রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-২৬

0
322

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸🥀
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
২৬;

“শেষ পর্যন্ত জিন্নাতকেও আপনি ছাড়লেন না!” রাজকন্যার কম্পিত কণ্ঠ ভেসে এলো। আয়াস বিমূঢ় হয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে রইলো। অক্ষিপট বন্ধ করলো। বুক ফুলিয়ে বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। অতঃপর মুখ উঁচিয়ে তাকালো রাজকন্যার পানে। ভেতরটা ছারখার হচ্ছে তার। তার জীবনটা এমন কেনো হলো? কেন সে ডাকাতই হলো? কেন জন্মের পর এই প্রাসাদটাই হলো না তার আসল ঠিকানা। যদি কোনো দাসীর গর্ভেও তার জন্ম হতো তবেও তো থাকতে পারতো এই প্রাসাদে। থাকতে পারতো রাজকন্যার আশেপাশে। দেখতে পারতো তাকে তৃপ্তি ভরে। তখন নিশ্চয়ই তার নামের সাথে জুটতো না কোনো কালিমা। নিজের উদ্দেশ্য,নিজের নাম বাঁচাতে নিশ্চয়ই করতে হতো না এতো
অ/ন্যায়,অ/বিচার,নি/পীড়ন! কেন তার জন্মটাই
পা/প হলো? কেন!

“রাজকন্যা! আমি আপনাকে সবটা খুলে বলতে…”

“খামোশ!”

রাজকন্যার ত/লোয়ার বিঁধল গিয়ে আয়াসের বক্ষস্থলে। ফ্যাচ করে কে/টে গেলো এক দলা চা/মড়া। ওমনি গল গল করে র/ক্ত পড়তে আরম্ভ করলো। আয়াস থমকে গেলো! তার পদতল অচল হয়ে পড়লো সেখানেই। এক চিনচিনে ব্যথায় আকস্মিক তার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। গলার কাছে রগ গুলো ফুলেফেঁপে উঠলো। অক্ষগোলকোর চারিকোণ কেমন র/ক্ত মুখো হয়ে উঠলো। আকস্মিক আক্রমণ তার বোধগম্য হতে নেহাতই অনেকটা সময় লেগে গেলো।

রাজকন্যার বজ্রকন্ঠ এখনও যেন ঝংকার তুলে চলেছে উপস্থিত মহলে। চারপাশের প্রহরীরা ভয়ে কাবু হয়ে গেলো। রাজকন্যা তাদের তথাকথিত রাজকুমারকে এমন করে আঘাত করলো? কিন্তু কেন?

আয়াস হা করে দম ছেড়ে দিলো। আর ঠিক তার পরপরই ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে আরম্ভ করলো। মুখ উঁচিয়ে রাজকন্যার অগ্নিমূর্তির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে চমৎকার হাসলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বুলি আওড়ালো,

“আমি আপনাকে নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবেসে ফেলেছি রাজকন্যা। তাই আপনার প্রত্যেকটা আঘাত আমার শিরোধার্য প্রনয়ণী। ভালোবাসি। ভীষণ।” বলতে বলতে বক্ষস্থলে হাত চাপলো আয়াস।

“প্রহরী!”

আবারও রাজকন্যার বজ্রকন্ঠ প্রতিধ্বনি তুললো উপস্থিত মহলে। পাঁচ ছ’জন প্রহরী ছুট্টে এলো রাজকন্যার সম্মুখপানে। মাথা নত করে ‘আদেশ করুন,রাজকন্যা’ বলে নিশ্চুপ দাঁড়ালো।

“বন্দী করো এই অর্বাচীনকে। এক্ষনি।”

আয়াসের সর্বাঙ্গ কেঁপে কেঁপে উঠলো। র/ক্ত পড়লো জোয়াল দিয়ে। রাজকন্যা অগ্নিমূর্তির ন্যায় স্থীর দাঁড়িয়ে আছে। জিন্নাত সমস্তটা দেখে রাজকন্যার পাশে এসে দাঁড়ালো।

“রাজকন্যে,শান্ত হও। এখন তুমি ক্রোধে। ক্রোধান্বিত অবস্থায় এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিওনা যেন পরে পস্তাতে হয়।”

রাজকন্যা কানে নিলো না জিন্নাতের কথা। আবারও গর্জে উঠলো,

“কি হলো? কথা কানে গেলো না?”

