রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-১৪

0
316

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸🤍
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[১৪]

চাচাজানের সঙ্গে দেখা হলো প্রভাতে। ভীষণ ভীতু দেখাচ্ছিলো তাকে। সবার নজর এড়িয়ে চুপিচুপি ঢুকেছেন প্রাসাদে। কিন্তু আকস্মিক রাজকন্যা সামনে এসে পড়বে ভাবনাতে ছিলো না।

“কোথায় গিয়েছিলেন চাচাজান?”

শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠে প্রশ্ন করলো রাজকন্যা। চাচাজান ভড়কে গেলেন। ধপ করে জ্বলে উঠলো তার ভেতরের ভয়।

“ক্ কোথাও না তো। একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম।”

“গত-কাল থেকেই?”

চাচাজান থমকে গেলেন! সে যে গতকাল থেকেই প্রাসাদে নেই সেকথা জ্ঞাত হয়েছে রাজকন্যার! এবার তিনি কি জবাব দেবেন? ভয়ার্ত গলায় ঢোক গিললেন চাচাজান। দৃষ্টি অস্থির করে ভাবছেন কোনো মিথ্যে যুক্তিযুক্ত কথা। যেন না চাইতেও বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় রাজকন্যা।

“গ্ গতকাল!! ন্ না!! আমি তো প্রাসাদেই ছিলাম?”

“চাচীজান তো বললেন আপনি এখনও ফেরেননি। তাছাড়া দ্বার-এ পাহারারত প্রহীরাও কিছু বললো না আমায়?”

“ক্ কি করে বলবে? আমি তো পশ্চাৎ দ্বার থেকে প্রাসাদে প্রবেশ করেছি।”

“আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন চাচাজান! সেখানেও আমাদের প্রহরীরা থাকে। ওরাও আমাকে কোনো খোঁজ দেয়নি।”

“তুমি কি আমার পেছনে গুপ্তচর রেখেছো?”

“না চাচাজান। আমার আপনাকে এক বিশেষ কাজে প্রয়োজন ছিলো। যার কারনেই আপনাকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি। তাছাড়া, আপনি কি আমার অগোচরে এমন কোনো কাজ করছেন যার কারনে আমার গুপ্তচরের শরণাপন্ন হতে হয়?”

চাচাজান ঘাবড়ে পড়লেন। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের জড়ো হয়েছে। সবটাই নিখুঁত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে রাজকন্যা। চাচাজান গোপনে নিঃশ্বাস ছাড়েন। রাজকন্যার সম্মুখে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলেন,

“কি বিশেষ কাজ?”

“আপনাকে আমার হয়ে ছোট্ট একটা ঘোষনা দিতে হবে রাজ্যবাসীর কাছে?”

চাচাজান পূনরায় ঘাবড়ান! পরপর বার কয়েক ঢোক গিলে বলেন,

“ক্ কি ঘোষণা?”

রাজকন্যা মুচকি হাসে। আর সেই হাসিতেই লুকিয়ে থাকে হাজারও একটা রহস্যের ছাপ। নিজের মাঝে একটা দাম্ভিকতার সুর টেনে বলে,

“আপনাকে ঘোষনা করতে হবে রাজা সিরাজ উদ্দীনের শূন্য আসনে আজ থেকে বিরাজ করবেন রাজকন্যার হূরিয়া!”

রাজকন্যার কথাটায় চমকে উঠলেন চাচাজান। তিনি এমন ভাবে চমকালেন যেন এমন বিস্মিত, অবিশ্বাস্য বানী তিনি এর আগে কোনোদিন শোনেননি। রীতিমত বজ্রাহত হলেন তিনি।

“কি?”

“জি চাচাজান।”

রাজকন্যা নরম কন্ঠে জবাব দিলো। চাচাজান স্বপ্ন ভঙ্গের ন্যায় কিছুক্ষন স্থবির দাঁড়িয়ে রইলেন। অতঃপর ধীরপায়ে প্রস্থান করলেন নিজের কক্ষের দিকে।

রাজকন্যারা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। মনেমনে বলল,

“খুব শ্রীঘ্রই ফাঁস হবে চাচাজান! সবটা ফাঁস হবে।”

____________

“কি!! ঐ পুঁচকে মেয়ে এখন রাজ্য শাসন করবে? আর আমাকে সেটাও দেখতে হবে?”

