রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-১৬

0
312

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[১৬]

হাতের ক্ষতস্থানে কারোর ছোঁয়া পেতেই ঘুম ভেঙে গেলো রাজকন্যা। চোখ মেলে পাশে তাকাতেই দেখতে পেলো জিন্নাতকে। মলিন মুখে তার হাতের ক্ষতস্থানে হাত বুলাচ্ছে। অস্পষ্ট শব্দে কিছু পড়ছে। পড়া শেষ হতেই মুখটা খানিক এগিয়ে এনে ফু দিলো। রাজকন্যা স্তিমিতনেত্র দেখতে লাগলো। জিন্নাত দেখেনি রাজকন্যার ঘুম ভেঙে গেছে। হঠাৎ তার চাহনি বোধগম্য হতেই কাতর কন্ঠে বলল,

“দুঃখিত রাজকন্যে। আমি তোমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে চায়নি।”

রাজকন্যার দৃষ্টি নড়ে। ভাবনার ঘোর কাটে। ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা টানার চেষ্টা করে বলে,

“অনেক ঘুমিয়েছি। আর বোধহয় প্রয়োজন হবে না।”

এই বলে উঠতে চেষ্টা করলো। জিন্নাত বিস্মিত হলো। হাত ঠেকিয়ে বাঁধা দিলো তাকে। পূনরায় শুয়ে দিয়ে বলল,

“একদম উঠবে না। এই মুহুর্তে বিশ্রাম করা ফরজ তোমার জন্যে।”

“আমি ঠিক আছি জিন্নাত। তোমরা আমায় নিয়ে এতো ভেবোনা!”

“ঠিক থাকো কিংবা না থাকো। এখন কেবল বিশ্রাম নেবে ব্যস।”

রাজকন্যা জিন্নাতের জেদের কাছে হার মেনে হাসলো। বলল,

“আচ্ছা বেশ। নেবো বিশ্রাম। তার আগে বলো দুটো দিন ছিলে কোথায়? জানো কতকি কান্ড ঘটে গেছে?”

“সব জানি রাজকন্যে। সব জানি।”

জিন্নাতের গলা কেমন শোনালো। কাতর স্বর। আবার চিন্তিত খানিক। রাজকন্যা ভ্রু কুঁচকালো। জিন্নাতের মনে কি চলছে বোঝার চেষ্টা করতে করতেই জিজ্ঞেস করলো,

“তোমার হঠাৎ কি হয়েছে? এতো চিন্তিত কেন তুমি?”

জিন্নাত চিন্তার জগতে হাতছানি দিলো। অন্যমনস্ক হয়ে বলল,

“রাজকন্যে,তোমার মনে আছে আরোভিকে খুঁজে পাওয়ার দিন আমি তোমায় বলেছিলুম আমি একজনকে দেখেছি! খুব চেনা চেনা লেগেছিলো কিন্তু চিনতে পারছিলাম না?”

রাজকন্যা ভাবতে চেষ্টা করলো। তার বেশি গহ্বরে ভাবতে হয়নি। অল্পতেই স্বরন করতে পারলো জিন্নাতের কথাটা। উদগ্রীব কন্ঠে বলল,

“হ্যাঁ মনে আছে বৈ কি। তুমি কাকে দেখেছিলে জিন্নাত?”

জিন্নাত হাওয়ায় ভেসে দাঁড়ালো। মেঝেতে রাখা তার ঝুলিটা উঠিয়ে রাজকন্যার পাশে রাখলো। অতঃপর ঝুলি হাতিয়ে একখানা চিত্র বের করে রাজকন্যা সামনে ধরে বলল,

“আমি এই ব্যাক্তিতে দেখেছিলাম সেদিন।”

রাজকন্যা নিজের আগ্রহ চেপে আর শুয়ে থাকতে পারলো না। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। চিত্রখানা নিজের হাতে নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলো। চিনতে পারলো না। তবে,অচেনাও যে মনে হচ্ছে না। কারোর মুখের সাথে গাঢ় মিল। তবে মনে পড়ছে না। তার বিস্ময় পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। জিন্নাতের দিকে একবার তাকালো। ফের চিত্রখানা দেখে বলল,

“আমি চিনতে পারছিনা উনাকে। তবে কোথাও তো দেখেছি নির্ঘাত।”

জিন্নাত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চিত্রখানার প্রতি স্থির দৃষ্টি রেখে বলল,

“উনি হলেন বেগমজির সোয়ামি। মানে তোমার ফুপাজান!”

