রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-২৭

0
290

#রাজকন্যা_হূরিয়া ❤️
লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
২৭;

পত্র খানা হাতের মুঠোয় নিয়ে ধপ করে বসে পড়লো ওস্তাদজী। বার্ধক্যের ভারে টনটন করে উঠলো তার সমস্ত শরীর। চোখমুখ জুড়ে বিরাজমান হলো হেরে যাওয়ার অদৃশ্য ছাপ! ঐ ধূর্ত পুঁচকে কন্যা এতোদূর জেনে গেলো? তবে কি ও আয়াসকে সবটা বলে দিয়েছে? আয়াস সবটা জেনে গেছে!

কথা গুলো ভাবতেই তার শ্বাসে টান লাগলো। শ্বাসকষ্টের মতো হলো। তার এমন দশা দেখে ছুটে এলো নাজিমউদ্দীন। ওস্তাদজী হা করে দম নিতে লাগলো। নাজিমউদ্দীন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাউকে জল নিয়ে আসতে বলল।

“মিত্র কি হলো তোমার! হঠাৎ এমন দশা.. কি আছে পত্রে.. যা পড়তেই তোমার শরীরের এই গতি হলো?”

নাজিমউদ্দীনের চোখে মুখে ভয়। হাত বাড়িয়ে পত্র খানা নিতে গেলে ওস্তাদজী ওমন অবস্থায়ও সরিয়ে নেয় পত্রখানা। নাজিমউদ্দীন সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় ওস্তাদজীর পানে।

“কি হলো? পত্রখানা আমায় পড়তে তো দাও?”

সন্দিহান মনেই জানতে চায় নাজিমউদ্দিন।

“ন্ না মিত্র! এই পত্র আমি তোমায় কিছুতেই পড়তে দিতে পারবোনা।”

অতিকষ্টে জবাব দেয় ওস্তাদজী। নাজিমউদ্দীন হাফ ছাড়ে। পত্র খানা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবারও ডাকে কাউকে,

“জল আনতে এতক্ষণ সময় লাগে?”

সঙ্গে সঙ্গে জলের গ্লাস হাতে নিয়ে ছুটে আসে একটা ছেলে। নাজিমউদ্দীন সেই জলটা খুব সাবধানে খাওয়ায় ওস্তাদজীকে। জল খেতেই ওস্তাদজী একটু শান্ত হয়। তা দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নাজিমউদ্দীন।

নাজিমউদ্দীন এবং ওস্তাদজী দীর্ঘদিনের মিত্র। খুবই ভালো মিত্র তারা। আর এতোটাই ভালো মিত্র যে নাজিমউদ্দীন চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে ওস্তাদজীকে। তাই ওস্তাদজী একবার বারণ করাতেই নাজিমউদ্দীন দ্বিতীয়বার আর দেখতে চাইলো না পত্র খানা।

ওস্তাদজীকে ধরে উঠালো নীচ থেকে। এগিয়ে নিয়ে গেলো শয্যার দিকে। নাজিমউদ্দীন সাবধানে বসালো ওস্তাদজীকে। বলল,

“তুমি একটু বিশ্রাম নাও মিত্র। আমি আয়াসকে খবর দেওয়ার ব্যবস্থা করি।”

ওস্তাদজী ছক কষে। হঠাৎ কান্নাজড়ানো গলায় বলে ওঠে,

“আয়াস যে আর ফিরে আসতে পারবেনা মিত্র! রাজকন্যা ওকে কারাবন্দী করেছে!”

নাজিমউদ্দীন চমকে ওঠে। তার চোখমুখে ভর করে আতংক।

“কি!! কেমন করে?”

“আমার পুত্রকে বন্দী করেছে ঐ কন্যা। শর্ত দিয়েছে.. যদি সিরাজ উদ্দীনকে ছেড়ে দেই তবেই ও আমার পুত্রকে ছাড়বে। এর আগে নয়!”

