#রাজকন্যা_হূরিয়া 🌸❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
২৯;
“এ-এটা অসম্ভব!”
আয়াসের গলা কাঁপে! বক্ষজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক যন্ত্রণাময় বিষাদ।
“এটাই বাস্তব আর এটাই সত্যি, রাজকুমার।”
“না!(কঠিন গলায়) আ- আমি কোনো রাজকুমার নই। আমায় ঐ নামে ডাকবেন না দয়াকরে!”
দম নিতে কষ্ট হয় আয়াসের। সে মানতে পারছেনা সে কোনো রাজকুমার হতে পারে! কেননা তার প্রিয় আব্বাজান, তার চোখের মনি তাকে এত বড় ধোঁকা দিতেই পারেনা। এ অসম্ভব!
রাজকন্যা এক দৃষ্টে চেয়েই রইলো আয়াসের মুখবিবরে। অস্থিরতায় কেমন হাসফাস করছে মানুষটা! বাস্তবতা বড়ই কঠিন! আর এর চেয়েও কঠিন বাস্তবতার মোকাবিলা তাকে আজ করতে হবে। করতেই হবে।
“এ- এ- এসব তুমি কি বলছো, আম্মাজান!”
ফুপুআম্মার কাতর কন্ঠ ভেসে আসে। রাজকন্যার টনক নড়ে। আয়াসের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফুপুআম্মার দিকে তাকাতেই দৃশ্যমান হয় ফুপুআম্মার অশ্রুসিক্ত নয়ন। রাজকন্যা ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
“হ্যাঁ ফুপুআম্মা। আমি সত্যি বলছি। আপনি কি একবার ঐ চিত্রখানা এই মুখটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখবেন?”
ফুপুআম্মার কোনো জবাব আসেনা। তিনি তার কম্পিত হস্তে নাজিমউদ্দীনের হাত থেকে কেড়ে নিলেন আয়াসের চিত্র খানা। অতঃপর রাজকন্যার কথা মতোই গভীর দৃষ্টি মেলে মিলালো। -হ্যাঁ, হুবহু সেই চেহারা। যেন এ আরেক নাজিমউদ্দিন দাঁড়িয়ে আছে! সেই চোখ,সেই মুখ,সেই হাসি!”
ফুপুআম্মার ভেতর থেকে হাঁকডাক পেড়ে জানান দেয় কথাগুলো। ফুপুআম্মা মুখে আঁচল চাপলেন কান্নার বেগ চাপতে। এপাশ থেকে রাজকন্যা আবারও বলে ওঠে,
“ঐ চিত্র খানা নাজিমউদ্দীনের নয় ফুপুআম্মা। ঐ চিত্র আপনার এবং নাজিমউদ্দীনের এক মাত্র পুত্র রাজকুমার আয়াসের। চিত্রকার আজই আমায় এই চিত্র তৈরী করে দিয়েছেন।”
হুহু করে কেঁদে ওঠেন ফুপুআম্মা। তার কান্নার শব্দ ভেবে আসতেই হা করে আঁটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দেয় আয়াস। ঢোক গেলে। তার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে! তার আব্বাজান তাকে মিথ্যে বলতে পারেনা! কোনোদিনও পারেনা।
রেদোয়ান এগিয়ে এসে আয়াসের পাশে দাঁড়ায়। কাঁধে হাত রেখে বলে,
“সরদার! আপনি রাজকুমার হলে অসুবিধাই বা কি? আপনি কি রাজকুমার হতে পারেন না?”
“রেদোয়ান তুমিও! তুমিও একথা বলবে? আর কেউ না জানলেও তুমি তো জানো আমি আমার আব্বাজানকে ঠিক কতটা বিশ্বাস করি। কতটা ভালোবাসি! আ- আমার আব্বাজান আমার সঙ্গে এতো বড় প্রতারনা করতে পারেন না!”
“আর যদি পারেন সরদার?”
“রেদোয়ান!”(রাগান্বিত স্বরে)
“হ্যাঁ সরদার! এ কথা আপনিও খুব ভালো করে জানেন যে ওস্তাদজী কতটা স্বার্থপর মানুষ! নিজের স্বার্থের জন্য আপনাকে দিয়ে কি না করিয়েছে!”
“কিন্তু রেদোয়ান.. তাই বলে বলে মিত্র আমাকে তো ধোঁকা দিতে পারেনা! আমি তার বাল্যকালের মিত্র! আমাদের শৈশব, কৈশোর থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপ একই সঙ্গে! সে আমায় অনন্ত ধোঁকা দিতে পারেনা!”
দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বলে ওঠেন নাজিমউদ্দীন। রাজকন্যা আকস্মিক হেসে ওঠে। তার হাসি দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকায় সকলে। তখনও রাজকন্যার ঠোঁটের কোনে লেগে থাকে তাচ্ছিল্য মিশ্রিত হাসি। রাজকন্যা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বুলি আওড়ায়,
“বিশ্বাস! ভরসা! ভালোবাসা! এই প্রত্যেকটা শব্দের ব্যবহার যদি আপনারা যথার্থ করতে পারতেন তবে সত্যিই আমার কোনো আক্ষেপ থাকতো না রাজকুমার। কিন্তু না, আপনারা দু’জনেই এই একই ভুল করে এসেছেন গত পঁচিশ বর্ষ অব্দি। একজন মানুষের উপর অন্ধবিশ্বাস, অন্ধভরসা এবং অন্ধ ভালোবেসে! (নাজিমউদ্দীনের দিকে তাকিয়ে) কেবল পঁচিশ বর্ষই নয়! না জানি আরও কত যুগ!”
নাজিমউদ্দীন ক্ষনকালের জন্য থমকালেন! স্থবির চিত্তে ডুব দিলেন অতীতের পাতায়। তার নিজের ভ্রাতা সমান মিত্র তাকে ঠিকিয়েছে? যে মিত্রকে এই গোটা জীবনটাই অন্ধের মতো বিশ্বাস করে, ভালোবেসে এসেছে সেই মিত্রই তাকে সবচেয়ে বড় ধোঁকা দিয়েছে? প্রতারণা করেছে নিজেরই পুত্রকে বদলে! হে রব!
“আয়াস যদি আমার পুত্র হয় তবে রুবা এবং মিত্রের পুত্র কে? মেরাজ? যদি মেরাজ ওদের পুত্র হয় তবে কেন সে এই অদলবদল ঘটালো? এর পেছনে মিত্রের উদ্দেশ্য কি?”
নাজিমউদ্দীন উদগ্রীব কন্ঠে জানতে চাইলেন। রাজকন্যার ওষ্ঠদ্বয়ের তাচ্ছিল্য মিশ্রিত হাসি এবার অদৃশ্য হলো। মলিন হলো মুখবিবর। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে লাগলো,
“কি আবার? এই সাম্রাজ্য!”
“ন- না না! মিত্র এই রাজ্য দখল করতে চেয়েছিলো কেবল আমার জন্য! যেন এই সিংহাসনে আমার রাজ চলে! এই গোটা সাম্রাজ্য যেন আমার হয়। মিত্র এই সমস্ত কিছু কেবল আমার জন্য করেছে।”
“তাই? তবে আপনি এখানে আসার পূর্বে আপনার মিত্রর কাছে কেন জানতে চাননি রাজকুমার আয়াসের মুক্তির বদলে আপনাকে বন্দী করে কেন পাঠাচ্ছে? সে নিজের পুত্রকে মুক্ত করতে নিজেই কেন বন্দী হলো না? কেন নিজের পুত্রকে মুক্ত করতে গোটা ডাকাতের দলটা নিয়ে এলো না এই ভেবে যে, যুদ্ধ করে হলেও পাতালঘরের ঐ কারাগার থেকে মুক্ত করবে নিজের পুত্রকে। কেন করলো না? জবাব আছে কোনো?”
নাজিমউদ্দীন যেন হোঁচট খেয়ে পড়লেন! তার ললাটে ফুটে উঠলো দুশ্চিন্তার অগুনিত ছাপ। আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে বললেন,
“ঐ পত্রে তুমি আমাকে বন্দী করে পাঠাতে বলেছিলে?”
“জি। আপনাকে বন্দী করার কথা আমি গোটাগোটা অক্ষরে লিখে পাঠিয়েছি। কেন? আপনার মিত্র আপনাকে পড়ে শোনাননি?”
নাজিমউদ্দীন আহত নয়নে তাকালেন আয়াসের পানে। বললেন,
“সে বলেছে ঐ পত্রে তুমি তোমার আব্বাজানের মুক্তি দাবী করেছো। যদি আমরা সিরাজকে মুক্ত করে দেই তাহলেই আয়াস মুক্তি পাবে! যা এই মুহুর্তে অসম্ভব ছিলো। এই রাজসিংহাসনে বসিবার একমাত্র হাতিয়ার হলো বন্দী রাজা সিরাজ উদ্দীন! তাকে মুক্ত করলে আমরা সবই খোয়াবো! এই বলে আমি নিজেই চলে আসি এখানে! আয়াসকে মুক্ত করতে!”