রাজকন্যা হতবিহ্বল হলো। অবাকের চূড়ান্তে পৌঁছে হা করে তাকিয়ে রইলো চিত্রখানার দিকে। সে তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। অবিশ্বাস্য গলায় বলে উঠলো,

“সে কি করে সম্ভব জিন্নাত! লোকমুখে শোনা গেছে উনি দীর্ঘ পঁচিশ বর্ষ আগে মারা গিয়েছেন।”

জিন্নাত গম্ভীর গলায় জবাব দিলো,

“না রাজকন্যে। লোকমুখে রটনা ছড়িয়েছে। ছড়িয়েছে বললে ভুল হবে,ছড়ানো হয়েছে। উনি মারা জাননি। উনি আজও বেঁচে আছেন। আর এটাই সত্যি।”

রাজকন্যার বুক কেঁপে ওঠে। এ কেমন রহস্যের বেড়াজাল। যে মানুষটা আজও বেঁচে আছে তাকে কেন দীর্ঘ পঁচিশ বর্ষ আগে মৃত বলে ঘোষনা করা হয়েছে? এর পেছনে কার কোন উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে? কেন এমন মিথ্যে রটনা ছড়ানো হয়েছে!

“আমি সেদিন রাতেই পূনরায় ঐ জঙ্গলে যাই। তখনও এক মায়াজাল দিয়ে চারপাশ সুরক্ষিত রাখা হয়েছিলো। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে ফুপাজান ওখানেই আছেন। আমি পরপর দু’দিন ঐ জায়গা নজরবন্দী করি। কিন্তু কোনো উপায়ে সে বুঝে যায়। ফের নিজে জাল বুনে। আবার নিজেকে সুরক্ষার জালে বন্দী করে। কিন্তু অবশেষে পার পায়নি। আমি উনাকে দ্বিতীয় বারের মতো দেখে নেই দুচোখ ভরে। এই চিত্রখানা আমি উদ্ধার করি রাজপ্রাসাদের সবচেয়ে পুরনো চিত্রকারের থেকে। উনার কাছে এই প্রাসাদের ছয় পুরুষের চিত্র আছে। যার মধ্যে ভাগ্যক্রমে এই চিত্রখানা পেয়ে যাই। এই চিত্র তার যৌবনের। তবে এখন সে বার্ধক্যে এসে পৌঁছেছে। তাই হঠাৎ দেখলে গরমিল মনে হতে পারে।”

সবটা শুনে মাথায় দুশ্চিন্তার বোঝা চাপলো রাজকন্যার। চিন্তান্বিত কন্ঠে বলল,

“উনি কি কারোর হাতে বন্দী?”

“না রাজকন্যে। উনি কারোর হাতে বন্দী নয়। বরং আমার মনে হয় উনার হাতে কেউ বন্দী।”

“কে!”

“জানিনা। আমাদের খোঁজ জোগাড় করতে হবে।”

“নিশ্চয়ই। খোঁজ তো আমরা জোগাড় করবোই।”

“কিন্তু রাজকন্যে তোমার এই শরীরে..”

“এই মুহুর্তে আমি নিজের কথা ভাবতে পারবো না! অসম্ভব!”

