#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸🥀
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[৯]
কালা-পাহাড়িয়ার কারাগারের ভেতরে কবিরাজ মশাইয়ের ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া গেলো। রাজকন্যা খবর পাওয়া মাত্রই ছুটে এলো। ভয়াবহ অবস্থা কবিরাজ মশাইয়ের। রাজকন্যার সমস্ত শরীর বরফ শীতল হয়ে উঠলো। মানুষ কাউকে মেরে ফেলার জন্য এতোটা তাড়না দেয়? কি দশা করেছে মুখটার। পুরো একদম থেঁতলে আছে। সেনাপতি আতাউল রাজকন্যাকে ডেকে বাহিরে নিয়ে গেলো। রাজকন্যার এখানে থাকা একদমই ঠিক হবেনা। আর কবিরাজ মশাইয়ের শরীরের যা অবস্থা তাতে তো তারই ভয় করছে। রাজকন্যা কি করে সহ্য করছে জানেনা সে।
“রাতের মধ্যপ্রহরে বেশির ভাগ প্রহরীরাই ঘুমিয়ে পড়েছিলো রাজকন্যা। সেই সুযোগেই কেউ কবিরাজ মশাইয়ের এই দশা করে রেখে গেছে।”
রাজকন্যার কানের পাশে একপাল মৌমাছি ভোঁ ভোঁ করে উড়তে থাকে। সে বাহ্যিক কোনো শব্দ শুনতে পায়না। কবিরাজ মশাইয়ের মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। যে তাকে খুন করেছে সে কতটা পাষাণ্ড ভাবতেই বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। অনেকটা দমবন্ধ হয়ে আসে তার এখানে।
রাজকন্যার অন্যমনস্ক ভাব সেনাপতি আতাউল এক-বারেই ধরতে পারে। সেও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বোঝার চেষ্টা করে এই মুহুর্তে রাজকন্যার মনের উপর থেকে কি প্রবল ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
“কবিরাজ মশাইয়ের কন্যার ব্যাপারে খোঁজ নিন সেনাপতি মশাই। কবিরাজ মশাইয়ের মেয়েকে অক্ষত অবস্থা ফিরে পাওয়া আমাদের কাছে যুদ্ধের চেয়ে কিছু কম নয়।”
আদেশের সুরে বলে ওঠে রাজকন্যা। সেনাপতি আতাউল নতশির করে আজ্ঞা পালন করে। বিচলিত মনে কিছু আওড়াতে নিলে হঠাৎ থমকে যায়। তাদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের পেছনে কারোর পা ফেলার শব্দ পায়। রাজকন্যাও সতর্ক হয়ে ওঠে। আত্মরক্ষার জন্য সার্বক্ষণিক তার সঙ্গে রাখা ছোট্ট অস্ত্রটি হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে। সেনাপতি আতাউলও সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয় গুপ্তচর আক্রমণ করার। সে তার অস্ত্রটি সন্তর্পণে হাতে উঠাতেই রাজকন্যা তার হাতের ছোট অস্ত্র খানা বিনাবাক্যে ছুঁড়ে মারে পাহাড়ের দিকে। ওপাশ থেকে কাতর কন্ঠে চেঁচায় কেউ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় সেনাপতি আতাউল। কিন্তু ততক্ষণে গুপ্তচর অদৃশ্য হয়ে যায় ঘটনাস্থল থেকে। কেবল বনের উপর পড়ে থাকে রাজকন্যা রক্ত মাখানো ছোট্ট ছুরিটা। রাজকন্যাও দ্রুত পায়ে ছুটে যায় সেখানে। সেনাপতি আতাউল চাপা আক্রোশে নিঃশ্বাস ছাড়ে। ভেতরের রাগ সংবরণ করতে না পেরে বলে ওঠে,
“গুপ্তচর! একবার হাতের নাগালে পেলে ওর বংশ উৎখাত করে ফেলতাম।”
“ক্রোধ সংবরণ করুন সেনাপতি মশাই। বুদ্ধি খাটান।”
“যেমন?”