প্রহরীরা ভয়ে কেঁপে ওঠে। নিজেদের প্রান রক্ষার্থে আয়াসকে বন্দী করে নিয়ে যায় কারাগারের দিকে। আয়াস সবটা হাসিমুখে বরন করে নেয়। তার মুখে বিন্দুমাত্র রাগ,কিংবা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নেই। সে হাসিমুখে চলে গেলো। যা দেখে রাজকন্যা আর শক্ত থাকতে পারলোনা। তার ইচ্ছে করলো চিৎকার করে কাঁদতে। সে পারছেনা আয়াসকে এতো কষ্ট দিতে। মরে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু আর যে কোনো উপায় নেই। ওস্তাদজী এবং নাজিমউদ্দীনকে মাত দিতে হলে আয়াসকে বন্দী করতেই হতো।

“কে কোথায় আছো? পন্ডিত মশাইকে ডেকে পাঠাও।”

কথাটা বলতে বলতে রাজকন্যা এগিয়ে গেলো রাজসভার দিকে। দু’জন প্রহরী তার আদেশ শোনা মাত্র ছুটলো পন্ডিত মশাইকে খবর দিতে। কিছু সময় পেরোতো পন্ডিত মশাই এসে হাজির হলো। রাজকন্যাকে সিংহাসনে বসে থাকতে দেখে কোমল হাসলো।

“স্বরন করেছেন রাজকন্যা?”

“হ্যাঁ পন্ডিত মশাই। আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।”

“আজ্ঞা করুন।”

“এখখানা পত্র লিখতে হবে।”

“যথাআজ্ঞা।”

পন্ডিত মশাই পত্র এবং কালী নিয়ে বসে পড়লেন। রাজকন্যা ধীরে ধীরে প্রত্যকটা কথা উপস্থাপন করলেন পন্ডিত মশাইয়ের সামনে। পন্ডিত মশাই নির্ভুল লিখে গেলেন সমস্তটা। লেখা শেষ হতেই পত্র খানা এগিয়ে দিলেন পন্ডিত মশাই। রাজকন্যা সবটা প্রথম থেকে পড়ল। নির্ভুল লেখা গুলো চোখে লাগার মতো। এই পত্র লেখা দিয়েই তবে শুরু হোক ডাকাত দল এবং রাজকন্যার যুদ্ধ।

রাজকন্যা প্রহরী ডাকলো। পত্র খানা এগিয়ে দিলো তাদের পানে। আদেশ করলো এই পত্র নিরাপদে যেন ডাকাতদের ডেরায় পৌঁছে যায়। এমনকি সরাসরি ওস্তাদজীর হাতে পড়তে হবে। এটুকু নিশ্চয়তা নিয়ে তবেই ফিরবে তারা। প্রহরী দু’জন পত্র খানা নিয়ে চলল ডাকাতদের ডেরায়। রাজকন্যা এবার একটু নিশ্চিন্ত হলো।

_____

কারাগারে বন্দী আয়াসের কাছে হাজির হলো প্রহরীরা৷ হাতে কাটাঘায়ে লাগানোর জন্য ঔষধী। তারা রাজকন্যার হুকুমে এসেছে এখানে। এই হুকুম পালন করতে আয়াসের হাতে নিজের জীবনও দিতে রাজি। অবশ্য ঘটনা কিঞ্চিৎ তেমনটাই হয়েছে। আয়াস রক্তিম চাহনিতে যেমন করে দেখেছিলো ওদের। মনে হয়েছে এই চাহনিতেই ওদের মৃত্যু অনিবার্য।

“রাজকুমার! আপনি দয়াকরে ঔষধী লাগাতে দিন। নয়তো রাজকন্যা আমাদের গর্দান নিবেন।”

