#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸🥀
#মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[৭]
রাজকুমার কক্ষে প্রবেশ করলো। রাজকন্যা লজ্জা মিশ্রিত মুখেই এগিয়ে এলো তার সন্নিকটে। আজ থেকে এই মানুষটা তার স্বামী। সর্বক্ষণের সঙ্গী। তার রাগ,অভিমান, অভিযোগকে প্রশ্রয় দিয়ে ভালোবেসে আগলে রাখা একমাত্র সঙ্গী। রাজকন্যা তার প্রেমে পড়েছে। ঠিক যেই মুহুর্তে সে এই মানুষটার জন্য কবুল পড়েছে ঠিক সেই মুহুর্তেই প্রেমে পড়েছে। খুব গভীর আর পবিত্র সেই প্রেম। ভীষন মায়াতেও জড়িয়েছে। রাজকুমারের শ্যামবর্ণ স্নিগ্ধ মুখের মায়ায়। তার ঐ বড়বড় ডাগরডোগর নেত্র জোড়ার প্রেমে পড়েছে। তার টকটকে লাল ওষ্ঠের প্রেমে পড়েছে। তার ঐ মসৃন মুখে চাপ দাঁড়ির প্রেমে পড়েছে। প্রেমে পড়েছে তার একঝাক চুলের উপর যারা লম্বা হয়ে নেমে এসেছে রাজকুমাররে ঘাড়ের উপর। তার মাথার ঐ মুকুট,গলায় মুক্তোর মালা,হাতে হরেক রকমের বালা সবটার.. সবটার প্রেমে পড়েছে রাজকন্যা। তার শীতল চাহনি,মায়াবী হাসি সবটাই ভালোবেসেছে সে। সবটা।
“বাব্বাহ! এক দেখাতেই হজম করবেন কি আমাকে?”
সোজা কথার বান ছুড়লো রাজকুমার। রাজকন্যা চোখ বড়বড় করে তাকালো। হঠাৎ লজ্জায় মাথাটা মিশিয়ে নিলো চিবুকের সঙ্গে। ইশ,কি বেয়াড়া হয়েছে সে। এভাবে কি কাউকে দেখে নাকি?
“লজ্জা পেলেন?”
রাজকুমার মুখটা নীচু করে রাজকন্যাকে একবার দেখলো। সে যে লজ্জায় মুখই তুলতে পারছেনা। রাজকুমার স্মিত হাসলো। ফের বলল,
“লজ্জা পেতে হবেনা। আজ থেকে আমার গোটা জীবনটা এই রমণীর নামে দলিল করে দিলাম। সে যখন চায়,যেভাবে চায় আমায় দেখতে পাবে।”
বলতে বলতে রাজকুমার এগিয়ে এসে আলতো করে হাত রাখে রাজকন্যার মুখবিবরে। রাজকন্যা কেঁপে উঠে। রাজকুমার ওর চোখে চোখ রাখে। পলক ঝাপটে বলে,
“আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি রাজকন্যা। খুব ভালোবেসে ফেলেছি।”
রাজকুমারের অঙ্গীকারে সারা শরীরে অদ্ভুত এক শ্রোত বয়ে যায় রাজকন্যার। সে অপলক দৃষ্টি রাখে রাজকুমারের নেশালো নয়নে। রাজকুমার ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে তার খুব কাছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে তার মুখবিবরে। রাজকন্যা চোখ বন্ধ করে নেয়। মনের অগোচরেই লজ্জিত হাসে। তার ওষ্ঠদ্বয় কাঁপে। অতঃপর টের পায় রাজকুমার মিশে যায় তার সাথে। খুব কাছে টেনে নিয়ে ভালোবাসার পরশ আঁকে ললাটে (কপালে)। রাজকন্যার নেত্রকোন ভরে ওঠে প্রশান্তিতে। সে চোখ মেলে তাকায় রাজকুমারের স্নিগ্ধ মুখে। ততক্ষণে রাজকুমার তাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে। রাজকন্যা কান পাতে তার বুকে। শুনতে পায় ভালোবাসার ডাক। সাড়া দেয় সেও। দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাজকুমারকে। তার বুক জুড়ায়। তার ছোট্ট জীবনটাতে আজকের মতো এতোটা প্রশান্তি যে কখনও পায়নি সেটা উপলব্ধি করে। আজই এই নতুন আর সুন্দর অনুভূতির সৃষ্টি করে সে। পরম শান্তি অনুভব করে। বাবাকে হারানোর বেদনা ভুলতে তার এক ক্ষনও লাগেনা। মন বলে সে এই ধরণির সবচেয়ে সুখী মানুষ। হ্যাঁ-সেই তো এই বসুমতীর সবচেয়ে সুখী মানুষটা। সবচেয়ে সুখী।
