রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-১২

0
313

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[১২]

আরোভিকে নিয়ে যখন তারা রাজপ্রাসাদে ফিরলো তখন প্রভাতের স্নিগ্ধ আলো ফুটেছে ধরণীতে। রাজকন্যা আরোভির জন্য কবিরাজ মশাইকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে নিজের কক্ষে এলো তড়িঘড়ি করে। এই পোশাকে আর কারোর নজরে আসা যাবেনা। কেউ দেখলেই প্রশ্ন করে বসবে। তখন মিথ্যে বলাও জটিল হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে রাজকুমারের কাছে। সে চায়না অকারণে রাজকুমারকে মিথ্যে বলতে। কক্ষে পা রাখতেই রাজকন্যার শরীরে কিছু একটা কম্পন অনুভব করলো। তার পা নিজ গতিতেই থমকে গেলো। নাকে এসে ঠেকছে আতরের খুশবু। কক্ষে শতাধিক জ্বীনের প্রবেশ ঘটেছে। কিন্তু কেন এসেছে তারা?কি চাই তাদের? রাজকুমার যদি টের পায়…! আর কিছু ভাবতে পারলো না রাজকন্যা। দ্রুত পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। তার মাথা ভার হয়ে উঠলো আতরের খুশবুতে। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে গেলো এই খুশবু। রাজকন্যা চারপাশে ব্যস্ত দৃষ্টিতে চোখ বোলাচ্ছে। বড় সতর্ক গলায় প্রশ্ন করলো,

“কি চাই তোমাদের?”

কোনো জবাব এলো না। হঠাৎ রাজকন্যার বুক কেঁপে উঠলো। রাজকুমারের ঘুমিয়ে থাকা জায়গাটা শূ্ন্য পড়ে আছে যে। রাজকুমার গেলো কোথায়? ছুটে গেলো খালি শয্যার কাছে। এখানেই তো শুয়ে ছিলো সে। কোথায় গেলো। রাজকন্যা ভুলে গেলো জ্বীনদের কথা। ছুটে গেলো গোসলখানায়। সেখানেও নেই। কক্ষ সংলগ্ন বারান্দা তেও নেই! নেই! কোথাও নেই। হাঁপিয়ে উঠলো রাজকন্যা। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে বিছানার কোল আগলে ধপ করে বসে পড়লো। দুশ্চিন্তায় মস্তিষ্ক দিখন্ড হয়ে যাচ্ছে। এবার বিপদ কি রাজকুমারের উপর এলো!

আকস্মিক কেঁপে উঠলো রাজকন্যা। একটা জ্বীন তার পাশ ঘেঁষে বসেছে। কানের কাছে মুখ এনে বলল,

“বিপদ বিপদ বিপদ!”

রাজকন্যা কেঁপে উঠলো। হাত বাড়িয়ে জ্বীনটাকে ছুঁতে নিলেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো সে। রাজকন্যা আতংকিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,

“কিসের বিপদ? বলে যাও আমাকে! কিসের বিপদ.. আ্ আমার রাজকুমার কোথায়?”

কোনো জবাব এলো না। এমনকি ধীরেধীরে ঘর থেকে আতরের খুশবুও মিলিয়ে যেতে আরম্ভ করলো। রাজকন্যা উঠে দাঁড়ালো। শূন্য ঘরে দৃষ্টি ঘোরালো বার কয়েক। কেউ নেই! চলে গেছে সব। তবে কি ওরাই রাজকুমারের অপহরণ করেছে। নাকি অন্যকেউ? কে আছে এই সব কিছুর মুলে?

“আ্ আচ্ছা? আরোভির অপহরণ যারা করেছে তারাই কি রাজকুমারের অপহরণ করেছে? হু.. হতে পারে!”

রাজকন্যা আর দেরী করলো না। ছুট্টে গেলো গোসলখানায়। নিজের পোশাক পাল্টে ফিরে এলো রাজকন্যার বেশে। তারপর আবারও ছুটলো আরোভির কক্ষে। আরোভি নিশ্চয়ই সবটা জানে। ওকে কে বা কারা অপহরন করেছে আর কেনই বা করেছে ও নিশ্চয়ই সবটা জানবে। আর রাজকন্যা নিশ্চিত যে রাজকুমারের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে এর কোনো সূত্র ঠিকই আছে। রাজকন্যাকে তাড়াহুড়ো করে ছুটতে দেখে কোত্থেকে এসে সামনে দাঁড়ালো আদিম।

“রাজকন্যা? কি হয়েছে? তোমাকে এতো বিচলিত দেখাচ্ছে কেন?”

