#রাজকন্যা_হূরিয়া🍁🌸
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[১৯]
রাজকন্যার তলোয়ার আরহামের ঘাড়ে। ইচ্ছে করলে এক্ষনি তার মাথাটা আলাদা করে দিতে পারে রাজকন্যা। কিন্তু তাতে কি হবে? রহস্য কি কমবে? কবিরাজ মশাই কি ফিরে আসবে? আরোভি কি ফিরে আসবে? আসবেনা! কেউ ফিরে আসবে না। বরং রহস্যের বিশাল সমুদ্র আরেকটু দীর্ঘ হবে। আর সেই সমুদ্রের জল আরেকটু ঘোলা হবে।
“র্ রাজকন্যা…”
“কে তুমি? কি তোমার পরিচয়?”
খুবই শান্ত অথচ জোড়ালো কন্ঠে জিজ্ঞেস করে রাজকন্যা। আহরাম মৃত্যু ভয়ে ঢোক গেলে। যদিও সে জানেনা কি তার অপরাধ তবুও রাজকন্যার ধারালো তলোয়ারের নীচে যখন গর্দান এসে পড়েছে তখন সে নিশ্চয়ই কিছু করেছে। আর যেটা পাকাপোক্ত ভাবে সনাক্ত করে বের করে ফেলেছে রাজকন্যা। রাজকন্যার চারপাশে প্রহরীরা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। রাজকন্যার আদেশ পাওয়া মাত্রই প্রহার করবে আরহামের উপর।
“রাজকন্যা আ্ আমি কিছু করিনি! দয়াকরে আমাকে মারবেন না।”
ভয়ে শরীর হাত পা কাঁপতে থাকে অনবরত। সেই সঙ্গে গলার আওয়াজও কিছুটা ডেবে ডেবে আসতে লাগলো। রাজকন্যা হঠাৎ হাসলো। কেমন রহস্যময়ী হাসি। যা দেখতেই আহরামের প্রাণপাখীটা হাঁকডাক পেড়ে উঠলো ভেতর থেকে। এক্ষনি সে ছুটি চায় যেন। আরহাম ঢোক গেলে। আকুতি মিনতি করতে করতে পূনরায় বলে,
“কসম আল্লাহর! আমাকে মারবেন না রাজকন্যা। আমি সত্যি কিছু করিনি।”
“সেনাপতি মশাই? নিয়ে আসুন ওকে।”
রাজকন্যা ঝরঝরে কন্ঠে ডেকে উঠলো কাউকে একটা। আরহাম চেনেনা এই ব্যক্তিকে। দেখেনি আগে কখনও। সে তো কেবল মহামন্ত্রীর কথাই জানতো। উনি আবার কে?
সেনাপতি আতাউল ভেতরে প্রবেশ করে। তার পেছন পেছন ভেতরে প্রবেশ করে আরও দু’জন প্রহরী। তবে তারা একা নয়। তাদের সঙ্গে আরও একজন আছে। যাকে দেখতেই চমকে ওঠে আরহাম। ভয়, বিস্ময় সবটা মিলিয়ে মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। ওকে রাজকন্যা কি করে উদ্ধার করলো? এ যে অসম্ভব।
আরহামের ঠিক দু’হাত সামনেই দাঁড়িয়ে আছে হুবহু তারই মতো দেখতে এক ব্যক্তি। তার অবস্থা শোচনীয়। কা’টা’ছেঁ’ড়া শরীর, র’ক্তা’ক্ত, বি’ধ্ব’স্ত!
আরহাম ভয়ে পিছিয়ে পড়ে দু’কদম। মুখ থেকে অস্পষ্ট স্বরে বের হয় ‘এ অসম্ভব’। কেউ না শুনলেও আরহামের এই অস্পষ্ট বলা কথাটা শুনতে পায় রাজকন্যা। এক ঠোঁটে হাসে রাজকন্যা। যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার হাসি। অতঃপর শীতল গলায় বলে,
“চিনতে পারছো আরহাম? ভালো করে দেখো তাকিয়ে। ঠিক তোমার মতোই দেখতে তাইনা?”