দরজায় ঠকঠক আওয়াজ পড়ে। রাজকন্যা এবং রাজকুমার দু’জনেই সচেতন হয়ে দূরে সরে পড়ে। পেছন মুড়ে তাকায় একই সাথে। ওপাশ থেকে আরহামের গলা ভেসে আসে,
“মার্জনা করবেন রাজকুমার! এখখানা পত্র এসেছে।”
রাজকুমার একবার আঁড়চোখে তাকায় রাজকন্যার দিকে। অতঃপর নিজেকে আড়স্ত করে পূর্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার প্রতি। রাজকন্যাও তাকাও প্রশ্নবিদ্ধ মুখে। রাজকুমার চোখের ইশারায় রাজকন্যাকে ভরসা দেয়। অর্থাৎ, ‘দুশ্চিন্তার কোনো কারন নেই।’ এগিয়ে গিয়ে পাট(দরজা) খোলে রাজকুমার। পাটের ওপাশ থেকে অপরাধী দৃষ্টিতে তাকায় আরহাম। মাথা নত করে। অতঃপর পত্রটি এগিয়ে দেয় রাজকুমারের দিকে।
“তোমার রাজ্য ধ্বংস হতে চলল,যুবক!”
পত্রে এমন কিছু লেখা পড়তেই চোয়াল শক্ত হয়ে পড়ে তার। ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে আরহামের দিকে তাকালে সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
“আমাদের যেতে হবে রাজকুমার।”
ভেতর থেকে রাজকন্যা তাদের কথোপকথন ঠিকঠাক শুনতে পায় না। তাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে। যদিও রাজকুমার নিশ্চিত করেছে দুশ্চিন্তার কোনো কারন নেই তবুও মন মানছেনা। মন বলছে তার অগোচরে কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে।
“যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি আসছি।”
বলে ভেতরে প্রবেশ করে রাজকুমার। রাজকন্যা না পেরে ছুটে আসে তার সামনে। চিন্তান্বিত মনে প্রশ্ন করে,
“কি হয়েছে? কোনো বিপদ নয়তো?”
“বিপদ তো বটেই রাজকন্যা। রাজ্যের উপর যুদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। আমাকে যে যেতে হবে।”
“সে কি! হঠাৎ..”
“চিন্তা করবেন না। আমি শীঘ্রই ফিরে আসবো।”
রাজকুমার আর কোনো কথা বলার সুযোগ দিলো না রাজকন্যাকে। কাছে টেনে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো কয়েক মুহুর্ত। অতঃপর ললাটে পূনরায় ভালোবাসার ছোট্ট একটা ছোঁয়া একেই বেরিয়ে গেলো। রাজকন্যা হতাশ দৃষ্টে তাকিয়ে আছে রাজকুমারের যাওয়ার পানে। তার ভেতরে প্রবল ঝড় বইছে! না জানি কোনো বিপদ ওত পেতে আছে রাজকুমারের জন্য। যদি যুদ্ধই হবে তবে তার রাজ্যও যুদ্ধ করবে রাজকুমারের হয়ে। রাজকুমার একা নয়। সে তার পাশে আছে।
রাজকন্যা ছুটে গেলো মহলে। প্রহরীদের আদেশ করলো মহামন্ত্রীকে খবর দিতে। প্রহরীরা ছুটে গেলো রাজকন্যার আদেশ পালনে। মহলে সোরগোলের আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে এলেন চাচাজান। রাজকন্যাকে এমন চিন্তিত আর হাসফাস করতে দেখে তিনি ঘাবড়ে গেলেন। ছুটে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে?’
রাজকন্যা আদেশের ভঙ্গিতে বলল,
“রাজকুমারের রাজ্য সংকটের মুখে চাচাজান। আমাদের এক্ষনি উনার প্রয়োজন মাফিক সৈন্য পাঠাতে হবে। আপনি ব্যবস্থা করুন।”
এরই মধ্যে ছুটে এলেন মহামন্ত্রী।
“রাজকন্যা, এতো জরুরী তলব?”