আদিমের সাথে রাজকন্যার এক-দিনে মোটে ২বার দেখা হয়। সেটাও আহারের সময়। বাকি সময়টায় কখনও মুখোমুখি হয়নি তারা। তবে আজ হওয়াতে যেন বড় উপকারই হলো। রাজকন্যা দাঁড়িয়ে পড়লো। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে চিন্তান্বিত কন্ঠে বলল,

“আদিম রাজকুমারের সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হয়েছে কি কোথাও?”

আদিম তার চিন্তা দেখে খানিকটা বিচলিত হলো। অতঃপর রাজকন্যার করা প্রশ্নে খানিকটা ঘোরে তলিয়ে গেলো। রাজকন্যা ওর বাহুতে হালকা চাপড় দিয়ে বলল,

“কি হলো? দেখেছো কি তাকে?”

“না।”

“ও দেখোনি!”

ক্ষনিকের জন্য কিঞ্চিৎ আসার আলো দেখতে পেয়েছিলো রাজকন্যা। কিন্তু আদিমের নাকোচ বানীতে আরও পীড়া বেড়ে গেলো যেন। হঠাৎই দমবন্ধ হয়ে এলো। তবুও সামলে নিলো নিজেকে, নিজের পীড়িত মনকে।

“রাজকুমার নিখোঁজ!”

বলল রাজকন্যা।

“সে কি!”

“হুম।”

“তোমাদের কক্ষে দেখোনি ভালো করে?”

“দেখেছি। নেই। তুমি এক কাজ করো.. কয়েক জন প্রহরী নিয়ে পুরো রাজপ্রাসাদটা ঘুরে দেখো। যদি খোঁজ না মিলে মহামন্ত্রীকে খবর পাঠাও আমি স্বরন করেছি বলে।’

“আমি এক্ষনি দেখছি।”

দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলে আদিম। রাজকন্যা কিছুক্ষন বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর হঠাৎই মনে পড়লো আরোভির কথা। পূনরায় ছুটলো তার কক্ষের দিকে। কবিরাজ মশাই নিশ্চয়ই এতক্ষণে আরোভির চিকিৎসা সম্পূর্ণ করেছেন। আরোভি সুস্থ হয়ে উঠবে। ওকে যে সুস্থ হতেই হবে। ওর বাবা কবিরাজ মশাইকে সে বাঁচাতে পারেনি! অমানবিক নি’র্যা’তনের স্বীকার হয়ে মৃ’ত্যু হয়েছে তার! আরোভির উপর থেকেও কম ধকল যায়নি। যদি আর একদিন দেরী হতো ওকে খুঁজে পেতে তাহলে নির্ঘাত ওরও লা’স উদ্ধার করতে হতো।

সব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রাজকন্যা। আরোভির কক্ষের সামনে পৌঁছে গেছে সে। বাহিরে প্রহরী দের পাহারায় রাখা হয়েছে। আর কোনো রকম কোনো বিপদের আচ সে আরোভির উপর আসতে দেবে না। কিছুতেই না।

“কবিরাজ মশাই কি চলে গিয়েছেন?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ রাজকন্যা।”

প্রহরীকে জিজ্ঞেস করতেই নত মাথায় সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো সে। রাজকন্যা হ্যাঁ সূচক মাথা কাত করলো। আর কিছু না বলে কক্ষের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। আরোভি বিশ্রাম নিচ্ছে শয্যায়। তার চোখ বন্ধ। শরীরের বেশিরভাগ ঢাকা পড়েছে চাদরের নীচে। আগের চেয়ে ওর মুখের অবস্থার বদল ঘটেছে। এখন অনেকটাই ফুটে উঠেছো ওর স্নিগ্ধ মুখটা। গৌরবর্ণ গায়ের রঙ। ভারী পল্লবে মোড়ানো চোখ জোড়া। চিকন ভ্রু। মসৃন ললাট। ললাটে ছড়িয়ে আছে একঝাঁক চুল। পিষ্টপুষ্ট একজোড়া ঠোঁট। ভীষণ মায়াবী মুখবিবর। চোখ জুড়িয়ে এলো রাজকন্যার। ওর এতো সুন্দর মায়ায় জড়ানো মুখটা দেখেও কি ওদের একটু মায়া হয়নি?এতোটা পাষান মানুষ হয় কি করে? গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রাজকন্যা। এগিয়ে যায় ঘুমন্ত আরোভির কাছে। নীরবে বসে ওর মাথার কাছে। মাথায় হাত রাখে। এই মুহুর্তে ওকে ডাকতে ইচ্ছে করেনা! না জানি কত দিন পর দু-চোখের পাতা এক করতে পেরেছে মেয়েটা। কিন্তু না ডেকেও যে উপায় নেই৷ রাজকুমারের খোঁজ পেতে হলে যে ওর থেকে সবটা জানতেই হবে।

মাথায় কিছুক্ষন হাত বুলিয়ে কোমল স্বরে ওর নাম ধরে ডাকলো রাজকন্যা। কিন্তু সাড়া দিলো না আরোভি। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে সে। রাজকন্যার মায়া যেন আরও বেড়ে যায়। এক রকম পাষাণ হয়েই ডাকে পূনরায়।

“আরোভি? আরোভি শুনছো?”