অসহায় কন্ঠে বলল একজন প্রহরী। বাকিরা তার সঙ্গে সায় দিয়ে তুমুল গতিতে মাথা নাড়লো। কিন্তু আয়াস ভ্রুক্ষেপহীন। তার দৃষ্টি ঐ প্রবেশ পথের দিকে। আশা ছিলো রাজকন্যা নিজেই আসবে। হয়তো অনেক কথা শোনাবে,কিন্তু আসবে। আসবেই। কিন্তু এলো না রাজকন্যা। পাঠালো কেবল এই অধমদের।

“আমি ওসব ঔষধি লাগাবো। দয়াকরে রাজকন্যাকে গিয়ে জানিয়ে দাও।”

সেই এক কথা। অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে প্রহরীরা। তার কোনো মতেই রাজকন্যার আজ্ঞা অমান্য করতে পারবে না। এতোবড় দুঃসাহস হয়নি কারোর।

“রাজকুমার! দয়াকরে এরূপ করবেন না। আমাদের কথাটা একবার শুনুন। সামান্য ঔষধি! আপনার জখম স্থানে না লাগাতে পারলে অনেক বড় সমস্যার সৃষ্টি হইতে পারে।”

“হোক। কবুল সেই সমস্যার। আমি কোনোরূপ ঔষধি লাগাবো না জানিয়ে দাও তোমাদের রাজকন্যাকে। আমি এই জখম নিয়েই মরতে চাই।”

জেদ ধরা গলায় বলে গেলো আয়াস। প্রহরীরা পড়লো মহা ফ্যাসাদে। একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।

রাজকন্যা কারাগারের বাইরে আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে আয়াসকে টের পেতে দেয়নি তার আগমন! কিন্তু তার জেদ ধরা গলায় এবার সে নিজেও চরম বিরক্ত হয়ে উঠলো। কিসের এতো জেদ ঔষধি লাগাতে। খানিকটা লাগালেই জখম স্থানটা ভরতো। তা না! পাপ করে করে ভান্ডার ভরবে অথচ শাস্তি পাওয়ার পর যত নাটক। এটা তো শাস্তি! যেটা রাজকন্যা তাকে ক্রোধে পড়ে দিয়েছে ভালোবেসে নয়।

আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা রাজকন্যা। বিরক্তির স্তুপ আরেকটু বাড়িয়ে নিয়েই এগিয়ে গেলো কারাগারের দিকে। কারাগারের বাইরে দাঁড়িয়ে হুকুম করলো প্রহরীদের,

“তোমরা বাইরে এসো। আমি দেখছি।”

রাজকন্যার আকস্মিক আগমন কাম্য ছিলো না কারোরই। রাজকন্যাকে দেখতেই আনন্দে চকচক করে উঠলো আয়াসের চোখ। মুখের পীড়াদায়ক ভাবটা কেটে গেলো এক নিমিষে। ফুটে উঠলো প্রাণোচ্ছল ভাব।

প্রহরীরা দ্রুত বেরিয়ে পড়লো কারাগার থেকে। রাজকন্যা হাত বাড়িয়ে ঔষধির বাটিটা নিজের হাতে তুলে নিলো। অতঃপর আবারও হুকুম করলো,

“উনার জন্য পরিষ্কার কিছু পোষাকের ব্যবস্থা করো।”

“আজ্ঞে রাজকন্যা।”