“অস্ত্র তার কাজ করে দিয়েছে। এখন আমাদের কেবল চোখ কান খোলা রাখতে হবে এই আহত ব্যক্তি কোন কবিরাজের কাছে যায় তার চিকিৎসা করাতে।”
সেনাপতি আতাউল ঝুঁকে রাজকন্যার অস্ত্র খানা হাতে তুলে আনে। কয়েক মুহুর্ত নিয়ে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে তার গায়ের তাজা রক্ত মুছতে মুছতে বলে,
“আপনার হাত থেকে কারোর পালানোর সাধ্য নেই রাজকন্যা।”
“বটেই। এবার আমাকে ফিরতে হবে সেনাপতি মশাই। কবিরাজ মশাইয়ের জানাযা পড়িয়ে উনাকে কবরস্থ করার ব্যবস্থা করুন।”
“যথা আজ্ঞা।”
রাজকন্যা এগিয়ে গেলো সুফির দিকে। একহাতে ভর দিয়ে উঠে বসলো সুফির পিঠে। অতঃপর সুফির পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে রওন হলো রাজপ্রসাদের উদ্দেশ্যে।
______
রাজকন্যা কক্ষে প্রবেশ করা মাত্রই রাজকুমারের চিন্তাক্লিষ্ট, বিমূঢ় মুখটা দৃশ্যমান হয়। রাজকুমার রাজকন্যাকে দেখতেই ছুটে গেলো তার নিটকে। যেন হারানো কোনো প্রিয় জিনিস খুঁজে পেলো অবশেষে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে করুন গলায় বলে,
“কোথায় ছিলেন আপনি? সেই কখন থেকে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।”
রাজকন্যা জবাব দিলো না। রাজকুমারকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই পেছন থেকে হাতে টান অনুভব করে রাজকন্যা। তাই অগত্যাই দাঁড়িয়ে পড়তে হয় তাকে। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজকুমারের বিচলিত কন্ঠটা পূনরায় এসে কানে বারি খায়,
“একি! আপনার তো ভীষণ জ্বর! এই শরীরে কোথায় গিয়েছিলেন রাজকন্যা?”
রাজকন্যা চমকায়। তার জ্বর? কই সে তো টের পেলোনা। রাজকুমার হাসফাস করতে করতে তার সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। তাড়াহুড়ো করে রাজকন্যার গালে,কপালে হাত বুলায়। ভীষণ বিষ্ময় নিয়ে আওড়ায়,
“কথা বলছেন না কেন? কখন এলো এতো জ্বর?”
রাজকন্যা এবারও জবাব দেয়না। শান্ত শীতল তার চাহনি। রাজকুমার ভড়কায়। বড্ড অদ্ভুত লাগে তার রাজকন্যাকে। এতো নিশ্চুপ কেন সে?
“আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রাজকুমার!”
