রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-১৭

0
325

#রাজকন্যা_হূরিয়া🤍🌸
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[১৭]

বাতাসের তীব্র বেগে ছিটকে পড়লো জিন্নাত। লোহার কারাগার হঠাৎ দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো অগ্নিশিখায়। জিন্নাত ভয়ে গুটিয়ে গেলো। চারপাশে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো এক খানা পরিচিত মুখ। জিন্নাত আঁতকে উঠল। গলা থেকে সেই আর্তনাদের শব্দ শুনতে পেলো ব্যাক্তিটি। শুনতেই যেন উল্লাস বেড়ে গেলো তার। সামনের দাঁত কপাটি বের করে হাসতে লাগলো বিকট শব্দে। জিন্নাত কোনোমতে উঠে দাঁড়ালো। তার শরীরের প্রত্যেকটা জায়গা কে’টে-ছিঁ’ড়ে নাজেহাল অবস্থা হয়েছে। দেখতেই ভীষণ শোচনীয় লাগছে। অথচ কেমন করে সহ্য করছে জিন্নাত! খুড়িয়ে খুড়িয়ে দু’কদম এগোলো সে। সামনের ব্যাক্তিটার দিকে আক্রোশের সহিত তাকিয়ে ক্রোধান্বিত কন্ঠে বলল,

“এতো বড় ধোঁকা! এতো বড় ধোঁকা আমার হলো কি করে?”

জিন্নাতের কথাটা ব্যাক্তিটির কানে কোনো হাসির বাক্য মনো হলো যেন। তার হাসির বেগ বাড়লো বৈ কমলো না। জিন্নাত আবারও কুঁকড়ে পড়লো যন্ত্রণায়। এমতবস্থায় তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকাও মানে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমান।

“অতি বাড় বেড়োনা, ঝড়ে পড়ে যাবে।”

ক্ষিপ্ত অথচ শান্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো জিন্নাত। মানুষটা হঠাৎ নিজের হাসি থামিয়ে নিলো। কিছুক্ষন গম্ভীর থেকে হঠাৎ বলে উঠলো,

“ভাঙ্গবে তবুও মচকাবে না হু? তুমি জানো এই মুহুর্তে কোথায় আছো তুমি?”

দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলতে বলতে আবারও অট্টহাসিতে কাঁপিয়ে তুললো চারিপাশ। জিন্নাত অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার রাজকন্যের এতো বড় বিপদ হতে যাচ্ছে আর সে এমন করে বন্দী হয়ে গেলো? কি করে মুক্তি পাবে এই দোজখ খানা থেকে। এর সবটাই যে আরবি হরফ দিয়ে আঁটকে দিয়েছে।

জিন্নাতের অস্থির দৃষ্টি অনুসরণ করে সে বলতে লাগলো,

“পালানোর পথ খুঁজছো? হাহাহা। তুমি এতোটাও বোকা নও! তাই এসব বোকা বোকা ভাবনা ছেড়ে দাও।”

জিন্নাত ফোঁস করে উঠলো। মানুষটা ভয় পাওয়ার নাটক করে আবারও হাসত লাগলো। যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে গলা খাদে নামিয়ে বলল,

“শোনো হে, মূর্খ পরী? তুমি মাটির একশহাত নীচে পাতালপুরীতে বন্দী। আর এই যে অগ্নিশিখায় গড়া কারাগার দেখছো? এটা একান্তই তোমার জন্য তৈরী, তোমার সাজার গন্ডি রেখা। এখান থেকে না তুমি বের হতে পারবে আর না তোমার রাজকন্যা তোমায় উদ্ধার করতে পারবে। যদি মুক্তি চাও তবে বলো? আমি তোমার চিরমুক্তির ব্যাবস্থা করবো। সত্যি বলছি।”

বলতে বলতে বিকট শব্দে হাসতে হাসতে প্রস্থান করলো মানুষটা। জিন্নাত অসহায় হয়ে বসে রইলো। রাজকন্যের কি হবে? কেমন করে বাঁচবে এই রাক্ষসদের থেকে।