____”মানে! রাজকন্যা আপনি এসব কি বলছেন?”

দরজার সম্মুখ থেকে ভেসে আসে রাজকুমারের গলা। রাজকন্যা হকচকিয়ে তাকায়। রাজকুমার প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। রাজকন্যা ভীত মনে ঢোক গিলে। আঁড়চোখে নিজের পাশে দেখতেই অনেকটা নিশ্চিত হয়! নাহ্__ চলে গেছে জিন্নাত। কিন্তু.. রাজকুমার কি শুনে ফেলেছে তাদের কথা? মুহুর্তেই ভয়টা কেটে গেলেও পরক্ষণেই আবার দিগুন ভয়ে ঢোক গেলে রাজকন্যা। প্রভুর কাছে প্রার্থনা জুড়ে,যেন রাজকুমার তাদের কথোপকথন শুনতে না পায়।

রাজকুমার কপাল কুঁচকে রেখে এগিয়ে এলো। রাজকুমারের পা যত এগোচ্ছে রাজকন্যার ভয় তত বাড়ছে। একপ্রকার আতংক সৃষ্টি হলো রাজকন্যার চোখে মুখে। ঠিক একই আতংক রাজকুমারের মুখেও। সে পূনরায় আওড়ালো,

“আপনার এমন শারীরিক অবস্থায় আপনি নিজের কথা না ভেবে রাজ্যের কথা ভাবছেন? রাজকন্যা, আগে আপনার নিজের সুস্থ হতে হবে,নিজের আগে ঠিক হতে হবে। তারপরই তো আপনাকে রাজ্য সামলাতে হবে তাই না? আপনি কেন নিজর কথা ভাবছেন না?”

রাজকন্যা ঠিক ঠাওরে উঠতে পারলোনা রাজকুমারের কথা। এবারও সেও প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে তাকালো। রাজকুমারের বিশেষ ভাবাবেগ হলো না রাজকন্যার চাহনিতে। সে তার মতোই বলে যেতে লাগল,

“আর একবার যদি শুনেছি আপনি নিজের কথা না ভেবে এই রাজ্যের কথা ভাবছেন তবে দেখুন কেমন করে বকি আমি? রাজকন্যা, এই রাজ্যের রাজাই যদি ঠিক না থাকে তবে রাজ্য কেমন করে ঠিক থাকবে? আপনাকে তো আগে নিজেকে ঠিক করতে হবে। তারপর তো রাজ্যের কথা ভাববেন!”

রাজকন্যা গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার মানে রাজকুমার তাদের মধ্যে শুনেনি। সে কেবল শেষ লাইন টুকুই শুনেছে।

“জি।”

“জি! কেবল জি? আমি যা বললাম তা কি ঢুকেছে মস্তিষ্কে।”

রাজকন্যা ঠোঁট বাঁকালো। বাচ্চাসুলভ কন্ঠে বলল,

“জি ঢুকেছে।”

রাজকুমার তার ভাবভঙ্গি দেখে হাসলো। শয্যায় রাজকন্যার পাশে বসে তার মুখবিবরে আলতো করে হাত রাখলো। অতঃপর ললাটে ভালোবাসার পরশ একে কোমল স্বরে বলল,

“শুকরিয়া।”

আকস্মিক এক শব্দ ভেসে আসলো রাজকন্যার বারান্দা থেকে। কিছু একটা পড়ে গেছে মনে হলো। রাজকন্যা এবং রাজকুমার দু’জনেই চমকে উঠলো। পরক্ষণেই সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালো সেদিকে। রাজকন্যা কপাল কুঁচকে গলা উঁচিয়ে বলল,

“কে ওখানে?”

কোনো শব্দ পাওয়া গেলো না। রাজকুমার উঠে দাঁড়ালো। ক্রোধে কপাল কুঁচকে এলো তার। এতোবড় স্পর্ধা.. তাদের কক্ষের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেউ তাদের কথা শুনছিলো। দ্রুত পায়ে হেঁটে যায় রাজকুমার। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। দিনের শেষ প্রহর। চারদিকে মিঠে আলো। সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুবুডুবু। রাজকন্যার গলা পাওয়া গেলো,

“রাজকুমার?”