“এখানেও আপনি ঠকে গেলেন নাজিমউদ্দীন। নিজের বিশ্বাসঘাতক মিত্রের কাছে।”
বলতে বলতে পাশ ফিরে তাকালো আয়াসের অসহায় মুখটার দিকে। এতকিছু শুনে আয়াস এখনও স্থীর দাঁড়িয়ে আছে সেটাই যেন অনেক কিছু। রাজকন্যা তাকাতে আয়াসও মুখ তুলে তাকালো। তার অক্ষিকাচ গলিয়ে টসটসে দু’ফোটা জল গড়াতেই হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিলো সেই জল। রাজকন্যা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আয়াসের দিকে স্থীর দৃষ্টি রেখেই পূণরায় বলতে আরম্ভ করলো,
“মেরাজ ওস্তাদজীর এবং রুবার অবৈধ সন্তান। ওস্তাদজী পুত্রের পিতা তো হয়েছিলেন বটে তবে কোনো কালেই তার মতো একজন পাপিষ্ঠ ব্যাক্তি বিয়ের মতো এমন একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি।”
“কিন্তু সে তো আমাকে জানিয়েছিল সে রুবাকে বিবাহ করেছে!”
বলে ওঠেন নাজিমউদ্দীন। রাজকন্যা না সূচক মাথা নাড়ে।
“না। সে কোনোদিনই এই পূন্য করেননি। রুবা আমাদের রাজ্যের কর্মরত এক দাসী ছিলেন। (আয়াসের দিকে তাকিয়ে) নাজিমউদ্দীন এবং ফুপুআম্মার বিবাহের পরে ওস্তাদজী প্রায়শই এই রাজ্যের গুপ্ত দরজা থেকে নাজিমউদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতেন। আর তাদের সাক্ষাৎের নিখুঁত ব্যবস্থা করতেন রুবা। রুবাকে অবশ্য ঠিক করে দেন চাচাজান..”
“ছোট ভাইজন!”
ফুপুআম্মার আহত কন্ঠস্বরটা ভেসে আসে। রাজকন্যা মলিন মুখে তাকায় ফুপুআম্মার পানে।
“হ্যাঁ ফুপুআম্মা! চাচাজান করেছিলেন এই পাপ। অবশ্য তারও উদ্দেশ্য ছিলো এই সিংহাসনে রাজ করিবার। তবে রাজা সিরাজ উদ্দীন যতদিন এই সিংহাসনে থাকবেন ততদিন তো সে কোনো ভাবেই ঐ সিংহাসনে বসতে পারবেন না। তাই বাকিদের মতো তারও লক্ষ্য হয়ে ওঠে আব্বাজানকে আসনচ্যুত করার। আর তাই তিনি হাত মেলালেন ওস্তাদজীর সঙ্গে।
ওস্তাদজী ছিলো নারীলিপ্সুক এক পাপিষ্ঠ! রুবা ছিলো সুন্দরী রমণী। রুবাকে দেখতেই তার মাথা ঘুরে যায়। সে তার ভেতরের পশুটাকে ধরে রাখতে পারেনা। ধীরে ধীরে রুবাকে করে তোলে নিজের ভোগ্যসামগ্রী। তিনি এই প্রাসাদে যতবার এসেছেন ততবারই রুবার সঙ্গে তার একান্তে সময় কেটেছে এক বেলা। রুবা ভাবতো ওস্তাদজী তাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে। আর বিয়েও করবে। কিন্তু সে তো জানতো না সে ওস্তাদজীর কেবল এক বেলার পৈশাচিক আনন্দের কারণ ছিলো মাত্র। আর কিছুই নয়।”
“হ্যাঁ মিত্র বরাবরই নারী পিপাসু ছিলো। কিন্তু রুবাকে সে সত্যি ভালোবেসেছিলো রাজকন্যা। আমার নিজের চোখে দেখা রুবাকে ভালোবাসার পর মিত্র আর কোনো নারীকে কু/নজরে দেখেনি!”
