রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-৩৩

0
580

#রাজকন্যা_হূরিয়া 🌸🥀❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৩৩; [ সমাপ্ত পর্ব ]

ঘরের ভেতর থেকে ওস্তাদজীর চিৎকার করা গলা ভেসে এলো। তার চিৎকার ভেসে আসতেই রাজকন্যার অধরযুগলে ভর করলো রহস্যময় হাসি। সমস্ত চেলারা এবং মেরাজ একত্রেই আতংক ভরা দৃষ্টিতে তাকালো ঘরের দিকে। কয়েকজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ছুট্টে গেলো ভেতরে। মেরাজও গেলো। রাজকন্যা তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। ক্ষণকাল অপেক্ষা করলো তাদের ফেরত আসার। কিন্তু ভেতর থেকে প্রায় অনেক্ষন যাবত কারোর সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। রাজকন্যা এবার একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালো। সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকালো একবার ঘরের ভেতরে।

“সেনাপতি মশাই?”

রাজকন্যা ডাকলো। ডাক পেতেই অপেক্ষারত সেনাপতি আতাউল দ্রুত পা চালিয়ে এসে উপস্থিত হলো রাজকন্যার সম্মুখে।

“রাজকন্যা, আজ্ঞা করুন?”

“আমি যেটা সন্দেহ করছি সেটা ঘটেনি তো?”

“আপনি কি সন্দেহ করছেন?”

“ওস্তাদজী পালায়নি তো?”

সেনাপতি আতাউলের টনক নড়ে। তৎক্ষনাৎ উপস্থিত হয় জিন্নাতও। ভয় মিশ্রিত গলায় বলে,

“সর্বনাশ হয়েছে রাজকন্যে! ওস্তাদজী গোপন সুড়ঙ্গ ধরে পালিয়েছে। প্রবেশ পথ বন্ধ। এখন উপায়?”

রাজকন্যা চমকায়,

“মানে! ওস্তাদজী শেষ অব্দি পালালো?”

“এটাই কাম্য ছিলো রাজকন্যা। আমাদের আরেকটু সতর্ক থাকলে হয়তো…”

সেনাপতি আতাউল বলে ওঠে। তাকে মাঝ পথে হঠাৎ থামায় রাজকন্যা। ফের রহস্যময় হেসে বলে,

“ওস্তাদজীর বাঁচা অসম্ভব সেনাপতি মশাই। কারন সুড়ঙ্গের শেষ পথে উনার জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যুকাল। অবশ্যই সেই ফাঁদ আমি নিজ হাতে তৈরি করেছি।”

“এটা কি সত্যি?”

জানতে চায় সেনাপতি আতাউল। রাজকন্যা হাসে। মাথা নেড়ে বলে,

“সত্যি। চলুন। আমাদের এবার ফিরতে হবে। রাজকুমার হয়তো আব্বাজানকে নিয়ে পৌঁছে গেছেন প্রাসাদে।”

“যথাআজ্ঞা।”

রাজকন্যা আবার ফিরে যায় তার প্রাসাদে। ততক্ষণে রাজকুমার আয়াস এবং রেদোয়ান রাজা সিরাজ উদ্দীনকে নিয়ে পৌঁছে যায় প্রাসাদে। রাজকন্যার পরিকল্পনা ছিলো ওস্তাদজীকে রাজ্যের লোভে ফেলে নিজের আব্বাজানকে উদ্ধার করে আনা। ওস্তাদজী পরিকল্পনা মাফিক সেই ফাঁদেই পা দেয়। এদিকে রাজকুমার, রাজকন্যার কথা মতো রাজা সিরাজ উদ্দীনকে বের করে ঠিক আগের মতো করে কক্ষ তালাবন্ধ করে রাখে। যেন কেউ বাইরে থেকে দেখলেও সন্দেহ করতে না পারে ভেতরে রাজা সিরাজ উদ্দীন নেই।

