওয়া হয়। অতঃপর ঘুমন্ত মানুষটাকে অহরন করে তারা। ঠিক কত সময় যাবত তার সঙ্গে শারীরিক নিগ্রহ হয়েছে সঠিক ভাবে অনুমান করতে পারেননি স্বয়ং কবিরাজ মশাইয়ো। রাজকন্যা প্রতিটি বাক্য গেঁথে নিয়েছে তার মস্তিষ্ক। তার রাজকুমারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এই অন্যায় সে কিছুতেই মেনে নেবেনা। এর বিহিত সে অতি দ্রুত করে ছাড়বে।

“প্রহার করাতে জ্বর এসেছে মাত্রাতিরিক্ত। যা ঔষধি আমি দিয়েছি তাতে আশাকরি রাজকুমার অতিদ্রুত এই পীড়া থেকে মুক্তি পাবেন। কিন্তু উনার সাথে সার্বক্ষণিক কাউকে থাকতে হবে। এই যে জলপট্টি রইলো। এটা খানিক বাদে বাদে পাল্টে নিয়ে পূনরায় উনার ললাটে দিয়ে রাখবেন। যদি জ্বরটা একদমই না কমে তবে আমাকে আবারও ডেকে পাঠাবেন। আমি এসে দেখে যাবো উনাকে।”

“জি কবিরাজ মশাই, আমি আছি রাজকুমারের সঙ্গে। আর সার্বক্ষনিক থাকবো।”

শেষোক্ত কথাটা বলতে বলতে করুন দৃষ্টিতে একবার দেখলো রাজকুমারের শুঁকনো মুখটা। বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রাজকন্যা। কবিরাজ মশাই পূনরায় বললেন,

“রাজকুমারের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করুন। জ্ঞান ফিরতে উনাকে কিছু তরল খাবার খাওয়াবেন। তেঁতো মুখে ঝাল খাবারই ঠিক হবে।”

“জি।”

“আমি এবার উঠলাম। দরকার পড়লে আমাকে খবর পাঠাবেন রাজকন্যা।”

“নিশ্চয়ই।”

কবিরাজ মশাই বেরিয়ে গেলেন। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আদিম আর আরহামও বেরিয়ে গেলো। বাকি রইলেন চাচীজান আর ফুপুআম্মা। ফুপুআম্মা শুরু থেকেই কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছেন রাজকুমারকে। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে। রাজকন্যার চোখ এড়ালো না তা। মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে ডাকলো ফুপুআম্মাকে। ফুপুআম্মা প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে রাজকন্যার দিকে তাকালেই রাজকন্যা বলে,

“উনার মাথায় একটু জলপট্টি দিয়ে দিবেন ফুপুআম্মা? আমি উনার আহারের বন্দবস্ত করে আসতাম।”

এই বলে উঠে গেলো নিজের জায়গা থেকে। ফুপুআম্মা খানিক্ষন নিশ্চুপ থেকে বুঝতে চেষ্টা করলো ঠিক কি বলতে চাইলো রাজকন্যা। পরক্ষণেই অবাক কন্ঠে আওড়ালেন,

“আমি?”

” জি ফুপুআম্মা।”

জবাব দিলো রাজকন্যা। ফুপুআম্মা বিস্মিত নয়নে এগিয়ে গিয়ে রাজকুমারের পাশে বসলো। তিনি বিস্মিত হলেও মনের মাঝে এক অদ্ভুত ভালোলাগা অনুভব করলেন। যা এর আগে কখনও হয়নি।

“চাচীজান, চাচাজান কোথায়?”

চাচীজান হঠাৎ চমকে উঠলেন রাজকন্যার এহেম প্রশ্নে। তিনি ঘাবড়ানো গলায় বললেন,

“উনি! উনি তো কোথাও একটা গিয়েছেন!”

“এতো সাতসকালে চাচাজান কোথায় গিয়েছেন চাচীজান?”

“আ্ আমি জানি না।”

“কখন ফিরবেন কিছু জানিয়েছেন?”

