রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-৪

0
494

#রাজকন্যা_হূরিয়া
#লেখাঃমুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৪.

দুপুরের খাদ্যভোজনের আয়োজন করা হলো একত্রে। নিমন্ত্রণে রইলো রাজপ্রাসাদের অন্যতম অতিথি রাজকুমার সাদ্দাত। সবাই এক এক করে এসে বসল। চাচাজান,চাচীজান,ফুপুআম্মা,আদিম,আলিয়া। রাজকন্যাও বিলম্ব করলো না। যথাসময়ে উপস্থিত হলো। আত্নীয়ের ঘরে ভদ্রতা দেখাতে হয়। দাসী পাঠিয়ে ডাকার পরই দেখা মিলল রাজপুত্রের। সেও এসে বসলো ঠিক রাজকন্যার সম্মুখে। রাজকন্যা সম্পুর্ন দৃষ্টিতে না দেখলেও আঁড়চোখে দেখলো রাজপুত্রকে। শ্যামবর্ণের উজ্জ্বল মুখ তার। চোখা নাক, ভারী পল্লব বিশিষ্টি ভরাট চোখ,মোটা ভ্রু। অধর জোড়া বেশ মোহনীয়। একবার দেখতেই চোখ ফিরিয়ে নিলো রাজকন্যা। পরনে নীলাম্বর পোশাক। কি মানিয়েছে পেটা শরীরে। পেশিবহুল বাহু আঁকড়ে এঁটে আছে। তারউপর রাজকীয় সব গয়নার বাহার। হাতে,গলায়,কানে কোনো জায়গাতেই কমতি রাখেনি কিছু।

“রাজকন্যা? নগর রাজ্যের কথা শুনেছো তো! রাজা রাজত আকবর তোমার আব্বাজানের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। তাদের শৈশব আর কৈশোর একত্রেই কেটেছে। বড় প্রিয় ছিলেন দু’জন দু’জনার। এই হলো রাজা মশাইয়ের একমাত্র পুত্র রাজকুমার সাদ্দাত। গতরাতে মধ্য প্রহরে এসে পৌঁছেছে সে এখানে। রাত করে তোমার সঙ্গে আলাপ করাবো হয়ে ওঠেনি। প্রভাতেও চেয়েছিলাম.. কিন্তু এতো পথ পেরিয়ে আসার পর রাজকুমারের শরীর নিশ্চয়ই ক্লান্ত ছিলো। সেজন্যই দুপুরের আহার-ভোজনের সময়টাই সঠিক বলে মনে হলো।”

কথাগুলো বলতে বলতে রাজকন্যা এবং রাজপুত্রের উভয়েরই সম্পুর্ন মনোযোগ আকৃষ্ট করলেন চাচাজান। তারা দু’জনেই কথাগুলো শুনতে শুনতে একে অপরের দিকে পূর্ন দৃষ্টিতে দেখে নিলো। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসির রেখাও টানল কিন্তু আগ বাড়িয়ে কেউই কিছু বলতে পারলো না। চাচাজান দু’জনের চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু একরকম ব্যর্থতা ছাড়া তিনি কিছুই কুড়াতে পারলেন না।

“রাজকুমার সাদ্দাত।”

খাবার চিবোতে চিবোতে ফুপুআম্মা একবার আওড়ালেন রাজকুমারের নামটা। বড়ই চমৎকার নাম। নামের সাথের মুখের কি মিল!

“জি। আমি রাজকুমার সাদ্দাত।”

ভরাট কন্ঠ তার। কানে গেলেই ঝনঝন করে বাজতে থাকে। ফুপুআম্মার কথার পিঠে জবাব দিলো রাজকুমার। ফুপুআম্মা অত গুরুত্বের সহিত তাকালেন না আর। নিজের খাওয়ায় মনোনিবেশ করলেন।

“রাজকুমার? আমাদের রাজকন্যা কে তো তুমি আগেই দেখেছো। চিত্রকারের কাছে রাজকন্যার আঁকা ছবি?”