আরহাম কেঁপে ওঠে আরেকদফা। ভয়ে,দুঃশ্চিন্তায় তার শরীরেও প্রতিটি শিরা-উপশিরায় র’ক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম। দম আঁটকে আসে ক্ষণকালেই।
“সন্দেহ তো আমার সেদিনই হয়েছিলো, যেদিন তুমি বলেছিলো তোমার আব্বাজানের শরীর ভালো নয় তাই তোমাকে যেতে হয়েছিলো। অথচ, আরহামের আব্বাজানতো সেই যুদ্ধেই শহীদ হন যে যুদ্ধে নগর রাজ্যের রাজা শহীদ হয়েছিলেন। কি ভেবেছিলে? রানীমার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটিয়ে চিরকালের মতো রানীমাকে পথ থেকে সরিয়ে দেবে? একের পর এক.. একের পর এক তোমার এই কুকর্মের মাশুল কত গুলো মানুষকে দিতে হয়েছে জানো? তুমি কবিরাজ মশাইকে খু’ন করলে, আরোভিকে খু’ন করলে, আর তারপর.. তারপর আমার রাজকুমারের উপর প্রহার করলে! যেন রাজকন্যার ধ্যান বেড়ে যায় তার রাজকুমারের উপর। আর আমি যেন অনায়াসে আমার দলবল নিয়ে এই রাজ্য গ্রাস করতে পারি। রাজ বংশের প্রত্যেকটা মানুষকে এভাবে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে আরামসে সবটা গ্রাস করতে পারি। (মৃদু হেসে) এতো সহজ নয়! রাজকন্যাকে হারানো এতো সহজ নয় আরহাম।”
রাজকন্যার অনর্গল বলে চলা কথা গুলো কাটার মতো বিঁধে গেলো আরহামের শরীরে। রাজকন্যা এতো কিছু জেনে গেছে আর সে? একটু আচ অব্দি পেলো না। শেষ অব্দি বাস্তবের আরহামকেই খুঁজে নিয়ে এলো এই তুচ্ছ মেয়েটা।
“এবার বলো কে তুমি? নয়তো এক কো’পে তোমার..”
আক্রোশ ভরা গলায় চেঁচিয়ে ওঠে রাজকন্যা। আরহাম মৃত্যু ভয়ে চুপসে যায় একদম। উপায়ন্তর না পেয়ে কাঁপতে কাঁপতে পা জড়িয়ে ধরে রাজকন্যার। বাঁচার জন্য আকুতি মিনতি করে বলে,
“র্ রাজকন্যা আপনি রুষ্ট হবেন না। দয়াকরে আমাকে সবটা বলার সুযোগ দিন? আ্ আমি সবটা বলতে চাই রাজকন্যা।”
পাখি তবে ধরা দিলো খাঁচায়। রাজকন্যা সন্তর্পণে তলোয়ারটা নামিয়ে নিলো। ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“সবটা স্বীকার করার জন্য কেবল একটাই সুযোগ পাবে তুমি। ফের কোনোরকম বোকামিতে জড়িয়োনা নিজেকে।”
আরহাম কম্পিত কণ্ঠে আওড়ায়,
“আমি বিশ্বাস করে নিয়েছি রাজকন্যা, আমার জীবনের আজই শেষ দিন। তাই আজ অন্তত মিথ্যে বলবোনা।”
“হু। বলো? কি বলতে চাও?”
