রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-১৫

0
323

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸🥀
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[১৫]

রাজকন্যার বাহু থেকে গলগল করে র’ক্ত ঝড়ছে। রাজকুমারের পোশাক ভিজে উঠেছে প্রায়। একহাতে শক্ত করে আগলে রেখেছে তার প্রনয়নীকে। আর অন্যহাতে তীরটা টেনে বের করার চেষ্টা করছে। রাজকন্যার ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে। যন্ত্রণায় কাহিল প্রায়। তবুও তীব্র মনোবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাজকুমারকে বাঁধা না দিয়ে নিজের মনোবল দিয়ে সাহায্য করছে। কিন্তু রাজকুমার নিজেই ভেঙে পড়ছে বারবার। তার অন্তর কাঁপছে। মন কাঁদছে! নিজের ভালোবাসার মানুষটার এহেম জখম সে মেনে নিতে পারছেনা।

“আহহহহ্!”

চাপা স্বরে আর্তনাদ করে খিঁচে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো রাজকন্যা! তীরটা বের করে ফেলেছে রাজকুমার। কোনো মতে সেটা দূরে ছুঁড়ে মেরে আঁকড়ে ধরলো রাজকন্যাকে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আওড়ালো,

“দুশ্চিন্তা নেই! আপনি এখন নিরাপদ।”

রাজকন্যা টের পাচ্ছে মানুষটার বুকের ভেতর ঘটতে থাকা তোলপাড়। ধুকপুক করে শব্দ করছে হৃদপিণ্ড। তার কি তীব্র তেজ। নিজের জখম ভুলে গেলো রাজকন্যা। মাথা তুলে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

“আমি ঠিক আছি রাজকুমার। আপনি এতো ঘাবড়াবেন না দয়াকরে।”

নিশাকান্তের আলোতে দৃশ্যমান হয় রাজকুমারের অশ্রুসিক্ত নেত্রজোড়া। রক্তিম আভায় ঘিরে থাকা নেত্রকোন। শত খানেক চিন্তায় কুঁচকে যাওয়া তার ললাট। রাজকন্যা মৃদু হাসে। হাত উঠিয়ে আলতো স্পর্শ করে রাজকুমার অশ্রুসিক্ত নয়ন। মৃদু কন্ঠে আওড়াতে চেষ্টা করে,

“এই জখম তো কিছুই নয় রাজকুমার। আমি জানি এরচেয়েও ভয়ানক জখম অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আর আমি এর জন্য প্রস্তুত।”

আহত দৃষ্টিতে তাকায় রাজকুমার। তার মন মানেনা। যেন শুনেও শুনেনা রাজকন্যার বানী। হুট করে কোলে তুলে ন্যায় রাজকন্যাকে। ক্ষিপ্ত স্বরে হুকুম করে,

“কবিরাজকে খবর পাঠাও!”

এই বলে দ্রুত পায়ে চলে আসে নিজেদের কক্ষে। রাজকন্যাকে শুয়ে দেয় শয্যায়। ছুটে যায় প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। কবিরাজ আসতে আসতে রাজকন্যার যতখানি র’ক্তক্ষরন হয়ে যাবে সেটা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। যার দরুন রাজকন্যার শরীরে বড় কোনো রোগ বাসা বাঁধতে সময় নিবেনা।

“আপনি জানেন আক্রমনকারীরা কারা ছিলো?”

র’ক্ত বন্ধ করার যাবতীয় উপকরণ লাগাতে লাগাতে প্রশ্ন করলো রাজকুমার। রাজকন্যা একপলক দেখলো রাজকুমারকে। অতঃপর শূন্যে দৃষ্টি ভাসিয়ে বলল,

“ঘর শত্রু বিভীষণ। জানিনা আমি।”

রাজকুমার চমকালো। তার নয়ন উৎসুক হয়ে উঠলো। কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো।

“এর মানে?”

“বিশেষ কিছু নয়!”

“শত্রুর বাস কি তবে নিজ গৃহেই?”

দৃঢ় কন্ঠে জানতে চায় রাজকুমার। রাজকন্যা ঢোক গেলে। চোখ বোঁজে। চাচাজানের হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা একবার কল্পনা করতে চেষ্টা করে। ফের চোখ মেলে তাকায়। মলিন কন্ঠে বলে,

“হয়তো কিংবা হয়তো না।”

“আমি আপনার জীবনের ঝুঁকি নিতে পারবোনা রাজকন্যা।”

“ঝুঁকি! জীবনে ঝুঁকি তো তখনই এসেছে যখন থেকে আব্বাজান নিখোঁজ হয়েছেন।”

“রাজা মশাই নিখোঁজ!”