রাজকন্যা চমকে উঠলো। রাজকুমার জবাব দিলো,

“জি,দেখেছি। চিত্রকার উনার মুখটা ঠিক করে আঁকতে পারেননি। উনি ছবির থেকে বাস্তবে অনেক বেশি সুন্দর।”

ঠোঁট কাটা পুরুষ! চাচাজান হঠাৎ কোনো জবাব খুঁজে পেলেন না। রাজকন্যা আবারও চমকালো! কারোর থেকে রূপের প্রশংসা পেতে কেই না ভালোবাসে? তাই বলে গুরুজনদের সামনে একটু লজ্জা করবেনা? এ কেমন কথা?

“আব্বাজান? আমাদের সাথে রাজকুমারের আলাপ করাবেন না?”

আলিয়া বেশ উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে আবদার করে বসল। চাচাজানের মুখের রঙ পাল্টে গেলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

“চুপচাপ খেয়ে নিজের কক্ষে যাও। ভোজনের সময় এতো কথা আমার পছন্দ নয়!”

আলিয়ার মুখ খানা চুপসে গেলো। আব্বাজানের কথায় খাওয়া থেকে মনই উঠে গেলো। আব্বাজান সর্বদা তার সঙ্গে এ আচরণই করেন! এর কারন জানা নেই তার। তবে মন থেকে দোষারোপ শুধু রাজকন্যার উপরই আসে। মনেহয়, কেবল রাজকন্যার জন্যই তার আর তার আব্বাজানের সম্পর্কে এতো দূরত্ব। একদিন ঠিক এর হিসাব নিবে সে। ঠিকই নিবে।

“চাচাজান, আপনি আলিয়ার সাথে এমন রূপ আচরন করবেন না। রাজকুমারের সঙ্গে যেহেতু আমার পরিচয় হলো বাকিদের সাথেও হবে। শতহোক উনি আমাদের অতিথি।”

রাজকুমার খাবার খেতে খেতে এক ঝলক দেখলো রাজকন্যাকে। কি মোয়ালেম, মোহময়ী রূপ তার। যেন ঘোরে তলিয়ে যাচ্ছে সে।

চাচাজান ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বলল,

“তুমি ঠিক বলেছো রাজকন্যা। আসলে দোষ আমারই হয়েছে। শরীরের অবস্থা দিন দিন এমন হচ্ছে যে সবকিছুতেই হঠাৎ রেগে যাওয়ার স্বভাব হয়েছে। আমার ছোট রাজকন্যা? আব্বাজানের উপর ক্রোধ রেখোনা!”

আলিয়া হাসলো। স্তিমিত হাসি। চাচাজান আবার আওড়ালেন,

“রাজকুমার? পরিচয় পর্ব সেরে দেই। এই হলো আমার একমাত্র কন্যা আলিয়া,আর আমার পুত্র আদিম। ইনি আমি পত্নী। আর উনি আমাদের ভগিনী। সর্ব-জ্যেষ্ঠ্যা।”

রাজকুমার ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসির রেখা টেনে সবার দিকেই একবার একবার করে তাকালো। সবাই তার সহিত হাসি বিনিময় করলো,একমাত্র ফুপুআম্মা ব্যতীত। তার মস্তিষ্কে বাহ্যিক কোনো ব্যাপার নেই। তিনি আপন মনে আহার গ্রহন করছেন। রাজকুমার কয়েক মুহুর্ত চেয়ে রইলো ফুপুআম্মার মুখপানে। একটু অদ্ভুত বটে মানুষটা। তাকাচ্ছেই না!

” রানী-মাকে দেখছিনা?”