রাজকুমার পূনরায় ভেতরে চলে যায়।

“কেউ নেই।”

রাজকন্যার দুশ্চিন্তা এবার আরও এক ধাপ বাড়ে। তাদের কথোপকথন রাজকুমার শুনতে না পেলেও কেউনা কেউ ঠিকই শুনেছে। কিন্তু কে?

নিকষ কালো রাত। আজ অম্বরে নিশাকান্তের দেখা নেই। অমাবস্যা হয়তো। খোলা অম্বরের নীচে ফাঁকা জমিনে ঠাঁই নিয়েছে আয়াস। ভাবছে বিভোর হয়ে।ক্রমশই এক অজানা ভয় তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিচ্ছে। মরমে মরে যাচ্ছে সে। আজকাল নিশ্বাস নিতে ভয় হয়। মনে হয় বিষাক্ত হাওয়া গিলে নিয়েছে। এক্ষনি মৃত্যু হয়ে যাবে। অথচ কোনো একদিন এই মৃত্যুকেই ভয় পেতো না। তার জন্মটাই তো ছিলো বিষাক্ত হাওয়ায়। সময়ের সাথে সাথে বিষাক্ত হাওয়াই হয়ে উঠলো তার অভ্যাস। পাপে পাপে জর্জরিত জীবনটা হয়ে উঠলো জাহান্নাম। কিন্তু এই জাহান্নামের ন্যায় জীবনটাই উপভোগ্য ছিলো। ভালো লাগতো। উপভোগ করতো। কিন্তু আজ! আজ যে সবটা ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে। পেছনের ফেলে আসা কালো অতীতে যখন রাজকন্যার পাদচারণ ঘটে সবটা পাল্টে যায়। তার পাপিষ্ঠ জীবনটা হঠাৎ জান্নাত হয়ে ওঠে। সুখের লোভ লেগে যায় তার। একটু ভালো থাকার লোভ। কিন্তু তা যে আদৌ সম্ভব নয়। যে কন্যাকে সে মন দিয়ে বসেছে সেই কন্যাকেই যে নিজ হাতে বলি দিতে হবে তাকে। হ্যাঁ___এটাই তার বাস্তবতা। এটাই তার ধর্ম।

“সরদার? রাজকন্যা তো ওস্তাদজীর প্রানপ্রিয় বন্ধু নাজিমউদ্দীনের সন্ধ্যান পেয়ে গেছেন!”

রেদোয়ানের কন্ঠে এমন বানী শুনতেই তন্দ্রা ছুটে গেলো আয়াসের। ধপ করে জ্বলে উঠলো বুকের ভেতরটা। শোয়া থেকে উঠে বসলো। মনের মাঝে বিরাজ করলো অজানা ভয়। রাজকন্যার সম্মন্ধে আর কতশত অজানা তথ্য বেরোবে জানা নেই তার। এ যেন মেয়ে নয়। অন্য কিছু!

“রাজকন্যার সঙ্গে সার্বক্ষণিক এক জ্বীন থাকে সরদার। রাজকন্যাকে এই খবর সেই দিয়েছে।”

ফোঁস করে উঠলো আয়াস। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হুকুম করলো,

“ঐ জ্বীনকে এক্ষনি বন্দী করার ব্যবস্থা করো। এমন ভাবে বন্দী করো যেন সারাজীবনের জন্য মনুষ্য সঙ্গের নাম নিতেও ভুলে যায়।”

“আজ্ঞে সরদার।”

রেদোয়ান ছুটে যায়। আয়াস চোখ বুঁজে টেনে বড় করে নিশ্বাস ছাড়ে। রাজকন্যার মুখ টা মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু মনে পড়েনা। তার এই কালো মনে রাজকন্যার পবিত্র মুখটা যে ভাসে না। তাতে আরও বেশি যন্ত্রণা হয় তার। অসহায় কন্ঠে বলার চেষ্টা করে,

“ক্ষমা করে দিও হুরপরী। আমায় ক্ষমা করে দিও।

#____চলবে🌸

[ নীরব পাঠক আছেন কি কেউ? সাড়াদিন। আপনাদের জন্য গুড নিউজ আছে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here