রাজকন্যা রাজদরবার শেষ করলো সবে। রাজসিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই তার সম্মান প্রদর্শনে উপস্থিত সকলেই উঠে দাঁড়ালো। সবাই নতশির করে আজকের মতো রাজদরবার সমাপ্ত করলো। রাজকন্যা ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটিয় তুলে নীচের দিকে নামার জন্য অগ্রসর হতেই কোথা থেকে ছুটে এলো এক আগন্তুক। র’ক্তা’ক্ত দেহ নিয়ে লুটিয়ে পড়লো রাজকন্যার পদতলে। আকস্মিক ঘটনায় হকচকিয়ে গেলো রাজকন্যা সহ রাজ্যসভার সকলে। চাপা গুঞ্জন ভেসে উঠলো বাতাসের সাথে। পাঁচ ছ’জন প্রহরী ছুটে এলো লোকটাকে ধরতে। তবে রাজকন্যার হাতের ইশারায় তাদের নিজ নিজ জায়গাতেই স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। রাজকুমার রাজকন্যার পেছনেই ছিলো। লোকটাকে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখেই সবার প্রথমে সে এগিয়ে এলো। রাজকন্যা তাকে বাঁধা দিলো না। বরং দু’জনে একসাথে মিলে লোকটাকে ধরে বসালো। রাজকন্যা চিন্তিত মনে একবার দৃষ্টি বোলালে লোকটার প্রতি। রাজকন্যার কিছু একটা মনে হতেই ভ্রু কুঁচকে ফেললো সে। একটু দূরে বসা চাচাজানের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফের লোকটার দিকে তাকালো। উদ্বেগ হয়ে আওড়ালো,

“একি! উনি তো আমার রাজ্যের সেনা। রাজকুমারের রাজ্যে যুদ্ধ ঘোষনা হওয়া কালীন উনিও গিয়েছিলেন যুদ্ধ করতে। এতোদিন পর.. এতদিন পর এই অবস্থায় আপনি কোথা থেকে ফিরলেন?”

চাচাজান অস্থির চিত্তে দাঁড়িয়ে পড়লেন হঠাৎ। অগ্রীম বিপদের আভাস পাচ্ছে সে। এই মুর্খ এখানে কেমন করে এলো?

লোকটা হা করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। রাজকন্যা ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকালো রাজকুমারের পানে। বলল,

“উনার জন্য জল আনার ব্যবস্থা করুন দয়াকরে।”

রাজকুমার দ্রুত পায়ে উঠে গেলো। রাজকন্যা আবারও তাকালো লোকটার পানে। লোকটার শরীরে তাজা র’ক্ত। যেন এক্ষনি জখম হয়ে র’ক্তা’ক্ত হয়েছে। রাজকন্যা দু’হাতে ধরে রাখলো লোকটাকে। সন্দেহজনক দৃষ্টিতে বারবার চাচাজানের দিকে দেখছে রাজকন্যা। রাজকুমারের রাজ্য যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে তো রাজকুমার ফিরে এলো অনেকদিন পেরিয়ে গেলো। যত সেনা পাঠানো হয়েছিলো তাদের সবাই তো ফিরে এসেছিলো। তবে এই লোকটা কেন ফেরেনি? এতোদিন যাবত কার নিকটে বন্দী থেকে এমন অত্যাচারীত হয়েছে?

“রাজকন্যা, জল।”

পেছন থেকে রাজকুমারের গলা পেতেই ভাবনার সুতো ছেড়ে রাজকন্যার। পেছন মুড়ে জলটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে চটজলদি লোকটাকে খাইয়ে দিলো। লোকটা জল পান করে একটু সুস্থ বোধ করলো। অতঃপর দুর্বল গলায় বলল,

“রাজকন্যা.. রাজকন্যা! আ্ আপনাকে আমার একটা তথ্য দেওয়ার আছে। আ্ আমি আপনাকে সবটা খুলে বলতে চাই।”

রাজকন্যা উদগ্রীব কন্ঠে বলল,

“অবশ্যই! আপনি বলুন? আমি শুনবো.. আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন? আপনার এমন অবস্থা কি করে হলো?”

দু’চার জন দৌড়ে এলো তাদের পানে। ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

“রাজকন্যা… উনার দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। নয়তো লোকটা বাঁচবে না নিশ্চিত।”

রাজকন্যা কথাটা বুঝলো। কিন্তু সায় দিলো না। সে চায়না আর কোনো তথ্য তার অজানা থাকুক। যেমন আরোভির বেলায় ঘটেছে!

“আ্ আপনার বিরুদ্ধে ষ্ ষ্..ষড়যন্ত্র করছে রাজকন্যা!”

রাজকন্যার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। শুকলো গলায় ঢোক গিললো সে। পাশ ফিরে একবার আঁড়চোখে রাজকুমারের দিকে তাকাতেই লোকটা আবারও বলল,

“এ্ এই যুদ্ধটাও এক্.. একটা ষড়যন্ত্র বৈ আর কিছুই ন্ ন্…”

আর কিছু বলতে পারলো না লোকটা। রাজকন্যার হাতে মাথা রেখেই শেষ নিঃশ্বাস ছাড়লো। রাজকন্যা কেঁপে উঠলো। আতংকিত নয়নে লোকটার তাকিয়ে থাকা দৃষ্টি খানায় চোখ বুলাতেই হাত থেকে পড়ে যেতো নিলো লোকটার নিস্তেজ শরীরটা। রাজকুমার ব্যাপারটা বুঝতেই তড়িঘড়ি ধরে ফেললো লোকটাকে। সবাই হাঁক পেড়ে উঠলো। প্রহরীরা ছুটে এসে সব একজোড় হলো। লোকটার প্রাণহীন দেহটাকে ধরাধরি করে নিয়ে গেলো বাইরে। রাজকন্যা তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। তার মুখখানা নিমিষেই ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে। রাজকুমার রাজকন্যার দৃষ্টি অনুসরণ করে তার কাঁধে হাত রাখলো। অভয় দিয়ে কোমল স্বরে বলল,