শুনেনা আরোভি। রাজকন্যা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে। মাথায় রাখা হাতটা নামিয়ে আনে আরোভির ললাটে। শরীরে জ্বর নেই তো! কিন্তু একি! জ্বরের বিপরীতে যে বরফ হয়ে আছে আরোভির শরীর। আঁতকে ওঠে রাজকন্যা। কেমন সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকায় আরোভির ঘুমন্ত মুখপানে। হঠাৎ কি মনে হতে একটানে আরোভির শরীরের উপর থেকে চাদরটা ফেলে দেয়। ওমনি দৃশ্যমান হয় আরোভির র’ক্তা’ক্ত শরীরটা। কেঁপে ওঠে রাজকন্যা! ছিটকে পড়ে খানিকটা দূরে। আরোভির খু’ন হয়েছে! কে করলো এই পা’ষা’ণী কাজ! তারই প্রাসাদে তারই আড়ালে এসব কি ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। থরথর করে কেঁপে ওঠে রাজকন্যা! মস্তিষ্ক ভোঁতা হয়ে যায় ক্ষনকালে। কেউ কি এসেছিলো এই ঘরে? এই সময়ে কবিরাজ মশাই ব্যতীত আর কারোর আসার সম্ভাবনা নেই। আর তাছাড়া প্রাসাদের কেউ জানেইনা এই কক্ষে কবিরাজ মশাইয়ের কন্যাকে এনে রাখা হয়েছে। তবে কি যাদের হাত থেকে আরোভিকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে! তারাই করেছে এই পাষাণী কান্ড!

______________

“সরদার.. আপনি কেন ঐ পুঁচকে কন্যাকে এতো সুযোগ দিচ্ছেন! ও যেকোনো মুহুর্তে আমাদের ধ্বংস করে ফেলতে পারে। এটুকু ক্ষমতা ওর আছে সরদার।”

সরদার বাঁকা হাসে। তলোয়ারে ধার দিতে দিতে মুখ উঁচিয়ে একবার দেখে জখম রেদোয়ানকে। রাজকন্যার এক আঘাতে আধমরা রেদোয়ান। তাই আরও ভয় পাচ্ছে ওকে।

“আপনি হাসছেন সরদার!”

“আমার মনে পড়ে ঐ বিশেষ ক্ষনটির কথা.. রাজকন্যার কাতর কন্ঠ,আহ্লাদী ডাক। আহ্ কি মধুর সুর রেদোয়ান!”

“আপনি তো ঐ কন্যার প্রেমে মসগুল সরদার। আপনার আব্বাজান জানতে পারলে..”

“আমি কারোর ধার ধারিনা রেয়োদান। আমি আমার দুনিয়া নিজে তৈরি করেছি। সেখানে কারোর হস্তক্ষেপ এই আমি মেনে নেবোনা।”

রেদোয়ান অজানা ভয়ে পিষ্ট হয়। বুক কাঁপে তার ভবিষ্যৎ ভেবে। কি আছে.. কি আছে তাদের ভাগ্যে।

“তুমি মিষ্টি করে দুষ্ট বলো, শুনতে ভালো লাগে..
আমার এই মন ভরে যায় গভীর অনুরাগে..
গভীর অনুরাগে..”

গুনগুনিয়ে ওঠে সরদার। তার স্পষ্ট মনে পড়ে সেই দিনটির কথা। যেদিন সে স্বীকারে বেরিয়ে হঠাৎ শুনতে পায় কারোর কাতর কন্ঠের মধুর সুর। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে তার ঘোড়াটি। অথচ সে একবারও তাকে হুকুম করেনি সেখানে দাঁড়াতে। তখনই সে উপলব্ধি করে গানের প্রতিটি কথা। যেন তাকেই কেন্দ্রবিন্দু করা হয়েছিলো তার গানের। তাকেই বারবার ডাকছিলো সেই গানের কথা গুলো। তাকেই বারবার ডাকছিলো। সে যাবে। একদিন নির্ঘাত যাবে। সম্মুখীন হবে রাজকন্যার। নিজের ভালোবাসার জাহির করবে সে। হ্যাঁ নিশ্চয়ই করবে।

#চলবে____

[ পাঠক গন একটু রেসপন্স করুন]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here