রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-১১

0
335

#রাজকন্যা_হূরিয়া❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[১১]

ঘরের চারপাশটা যেমন সুনশান-নিস্তব্ধ ঘরের ভেতরটা তার চেয়েও অত্যাধিক সুনশান। মাটির ঘরের পাটের দরজাটা ভেজিয়ে রাখা ছিলো। তার মানে ভেতরে যে কেউ আছে তা একশভাগ নিশ্চিত রাজকন্যা। জিন্নাত তাকে আঁটকায়। ভেতরে বিপদ থাকতে পারে ভেবে নিজেই আগে প্রবেশ করে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করতে পারলেও বের হওয়ার নাম নেই। রাজকন্যা চিন্তায় পড়ে গেলো। জিন্নাত এখনও বের হচ্ছে না কেন? এবার নিজেই ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। ভেতরে মাটির গৃহতলে (মেঝে) নিভু নিভু করে জ্বলছে একটা ভাঙা হারিকেন। দক্ষিনা হাওয়াতে বারবার নিভে যাচ্ছে প্রায়। আবার জ্বলে উঠছে দপদপ করে। রাজকন্যা চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি বোলালো। শঙ্কিত মনে ভাবলো, ‘জিন্নাত কি বন্দি হলো?’

কিন্তু কাউকেই দেখছে না রাজকন্যা। এ ঘর থেকেই কারোর চিৎকার ভেসে এসেছিলো। এখন যে নিস্তব্ধতায় খা খা করছে চারিদিকে। রাজকন্যার পা থমকে গেলো হঠাৎ। তার ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় তাকে জানান দিলো কেউ তার পেছনে তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক্ষনি আক্রমণ চালাবে নির্ঘাত।

সত্যি তাই হলো। পেছন থেকে কেউ তলোয়ার চালাতেই কায়দা করে নীচের দিকে ঝুঁকে গেলো রাজকন্যা। ফের নীচের দিকে আক্রমণ আসতে কৌশলে ওখান থেকে সরে পড়লো। আর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাক্তিটির পেছনে গিয়ে শক্ত হাতে কোপ বসালো তার পিঠে। লোকটা ব্যাথায় আর্তনাদ করে হাঁক ছাড়লো। নিজেকে বাঁচাতে ছিটকে পড়লো বিপরীত পাশে। পেছন মুড়ে রাজকন্যার অগ্নি দৃষ্টি দেখতেই কাঁপন ধরে গেলো শরীরে। একি দেখছে সে! রাজকন্যা হূরিয়া এতোদূর অব্দি চলে এসেছে? কিন্তু না। সে ভয় পেলো না। বরং পুরুষের দাম্ভিকতা টেনে চোয়াল শক্ত করলো। একটা পুঁচকে মেয়ের হাতে সে কিছুতেই জখম হতে পারেনা। তাই শক্ত হাতে তলোয়ার চেপে ধরে আবারও হামলা চালালো রাজকন্যার উপর। তবে এবারও ব্যর্থ হলো। রাজকন্যার অগ্নিমূর্তি আরও দিগুণ বেড়ে গেলো। সে এলোপাতাড়ি তলোয়ারের কোপ শুরু করলো। যা দেখতেই বাধ্য হয়ে সরে পড়তে হলো তাকে। একপ্রকার ছুট্টে পালালো ঘটনাস্থল থেকে। তাকে পালাতে দেখে রাজকন্যা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আশেপাশে কড়া দৃষ্টিতে দেখে। বন্দীকে কোথায় রাখা হয়েছে? সব দিকেই যে ফাঁকা! আর জিন্নাতই বা কোথায়? ঘাড় ঘুরিয়ে পূনরায় এদিক সেদিক দেখে রাজকন্যা। হাতের তলোয়ারটা রেখে দেয় যথাস্থানে। হঠাৎ কারোর পদধ্বনি ভেসে আসে এদিকটায়। কেউ আসছে.. আবার কোনো শত্রু নয়তো? রাজকন্যা লুকিয়ে পড়ে আড়ালে। গলার আওয়াজ পাচ্ছে সে। ভেজানো দরজা ঠেলে এক এক করে চারজন ভেতরে প্রবেশ করে। সঙ্গে এক কন্যাও আছে। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তার হাত-পা বাঁধা পরনের পোশাক এলোমেলো। কেবল এলোমেলোই নয়! তার অবস্থা শোচনীয়। রাজকন্যার আর বুঝতে বাকি রইলো না এই কন্যার চিৎকারের আওয়াজই শুনেছে সে। আর এই লোকগুলো তার সঙ্গে কি করেছে.. বুঝে নিলো রাজকন্যা। ভাবতেই রাগ আর ঘৃনায় গা গুলিয়ে উঠলো তার। মনের মাঝে ভর করলো তীব্র ক্ষোভ। ভয়ংকর রাগ। যে রাগ তাকে ক্ষনকালের ব্যবধানে রনচন্ডির রূপ দিতে দেরী করলো না। আর আড়ালে থাকা সম্ভব হলো না। লোকগুলো আবারও খারাপ কাজে লিপ্ত হতে যাচ্ছে। বেচারিকে চামড়ার বেল্ট দিয়ে এলোপাতাড়ি মারা হচ্ছে। আর সে কেবল আর্তনাদ করে চলেছে।