আরহাম একবার ঢোক গেলে। অতঃপর মুখ উঁচিয়ে একবার তাকায় তার হুবহু চেহারার অধিকারী ব্যক্তিটির দিকে। এ যে আর কেউ নয় তারই জমজ ভাই। খুব ছোট বেলা থেকেই ও আরহামকে অপছন্দ করতো। এর মূখ্য কারন ছিলো ওর সব বিষয়ের পারদর্শিতা। যেকোনো পরীক্ষায় আহরাম থাকতো সবার প্রথমে। আর তারপর সে। স্বাভাবিক ভাবেই আব্বাজান আরহামকে প্রশংসায় প্রশংসায় ভরিয়ে তুলতেন। আর তার ভাগ্যে? অপমান আর লাঞ্ছনা ছাড়া কিছুই জোটেনি। এসব অতি তুচ্ছ কারনেই সে ঘর ছেড়েছিলো। তখন বয়স আর কতই বা হবে? ১০ ১২? হ্যাঁ অনেকটা অমনই। জেদ করে ঘর ছাড়ে ঠিকই তবে তার সামনের পরিকল্পনা ছিলো নিতান্তই শূন্য। আগে কি করবে, কোথায় থাকবে,কার কাছে থাকবে.. এসব সে জানতো না। ঠিক তখনই তার দেখা হয় ডাকাতদের ওস্তাদজী সাথে।
“আমি রেদোয়ান। আরহামের জমজ ভাই।”
এক লাইন বলে থামে রেদোয়ান। ঢোক গেলে। নিজেকে ধাতস্থ করে। অতঃপর আবারও বলতে শুরু করে,
“এই রাজ্য আমার লক্ষ্য। আজ থেকে নয় প্রায় পনেরো বছর আগে থেকে। আর আমার এই লক্ষ স্থীর করে দিয়েছিলো আমার ওস্তাদজী। তিনি একজন ডাকাত সরদার ছিলেন। সরদার থেকে পদবী মুছে উনি ওস্তাদজী হন। আমাদের সবার গুরু। প্রায় অনেক দিন পূর্বে ওস্তাদজী আমাকে বলেন আমাকে নগর রাজ্যের রাজপুত্র সাদ্দাতের বন্ধু আরহাম সেজে সিরাজদি রাজ্যে যেতে হবে। সার্বক্ষণিক রাজকুমারের সঙ্গে না থাকলেও রাজকন্যার প্রতি মুহুর্তের খবর তার চাই। রাজকন্যা কখন কি করবে, কখন কোথায় যাবে,কখন কার সাথে কথা বলবে? একদম গুনেগুনে খবর দিতে হবে। আমি তাই করলাম। ওস্তাদজীর কথা মতো নিজের ভাইকে কাপুরুষের মতো বেধরাম মেরে বন্দী করে দিলাম নিজের রাজ্যের গুপ্ত-কারাগারে। কেউ জানতেও পারলোনা আরহামের জায়গায় রেদোয়ান চলে এসেছে। আমি হয়ে গেলাম আরহাম। রাজকুমারের প্রানপ্রিয় বন্ধু। চলে এলাম লক্ষকেন্দ্রে। আর পিছু নিতে শুরু করলাম আপনার। এই রাজ্যে কখন কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে সব খবর পৌঁছাতে লাগলাম ওস্তাদজীর কাছে। এমনকি আপনার রাজসিংহাসনে বসার খবরটাও আমিই দিয়েছিলাম। আর তাই ওস্তাদজী আপনাকে একেবারে খতম করতে সেদিন রজনীতেই গুপ্তচর পাঠিয়ে আপনার উপর আক্রমণ করায়। আর আমার এই পায়ের চোট কোনো পাহাড় থেকে পড়ে হয়নি। এই চোট হলো সেদিনের,যেদিন কালাপাহাড়িয়ার কারাগারে আপনি শেষ বারের গিয়েছিলেন কবিরাজ মশাইয়ের সাথে দেখা করতে। আর গিয়ে দেখলেন নৃশংস অবস্থায় মরে পরে আছে কবিরাজ মশাই। উনার এই দশা আমি এই নিজ হাতে করেছিলাম। আর পাহাড়ের পেছনে আপনি যাকে আঘাত করেছিলেন সে আর কেউ নয় আমিই ছিলাম। এই ক্ষতও সেটারই। আরোভিকেও আমিই মা’রি। যদি আরোভিকে সেদিন না মা’র’তা’ম তবে সেদিনই আমার শেষ দিন হতো। কেননা,আরোভি সবটাই জানতো। আর আপনি যদি ওকে ওর এই অবস্থার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেন তাহলে ও নিশ্চয়ই সবটা বলে দিতো আপনাকে। স্বাভাবিক ভাবেই ওও মুখিয়ে ছিলো আপনাকে সবটা বলার জন্য। তাই আরোভিকে খু’ন করি। হ্যাঁ, আপনার সন্দেহ হয়তো আমার উপরেও আসতে পারতো তাই মিথ্যে বলতে হঠাৎ বলেছিলাম আমি রাজ্যেই ছিলাম না। আব্বাজানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আর আপনার এসব বিষয়ে যেন কোনো সন্দেহই না হয় তার জন্য আমি রাজকুমারের উপর আক্রমণ করাই।”