“মন্ত্রী মশাই, নগর রাজ্যের জন্য সৈন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।”
“যথাআজ্ঞা রাজকন্যা।”
এই বলে মন্ত্রীমশাই যেতে নিতে বাঁধ সাধেন চাচাজান। বলেন,
“দাঁড়ান মন্ত্রী মশাই। আগে ঘটনা কি বুঝতে হবে।”
মন্ত্রী মশাই দাঁড়িয়ে পড়ে। তবে থামার জন্য নয় যাবার জন্য। তাড়া দিয়ে বলে,
“রাজকন্যা না বুঝে কিছু করেননা ছোট রাজামশাই। আপনি বেশি ভাববেন না।”
এই বলেই ছুটে যায় মন্ত্রীমশাই। চাচাজানের মুখ খানা ছোট হয়ে আসে অপমানের সুক্ষ্ম রেখায়। পাশাপাশি এক অজানা ভয়ও কাজ করছে মনে।
“রাজকন্যা? রাজকুমারকে না বলে ওর রাজ্যে সৈন্য পাঠানো ওর জন্য অপমান জনক নয়?”
“এ আপনি কি বলছেন চাচাজান?”
“ঠিকই বলছি রাজকন্যা। রাজকুমার আমাদের রাজ্যের জামাতা। আর কোনো পুরুষই চাইবেনা তার শশুর বাড়ি থেকে তাকে কোনো ভেত পাঠানো হোক।”
“এটা ভেত নয় চাচজান। যদি উনি সত্যি সুপুরুষ হন তবে উনি আমার দুশ্চিন্তা বুঝবেন।”
রাজকন্যা প্রস্থান করে। চাচাজান দাঁড়িয়ে থাকে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে। ওদিকে মন্ত্রীমশাই এক মুহুর্তও বিলম্ব করে না সৈন্য পাঠাতে। রাজকন্যার আদেশ অনুযায়ী সব ব্যবস্থা করে দেন তিনি।
“রাজকন্যে? হঠাৎ হলো কি?”
জিন্নাত প্রশ্ন করলো।
“রাজকুমার বিপদে জিন্নাত!”
“সে কি! হঠাৎ করে কি এমন হলো?”
“ওসব কথা ছাড়ো! আমরা কি যেতে পারিনা?”
“ও মা! এ কেমন কথা? কোথায় যেতে চাও তুমি?”
“উনার রাজ্যে?”
“না না! এ সম্ভব নাকি?”
“কেন সম্ভব নয়?”
“রাজকন্যে.. বোঝার চেষ্টা করো। ওখানে যুদ্ধ চলছে আর তুমি নববধূ। এমতবস্থায় এসব সম্ভব নাকি? তাছাড়া রাজকুমার জানতে পারলে ভাবতে পারছো কেমন ক্রোধে পড়বেন?”
রাজকন্যা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ধপ করে বসে পড়লো সজ্জিত শয্যায়। তার এখানে বসে দুশ্চিন্তা করা ছাড়া যে আর কোনো উপায়ও নেই। কিন্তু এত দুশ্চিন্তাও যে করতে পারছেনা। বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে খুব।
___
দু-দিন পেরিয়ে গেলো। রাজকুমারের খোঁজ এখনও পায়নি রাজকন্যা। দুশ্চিন্তায় তার শরীর ভেঙে আসছে। কোন অবস্থায় আছে,কেমন আছে কিছুই জানেনা সে। ঠিক সেই মুহুর্তে খবর এলো সেনপতি আতাউলের। কবিরাজ মশাই তাকে কিছু বলতে চায়! সে ছুটলো কালা-পাহাড়িয়ার কারাগারে। কাউকে কিছু না বলে বের হলো রাজপ্রাসাদ থেকে। ঘোড়াশাল থেকে সুফিকে নিয়ে রওনা হলো পথে। প্রায় অনেক ক্রোশ পথ অতিক্রম করার পর পেয়ে গেলো গন্তব্য স্থল। সুফিকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। উপর থেকে হাটঁতে হাঁটতে পাতালে নেমে এলো। কারাগারের সামনে এসে পৌঁছাতেই উঠে আসলো সেনাপতি আতাউল।
“রাজকন্যা আপনার বিবাহের জন্য অনেক অনেক মোবারকবাদ।”
রাজকন্যা স্মিত হাসলো। মাথা নেড়ে কারাগারের বন্দির দিকে তাকালো। ঠোঁট নেড়ে আওড়াল,
“কবিরাজ মশাই কি বলতে চান আমাকে?”
মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে আছে কবিরাজ মশাই। এই কয়দিনে তার অবস্থা নাজেহাল। চোখ মুখের অবস্থাও খুবই করুন। মনে হয় যেন অণ্যআহার ছুঁয়েও দেখেন না তিনি। ইচ্ছে করেই নিজের মৃত্যু ডেকে আনছেন।
অতিকষ্ট উঠে বসলো কবিরাজ মশাই। রাজকন্যা তার মুখ চেয়ে তাকিয়ে আছে। রাজকন্যাকে দেখতেই তার মুখে মলিন হাসির রেখা ফুটলো। মলিন হেসেই আওড়ালো,
“আপনার খুব বিপদ রাজকন্যা। সাবধানে থাকবেন আপনি।”
রাজকন্যার বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে। সেদিনের তুলনায় কবিরাজ মশাইকে আজ অন্যরকম লাগছে। মনে হচ্ছে যেন সে কোনো ঘোর থেকে বেরিয়েছেন।
“আমার বিপদ?”
“হ্যাঁ রাজকন্যা, আপনার বিপদ। খুব বিপদ।”
“কেমন বিপদ?”
“তা আমি বলতে পারবোনা রাজকন্যা। বললে আমার কন্যাকে ওরা বলি দিবে।”
“কারা?”
“আমি শুধু আপনাকে এটুকুই বলতে পারবো আপনি সাবধানে থাকবেন।”
“আপনি আমাকে নির্দিধায় বলুন কবিরাজ মশাই। আমি আপনাকে ওয়াদা করছি আমি আপনার কন্যাকে মুক্ত করবো।”
“আপনি আমার কন্যাকে কখনও সচক্ষে দেখেননি রাজকন্যা। তাই ওরা এই সুযোগে আপনাকে বারবার চোখের ধোঁকা দিয়ে যাবে আপনি টেরও পাবেন না। তাই আমাকে মার্জনা করুন। আমাকে বারবার একই প্রশ্ন করবেন না দয়াকরে। আমি কারোর নাম মুখে নিতে পারবোনা।”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রাজকন্যা। মায়া হচ্ছে কবিরাজ মশাইয়ের উপর। কে লুকিয়ে আছে এই নোংরা খেলার পেছনে? কার মুখ লুকিয়ে আছে?
“শুনলাম আপনার বিবাহ সম্পন্ন করেছেন ছোট রাজামশাই?”
” জি।”
“আপনার নব জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো। সুখী হন আপনি। আপনার সুখ মানেই এই রাজ্যের সুখ।”
“হু। সেনাপতি মশাই?”
“আজ্ঞে রাজকন্যা?”
“কবিরাশ মশাইকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করুন।”
“না। না না না! র্ রাজকন্যা এই কর্মটি ভুলেও করিবেন না?”
আতংকে কেঁপে উঠলো কবিরাজ মশাই। হাসফাস করতে করতে বলে উঠলো কথাগুলো। রাজকন্যা আর সেনাপতি উভয়ই অবাক হলো। একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। রাজকন্যা অবাক স্বরেই বলল,
“কেন?”
“ও্ ওরা জানতে পারলে.. আ্ আপনাকেও মেরে ফেলবে!”
“কি জানতে পারলে?”
দৃঢ় কন্ঠে প্রশ্ন করলো রাজকন্যা। কবিরাজ মশাই মিইয়ে পড়লেন। গুটিয়ে গেলেন কারাগারের এক প্রান্তে। কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
“আমায় এখান থেকে মুক্ত করবেন না রাজকন্যা। আমি আপনার দুটি চরনে পরি!”
রাজকন্যা অবাকের চমর পর্যায়ে পৌঁছে কপাল চাপলো। কি হচ্ছে তার অগোচরে? কারা ওর শত্রু? কারা মেরে ফেলতে চায় ওকে? কবিরাজ মশাই কেন বন্দি হয়ে থাকতে চান? চারপাশে রহস্যের গন্ধে গা গোলাচ্ছে যে। কি করবে সে এখন?
#চলবে