“অধম পুরুষ জাতি! এবার থামো তোমরা। নয়তো মৃত্যু অনিবার্য তোমাদের।”

তেজি কন্ঠে গর্জে উঠলো রাজকন্যা। তার এহেম গলার স্বর কাঁপিয়ে তুললো চার পুরুষের অন্তর। থমকাতে হলো তাদের। চোখেমুখে পাষবিক হিংস্রতা নিয়েই ফিরে তাকালো পেছনে। তাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে একটা পুঁচকে কন্যা। বয়স বেশি হলে বিশের কোঠায়। তার চাহনির তীব্র তেজে কেমন হৃদয় কাঁপানো ব্যাপার আছে। তারা মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে দু’পা এগোলো রাজকন্যার দিকে। তাদের পদচারনে রাজকন্যা তৎক্ষনাৎ একটানে বের করে আনলো তার ধারালো অস্ত্র। ক্রুদ্ধ চাহনিতে উঁচিয়ে ধরলো তলোয়ার। রুষ্ট কন্ঠে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,

“পতিত হও নিজের পাপ থেকে। নয়তো এক কোপে তোমাদের ধর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলবো।”

চার পুরুষ মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো একে অপরের। এই টুকুনি কন্যার এতো তেজ? হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলো চারজনে। ততক্ষণে চারজনের থেকে ছাড়া পেয়ে মেয়েটা নিজেকে আড়ষ্ট করে রেখেছে। এই নয়দিনে সে যতবার নির্যাতিত হয়েছে ঠিক ততবার মনেমনে মরেছে। কেবল উপরওয়ালার কাছে ভিক্ষা চেয়েছে নিজের জীবনটা। উপরওয়ালাও যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ওর থেকে। কেমন পাষাণ হলো এই ধরণীও। মুখ বুঁজে সবটা সহ্য করেছে এই প্রকৃতিও। তাই সে বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছে। এখন কেবল প্রতি ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুকামনা করে নিজের।

“মেঘ না চাইতেই বর্ষণ শুরু। ওস্তাদজী যে আরও একটা নেশাদ্রব্য আমাদের জন্য পাঠালেন খবর দিলেন না কেন?”

বলে উঠলো একজনে। যা শুনতেই ফোঁস করে উঠলো রাজকন্যা। নিজের ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে।

“কি গতর দেখো দেখি? লোভ যে সামলাতে পারছিনা।”

তার পাশের জন বলে ওঠে এবার। রাজকন্যা কপাল কুঁচকে তাকায়। ভালো করে খেয়াল করলে বুঝতে পারে তারা টাল হয়ে ঢুলছে কিঞ্চিৎ। এর মানে এরা নেশাদ্রব্য খেয়ে আছে পূর্বেই। তাই আরও পাষবিক হয়ে আছে।