রাজকুমার শান্তস্বরে প্রশ্ন করলো।

চাচাজান,চাচীজান,আর রাজকন্যা একত্রেই মুখ উঁচিয়ে তাকালো রাজকুমারের দিকে। যেন সে কোনো কঠিন কথা বলে ফেলেছে। প্রথম ভাগে সবার হঠাৎ এমন চাহনি দেখে সে ভড়কে গেলো কিঞ্চিৎ! তার ঘাবড়ানো মুখ খানা ধরতে পারলো সবাই। তাই ধীরেসুস্থে তাদের চাহনি স্বাভাবিক করলো। চাচাজান বললেন,

“তার শারীরিক অবস্থা একটু খারাপ থাকে। তাই নিজের কক্ষেই থাকেন তিনি। বাহিরে কমই আসেন।

রাজকুমার বুঝে নিলো। কোমল হাসলো। অতঃপর খাওয়াও মনোযোগ ঢাললো।

____

প্রসাদের পেছনে অবসর সময় কাটানোর জন্য রয়েছে মস্ত বড় উদ্যান। উদ্যানে হরেকরকমের ফুল গাছ,ফল গাছ,জংলী গাল.. বড়বড় অশ্বত্থ গাছ কোনো কিছুরই অভাব নেই। রোজ সাঁঝবেলাতে রাজকন্যা এখানে এসে একান্তে সময় কাটায়। রাজ্যের ব্যাপারে,আব্বাজানের ব্যাপারে আর সামনের ঐ রাক্ষদের উৎখাত করার ব্যাপারে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত থাকে। মনের অজান্তেই রাক্ষসদের প্রতি তার মন কাঁদে। কেন ওদের উৎখাত করা হলো। কি দোষ ছিলো ওদের? আব্বাজানকে কোথায় খুঁজবে? কোথায় খুঁজলে ফিরে পাবে! কে একটা খবর দিবে যে তার আব্বাজান,এই রাজ্যের রাজা এখানে আছে। তাকে এসে উদ্ধার করে নিয়ে যাও। কে আনবে এই সংবাদ।

“হূরিয়া! হূরিয়া নামের অর্থ কি জানেন?”

হঠাৎ কোনো পুরুষালি কন্ঠ কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে চমকে উঠলো রাজকন্যা। তার ব্যক্তিগত সময়ে নাক গলায় এমন ব্যক্তি রাজপ্রাসাদে নেই। কিংবা এমন দুঃসাহসও কারোর নেই। থাকার কথাও নয়। তবে কে? পেছন মুড়ে তাকালো রাজকন্যা। চোখে ভাসছে বিরক্তি আর ক্রোধের মিশ্রিত ছায়া। সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে রাজকুমার সাদ্দাত। হঠাৎ করে চোখের কালো ছায়াটা সরে গেলো। রাগটাও আর রইলো না। জবাবের ভান্ডারে তলানীতেও খুঁজে পেলো না কোনো জবাব। পাল্টা প্রশ্ন করলো,

“আপনি এখানে?”

“জি। আগামীকাল যাকে বিবাহ করবো তার সঙ্গে তো একান্তে একটা কথাও হয়নি। সে কি আমাকে আদৌও বিবাহ করতে চায়? নাকি চায় না.. জানতে হবে না?”

“ভালো বলেছেন।”

“সত্যি বললাম কি?”

“জি। সত্যি বলতে এই মুহুর্তে আমি আপনাকে বিবাহ করিতে চাইনা।”

“অন্যকাউকে চান?”

সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলো রাজকুমার। তার মুখটা হঠাৎ আঁধারে তলিয়ে গেলো। কন্ঠে কেমন ফাঁক। রাজকন্যা মুখ তুলে চাইলো। আবার উল্টো ঘুরলো। সূর্যের অস্তাচল পর্বতের অন্তরালে গমন হচ্ছে। চারপাশ কুসুমিত হয়ে উঠছে ক্রমশ। রাজকন্যা সেদিকেই মোহিত হয়ে পড়লো। আর এদিকে রাজকুমার মোহিত হয়ে পড়ল রাজকন্যার সাঁঝবেলার স্নিগ্ধ মুখখানার প্রতি। লাল কুসুম আলো পড়লো রাজকন্যার মুখের উপর। চিকচিক করে জ্বলছে তা। রাজকন্যার নাকের নোলকটা সেই আলোটুকু নিজের গায়ে একটু একটু করে মেখে নিচ্ছে। রূপবতী রাজকন্যার মুখখানা গাঢ় থেকে গাঢ় করে তুলছে অদ্ভুত মায়ায়। কানের ঝুকমো,গলার হার,হাতের বালা এমনকি কোমরের বিছাতেও কুসুমিত আলোর রাজ বসেছে। হিংসেয় জ্বলে যাচ্ছে রাজকুমারের মন। ক্রোধে ফেটে পড়ছে এই ক্ষনের উপর। এতো বড় দুঃসাহস কেন করছে এই আলো? কেন করবে? ওরা কি জানেনা, রাজকন্যাকে সে বিবাহ করিতে এসছে?

“অমন করে কি দেখছেন?”

“আপনাকে!”

রাজকন্যার প্রশ্নের বিপরীতে নির্লজ্জের মতো জবাব দিয়ে বসলো রাজকুমার। রাজকন্যা লজ্জা পেলো। নড়েচড়ে উঠে একটু পাশে সরে গেলো। রাজকুমার দৃষ্টি সামনের দিকে তুলে ধরলো। মনেমনে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কিছু বলতে পারলো না।

“এই মুহুর্তে কাউকেই চাই না বিবাহ করিতে। আমার যে অনেক দায়িত্ব!”

রাজকন্যা আওড়ালো। রাজকুমার পুনরায় পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রাজকন্যার প্রতি। বলল,

“আমি আপনার পাশে থাকলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে লক্ষপূরনে?”

“হয়তো হবে না। কিন্তু আপনি কেন হঠাৎ আমাকে বিবাহ করিতে চান?”

“হঠাৎ নয়! আমি আপনাকে…”

এটুকু বলেই থেমে গেলো রাজকুমার। রাজকন্যা উৎসুক নয়নে চেয়ে ছিলো। হঠাৎ তার থেমে যাওয়ার অধৈর্য্য কন্ঠে বলল,

“কি?”

“বিশেষ কিছু নয়। আপনি বললেন না কিন্তু, আপনার নামের অর্থ কি?”

“জানিনা।”

“জান্নাতকি ফেরেশতা,খুবসুরাত,হাসিনা এবং হূর!”

রাজকন্যা চকিতে দেখলো। বলল,

“এতোগুলো অর্থ!”

“ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই। আপনি সত্যি হূরপরী রাজকন্যা। খুবসুরাত হাসিনা।”

রাজকন্যা বোবা দৃষ্টি মেলে তাকালো। তার এখানে কি বলা উচিৎ সে জানেনা। জাবাব আওড়াতে পারলো না। রাজকুমার হাসলো। অদ্ভুত হাসি। আবারও বলল,

“আমি আপনাকে বিবাহ করিতে প্রস্তুত রাজকন্যা। আশাকরি,আপনি দ্বিমত করিবেন না!”

“দ্বিমত করেও ফল নিতান্তই শূন্য, রাজকুমার। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আমাদের বিবাহ হইবে।”

কথাটা বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রাজকন্যা। রাজকুমার এক-কদম এগোলো রাজকন্যার দিকে। মুঠোকরা হাত খুলে জ্বলজ্বল করা একটা মুক্তোর মালা বের করলো। রাজকন্যার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“আপনার জন্য সামান্য উপহার।”

রাজকন্যা হাত বাড়িয়ে নিলো। খুব কাছ থেকে দেখলে বোঝা যাবে মালাটার গায়ে আরবি হরফে দুটো নাম লেখা আছে। ‘রাজকন্যা হূরিয়া’। রাজকন্যা লেখাটা পড়ামাত্রই মুখ উঁচিয়ে তাকালো রাজকুমারের পানে। রাজকুমার হাসলো। মোহনীয় হাসি। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ঝরঝরা কন্ঠে বলল,

“সামান্য চেষ্টা।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here