বজ্রকন্ঠে হাঁক ছাড়লেন ওস্তাদজী। উপস্থিত রেদোয়ান সহ সবার ভেতরেই ভয়ের রেশ ঢুকে গেলো তার বজ্রকন্ঠে। সবাই মাথা নীচু করে জমিনের দিকে তাকিয়ে আছে। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। মুলত জবাব দেওয়ার দুঃসাহস নেই!

“আয়াস কোথায়?”(চেঁচিয়ে)

“ওস্তাদজী, সরদার তো তার কক্ষে নেই। স্বীকারের বেরিয়েছেন!”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো ওস্তাদজী।

“এখন কি স্বীকার করার সময় হ্যাঁ? তাকে এক্ষনি ডেকে পাঠাও। জানাও তার আব্বাজান স্বরন করেছে তাকে!”

“আব্বাজান.. আমি তো এখানে!”

বলতে না বলতেই আগমন ঘটলো তাহার পুত্রের। হাতে তীর-ধনুক নিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো আব্বাজানের সামনে। আশেপাশে সবার ভয়ার্ত মুখ পানে একবার দৃষ্টি রেখে হাতের তীর-ধনুকটা বাড়িয়ে দিলো রেদোয়ানের দিকে। রেদোয়ান দেরী না করে নতশির করে তীর-ধনুকটা নিয়ে নিলো। ওস্তাদজী রাগ আর ক্ষোভে এখনও আগুন প্রায়। যদিও পুত্রের আগমনে কিছুটা হলেও দুঃশ্চিন্তা কমছিলো কিন্তু হঠাৎই আবার রাজকন্যার সিদ্ধান্তের কথা মনে পড়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলেন ভেতরে। ফোঁস ফোঁস শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগলেন। আয়াস হাত বাড়িয়ে আব্বাজানের দুই বাহুতে রাখলো। কন্ঠ কোমল রেখে পূনরায় শুধালো,

“কিসের এতো দুঃশ্চিন্তা করছেন আপনি?”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে একপ্রকার মিইয়ে পড়লো ওস্তাদজী। পুত্রের হাতের উপর হাত রেখে ক্লান্ত স্বরে বললেন,

“হূরিয়া রাজ সিংহাসনে বসবে বলে ঘোষনা করেছে আয়াস। আমরা কি তবে হেরে যাচ্ছি আমাদের উদ্দেশ্যের পথে?”

আয়াস মৃদু হাসলো। ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,

“ব্যস? এইটুকুই?”

ওস্তাদজী অবাক হলেন। খানিক রাগ মিশ্রিত গলায় বললেন,

“ব্যাপারটা তুমি এতো হালকা ভাবে নিওনা আব্বাজান! আমাদের এতো বছরের সাধনায় এমন করে জল পড়তে দিওনা।”

“রেদোয়ান..(গলা উঁচিয়ে)”

” আদেশ করুন সরদার?”

“আব্বাজানের জন্য ঠান্ডা একগ্লাস শরবতের ব্যবস্থা করো। আর হ্যাঁ.. বন্দীশালার বন্দী রাজা সিরাজ উদ্দীনকে দিতে ভুলোনা যেন।”

“যথাআজ্ঞা সরদার।”

এই বলে চলে গেলো রেদোয়ান। আয়াস আবারও গলা উঁচিয়ে ডাকলো,

“এই মকবুল? আব্বাজানের বসার ব্যবস্থা কর।”

“আজ্ঞে সরদার।”

মকবুল নামের ছেলেটিও ছুটলো। ঠিক সিংহাসনের ন্যায় বড় একটা চৌপায়া নিয়ে হাজির হলো সে। ওস্তাদজীর সামনে রেখে মাথা নত করে সেখানে বসবার জন্য অনুরোধ করলো। আয়াস তাকে বসিয়ে দিলো সিংহাসনে। অতঃপর নিজেও বসলো আব্বাজানের পায়ের কাছে। পায়ে মালিশ করতে করতে বলল,