দৃঢ় কন্ঠে বলেন নাজিমউদ্দীন। আয়াস উৎসুক নয়নে তাকায় তার পানে। আব্বাজানের নামে খানিকটা হলেও ভালো কথা শুনে ভেতরটা কিঞ্চিৎ শান্তি লাগছে। তবে তা বেশিক্ষণ টিকলো না। অবশ্য টিকতে দিলোনা রাজকন্যা। তার শান্তিকে অশান্তিতে রূপান্তর করে বলে উঠলো,
“অসম্ভব! আপনি জানেন আপনারই প্রানপ্রিয় মিত্র আপনার সুন্দরী পত্নীকেও নিজের নোংরা দৃষ্টি থেকে বাইরে রাখেন নি! তিনি তো পুরো পরিকল্পনাও করে ফেলেছিলো, যে করেই হোক বেগমজিকে সে একবার হলেও ভোগ করবে! নিজের সজ্জিত শয্যায় তুলবে।”
“রাজকন্যা.. এসব আপনি কি বলছেন?”
বজ্রকন্ঠে হুংকার ছাড়ে আয়াস। তবে সেটা নিজের কথিত আব্বাজানের নামে এহেম কথা শুনে নয়, বরং বেগমজিকে নিয়ে তার আব্বাজানের এমন নোংরা মানসিকতার বর্ননা শুনে। নাজিমউদ্দীনও আর স্থির থাকতে পারেন না। মাথার র’ক্ত টগবগ করে উঠতেই ছিটকে ওঠেন তিনি!
“এসব তুমি কি বলছো কোনো ধারণা আছে তোমার?” বলেন নাজিমউদ্দীন।
“আমি সবটা নিখুঁত জেনেই বলছি। রাজকন্যা জবাব দেয়।
” চাচাজান হয়তো জীবনের প্রথম ভালো কাজ টা তখনই করেছিলেন যখন তিনি ওস্তাদজীর এই নোংরা পরিকল্পনা সম্মন্ধে অবগত হন। তিনি ক্রোধে ফেটে পড়েন। ওস্তাদজীকে হুমকি দেন, যদি সে ভুল করেও তার ভগিনীকে বাজে নজরে দেখে তবে সে নির্ঘাত তাকে রাজা সিরাজ উদ্দীনের হাতে তুলে দিবেন। ওস্তাদজী শান্ত হন। তিনি ভাবেন বেশি লোভে সে সব হারাতে পারে। তাই তিনি এই ব্যাপারে ক্ষমা চান চাচাজানের কাছে। তিনি আর কোনোদিন তার ভগিনীকে খারাপ নজরে দেখবেনা। কথা রাখতে তিনি ফুপুআম্মার থেকে কু’দৃষ্টি সরালেও তার অনাগত সন্তানের থেকে নিজের কু’দৃষ্টি সরালেন না। যদি তাকে কোনো কারনে চাচাজানের সঙ্গ ছাড়তেও হয় তবে যেন চাচাজানের চেয়েও বড় অস্ত্র সে নিজের কাছে রাখতে পারে। আর সেটা হলো ফুপুআম্মার অনাগত সন্তান! কে বলতে পারে হয়তো কোনোদিন এই সন্তানই তার সবচেয়ে বড় মোক্ষম হাতিয়ার হবে? হলোও যে তাই(আয়াসের পানে তাকিয়ে)! ফুপুআম্মার অনগত সন্তানকে নিয়ে ওস্তাদজী ছক কষে ফেললেন। কিন্তু সেই পথে বাঁধা হলেন রুবা! ওস্তাদজী জানতে পারলো রুবাও মা হতে চলেছে। আর তার অনাগত সন্তানের পিতা সে নিজেই। শুরু হলো বাড়তি ঝামেলা! রুবা মেরাজকে পেটে নিয়ে বুঝেছিলো নরক য’ন্ত্রণা কাকে বলে? এমন একটা দিন ছিলো না যে ওস্তাদজী রুবাকে এক দন্ড শান্তি দিয়েছে! এতোটা মানসিক এবং শারীরিক যন্ত্রণা সে সহ্য করেছে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইতিহাস আজও কাঁদে! তবে এতকিছুর পরও রুবা হার মানেনি! একজন দায়িত্ব বান মায়ের মতো সে তার সন্তানকে এই পৃথিবীর আলো দেখাতে পেরেছিলো। আর তার পরই ছাড়লো এই বি/ষাক্ত দুনিয়া! হয়তো ওটাই ছিলো রুবার প্রথম নেওয়া শান্তির নিঃশ্বাস!
ওস্তাদজী মেরাজকে নিজের কাছে রাখতে চাইলেন না। ফেলে দেওয়ার কথা প্রায় ভেবেই নিয়েছিলেন কিন্তু তখনই তার মনে হয় সে ভুল করছে। এই সন্তানকে ফেলে না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিলে আখেরে তারই লাভ!