“না বললেন নি তো।”

“প্রাসাদে ফিরতেই বলবেন রাজকন্যা আপনাকে স্বরন করেছিলেন।”

“অ্ অবশ্যই।”

চাচীজান কোনো মতে জবাব দিয়ে প্রস্থান করলেন। রাজকন্যা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো।

____________

রাজকুমারের জ্ঞান ফিরেছে দুপুরের প্রথম ভাগে। রাজকন্যা কবিরাজ মশাইয়ের আদেশ মতো যাবতীয় আহার করিয়েছে রাজকুমারকে। আর তার ঠিক খানিকটা সময় পরই শরীর ঠান্ডা হয়ে জ্বর ছেড়ে দিয়েছে। এখন প্রায় গভীর রাত। ঘুম আসছে না কারোরই। রাজকুমার সোজা হয়ে শুয়ে আছে। দৃষ্টি উপরের দিকে শূন্যে। রাজকন্যা কতক্ষণ পরপরই এপাশ ওপাশ করছে। রাজকুমার না ঘুমালে তার যে বের হওয়া অসম্ভব।

“ঘুমোচ্ছেন না কেন? খারাপ লাগছে কি?”

প্রশ্ন করলো রাজকুমার। রাজকন্যা চমকে উঠলো যেন। পাশ ফিরে রাজকুমারের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। বলল,

“খারাপ লাগছেনা। তবে ঘুমও ধরা দিচ্ছে না চোখে। কিন্তু আপনি কেন জেগে আছেন? আপনাকে তো ঘুমোতে হবে। শরীরের যে বিশ্রাম দরকার।”

“আমারও ঘুম আসছেনা।”

করুন কন্ঠে বলল রাজকুমার। রাজকন্যা উঠে বসল।

“ক্ষিদে পেয়েছে কি?”

“না। পেটের খাবারই হজম হয়নি এখনও।”

“তবে কি শরীর খারাপ লাগছে?”

“উঁহু.. মন বলছে তার মন খারাপ!”

“সে কি!”

“হু। আপনি কি মন ভালো করতে পারেন রাজকন্যা?”

“জানিনা তো! কখনও কারোর মন ভালো করিনি আমি।”

“চেষ্টা করবেন একবার?”

“অবশ্যই। একবার নিশ্চয়ই করবো।”

“মনটা আপনাকে ছুঁতে চায়! বারন করলেও জেদি হয়ে ওঠে!”

রাজকন্যা লজ্জা পেলো রাজকুমারের কথায়। কিছু মুখে আটকায় না রাজকুমারের! কেমন গরগর করে বলে দেয় সবটা!

“আমি কি একবার ছুঁতে পারি আপনাকে? একটু গভীর ভাবে?”

রাজকন্যার গলায় কিছু একটা বিঁধল। ঢোক গিললো বার কয়েক। মাথা ঝুঁকে পড়লো নতজানু হয়ে। মুখ উঁচিয়ে তাকাতে পারলো না কোথাও। রাজকুমার হাতে ভর দিয়ে উঠে বসলো। ব্যাথায় টনটন করছে শরীর। বড় আক্ষেপ হচ্ছে তার! গুপ্তচর আক্রমণ করলো কিন্তু অজ্ঞান অবস্থাতে। জ্ঞান থাকা অবস্থায় আক্রমন করলে কি এমন অসুবিধা হতো তাদের?

“আপনি যখন লজ্জা পান তখন আপনাকে দেখতে রসগোল্লার মতো লাগে। পারি না শুধু খেয়ে ফেলতে!”

“ধ্যাৎ!”

অতিকষ্টে জবাব দিতে পারে রাজকন্যা। রাজকুমার গালে হাত দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকায় রাজকন্যার দিকে। মিষ্টি রঙের পোষাকে তার গৌরীকে মন্ত্রমুগ্ধ লাগছে। তার প্রনয়নী। তার মনোহরিনী।

“আপনি খুব বেশরম।”

“জানি তো।”

“জানেন না। আ্ আপনি কিছু জানেন না।”

“আপনি যে ভয় পাচ্ছেন! আমি কিন্তু ছুঁইনি আপনাকে!”

পূনরায় ঢোক গিলতে হলো তাকে। লোকটা এমন সব কথা বলে যাচ্ছে। লজ্জায় যে মরেই যাবে সে।

“চুপ করুন না।”

“লজ্জা পাচ্ছেন!”

“একদম না!”

“তবে দেখছেন না কেন আমায়?”

“আপনার মন ভালো করতে হলে কি করতে হবে বলুন না?”