“অসম্ভব! সিরাজকে মুক্ত করলে আমাদের রাজপ্রাসাদ দখল করা অসম্ভব হয়ে যাবে। আমাদের এতো বর্ষের স্বাধনা…”

“সব এক নিমিষে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।”

“কিন্তু আয়াসকে রাজকন্যা বন্দী করলো কেমন করে! রাজকন্যা আয়াসের সঙ্গে পেরে উঠেছে এটাই যে অবিশ্বাস্য!”

“আয়াসের বোকামোর জন্যই সবটা হয়েছে মিত্র। ওর প্রতি এতোটা অন্ধবিশ্বাস করা বোধহয় আমার ঠিক হয়নি।”

“তুমি এতো চিন্তা করিওনা। আয়াসকে মুক্ত করতে আমি যাবো ঐ প্রাসাদে। তবুও আমি সিরাজের মুক্তি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারবোনা। ওকে মুক্ত করা অসম্ভব মিত্র।”

“তুমি যাবে ঐ প্রাসাদে!”

“হ্যাঁ, আমি যাবো।”

বলেই উঠে দাঁড়ালো নাজিমউদ্দীন। আর এক মুহুর্ত দেরী করলো না। হনহন করে বেরিয়ে গেলো।

নাজিমউদ্দীন বেরিয়ে যেতেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠলো ওস্তাদজী। শয্যায় গা এলিয়ে দিয়ে শয়/তানি হেসে বলল,

“রাজকন্যা এতোটাও বোকা নয় প্রিয় মিত্র। আর আমি তো তার থেকেও একধাপ উপরে। আমাকে মাত দেওয়া এতো সহজ হবেনা। এই কে কোথায় আছিস?”

“আজ্ঞে ওস্তাদ?”

“মেরাজকে খবর দে।”

“কিন্তু ওস্তাদজী, মেরাজজী তো চিকিৎসায় আছেন।”

ওস্তাদজী ঠোঁটের কোনে পূণরায় বাঁকা হাসি টানলেন। বললেন,

“ওর কানে কানে গিয়ে বলবি ওস্তাদজী আপনাকে স্বরন করেছেন। ব্যস তাতেই ও ছুটে আসবে। যা।”

“আজ্ঞে ওস্তাদজী।”

________

রাজকন্যা নিজের কক্ষে ক্রমাগত পায়চারি করে চলেছে। ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে নাজিমউদ্দীনের আগমনের অপেক্ষায়। নাজিমউদ্দীন এই প্রাসাদে ফিরে আসলেই তার অনেক অজানা প্রশ্নের জট খুলে যাবে। সেটারই অপেক্ষা কেবল।

“রাজকন্যে,এতো হতাশ হয়ো নাকো। নাজিমউদ্দীন ঠিক আসবেন।”

“জিন্নাত আমার ভয় হচ্ছে। যদি নাজিমউদ্দীন না আসেন?”

“আসবে রাজকন্যে। কেননা,তোমার টোপ উনারা গিলে নিয়েছেন। আর তাছাড়া তোমার ভাবনা যদি সঠিক হয় তাহলে নাজিমউদ্দীনকে আসতেই হবে।”

রাজকন্যা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পায়চারি করা বন্ধ করে স্বস্তির দাঁড়াল। ভাবুক কন্ঠে বলল,

“ফুপুআম্মা কোথায় গো?”

“নিজের কক্ষেই হবেন।”

“দাসী? দাসী?”

“আজ্ঞে রাজকন্যা!”

“ফুপুআম্মাকে তৈরি করে দাও। এক্ষনি।”

“আজ্ঞে।”

রাজকন্যা উত্তেজনা পূর্বক হেসে নিঃশ্বাস ছাড়লো। আবারও ডাকলো প্রহরীদের।

“প্রহরী?”

“আজ্ঞে রাজকন্যা!”

“আয়াসকে এবং রেদোয়ানকে নিয়ে এসো ফুপুআম্মার কক্ষে।”

“যথাআজ্ঞা।”

“আসতে পারি?”