মেরাজ এবং রাজকুমার আয়াসের জন্মক্ষণ একই মুহুর্তে ছিলো। রাজকুমার আয়াসের জন্মের পূর্বক্ষণে ওস্তাদজী নাজিমউদ্দীনকে এমন ভাবে প্র’রোচনায় ফেলে যে নাজিমউদ্দীন সেদিন প’শুর মতো প্র’হার করে ফুপুআম্মাকে। আর যার পরেই ফুপুআম্মার প্রসব বেদনা শুরু হয়! এমন ভাবে প্র’হার করার কারনে স্বাভাবিক ভাবেই সবাই ভেবে নেয় তাদের সন্তান আর বাঁচবে না! এসব কিছু করার পেছনে ওস্তাদজীর দুটো কারন ছিলো,
এক, নিজের ভগিনীর সাথে ঘটা এই অন্যায়ের বিচার করতে রাজা সিরাজ উদ্দীন নির্ঘাত নাজিমউদ্দীনকে বন্দী করে ককারাবাসে রাখবেন।
এবং দুই, ফুপুআম্মার সন্তান জন্মাবার পূর্ব থেকেই যেন সবাই নিশ্চিত থাকে যে ফুপুআম্মার সন্তান মৃত জন্মেছে!
ওস্তাদজী সমস্ত পরিকল্পনা একে একে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। তার উদ্দেশ্য সফল হলো। রাজকুমার আয়াসের জন্মাবার ঠিক পরমুহুর্তেই চাচাজান তাকে সরিয়ে ওস্তাদজীর হাতে তুলে দেয়। এবং রাজকুমারের ফাঁকা জায়গায় রেখে দেয় এক মৃত সন্তান। যেন ফুপুআম্মার চোখ মেলেই দেখতে পায় সে একজন মৃত সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।”
এটুকু বলে রাজকন্যা থামে। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নেয়। আয়াস ততক্ষণে চোখ বুঁজে নেয়! বক্ষজুড়ে বি’ষাক্ত ব্যাথাটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। দম আঁটকে যাচ্ছে! আপন জন! আপন জন বলতে ঐ একটা মানুষই তো ছিলো। তার আব্বাজান। যে কি তার জীবনের গোটা পঁচিশ টা বর্ষ অব্দি কেবল ধোঁকাই দিয়ে এসেছে। তার সুন্দর পরিচ্ছন্ন জীবনটাকে শুরু হওয়ার পূর্বেই শেষ করে দিয়েছে! কেন? কেন করলো সে এমন?
নাজিমউদ্দীন হা করে নিঃশ্বাস নিলেন। তার একজন ভ্রাতা ছিলেন। ছোট। সে সব সময় বলতো তাদের কুঁড়েঘরটা ভেঙে যাওয়ার পেছনে তার মিত্রেরই হাত আছে। একদিন মিলবে তার কথা! ঠিক! আজ মিলে গেলো তার কথা! তার জীবনের প্রথম ক্ষতিটা তার মিত্রই করেছিলো! সে ভুলে গেলো কেমন করে? তার ভ্রাতা,মাতা পিতা সবাইকে সে এক এক করে কেঁড়ে নিলো। আর শেষ অব্দি তার পুত্রকেও! টানা একুশ টা বর্ষ! হ্যাঁ, ঠিক একুশ বর্ষ! তার ছেলেটা তো তার সম্মুখেই বড় হয়েছে। সারাক্ষণ খেলেছে,হেসেছে! কিন্তু সে হতভাগার মতো সবটা দেখে গেছে! কোনোদিন একবারের জন্য ভাবতে পারেনি এই ছোকরা তার পুত্র হতে পারে। এর জন্যই হয়তো নিজের সন্তানের চেয়েও এই ছোকরার প্রতি তার টান, তার দুর্বলতা বরাবর বেশি ছিলো!-