বিস্মিত কন্ঠে আওড়ালো রাজকুমার।

“কিন্তু আব্বাজান যে বলেছিলেন রাজা মশাই গত হয়েছেন?”

“না। আব্বাজান বেঁচে আছেন।”

“আপনি এতোটা নিশ্চয়তার সঙ্গে কি করে বলছেন?”

“আমার বিশ্বাস রাজকুমার। আমি বিশ্বাস করি। আর আমি জানি আমার মন সঠিক বলছে।”

“কিন্তু…”

“রাজকন্যা.. আপনার এ দশা কি করে?”

ছুটে এলেন কবিরাজ মশাই। সঙ্গে এলো আরহাম,আদিম, মহামন্ত্রী আরও কয়েকজন। রাজকন্যা ক্লান্ত দৃষ্টিতে দেখলো তাদের। মহামন্ত্রী এগিয়ে এলো রাজকন্যার পাশে। চিন্তান্বিত কন্ঠে বললেন,

“শত্রুরা এমন ভাবে আক্রমণ করবে আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি রাজকন্যা!”

কবিরাজ মশাই বসে পড়ে রাজকন্যার পাশে। তার চিকিৎসার সকল প্রকার সরঞ্জাম বের করে লেগে পড়ে কাজে। রাজকন্যা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মলিন হাসার চেষ্টা করে বলে,

“শত্রুরা তো যেকোনো ভাবেই আঘাত করতে পারে মন্ত্রী মশাই। কেবল আমরাই পারিনা। আমরা তাদের মতো কাপুরুষ নই। আমরা পেছন থেকে আক্রমণ করিনা। আমরা সামনাসামনি মোকাবিলা করি। আর সারাজীবন তাই করবো। কেননা, এটাই আমাদের ধর্ম।”

“মন্ত্রী মশাই, আমি এর যথাযোগ্য জবাব চাই। আগামীকালকের মধ্যেই ওদের আমি সচক্ষে দেখতে চাই। আপনি প্রহরী বাড়ান। প্রাসাদকে সুরক্ষিত রাখুন।”

“আজ্ঞে রাজকুমার।”

মন্ত্রী মশাই প্রস্থান করলেন। রাজকুমার ভেতরে ভেতরে ক্রোধে ফেটে পড়ছে। কার এতো বড় দুঃসাহস হতে পারে? রাজকন্যা পর্যবেক্ষণ করছে রাজকুমারকে। আরহাম এসে দাঁড়ালো রাজকুমারের পাশে। তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,

“আমি ব্যাপারটা দেখছি রাজকুমার। আপনি শান্ত হোন।”

“আমি শান্ত হতে পারবোনা আরহাম। ওদেরকে আমার সামনে চাই। যেকোনো মূল্যে।”

“আমি দেখছি।”

এই বলে আরহাম প্রস্থান করলো। সঙ্গে গেলো আদিমও। এদিকে কবিরাজ মশাইয়ের কাজও শেষের দিকে। তিনি ঔষধি লাগিয়ে রাজকন্যার হাতে ভালো করে পট্টি লাগিয়ে দিয়ে ক্ষনিকের মাঝেই বিদায় হলেন। রাজকন্যা তার যাওয়ার পানে একবার তাকিয়ে শয্যা ছেড়ে নেমে এলো নীচে। রাজকুমার তখন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাজকন্যা এগিয়ে গেলো সেদিকটাতে। রাজকুমারের পেছনে দাঁড়িয়ে কোমল স্বরে আওড়ালো,

“এতো ক্রোধান্বিত কেন হচ্ছেন? আপনার প্রনয়নী তো ঠিক আছে।”

রাজকন্যার গলা পেয়ে রাজকুমার চটজলদি পেছন মুড়ে তাকালো। ব্যস্ত হয়ে পড়লো হঠাৎ।

“আপনি উঠে এলেন কেন? একটু বিশ্রাম নিতে পারলেন না হু? এতো কিসের শক্তি আপনার?”

রাজকন্যা মিটমিটিয়ে হাসলো। রাজকুমারের দিকে দিকে তাকিয়ে মোহান্বিত কন্ঠে বলল,

“আপনি এতো মোহমুগ্ধ কেন?”