প্রহরী বেরিয়ে যেতেই ভেসে এলো কারোর গলা। রাজকন্যা নিজের প্রফুল্লতা চেপে পেছন মুড়ে তাকালো। ততক্ষণে অদৃশ্য হয়েছে জিন্নাত। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে রাজকুমার সাদ্দাত। তাকে দেখতেই রাজকন্যার হাসিখুশি মুখখানা চুপসে গেলো।

“রাজকুমার! আসুন?”

রাজকুমার অনুমতি পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।

“কবিরাজ মশাই বললেন আপনার শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটছে। চিন্তার আর কোনো কারন নেই।”

“আজ্ঞে। আগের চেয়ে বেশ ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো?”

রাজকন্যা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলল,

“জী ভালো আছি। বসুন না দয়াকরে।”

রাজকুমার বসতে বসতে চারপাশে একবার দৃষ্টি বুলালো। অতঃপর কি ভেবে বলে উঠলো,

“ও কি আপনাকে ছুঁয়েছে রাজকন্যা?”

রাজকন্যার ভ্রু কুঞ্চিত হলো।

“ও মানে! কে? কে আমাকে ছোঁবে?”

“আয়াস!”

রাজকন্যার কপালের ভাজ অদৃশ্য হয়ে গেলো। এবার তাকে একগাদা বিরক্তি আর অস্বস্তি চেপে বসলো। গলা কঠিন করে বলল,

“এর মানে কি রাজকুমার? আপনি এসব কি প্রশ্ন করছেন আমায়?”

রাজকুমার একটু ভড়কে গেলো। আমতাআমতা করে বলল,

“ন্ না আসলে, আমার কথার মানে অন্যকিছু রাজকন্যা। আপনি ভুল বুঝবেন না।”

“অন্যকিছু? কি সেটা?”

“ওরা আসলে মানুষ হিসেবে খুবই জঘন্য হয় রাজকন্যা। ওদের উদ্দেশ্য থাকে নারীদেহ্। আর আপনি যেমন ভয়ংকর সুন্দর তেমন..”

“সে মানুষ হিসেবে যেমনই হোক না কেন প্রথমত সে আমার স্বামী..”

রাজকন্যা প্রতিবাদী কন্ঠে জবাব দিতেই তাকে থামিয়ে দিলো রাজকুমার। বলে উঠলো,

“থাকবে না! হু। আর থাকবে না। আমি আপনাদের আলাদা হওয়ার ব্যবস্থা করে দেবো রাজকন্যা।”

রাজকন্যা ধপ করে জ্বলে উঠলো। কিন্তু তাতে বিশেষ ভাবান্তর হলো না রাজকুমারের। সে নিজের মতো করে হাসলো। বলল,

“ছোটবেলা থেকে নিজের প্রত্যেকটা জিনিসে অন্যকাউকে ভাগ বসাতে দেখেছি। নিজের অধিকারেও আব্বাজান ভাগ বসিয়ে দিয়েছেন তার বড় সন্তান যদি আজ বেঁচে থাকতো তাহলে এটা তার হতো এই বলে। সব মুখ বুঁজে মেনে এসেছি। কিন্তু আর নয়। যে জিনিসটা আমার সেটা কেবলই আমারই রাজকন্যা। আমি তাতে আমি কারোর ভাগ বসাতে দেবোনা।”

“আমি কোনো পন্য নই রাজকুমার। যে যার যখন ইচ্ছে হলো সে আমায় নিয়ে গেলো। আমার বিবাহ হয়ে গিয়েছে। আর এই অবস্থায় আপনি এসব নিয়ে না ভাবলেই আমি খুশি হবো।”

“না রাজকন্যা। আপনি আমার। আর আপনাকে আমি নিজের করেই ছাড়ব! যে-কোনো মূল্যে।”

“রাজকুমার..”

—“রাজকন্যা, নাজিমউদ্দীন এসেছেন!”