“ওস্তাদজী বুদ্ধি করে নাজিমউদ্দীনকে ভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয়। আর এদিকে ৪বর্ষ অব্দি রাজকুমার আয়াসকে নিজের মতো করে বড় করতে আরম্ভ করে। রাজকুমার আয়াসের মাঝে নিজের সব বিদ্যা ঢেলে দেয় ওস্তাদজী। যেন নাজিমউদ্দীক তাকে দেখা মাত্রই বলে দিতে পারে এই পুত্র ওস্তাদজীর ছাড়া আর কারোর হতে পারেনা। অন্যদিকে মেরাজকে সমস্ত রাজকীয় সুখ, ভোগবিলাস দিতে শুরু করে। যেন ওকে দেখতেই নাজিমউদ্দীন চিনে নেয় এটাই তার এবং বেগমজির সন্তান। নাজিমউদ্দীন পূনরায় ভুল করেন। নিজের পুত্রকে চিনতে পারেননা। ওস্তাদজীর পাতা ফাঁদে আবারও পা দেয় সে। ওস্তাদজী জানায়, সে চলে যাওয়ার পরই ফুপুআম্মার কোল আলো করে জন্মায় মেরাজ। কিন্তু সে মেরাজকে নিজের মাতৃপিরচয় দেওয়ার পূর্বেই বিতাড়িত করে রাজ্য থেকে। দাসীদের দিয়ে ফেলে আসতে বলে কোনো এক জঙ্গলে। সে খবর পেয়ে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। নিজের সন্তানের আদর দিয়ে, স্নেহ দিয়ে বড় করে। নাজিমউদ্দীন তার কথাই মেনে নেয়। সে ভাবে বেগমজি হয়তো সত্যি সত্যি তাদের পুত্রকে বিতাড়িত করে রাজ্য থেকে।”
আয়াস ধপ করে বসে পড়ে মেঝেতে! তার সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে আসে। থরথর করে কাঁপতে লাগে সর্বাঙ্গ। আর কিছু শোনার বিন্দু মাত্র শক্তি তার মাঝে অবশিষ্ট নেই। দম ফুরিয়ে এসেছে যেন! বুকের পা পাশে শক্ত করে চেপে ধরলো ডান হাতটা! মনে হচ্ছে যেন মরে যাচ্ছে সে!
“সরদার! সরদার কি হলো আপনার?”
আঁতকে উঠলো উপস্থিত সকলে। রেদোয়ান অস্থিরতা নিয়ে বসে পড়লো তার পাশে। কাঁধে, পিঠে হা বুলাতে বুলাতে আওড়ালো কথাগুলো। ওদিক থেকে ছুটে এলেন নাজিমউদ্দীন! আয়াসের সম্মুখে বসে অসহায় কন্ঠে আওড়ালেন,
“রাজকুমার.. আব্বাজান? কি হলো তোমার!”
নাজিমউদ্দীন এর কন্ঠে ‘আব্বাজান’ ডাকে মন জুড়ালো যেন আয়াসের। তার সমস্ত খারাপ লাগা যেন এক নিমিষে উধাও হয়ে গেলো।
ছুট্টে এলেন ফুপুআম্মাও। ঠিক আয়াসের সম্মুখে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লেন। কিছু না বলেই বুকে জড়িয়ে নিলেন পুত্রকে। অমনি কান্নার ঢল পড়লো যেন।হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি। কাঁদলেন নাজিমউদ্দীনও,কাঁদল আয়াস এবং রেদোয়ানও। কাঁদল রাজকন্যাও। কাঁদতে কাঁদতেই আবার হাসলো রাজকন্যা। ঠিক নেই কত গুলো যুগ পেরিয়েছে ফুপুআম্মা এমন ভয়ানক ভাবে কাঁদেন না। আজ কাঁদছেন। নিজেকে উজাড় করে কাঁদছেন। দুঃখে নয়। সুখের কান্না কাঁদছেন। সে পেরেছে ফুপুআম্মার সর্বস্ব ফিরিয়ে দিতে। এবার কেবল প্রতীক্ষা নিজের আম্মাজানের এমন আনন্দের কান্না দেখার। আব্বাজান ফিরে এলে আম্মাজানও ঠিক এমন করেই কাঁদবেন।
#চলবে___
[ অনেক বড় পর্ব লিখেছি। মন্তব্য করতে কিপ্টামি করবেন না কেউ🙂। গতকাল পর্বটা ডিলিট হওয়ার জন্য আজ আর লিখতামই না। লিখলাম কেবল আপনাদের জন্য, আজ না পেলে আপনাদের মন আরও খারাপ হয়ে যাবে এর জন্য! তাই আশা করবো সবাই মন্তব্য করবেন। পর্বটা আরও বড় হতো। এখনও খানিকটা অংশ লেখা হয়নি। বেশি বড় পড়তে আবার বিরক্ত লাগে তাই বাদ দিছি। নেক্সট পর্বে লিখবো ইনশাআল্লাহ ]