এর মধ্যে একজন দাঁত কপাটি কেলিয়ে এগিয়ে এলো রাজকন্যার পানে। কেমন বিকৃত হাসতে হাসতে রাজকন্যাকে ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। রাজকন্যা দু’কদম পিছিয়ে পড়েই করে ফেললো এক অবিশ্বাস্য কাজ। তলোয়ার বাড়িয়ে এক কো’পে দি’খন্ড করলো তার হাতের পাঁচ আঙ্গুল। জীবন্ত আঙ্গুল গুলো মাটিতে পড়ে প্রায় অনেক্ষন ছটফট করলো। আর এদিকে লোকটা ভয় আর যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে জ্ঞান হারালো। রাজকন্যা বাঁকা হাসলো। যার দরুন শরীরে আগুন ধরে গেলো তাদের। রাজকন্যা তাদের দিকে তাকালো। ঠোঁটের কোনে দাম্ভিক হাসি নিয়ে বলল,

“রাজকন্যা হূরিয়া এতোটাও দুর্বল নয় যে তাকে এতো সহজেই পরাজয় করে ফেলবে। এই গোটা সাম্রাজ্যের একমাত্র শাসক.. রাজকন্যা হূরিয়া।”

খানিকটা দমে গেলো তিন পুরুষ। ধাতস্থ করলো নিজেদের। দু’জন তো প্রস্তুত নিয়ে ফেললো পালানোর। তবে একজনের ব্যাক্তিত্বে করাঘাত লাগলো। সামান্য এক কন্যার হাতে পরাজিত হয়ে কাপুরুষের ন্যায় ফিরতে পারবেনা সে। কিছুতেই না। তাই পুরুষের দাম্ভিকতা বজায় রেখেই তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে গেলো। রাগে ক্ষোভে আক্রোশে ফেটে পড়ে বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠে তলোয়ার চালালো রাজকন্যার দিকে। রাজকন্যা এবার পিছু হটলো না। সম্মুখে দাঁড়িয়ে পাল্টা আঘাতে লোকটার হাতের তলোয়ার ফেলে দিলো বহুদূরে। সে বুঝে ওঠার আগে পূনরায় আঘাত করলো। এবার তলোয়ার গিয়ে বিঁধল তার বাহুতে। ব্যাথায় আর্তনাদ করারও সময় পেলো না সে। এর মাঝেই বুকে সজোড়ে ধাক্কা খেয়ে লুটিয়ে পড়লো জমিনে। ক্ষনকালে অনুভব করলো সে কারোর পদতলে আঁটকে পড়েছে। তার নিঃশ্বাস নেওয়া দুঃসাধ্য হয়ে উঠলো। রাজকন্যা তার তলোয়ার দিয়ে চেপে ধরলো লোকটার বক্ষস্থলে। ফ্যাচ করে খানিকটা গেঁথে গেলো ধারালো তলোয়ার। তলোয়ারের মুখ র’ক্তসিক্ত হয়ে গেলো। রাজকন্যা মুখ উঁচিয়ে গুটিশুটি মেরে কাঁপতে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালো। হাত বাড়িয়ে ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসির রেখা টেনে কাছে ডাকলো। সে প্রথমে নড়লো না। কেমন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো। রাজকন্যা তাকে ভরসা দিলো। নরম গলায় ডাকল,

“ভয় পেয়ো না। আমি তোমাকে এই নরকীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করতে এসেছি। ভয় পেয়োনা। আমার কাছে এসো।”

মেয়েটা নড়লো। কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। তবুও একবুক সাহস নিয়ে এগিয়ে এলো রাজকন্যার দিকে। রাজকন্যা সহাস্যে আগলে ধরলো মেয়েটাকে। তার বয়স বেশি না। পনেরো কি ষোল। যে বয়সটা জীবনের সবচেয়ে স্বরণীয় আর আবেগঘন হয়। যে বয়সটায় উপলব্ধি হয় জীবনটা ঠিক কতটা উপভোগ্য। কিন্তু সে বয়সটাই যে ওর সবচেয়ে বড় কাল হয়ে দাঁড়ালো। কি করে ভুলবে ও এই কালরাত্রি গুলো! কি করে ভোলানো যাবে ওর সাথে ঘটতে থাকা সমস্ত পাপ কাজ। হ্যাঁ, উপায় আছে। রাজকন্যা ওকে ছেড়ে পাশে সরে এলো। হাতের তলোয়ারটা ওর হাতে শক্ত করে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