রাজকুমার ভড়কায় কিঞ্চিৎ। হঠাৎই রাজকন্যার কথার তাল ধরতে পারেনা সে। আমতাআমতা করে বলে,

“জানিনা তো।”

“আমি আপনার প্রণয়ে বিভোর রাজকুমার। এতো কেন ভালোবাসলাম আপনাকে? এতো কেন মাতাল হলাম আপনাতে? কেন! আপনার প্রতি আমার অতিরিক্ত চাওয়া ধ্বংস করে দিবে নাতো এই বসুন্ধরাকে? আমাকে,আপনাকে.. ধ্বংস করবে না তো?”

রাজকুমার অজানা ভয়ে কেঁপে উঠলো। তার ভয়ার্ত মুখশ্রী ঠিক কতটুকু বোধগম্য হলো রাজকন্যার বোঝা গেলোনা। রাজকন্যার গলা ক্রমশই জড়িয়ে আসছিলো। চোখ ঘোলাটে হয়ে উঠলো। রাজকুমার বুঝতে পারলো ঔষধির আচর পড়েছে তার উপর। রাজকন্যা ধীরেধীরে ঘোরে তলিয়ে গেছে। রাজকুমার আর দেরী করলো না। কোলে তুলে নিলো রাজকন্যাকে। অতঃপর শয্যায় এনে শুয়ে দিতেই ব্যাথা ভুলে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলো রাজকন্যা। তবে ঘুমের মাঝেও একটা শব্দ আওড়লো,

“ধ্বংস!”

______________

ধারালো অস্ত্রে নিজের মুখটা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে রেদোয়ান। ভয়ে তার গলা শুঁকিয়ে কাঠে পরিনত হয়েছে। যেকোনো মুহুর্তে ধর থেকে তার মাথা আলাদা হয়ে যেতে পারে। এই মুহুর্তে মৃত্যু চোখের সামনে তাল তুলে নাচছে।

“সরদার.. আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন!”

“খবরদার! আর একটা মিথ্যে বানী এই জবান থেকে বেরোলো দিখন্ড হবে এই মাথা!”

বজ্রকন্ঠে হুংকার ছাড়লো আয়াস। রাগে তার মস্তিষ্ক ভোঁতা হয়ে এসেছে। ঠিক ভুলের পার্থক্য এই মুহুর্তে আর সম্ভব নয়। আশেপাশের সমস্ত চেলাপেলা ভয়ে জমে গেছে প্রায়। সরদারের হঠাৎ এই রূপে মৃত্যুর কালো ছায়া দেখতে পাচ্ছে তারা। ওস্তাদজীর কথা শোনার দায়ে এবার যে জান যাবে তাদের! কি হতো ওস্তাদজীর একটা কথা না শুনলে?

“স্বীকার কর আমার অগোচরে তোরা ষড়যন্ত্র করে রাজকন্যার উপর হামলা করেছিস! স্বীকার কর।”

আয়াস আবারও হাঁক ছাড়লো। কন্ঠ ভয়ংকর। তার এই ক্রোধে যে ধ্বংস হয়ে যেতে সবকিছু। বিবেচনা করেননি ওস্তাদজী। সেই আফসোসেই ম’রে যাচ্ছে রেদোয়ান।

আয়াসের রাগের একমাত্র কারন তারই অগোচরে তারই মনের মানুষের উপর হামলা করা হয়েছে! কেন করলো? কিসের এতো তাড়া সবার? সে তো সবটা ঠান্ডা মস্তিষ্কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবে? আর কি চায় এদের?

“সরদার কসম লাগে আমার কথাটা একবার শোনেন। আমি আপনাকে সত্যিটাই বলবো।”

“সত্যিটা আমি বলছি, তুই আমার খেয়ে আমার পড়ে আমার পিছেই ছুরিঘাত করছিস! বিশ্বাসঘাতক!”

“সরদার! আমি আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। আমি করতে পারিনা সরদার।”

“খামোশ!”

বাজখাঁই গলায় আবারও চেঁচিয়ে উঠলো আয়াস। রাগে ক্ষোভে এবার সে পাগল হয়ে যাবে। ধারালো অস্ত্র সরিয়ে নিলো সে। রেদোয়ান যেন মরতে মরতে বেঁচে গেলো। আয়াস প্রস্থান করলো সেখান থেকে। বেরিয়ে চলে গেলো উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে। এই নরক যন্ত্রণা তার আর ভালো লাগেনা। একটু সুস্থ হাওয়ায় বাঁচতে চায় সে। এই বিষাক্ত হাওয়া থেকে বহুদূর গিয়ে।

#চলবে____

[ রেসপন্স করুন। লেখাটা বোধহয় এতোটাও খারাপ নয়]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here