কথা গুলো অনবরত বলে গেলো রেদোয়ান। রাজকন্যা রুষ্ট চাহনিতে তাকিয়ে রইলো রেদোয়ানের দিকে। ক্ষেপা কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“এতো বড় স্পর্ধা তোমার! এর মাশুল তোমায় গুনতে হবে রেদোয়ান। সেই একই সঙ্গে মাশুল গুনবে তোমার পুরো ডাকাত বংশের। রাজকন্যা হূরিয়া কথা দিচ্ছে.. এতোবড় স্পর্ধাকারী ডাকাতের বংশকে উৎখাত করবো আমি। আমি।”
রাজকন্যার বজ্রকন্ঠে চারদেয়ালও যেন হুংকার ছাড়লো। প্রতিধ্বনি তুললো রাজকন্যার প্রতিটি বাক্যের। রাজকন্যা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।
“সেনাপতি মশাই, বন্দী করুন এই বিশ্বাসঘাতককে। আর বার্তা পাঠান ওস্তাদজীকে, রাজকন্যা হূরিয়ার তলোয়ারের নীচে গর্দান দিতে যেন প্রস্তুত থাকে সে। কেননা, তার মৃ/ত্যু তো অনিবার্য।
•
বার্তা পৌঁছে গেলো ডাকাতদের কুঠুরিতে। তবে তা ওস্তাদজীর হাতে পড়ার আগে আয়াসের হাতে পড়লো। সে পড়লো এই বার্তা। একবার নয়, বারবার পড়লো। পড়তে পড়তে ব্যুত হয়ে রইলো অদৃশ্য নেশায়। কি যেন জাদু আছে রাজকন্যার মাঝে। কেননা সে ঐদিকে তাকে মৃ’ত্যুর আহ্বান করছে আর সে স্ব-ইচ্ছায় মাথা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমন পাগল হলে কি করে চলবে?
রাজকন্যা নগর রাজ্যে পৌঁছানোর পূর্বে তারা আসল লোককে ঠিকই সরিয়ে দিতে পেরেছিলো কিন্তু তাড়াহুড়ো আর সময়ের স্বল্পতায় আরহামকে সরাতে পারলো না। আর রাজকন্যা ঠিকই উদ্ধার করে ফেললো আরহামকে। এই কন্যা সত্যিই স্বাভাবিক নয়। কিছু তো একটা আছে তার মাঝে।
” সরদার? রেদোয়ানকে বন্দী করেছেন রাজকন্যা।”
বলে উঠলো লতিফ। আয়াস ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,
“জানি।”
“তাকে উদ্ধার করা উচিৎ সরদার। নয়তো রাজকন্যা তাকে মেরে ফেলবে।”
“মারবে না লতিফ। দুশ্চিন্তা করিস না।”
লতিফের মনে ভয়। রাজকন্যার পরের স্বীকার হওয়ার। তার গলা কাঁপছে। কম্পিত স্বরেই পূনরায় বলল,
“আপনি এতো নিশ্চয়তা দিয়ে কি করে বলছেন সরদার?”
আয়াস হাসে। চমৎকার হাসি। রাজকন্যার পাঠানো বার্তায় আরেকবার নেশালো দৃষ্টি বুলিয়ে বলল,
“কারন আমি তাকে চিনি।”
লতিফ ভয়ে গুটিয়ে যায়। সরে আসে আয়াসের পেছন থেকে। এই সরদার না এক্কেবারে পাগল। যদি এই ডাকাত কুঠুরিতে কখনও ধ্বংস আসে তবে নির্ঘাত এই পাগলের জন্যই আসবে।
আয়াস উঠে দাঁড়ায়। বার্তাটি খুব যত্ন করে রেখে দেয় পোশাকের ভাঁজে। মুচকি হাসতে হাসতে তলোয়ারটা হাতে উঠিয়ে লতিফকে উদ্দেশ্য করে বলে ,
“আব্বাজান ফিরলে বলবি তার প্রানপ্রিয় বন্ধু যেন আজ থেকে এই কুঠুরিতেই থাকে। ওখানটা তার জন্য নিরাপদ নয়। রাজকন্যা যখন তখন পৌঁছে যেতে পারে সেখানে। আর তাকে আঁটকানো এতো সহজ হবেনা। কারন সে জ্বীন নয়।”
“আজ্ঞে সরদার।”
নশতির করে বলে লতিফ। আয়াস বড়বড় পা ফেলে বেরিয়ে যায় রাজ্যের উদ্দেশ্যে।
#চলবে___