সবাই নতশির করে ছুটে গেলো আয়াসের জন্য পরিষ্কার পোষাক নিয়ে আসতে। রাজকন্যা একটু নীচু হয়ে কারাগারের ভেতর প্রবেশ করল। আয়াস সেই প্রথম থেকেই হাসি-হাসি মুখ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার মনোহারিণীর পানে। রাজকন্যা ললাট কুঞ্চিত রেখে বিরক্তি সূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে গেলো। ওমনি সুযোগ বুঝে চোখ টিপল আয়াস। ঠোঁটের কোনে খেলে গেলো বাঁকা হাসি। রাজকন্যা চকিতে তাকালো। কুঞ্চিত ললাট আরও কুঞ্চিত হলো। তেঁতে উঠে আঙ্গুল উঁচিয়ে কয়েক কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হলেও বলতে পারলো কিছু। আয়াস মুখ খানা বাচ্চাসুলভ করে নিলো। ঠোঁট উল্টে অক্ষিপট কুটিকুটি করে তাকালো। রাজকন্যা দৃষ্টি সরালো। ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের ভারী পোশাকটা ধরে কোনো মতে বসলো আয়াসের সম্মুখে। আয়াস তখন মিটমিটে হাসছিলো।হাতে ভর দিয়ে সে নিজেও একটু কাছে এগিয়ে এলো রাজকন্যার। রাজকন্যা রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। ওমনি তার হাসি মুখখানা পূনরায় বাচ্চাসুলভ আকার নিলো। যার দরুন এবারও রাজকন্যা নিশ্চুপ রইলো। কোনোরূপ কথা না বলে ঔষধির বাটিটা মেঝেতে রেখে হাত বাড়ালো আয়াসের বক্ষস্থলে। আয়াস এক ধ্যানে দেখে চলল তার প্রনয়নীকে। তার গৌরীকে। রাজকন্যা গৌরী। দুধে-আলতা গায়ের রঙ। গোলগোল আঁখিদুটি অনেকটা রসগোল্লার মতো। কেউ হঠাৎ দেখলে বলতেই পারবেন না এই দৃষ্টি মুহুর্তেই কতটা ভয়ংকর হতে পারে। পাতলা মসৃণ ঠোঁট দুটো আরও বেশি সুন্দর। ভুলবশত একবার দৃষ্টি পড়লে ফেরানো দায়। ইচ্ছে করে ভুল করে একটু হায়া শরম খুইয়ে ছুঁয়ে দিতে। এরপর রাজকন্যার যে আক্রমণ হবে তার জন্য অবশ্যই পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হবে। ভাবতে ভাবতে মনে মনে নিজেকে পাগলের উপাখ্যান দিয়ে হেসে উঠলো আয়াস।

আয়াসের রক্তভেজা পোশাকটা খুলতে হাত কাঁপছিলো রাজকন্যার। রক্ত শুঁকিয়ে কটকট করছিলো। বক্ষস্থল থেকে তা অনাবৃত হতেই উদাম দেহখানা প্রকাশ্যে ভাসলো। একই সঙ্গে বক্ষস্থলের লম্বা করে কে/টে যাওয়া জায়গাটা। র/ক্ত ঝড়া বন্ধ হয়েছে বেশ খানিকটা পূর্বেই। তবে আরও বেশি দেরী করে ঔষধি দিতে গেলে সংক্রমণ ঘটতে পারে।

রাজকন্যার বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। হাতের মধ্যে ঔষধি নিয়ে আয়াসের বক্ষস্থলে লাগাতে গিয়েও হাত কাঁপল তার। যেকোনো মানুষই তার প্রিয় মানুষটার সামনে এসে দুর্বল হয়ে যায়। সেও এই নিয়মের ব্যতিক্রমে যায়নি। সত্যি সত্যি দুর্বল হয়ে পড়লো মানুষটার সামনে। এখন উপলব্ধি হচ্ছে, কি করে তার দেওয়া জখম মুখ বুঁজে গ্রহন করেছিলো মানুষটা!

“ভয় পাচ্ছেন?”

আয়াসের কন্ঠে চমকে উঠলো রাজকন্যা। ভীত দৃষ্টিতে একবার তাকালো আয়াসের হাস্যজ্জ্বল মুখখানে। ফের দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। সত্যিই সে ভয় পাচ্ছে।

“আমার ব্যাথা লাগবেনা। আপনি নিশ্চিন্তে ঔষধি লাগাতে পারেন। আর আপনি তো জানেন না, আপনার হাতে জাদু আছে। তখন যেভাবে আঘাত করেছেন.. সত্যি বলতে ব্যাথা আমার মোটেও লাগেনি।”

বলতে বলতে দুর্বোধ্য হাসলো আয়াস।

“চুপ করুনতো। আমাকে আমার কাজ করতে দিন।”

ধমকি সুরে বলে উঠলো রাজকন্যা। আয়াস খামোশ হলো। মুখে আঙ্গুল চেপে শান্ত হয়ে গেলো। রাজকন্যা তার কান্ড দেখে পূণরায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মানুষটা ক্লান্ত হয়না কোনো কিছুতে। অদ্ভুত।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here