বড্ড করুন গলায় কোনো মতে বলে রাজকন্যা। রাজকুমার দমবন্ধ করে তাকায় রাজকন্যার তপ্ত মুখশ্রীতে। পুড়ে যাচ্ছে যেন। ধূসররঙে ভরে গেছে ফর্সা মুখখানা। ফ্যাকাসে মুখবিবর। সে হাত উঁচিয়ে রাখলো রাজকন্যার তপ্ত মুখবিবরে। হাত রাখা যাচ্ছে না। রাজকন্যার সঙ্গে সঙ্গে সেও পুড়ছে। আর দেরী করলো না। রাজকন্যাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে শয্যাও শোয়ালো। অতঃপর গলা উঁচিয়ে দাসী-দের ডাকলো। কবিরাজকে খবর দেওয়া হলো। অতঃপর এগিয়ে রাজকন্যার পাশে গিয়ে বসলো। তার শরীর ঢেকে দিলো ওম চাদরে। রাজকন্যা থেকে থেকে কাঁপছে। রাজকুমার কিছুতেই বুঝতে পারছেনা রাজকন্যার এই করুন দশা। কোথায় গিয়েছিলো,কোথা থেকে ফিরলো আর এই জ্বর.. সব কিছুর সাথে কি কোনো সংযোগ আছে? ভাবতে পারেনা আর! অজানা এক আশংকায় গলা কাঁপে তার। ভেতর থেকে আওয়াজ আসে! অদ্ভুত আওয়াজ। তাকে সতর্ক বার্তা জানায়।
সময় গড়াতে কবিরাজ মশাই এসে হাজির হয়। রাজকন্যাকে দেখে সুক্ষ্ম মস্তিষ্কে। পর্যবেক্ষণ করে,ভাবে। অতঃপর গম্ভীর গলায় বলে,
“কোনো বস্তু দেখে ভয় পেয়েছে। যার ফলশ্রুতি জ্বর। চিন্তার কোনো কারন নেই। অতিদ্রুত সেরে যাবে।”
চিন্তার কোনো কারন নেই। তবুও শান্ত হতে পারলো না রাজকুমার। সবাই চলে গেলো কক্ষ ছেড়ে। আর সে কেবল পায়চারি করতে লাগলো। অজানা আতংক তাকে ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ তার পা থমকে পড়ে। সে অনুভব করে কক্ষে কারোর উপস্থিতি। থমকে দাঁড়ায় সে। গতকালও ঠিক একই রকম অনুভূতি অনুভব করেছিলো সে। তবে রাজকন্যা সম্মুখে থাকায় সে কিছু বলতে পারেনি। কক্ষের চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলায়। কে এসেছে কক্ষে? জ্বীন! তার চোয়াল শক্ত হয়। চোখ বুঁজে কিছু একটা পড়ে। অতঃপর মুখ গোলাকার করে ফু দেয়। অমনি কক্ষ আগের মতো হয়ে যায়। সে আর রাজকন্যা বাদে আর কারোর অস্তিত্ব টের পায়না। সে এবার নিশ্চিত হয়। কক্ষে কোনো জ্বীনের আগমন ঘটেছিলো। রাজকন্যা কি জানে এই খবর? সেদিন আরহামও বলছিলো।
রাজকুমার কক্ষ থেকে প্রস্থান করে। এই বিষয়ে আরহামের সঙ্গে কথা বলা উচিৎ। রাজপ্রাসাদে জিন্নাত জাতি ঘোরাফেরা করে। অথচ কারোর কোনো মাথাব্যাথা নেই। বড় অদ্ভুত লাগে তার।
জিন্নাত আবারও প্রবেশ করে কক্ষে। তার মুখশ্রী বেজায় ভড়কানো। রাজকুমারের কান্ডে ভড়কে গেছে সে। রাজকন্যার অসুস্থতার কথা শুনে ছুটে এসেছিলো। উত্তেজনার বশে খেয়াল করেনি ঘরে রাজকুমার আছে। তাই ভুল করেই ঢুকে পড়ে। কিন্তু রাজকুমার তার অস্তিত্ব শক্ত হাতে ধরে ফেলবে বুঝে উঠতে পারেনি। কি কঠিন দোয়া পড়লো সে। এক ফুয়ে ছিটকে পড়লো ঠিক একশ মাইল দূরে।
রাজকন্যা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। গায়ে চাদর টানা। জিন্নাত এগিয়ে গেলো তার কাছে। পাশে বসলো নিবিড়ভাবে। অতঃপর মাথায় হাত রেখে মোলায়েম স্বরে ডাকলো,
“রাজকন্যে? ও রাজকন্যে?”