কক্ষের বাইরে থেকে ভেসে এলো এক প্রহরীর গলা। রাজকন্যা থেমে গেলো। রাজকুমারের নামটা উচ্চারণ করতে নিয়েও আর কিছু বলতে পারলো না। ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

“এই কক্ষে তোমার সঙ্গে আমার রঙ্গিন দুনিয়া সাজাতে কেউ আটকাতে পারবেনা রাজকন্যা। তোমাকে তো আমার হতেই হবে। আমি একটা ডাকাতের সামনে কিছুতেই হার মানবোনা। অসম্ভব!”

_____

নাজিমউদ্দিন দাঁড়িয়ে আছে রাজসভায়। উপস্থিত মহলে তিনি আর কয়েকজন প্রহরী ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি চোখ বুলিয়ে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছেন। তার সম্মুখেই বিশাল সিংহাসন। তার স্বপ্নের সিংহাসন। একদিন ঐ সিংহাসনে তার রাজ চলবে। এই গোটা সাম্রাজ্যে কেবলই তার রাজ চলবে। সবাই তাকে রাজার মতো সম্মান করবে। তার আদেশ পালনে সর্বদা নিয়োজিত থাকবে শতশত প্রহরী।

“ধ্যান করছেন বুঝি?”

নাটকীয় সুরে বলে উঠলো রাজকন্যা। নাজিমউদ্দীন আকস্মিক চমকে উঠলো। সম্মুখে তাকাতেই দৃশ্যমান হলো তার স্বপ্নের সিংহাসন আগলে বসে আছে রাজকন্যা হূরিয়া। মুখে বিসদৃশ হাসি।

“দ্বী-প্রহরের স্বপ্নকে কি বলে জানেন? দিবাস্বপ্ন! যা কোনোদিন পূরণ হওয়ার নয়।”

নাজিমউদ্দীন ধাতস্থ করলেন নিজেকে। রাজকন্যা হূরিয়ার অনেক গল্প তিনি শুনেছেন। আজ সামনাসামনি দেখে সত্যি বড় অবাক না হয়ে পারছেন না। এই টুকুনি পুঁচকে মেয়ের কথা বলার ধরণই যেন ভিন্ম। এমন কথায় যেকোনো মানুষই ভড়কাবো। ভয় পাবে। চিন্তায় পড়বে। তারও তেমনই হচ্ছে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। ভয়ও করছে কিঞ্চিৎ।

নাজিমউদ্দীনকে নিশ্চুপ দেখে ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসির রেখা টানলো রাজকন্যা। আকস্মিক দাঁড়িয়ে পড়ে বজ্রকন্ঠে হুকুম দিলো,

“কে কোথায় আছো? বন্দী করো নাজিমউদ্দীনকে।”

রাজকন্যার বজ্রকন্ঠ কানে আসতেই হকচকিয়ে তাকালো নাজিমউদ্দীন। মুখ খুললো কিছু বলবে বলে তার পূর্বেই বন্দী হলো। রাজকন্যা রাজকীয় ভঙ্গিতে নেমে এলো সিংহাসন থেকে। ছটফট করা নাজিমউদ্দীনের নিকটে এসে পূর্বের ন্যায় হাসলো। অতঃপর আস্তে করে বলল,

“স্বাগতম আপনাকে,আমার রাজ্যে। নিয়ে চলো উনাকে।”

বলেই হাঁটা ধরলো রাজকন্যা। রাজকন্যাকে অনুসরণ করে চারজন প্রহরী নাজিমউদ্দীনকে নিয়ে এগোলো তার পেছন পেছন। রাজকন্যা হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালো ফুপুআম্মার কক্ষের সামনে। বেগমজির কক্ষ চেনে নাজিমউদ্দীন। ভুলেনি কিছুই। আচমকা বেগমজির কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে থমকে গেলো সে। অকস্মাৎ তার মনে পড়লো পুরণো সব অতীত। -‘এক যে ছিলো সোনার কন্যা,মেঘ বরন কেশ;’

#চলবে

[ আপনারা কমেন্ট করেন না কেন?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here