যখন ওস্তাদজী রাজা সিরাজ উদ্দীনকে নিতে তার তালাবন্ধ কক্ষে প্রবেশ করে তখন তাকে সেখানে দেখতে না পেয়েই চিৎকার করে ওঠে। কেননা, যদি রাজা সিরাজ উদ্দীনই না থাকেন তাহলে তার রাজ্য হাসিল করা চিন্তা নিতান্তই বোকামো। তাই উপায়ন্তর না পেয়ে তিনি তার পুত্র মেরাজকে সঙ্গে করেই পালিয়েছেন। যদি বেঁচে থাকেন তবে নিশ্চয়ই পূণরায় আরও একবার চেষ্টা করা যাবে রাজ্য হাসিল করার।

___🌼

প্রিয় মানুষটাকে পেয়ে প্রায় এক যুগ পরে কথার পিঠে কথা বললেন রাণীমা। আনন্দে আত্মহারা রাজকন্যা আজ চিৎকার করে কেঁদেছে। আব্বাজানকে, আম্মাজানকে বুকে আগলে নিয়ে পাগলের মতো কেঁদেছে। সে পেরেছে, একজন স্বার্থক সন্তান হতে। একজন সন্তান হিসেবে নিজের সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে। এবং গোটা রাজ্যের শাসকদাতা হয়ে নির্ভুল ভাবে তার গোটা সাম্রাজ্যকে সামলাতে। সে সফল হয়েছে। সে নিজের নামের মমার্থ বহন করে নিয়ে যেতে পেরেছে। আর সবার বিশ্বাস তার জীবনের শেষ দিন অব্দি সে পারবে। নিজের রাজ্যকে নিজের করে রাখতে পারবে রাজকন্যা হূরিয়া। তাকে কেউ টলিয়ে দিয়ে তার রাজ্য কেঁড়ে নেওয়ার জন্য আজও কেউ জন্মায়নি। সেদিন থেকেই রাজকন্যা হূরিয়ার জন্য সবার মনে জন্মায় পাহাড় সমান ভালোবাসা,ভয় এবং বিনম্র শ্রদ্ধা।

___

রেদোয়ান অনেক সাধনা করে নিজের করে পেয়েছিলো আগুনের ন্যায় রূপবতী পরীকে। যার রূপে আজও বিমোহিত গোটা ধরণী। কিন্তু বাস্তবতার সাথে পেরে ওঠা তার সাধ্যে ছিলো না। তার পাপের শাস্তি হিসেবেই এক বর্ষ একত্রে থাকার পর জিন্নাতকে নিয়ে যায় তার বংশধরেরা। কেননা, জিন্নাত যখন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছিলো তখন তার জীবন ফিরে পেতে রাজকন্যা জিন্নাতের বংশধরদের কাছে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হয়েছিলো তারা যেদিন জিন্নাতকে নিতে চাইবে রাজকন্যাকে সেদিনই জিন্নাতকে তাদের সঙ্গে ফিরে যেতে দিবে। জিন্নাত ফিরে যায় তার নিজের দেশে। নিজের আপনজনদের কাছে। আর কোনোদিন ফেরেনা। কিন্তু রেদোয়ান আমৃত্যু অপেক্ষা করে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, জিন্নাত একদিন ঠিকই ফিরবে।

রাজকন্যা সেদিন দ্বিতীয় বারের মতো কাঁদে। সে জিন্নাতকে সবার উর্ধ্বে ভালোবাসতো। তাদের এই বিচ্ছেদে ইতিহাস আজও কাঁদে। জিন্নাতকে যেদিন নিয়ে যাওয়া হলো সেদিনই রাজকন্যা জানতে পারলো সে মা হতে চলেছে। সময় এতোটাই স্বল্প ছিলো যে রাজকন্যা এই সুখবর টুকুও জানাতে পারেনি জিন্নাতকে। জিন্নাত এক বুক অভিমান নিয়ে চলে গেলো চিরতরে।

___

সেই ঘটনার আজ পাঁচ বর্ষ চলছে। রাজকন্যা হূরিয়া এখন দুই কন্যা সন্তানের জননী। তাদের বয়স চার। দু’জনই মায়ের মতো তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্না। তবে তার ছোট কন্যা একটু অধিক বুদ্ধিমতি। বড় কন্যা তিয়াসা এবং ছোট কন্যা তুর। তাদের বয়সের পার্থক্য কয়েক লহমা। তুর যেমন দুষ্টামিতে ওস্তাদ তেমন নিজের সততার উপরেও অটল।

তিয়াসা সারাক্ষন নিজের পাঠ্য বই নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তার ইচ্ছে অধিক জ্ঞান অর্জন করে আম্মাজানের মতো রাজ্যভার সামলাবে। কিন্তু তুরের এসবে কোনো আগ্রহ নেই। সে যে আসলে কি চায় সেটা কেউই জানেনা। রাজকন্যা হূরিয়াও নয়।

“আম্মাজান, জিন্নাত কি আর কখনও ফিরবেনা?”