রাজকন্যার হুঁশ ফেরেনা। সে এখনও অচেতন। জিন্নাত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। দোয়া পড়ে ফু দেয়। প্রায় অনেক্ষন ওর গা ঘেঁষে লেপ্টে থাকে। শরীরে ঔষধের প্রলেপ পড়ায় জ্বরটা আস্তে আস্তে নেমে যায়। রাজকন্যার ঘোরও অনেকটা কেটে যায়। সে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। তখনও জিন্নাত তার গা ঘেঁষে বসে আছে। তুলতুলে নরম শরীর জিন্নাতের। রাজকন্যা প্রথমে বিড়াল ভাবে। অতঃপর মনকে বুঝায় তার কক্ষে ছোট বিড়ালের চেয়েও বড় বিড়াল বাস করে। ভেবে মনেমনে হাসে। জিন্নাত চোখ বড় বড় করে দেখে রাজকন্যাকে। গালে, কপালে হাত ঠেকিয়ে আগ্রহী কন্ঠে জানতে চায়,
“ছেড়েছে জ্বর?”
“ছেড়েছে। কখন এলে তুমি?”
রাজকন্যা প্রশ্ন করে। জিন্নাত তার কপাল থেকে হাত সরিয়ে মাথায় রাখে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“অনেক্ষন। জ্বর বাঁধালে কি করে?”
“জানিনা। হঠাৎ জ্বর এলো।”
“কালা-পাহাড়িয়ার কারাগারে গিয়েছিলে.. কি হলো সেখানে?”
জিন্নাতের প্রশ্নে রাজকন্যা হঠাৎ চমকে উঠলো। বিমূঢ় কন্ঠে আওড়ালো,
“খুব নৃশংস ভাবে হত্যা হয়েছে কবিরাজ মশাইয়ের।”
জিন্নাত কেঁপে উঠলো রাজকন্যার এহেম বানীতে। কন্ঠে অবিশ্বাসের ছাপ ফেলে বলল,
“এতো প্রহরীর মাঝে কেমন করে কি করলো?”
“প্রহরীরা তখন জেগে ছিলো না। খুনী মধ্যরাতে গিয়েছিলো।”
“হে রব!”
“হু। আর জানো? আমার হাতে এক গুপ্তচর আহত হয়েছে!”
জিন্নাত প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে তাকালো রাজকন্যার দিকে। রাজকন্যা ধীরেধীরে সবটা খুলে বলল জিন্নাতকে। জিন্নাত সবটা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলল,
“আমি আছি তো। কবিরাজ মশাইয়ের একমাত্র কন্যাকে পাতলপুরী থেকে খুঁজে আনার দায়িত্ব আমার।”
রাজকন্যা মলিন হাসে। জিন্নাতের হাতটা ধরে আলতো করে। বলে,
“এই মুহুর্তে তুমিই আমার একমাত্র ভরসা জিন্নাত।”
জিন্নাত ওর অন্য নরম হাতটা রাজকন্যার হাতের পিঠে রাখে। ভরসা দিয়ে বলে,
“খালি হাতে ফিরবো না কথা দিলাম। ভরসা রাখো।”
এই বলে অদৃশ্য হলো জিন্নাত। রাজকন্যা শূন্যে দৃষ্টি ভাসালো। কবিরাজ মশাইয়ের বিকৃত মুখটার কথা মনে পড়লে এখনও বুক কাঁপে তার। নিজের কন্যার প্রানের বদলে প্রান দিলো কবিরাজ মশাই। তার কন্যাকে খুঁজে বের করতেই হবে। যে করেই হোক।
কক্ষের কাছাকাছি কারোর পদধ্বনি ভেসে আসে। রাজকন্যা চোখ বুঁজে। সে চায়না এই মুহুর্তে কারোর সঙ্গে কোনোরকম কথা বলতে। এমনকি রাজকুমারও নয়। সে এখন একা থাকতে চায়। একদম একা।
#চলবে
[ বিঃদ্রঃ গল্পটা ১০মানুষ পড়লেও দয়াকরে রেসপন্স করবেন।🙂]