“দি’খন্ড করো এই নরপশুর মাথা।”

রাজকন্যার রুষে ওঠা কন্ঠে শরীরে শক্তি অনুভব করলো মেয়েটা। ক্ষ্যাপা বাঘিনীর ন্যায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো লোকটার পানে। লোকটা কেঁপে উঠলো। নিজের মৃ’ত্যুকে সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রান ভিক্ষা চাইতে লাগলো। কিন্তু কাজ হলো না। মেয়েটা আর শক্তি হারালো না। এই কয়দিনের তীব্র যন্ত্রণা হঠাৎই মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো তার। বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো। তার সুন্দর জীবনটাকে এমন ভাবে কুৎসিত করে দেওয়ার বিষাদ জাগলো মনে। গলা ফাটিয়ে বিকট এক চিৎকার করেই এক কো’পে মাথা আলাদা করে দিলো লোকটার। সঙ্গে সঙ্গে এক খাবলা তাজা র’ক্ত ছিটকে এলো চোখে মুখে। একপ্রকার নেয়ে উঠলো তাজা র’ক্তে। হঠাৎই হুহু করে কেঁদে উঠে বসে পড়লো গৃহতলে। আজ তার মুক্তি হয়েছে। চিরমুক্তি। রাজকন্যা হাঁটু ভাজ করে বসলো ওর পাশে। কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় জিঙ্গেস করলো,

“কোন রাজ্যে বাস তোমার? এর আগে কখনও দেখিনি তোমাকে।”

“আমি এই রাজ্যেই থাকি। রাজপ্রাসাদের কবিরাজ মশাইয়ের কন্যা আমি!”

ফোপাঁতে ফোপাঁতে জবাব দিলো মেয়েটা। রাজকন্যা কেঁপে উঠলো। আচমকা তার বুকের ভেতর উথাল-পাতাল ঢেউ শুরু হলো। কবিরাজ মশাইয়ের কন্যা! যাকে সে উদ্ধার করলো সেই কবিরাজ মশাইয়ের কন্যা! চটজলদি নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো মেয়েটাকে। অবাক কন্ঠে বলল,

“তোমার নাম কি?”

“আরোভি।”

র’ক্তে ভেজা মলিন মুখ তার। না জানি কতটা পীড়া সহ্য করেছে এ’কদিনে। ওকে এই মুহুর্তে আর কোনো প্রশ্ন করা ঠিক হবেনা। এক্ষনি ওকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যাবস্থা করতে হবে।

“রাজকন্যে?”

পেছনে জিন্নাতের অস্তিত্ব টের পেলো। চটজলদি পেছন মুড়ে তাকিয়ে দেখল সত্যি জিন্নাত এসেছে। তার চোখেমুখে অজানা ভয়। রাজকন্যা উদ্বিগ্ন মনে প্রশ্ন করলো,

“কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”

“আমি কাকে যেন দেখেছি গো। মুখটা ভীষণ পরিচিত।”

“কে?”

“ঠিক মনে করতে পারছিনা। আমি উনার পিছু নিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুদূর যেতেই উনি আমার অস্তিত্ব টের পেয়ে যান। অমনি দোয়া পড়ে আমাকে মাঝপথেই আঁটকে দেন। আমি আর যেতে পারিনি। আপ্রান চেষ্টা করেছি।”

“এই বিষয়ে আমরা পরে কথা বলবো জিন্নাত। আগে আরোভিকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো।”

“ঐ কি তবে কবিরাজ মশাইয়ের কন্যা?”

“তুমি ঠিক ধরেছো।”

“হে রব। একি অবস্থা হয়েছে।”

“আমাদের হাতে সময় নেই জিন্নাত৷ ওকে প্রাসাদে নিয়ে ফিরতে হবে।”

“যথাআজ্ঞা।”

#চলবে_____

[ বিঃদ্রঃ রেস্পন্স করুন জনগন।🙂]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here