“রাজকন্যা, নিজেকে সামলান। লোকটার কথা গুলো এতো গুরুগম্ভীর ভাবে না নিলেও চলবে। হতে পারে ও কোনো গুপ্তচর।”

“না। ও কোনো গুপ্তচর নয়। ও আমার রাজ্যের সেনা। আমার রাজ্যের।”

দৃঢ় কন্ঠে প্রতিবাদ করে উঠলো রাজকন্যা। রাজকন্যার এমন আচরনের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না রাজকুমার। আকস্মিক ভড়কে গেলো। রাজকন্যার সেদিকে হুঁশ নেই। সে ক্রোধান্বিত হয়ে প্রস্থান করলো। রাজকুমার কিছুক্ষন একই ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ চাচাজানের দিকে তাকালো। তার দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিলো। যার পরিপ্রেক্ষিতে পরপর বার কয়েক ঢোক গিললো চাচাজান। মাথা নীচু করে আকাশপাতাল ভেবে চললেন। রাজকুমার আর দাঁড়িয়ে রইলো না। দ্রুত পায়ে ছুটলো রাজকন্যার পেছনে।

রাগে ক্ষোভে রাজকন্যার দৃষ্টি আগুনের ন্যায় আকার নিলো। যেন যেদিকেই তাকাচ্ছে সেদিকেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ঠিক এমন মুহুর্তে তার সামনে ধ্বংস হতে চলে এলো আরহাম। সেও এই পথ ধরেই যাচ্ছিলো। আকস্মিক রাজকন্যার সামনে পড়ায় থতমত খেলো। কি করবে ভেবে না পেয়ে আশেপাশে তাকাতে লাগলো। একবার নতশির করে শ্রদ্ধা জানায় একবার আশেপাশে পালানোর পথ খোঁজে। রাজকন্যা কি ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ে হঠাৎ। তার ক্রোধানল দৃষ্টি গিয়ে পড়ে আরহামের পায়ের ক্ষতস্থানে। পায়ে জড়ানো পট্টিটা রক্ত মুখো হয়ে আছে। রাজকন্যার মস্তিষ্ক আগাম বার্তা দিলো। রাজকন্যা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,

“তোমার পায়ের এমন দশা হলো কেমন করে?”

আরহাম হকচকিয়ে গেলো। ধরা পড়া চোরের ন্যায় পায়ের সরে যাওয়া কাপড়টা নীচু হয়ে দ্রুত টেনে দিলো। পট্টি বাঁধা জায়গাটা ঢেকে যায়। আরহাম রাজকন্যার সামনে কি জবাব দেবে ভেবে পায়না। ভয়ে তার গলা আঁটকে গেছে। রাজকন্যার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বিঁধে আছে আরহামের ভীত মুখশ্রীতে। ফের গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো রাজকন্যা,

“চুপ করে আছো যে? কি লুকোচ্ছ তুমি?”

ভয়ে চুপসে যায় আরহাম। এখনও জবাব দিতে পারেনা সে। এমন সময় পেছন থেকে আগমন ঘটে রাজকুমারের।

“গতকালই হয় ওর এই জখম।”

বলে রাজকুমার। রাজকন্যা পেছন মুড়ে তাকায়। অবিশ্বাস্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“কেমন করে হলো?”

এবার রাজকুমারের মুখেও বিরাজমান হয় একই ভয়। রাজকন্যার চাহনি তীক্ষ্ণ হয় ক্রমশ। কি লুকোচ্ছে তারা দু’জনে? কি এমন রহস্য লুকিয়ে আছে আরহামের এই আঘাতের পেছনে?

“রাজকন্যা আমি বলছি?”

আদিমএর আগমন ঘটে এবার। সে বর্ননা করে গুপ্তচরদের খুঁজতে গিয়েই একটা পাহাড়ের খাদে পা পিছলে পড়ে যায় আরহাম। অতঃপর এই জখম। কথা গুলো বিশ্বাস যোগ্য হলেও একটা প্রশ্ন ঠিকই রয়ে যায় রাজকন্যার মনে। তবুও সবাইকে দেখাতে বিশ্বাস করে নেওয়ার ভান করে প্রস্থান করে।

#চলবে

[ বিঃদ্রঃ আমি চাই গল্পটায় অনেক সাড়া হোক। লেখাগুলো খুব সাবধানে আর গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করি। আর সেখানে যদি পাঠকদের রেসপন্স থাকে না থাকার মতো। তখন দুঃখ তো লাগবেই!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here