“আমি আপনার একমাত্র পুত্র আব্বাজান। আপনার দুই নয়নের মনি। আপনি যেমন আমায় খুব ভালোবসেন স্নেহ করেন ঠিক তেমনই আমিও আপনাকে খুব ভালোবাসি আর সম্মান করি আব্বাজান। আপনি আমার কাছে ছোট্ট একটা আবদার করেছেন আব্বাজান। আর আমি সেই আবদার রাখবোনা এ যে অসম্ভব! আমি যে আপনার লাগি নিজের জান টাও কবজ করতে দ্বিধা করিনা আব্বাজান। আপনি শুধু ভরসা রাখেন আপনার পুত্রের উপর। আমি আপনার আবদার পূরন করবো। করবোই করবো।”

ওস্তাদজী এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন আয়াসের দিকে। উপরে স্নেহ দেখালেও ভেতরে ভেতরে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। শত্রুর উপর ভরসা করা যায় না। তবুও সে করছে! কারন সে শত্রুকেই নিজের হাতিয়ারের ন্যায় ধারালো অস্ত্র হিসেবে গড়ে তুলেছে এতোদিন। হ্যাঁ, আয়াস তার নিজের সন্তান নয়। সে তো ইহকালেও কাউকে বিয়েই করেনি। দীর্ঘ পঁচিশ বছরের ইতিহাস তিনি একা গোপনে বহন করে এসেছেন। আজও বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। না জানি আরও কতকাল বয়ে নিয়ে যেতে হবে। নিজের স্বার্থ না থাকলে কবেই যে দি’খন্ড করতো এই অতিবুদ্ধি সম্পন্ন পুত্রের। মাঝেমাঝে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেন জীবনের এই বার্ধক্যে পৌঁছে। বয়সের সাথে সাথে শক্তি বাড়েনা। যেটার আক্ষেপ রয়ে যাবে তার গোটা জীবনটায়।

“কি ভাবছেন আব্বাজান?”

ভাবনার ঘোর কাটে ওস্তাদজীর। কিছুটা চমকান তিনি। কি জবাব দিবেন ভাবতে ভাবতে হুট করে বলে উঠলেন,

“সিরাজের কন্যা বড়ই চতুর! কখন কি করে..”

“আপনার পুত্র এখনও বেঁচে আছে আব্বাজান। ছোট্ট একটা মানুষ.. একটু সখ হয়েছে পিতার সিংহাসনে বসার! বসুক.. একটু আরাম আয়েস করুক? অসুবিধা তো নেই। সময় হলে ঐ ছোট্ট মানুষটার থেকে কি করে সবটা কেড়ে নিতে হয় আপনিও দেখবেন আব্বাজান।”

“আমাদের সময় টা আসবে কোন ক্ষনে?”

“আসবে। অতিশীঘ্রই আসবে।”

“সরদার, শরবত।”

“হু.. বলে হাত বাড়িয়ে শরবতটা নিয়ে নিলো আয়াস। অতঃপর আব্বাজানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

” শরবতটা খেয়ে মাথা ঠান্ডা করেন আব্বাজান। আমি আসছি।”

“কোথায় যাচ্ছো তুমি?”

“রাজকন্যার কাছে!”

_____________

রাতের মধ্য প্রহর। রাজকন্যা কাঁচা ঘুম থেকে ডেকে তুললো রাজকুমারকে। রাজকুমার চোখমুখ কুঁচকে দেখছে রাজকন্যাকে। তার ঘুমের রেশ কাটেনি এখনও। তাই চোখ মেলে তাকাতে কষ্ট হচ্ছে।

“কি হলো রাজকন্যা! এই নিশীথে কি কাউকে ডেকে তুলতে হয়?”

রাজকন্যা মুচকি হাসলো। হাত বাড়িয়ে রাজকুমারের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

“আজ চাঁদনি রাত। চলুন না চন্দ্রবিলাস করবো?”