“আমাকে কাছে আসতে দিন।”

কেঁপে উঠলো রাজকন্যা। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে রাজকুমারের লজ্জার বান। আপাদমস্তক শিরশির করে উঠলো এক পবিত্র অনুভূতিতে। বুকের ভেতর হাতুড়ির বারি গুলো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে। ধক ধক শব্দ করে যাচ্ছে তারা। নিঃশ্বাস আর অক্ষিপট অনেক্ষন পূর্বেই বন্ধ হয়ে গেছে।

“তাহলে আমার মন ভালো হবে।”

পূনরায় বলল রাজকুমার। রাজকন্যা হঠাৎ ভারী নিঃশ্বাস ছাড়লো। রাজকুমার পলক ঝাপটে মাথাটা আরেকটু নীচু করে এক পলক দেখে নিলো তার রমনীকে। তার লজ্জাবতীকে।

“আপনি ও না ভীষণ লজ্জা পান।”

“আ্ আমি আসছি..”

এই বলে রাজকন্যা শয্যা ত্যাগ করতে নিলেই পেছন থেকে হাত টেনে ধরে রাজকুমার। ব্যাকুল কন্ঠে বলে,

“আমার তো মন খারাপ রাজকন্যা!”

রাজকন্যা জবাব দিতে পারেনা। তার নিঃশ্বাস ভারী পড়ছে। তা বুঝতেই হাত ছেড়ে দেয় রাজকুমার। রাজকন্যা ছাড়া পেয়ে এপাশে এসে পালাতে চাইলেই পথ রোধ করে রাজকুমার। লাগামহীন কন্ঠে বলে,

“ভালোবাসি,খুব বেশি ভালোবাসি আপনাকে!”

রাজকন্যা ঘুরে যায় উল্টো দিকে। তৎক্ষনাৎ দৃশ্যমান হয় রাজকন্যার উদার পিঠ। রাজকুমার বেসামাল হয়ে হাত বুলায় রাজকন্যার পিঠে। রাজকন্যা দমবন্ধ অনুভূতিতে কেঁপে ওঠে। খামচে ধরে নিজের পোষাক। চোখ বন্ধ করে শ্বাসরুদ্ধ করে নেয়। রাজকুমার মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে ন্যায় রাজকন্যাকে। তার কাঁধে গাঢ় চুমু একে হাতের বাঁধন শক্ত করে বলে,

“একবার বলুন না ‘ভালোবাসি!’ ”

রাজকন্যা কাঁপতে লাগে। কিছু বলতে পারেনা। রাজকুমার তার কোমর ছেড়ে বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। রাজকন্যার ললাটে ভালোবাসার পরশ এঁকে কোমল স্বরে বলে,

“আমার সাথে পালাবেন রাজকন্যা?”

“ক্ কোথায়?”

“আমি যেথায় নিয়ে যাবো?”

“প্ পালাবো কেন?”

“জানিনা।”

“পাগল।”

“ভীষণ!”

“ভালোবাসি!”

রাজকুমার বিস্ময়ে হা করে তাকালো হঠাৎ। রাজকন্যা এভাবে হুট করে কথাটা বলে বসবে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সে। তার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেলো।

“ক্ কি বললেন!”

রাজকন্যা লজ্জায় মুখ লুকালো। কিন্তু সহ্য হলো না রাজকুমারের। ঠিক নিজের সম্মুখে স্থির দাঁড় করালো তাকে। বলল,

“আ্ আর একবার শুনতে চাই! দয়াকরে বলুন?”

রাজকন্যা করুন চোখে তাকালো। বলল,

“বড্ড জ্বালাচ্ছেন!”

“বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি যে!”

“আমিও!”

মাথা নত করে পূনরায় স্বীকার করলো রাজকন্যা। খুশিতে রাজকুমারের নেত্রকোন ভিজে উঠলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে আর্তনাদী কন্ঠে বলল,

“আমি বদ্ধ উন্মাদ আপনার প্রেমেতে। একেবারে বদ্ধ উন্মাদ মনোহরিণী।”

বলতে বলতেই অধরে অধর আঁকড়ে ধরলো রাজকুমার। রাজকন্যা অনুভব করলো তবে আর কিছুই বলার সুযোগ দিলো না রাজকুমার। এই রজনী তার জন্য শ্রেষ্ঠ রজনী করে তুললো রাজকুমার। শ্রেষ্ঠ রজনী।

#চলবে

[ বিঃদ্রঃ কষ্ট করে লিখি! কষ্ট করে একটু রেসপন্স করুন]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here