তুর গুনী মনে প্রশ্ন করে। চারপাশে চাঁদনীর উজ্জ্বল আলো। ঝলমলে করছে রাজকন্যার কক্ষ। আয়াস তিয়াসাকে নিয়ে বসে আছে। নানান গবেষণা চলছে বাবা-মেয়ের। এদিকে মা-কে অলিন্দের এক কোনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার মনের কথা যেন এক লহমায় পড়ে ফেললো সে।

রাজকন্যা অদ্ভুত ভাবে দেখে তুরকে। কি যেন ভাবে। তারপর হঠাৎ হাসে। মুচকি হাসি। নীচের দিকে ঝুঁকে মেঝেতে বসে পড়ে রাজকন্যা। তারপর তুরকে কোলে নিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তুরের মাথায় আলতো হাতে বিলি কাটতে কাটতে বলে,

“জানিনা মা। হয়তো আসবেনা।”

“আমার কি মনে হয় জানেন আম্মাজান?”

“কি মনে হয়?”

রাজকন্যা তুরের মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জানতে চায়। তুর চটপট জবাব দেয়,

“জিন্নাত আমাদের সঙ্গেই থাকে। আমি ওকে দেখি আম্মাজান।”

রাজকন্যা মলিন হাসে। ফের দৃষ্টি খানা শূন্যে ভাসিয়ে রাখে। আর আনমনে বলে,

“না রে মা। জিন্নাত নেই। ওটা তোর ভুল ধারণা। ওটা তোর কল্পনা।”

তুর তীব্র প্রতিবাদী গলায় বলে,

“না আম্মাজান। আমি সত্যি বলছি। আপনি বিশ্বাস করুন না আমার কথা।”

“আচ্ছা করছি বিশ্বাস। তুমি জিন্নাতকে দেখো?”

“দেখি তো। কি সুন্দর জিন্নাত। অন্নেক সুন্দর। অন্নেক নরমমম।”

কথাগুলো বলতে ভীষণ ভালো লাগছে তুরের। মায়ের মতো সেও জিন্নাতকে অনেক ভালোবাসে। অবশ্য কোনোদিন দেখেনি তাকে। কেবল কল্পনায় বাঁচে জিন্নাত। কিন্তু তুর তাকে ছুঁয়ে দেখলো কেমন করে?

“কি বললে?” (চমকে উঠে)

“সত্যি আম্মাজান।”

রাজকন্যা তুরকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ন্যায়। উদগ্রীব গলায় জানতে চায়,

” তুমি জিন্নাতকে ছুঁয়ে দেখেছো?”

“হুমমমম।”

তুমুল গতিতে উপর নীচ মাথা নাড়ে তুর। রাজকন্যা কেমন বিমুঢ় হয়ে পড়ে। তবে কি সত্যিই জিন্নাত আসে তার কন্যার কাছে? কিন্তু ওর কাছেই কেন আসে? তার কাছে কেন আসেনা? কিংবা রেদোয়ানের কাছে কেন আসেনা? তিয়াসার কাছেও তো আসেনা। তবে!
কেবল তুরের কাছেই কেন আসে?

“মা জ- জিন্নাত তোমায় কিছু বলেছে?”

তুর গুনী ভঙ্গিতে গালে হাত দেয়। ভাবে। কিছুক্ষন গম্ভীর থেকে হঠাৎ আগ্রহ ভরা কন্ঠে বলে ওঠে,

“হ্যাঁ বলেছে!”

“ক- কি বলেছে?”