“আমার ঘুম আসছে।”

“উফফ চলুন তো।”

এই বলেই হাত টেনে শয্যা থেকে নামিয়ে আনলো রাজকুমারকে। অতঃপর টেনে নিয়ে গেলো একদম রাজপ্রাসাদের বাইরে উপবনে(বাগানশোভিত)। অম্বরের বক্ষ চিঁড়ে নিশাকান্তের আলো পড়েছে সমস্ত উপবনে। জ্বলজ্বল করে জ্বলছে চারিধার। চোখ জুড়িয়ে এলো রাজকন্যার। এমন মধুর ক্ষন আর বুঝি হয়না। হতেই পারেনা। এটাই যেন এই বসুন্ধরার সবচেয়ে বিশেষ ক্ষন। সবচেয়ে সুন্দর, মধুর ক্ষন। এই ক্ষনের প্রেমে পড়তে চায় রাজকন্যা। গভীর প্রেমে পড়তে চায়। উপবনের ঠিক মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে রাজকন্যা। নিশাকান্তের আলো এবার সমস্তটা তার অঙ্গে বিরাজ করছে। চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে তুলছে তাহার সারা অঙ্গ। দূর থেকে দাঁড়িয়ে তার মনোহরণিকে দেখে চোখ জুড়াচ্ছে রাজকুমার। মাঝেমাঝে নিজেকে যে ঠিক কতটা ভাগ্যবান বলে মনে হয় সে নিজেও জানেনা। এই ধরণীর একমাত্র ভাগ্যবান পুরুষ সে।

রাজকন্যার চোখে চোখ পড়লো রাজকুমারের। রাজকন্যা লজ্জামিশ্রিত চমৎকার হাসলো। হাত বাড়িয়ে ইশারায় কাছে ডাকলো তাকে। রাজকুমার দাঁড়িয়ে না থেকে এগিয়ে গেলো রাজকন্যার পানে। ঠিক তার সম্মুখে দাঁড়ালো। আত্মতৃপ্ত কন্ঠে বলল,

“উপরওয়ালা আপনাকে কি দিয়ে তৈরি করেছে বলুন তো?”

রাজকন্যা হেসে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্য মান হলো তার আঁকাবাকা গজদাঁত। বাতাসের গতি খুবই অল্প। অল্প বিস্তর গতিতে কপালের উপরের চুল গুলো মৃদু তালে উড়ছে। রাজকন্যা সেগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে বলল,

“স্বামীর পাঁজরের হাড় দিয়ে নাকি স্ত্রীকে তৈরি করা হয়। সেই মাফিক আমিও আপনার অংশেই সৃষ্টি জনাব।”

রাজকুমার হাসলো। প্রশংসনীয় হাসি। হাত বাড়িয়ে রাজকন্যার দু’গালে আলতো করে রাখলো৷ ঠোঁটের হাসিটা বজায় রেখে বলল,

“আজ যখন আপনাকে সিংহাসনে বসতে দেখলাম, আমি ক্ষনিকের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম! আপনার শাসন,আপনার বারন, আপনার ন্যায় বিচার, ন্যায় বানী.. সবটাতেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েছি আমি। আপনি যে পরিপূর্ণ নিখুঁত মনোহরণি। পরিপূর্ণ নিখুঁত। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি বড়ই কৃতজ্ঞ। কেননা আমি ভাগ্যবান।”

কথাগুলো বলতে বলতে রাজকুমার যেমন মুগ্ধ হচ্ছিলো ঠিল তেমনই মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনছিলো রাজকন্যা। কিন্তু হঠাৎ ঘটে গেলো এক অকল্পনীয় কান্ড। বড় অশ্বত্থ গাছটার আড়াল থেকে তীর এসে সোজা বিঁধে গেলো রাজকন্যার বাহুতে। রাজকন্যা চাপা আর্তনাদ করে লেপ্ট গেলো রাজকুমারের সঙ্গে! রাজকুমার আঁতকে উঠে রাজকন্যাকে আগলে ধরে পাশে সরে যেতেই আরেকটা তীর তীব্র তেজে ছুটে এলো। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তীরটা তাদের ছুঁতে ছুঁতে বেরিয়ে গেলো। রাজকুমার হাঁক পেড়ে প্রহরী ডাকতেই ঝোপঝাড় ভেঙে পালালো গুপ্তচর!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here