তুর যেন লজ্জা পেলো। লাল হাসি দিয়ে বলল,

“জিন্নাত বলে আমি অন্নেককক সুন্দর। একদম আপনার মতো। আমায় বলে আমি নাকি ঠিক আপনার মতো হয়েছি। আপনি যেমন ছিলেন ঠিক তেমন।”

রাজকন্যার হৃদকম্পন বেড়ে যায়। অজানা ভয় ভর করে তার মুখশ্রীতে।

তাকে এমন ভয় পেতে দেখে তুরের উৎসাহ ঘেরা মুখটা চুপসে যায়। অসহায় গলায় বলে,

“আম্মাজান.. কি হয়েছে আম্মাজান?”

“ব- বিপদ!”

অস্পষ্ট স্বরে আওড়ায় রাজকন্যা। কিন্তু তুরের সুক্ষ্ম মস্তিস্কে গেঁথে পড়ে কথাটা। সে অদ্ভুত স্বরে বলে ওঠে,

“আমি থাকতে আমার প্রাসাদে কোনো বিপদের আচ আসতে দিবোনা আমি।”

রাজকন্যা হতবিহ্বল হয়ে যায় তুরের কথা শুনে। অবাক স্বরে আওড়ায়,

“এসব কি বলছিস? তোর বয়সই বা কত! এখনই এসব নিয়ে ভাবছিস? এসব মাথায় আসে কেমন করে?”

তুর হেসে পড়ে। বলে,

“গতকাল মাস্টারমশাই যখন আমায় পড়াচ্ছিলেন তখন উনি বলেছেন। আপা বড় হলে সিংহাসন সামলাবে। আর আমি নাকি রাজ্য সামলাবো।”

রাজকন্যার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্তস্রোত বয়ে যায়। তার চার বছরের কন্যা এসব কি বলছে? আর জিন্নাত? কোন বিপদের বার্তা দিয়ে গেলো?

“রাজকন্যা? দুশ্চিন্তা কেন? কি ভাবছেন?”

সম্মুখ পান থেকে ভেসে আসে আয়াসের গলা। রাজকন্যা ভয়ে কেঁপে ওঠে। এক অজানা ভয় ক্রমশ বক্ষস্থলে বৃহদাকার জায়গা নিয়ে বাস আরম্ভ করে। তবে কি ইতিহাস আবারও পুনরাবৃত্তি ঘটাবে? সেই একই ঘটনা.. সকল পাপ কাজের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে রাজ সিংহাসন!

“আম্মাজান.. আম্মাজান?”

তুরের ছোঁয়ায় ঘোর কাটে রাজকন্যার। সে আবারও চমকায়। তিয়াসাকে নিয়ে আয়াস বসে পড়ে রাজকন্যার সম্মুখে। রাজকন্যার হাত দুটো শক্ত করে ধরে আয়াস। ভরসা জোগায়। ফের আবারও একই কথা জানতে চায়,

“কি হয়েছে?”

“ইতিহাস!”

“ইতিহাস! ইতিহাস কি?”

“রাজ সিংহাসনের জন্য আবারও যুদ্ধ হবে রাজকুমার। আবারও!”

রাজকন্যার কন্ঠে এমন বানী শুনে চমকায় আয়াসও। সেই ঘটনার আবারও পুনরাবৃত্তি!

তিয়াসা কিছু বুঝেনা কি ঘটছে এখানে। কিন্তু তুর ঠিকই হেসে চলেছে। রহস্যময় হাসি।

_______________সমাপ্ত___________________

[ এখানেই সমাপ্ত কেন করলাম জানতে চাইবেন না দয়াকরে। গল্পের শুরু থেকে শেষ অব্দি রহস্য নিয়ে ছিলো। রহস্য নিয়েই সমাপ্ত হলো। কিছু থিম হয় এমন ‘শেষ হইয়াও হয়না শেষ’। রাজকন্যা হূরিয়াও ঠিক ওমনই। জানিনা এই গল্পের মাধ্যমে ঠিক কতটুকু জায়গা দখল করতে পেরেছি আপনাদের মনে।

এতোদিন পাশে থেকে সাপোর্ট করার জন্য ভালোবাসা। পরিশেষে এটাই বলবো ভালোবাসি পাঠকমহল। ভীষণ ভালোবাসি🌼]

  • [ বিঃদ্রঃ কাল থেকে প্রেমগাঁথার নতুন পর্ব পোস্ট করা হবে ইনশাআল্লাহ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here