শাপলা ও সেতুর গল্প পর্ব-৬

0
279

#শাপলা_ও_সেতুর_গল্প
#প্রভা_আফরিন
[পর্ব-৬]

সূর্য মুখর সকালে যাত্রী ভরা লোকাল বাস ধাবিত হচ্ছে দ্রুতগতিতে। ঝলমলে রোদ এসে পড়েছে বাসের পূর্বপাশে। সোনালী উষ্ণ চাদরের তীব্র পরশ থেকে বাঁচতে হাতের সাহায্যে দৃষ্টিজোড়া আড়াল করতে ব্যস্ত রাসিফ। কপালে বিরক্তির ঘর্মাক্ত ভাজ। বিরক্তি রোদের জন্য নয়। বাসের সিট এতটাই সংকীর্ণ যে রাসিফের হাটু আঁটছে না তাতে। বেঁকেবুকে খুবই কষ্টে সে বসে আছে। পড়নের মেটে পাঞ্জাবিখানা কুচকে গেছে এদিক-সেদিক। তারওপর পাশের সিটে বসা যাত্রীর কোলে থাকা বাচ্চার জুতো পড়া পা বারবার এসে ওর ধবধবে পাজামায় লাগছে। রাসিফের বিতৃষ্ণাকে চরমে পৌঁছে দিতেই বোধহয় কিছুক্ষণ পরই বাসের চাকা থেমে গেলো। কন্ডাক্টর নেমে গিয়ে কিছুক্ষণ পর উচ্চস্বরে বললো,

“চাক্কা গেছে। বাস আর সামনে আগাইবো না।”

মুহূর্তেই বাসে বিশৃঙ্খলা তৈরি হলো। বাস এমন স্থানে নষ্ট হয়েছে যার আশেপাশে কোনো স্ট্যান্ড বা গ্যারেজ নেই। অগত্যা সবাইকে নামতে হলো। কেউ কেউ বিরক্তি নিয়ে নেমে গেলো, আবার কেউ বকাবকি করলো সময় নষ্ট করার জন্য। ভাড়া নিয়েও রাগারাগি হতে থাকলো কন্ডাক্টরের সাথে। ড্রাইভার তার পানখাওয়া ঠোঁটের একপাশে আয়েশ করে সিগারেট গুজে বসে ছিলো। নামার সময় সেদিকে তাকিয়ে রাসিফের ইচ্ছে করলো ড্রাইভারের টাক মাথার অবশিষ্ট চুলগুলো টেনে তুলে দিতে। দোকান ফেলে তাকে ছুটতে হচ্ছে আত্মীয়ের বাড়ি। এমন সময় বিড়ম্বনার মানে হয়! কিন্তু সব ছাপিয়েও রাসিফের মনে কৌতুহল উদ্রেক হলো। বাসে থেকেই একটা পরিচিত কন্ঠের কর্কশ ঝগড়া শুনতে পেলো সে। নামতেই ওর চক্ষুদ্বয় ছলকে উঠলো। সরু থুতনির অধিকারী, কাধ ছাড়ানো চুলের মেয়েটা বিধে গেলো ওর দৃষ্টিতে। মেয়েটা কোমড়ে হাত দিয়ে ভাড়া নিয়ে ঝগড়া করছে। কি যেন নাম তার? রাসিফের ভাবতে বেগ পেতে হলো না। মেয়েটার নাম লিখি। যার মুখটা চু’ন্নি ভেবে সে প্রায় ঠোটস্থ করে ফেলেছিলো। এত সহজে ভুলবে কি করে!

লিখির কন্ঠস্বর খুবই কর্কশ শোনাচ্ছে। ভাড়া ফেরত দেওয়ার জন্য কন্ডাক্টরের সাথে কোমড় বেধে ঝগড়া করছে সে। কন্ডাক্টর হাফ ফেরত দিতে রাজি কিন্তু লিখি পুরোটাই চায়। তার অফিসে যেতে সময়ের যে লস হলো তার খেসারত হিসেবে সে পুরো টাকাটাই দাবী করছে। রাসিফ বোকার মতো তাকিয়ে রইলো সে দিকে। লিখি ঝগড়ায় জিতলো শেষমেষ। বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে ভাড়ার পুরো টাকা নিয়ে ফিরতেই ওর চোখ পড়লো রাসিফের ওপর। লিখি সামান্য চমকালেও বাইরে বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। রাসিফ এগিয়ে গিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললো,
“ওহহ, আমরা আবারও একই বাসে ছিলাম! তাই তো বলি বিপত্তি বাধলো কেনো? আপনি আমি যেখানে, বিপদের আখড়া সেখানে।”

লিখি টাকাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাসিফের দিকে তাকালো। দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হলো স্বল্প সময়ের জন্য। লিখি নির্লিপ্ত গলায় বললো,
“আর তাই আমাদের দূরত্ব রেখে চলা উচিত।”

লিখি রোডের সামনে গিয়ে গাড়ির জন্য তাকালো। এদিকটায় দোকানপাট বিশেষ নেই। কোনো স্টপেজও চোখে পড়ে না। সে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। রাসিফ পাশে দাঁড়িয়ে গলা ঝেড়ে নিলো। জানান দিলো নিজের উপস্থিতি। পাঞ্জাবির কলার টানতে টানতে বললো,
“আপনি কি এই পথেই রোজ যাতায়াত করেন?”

“কেনো বলুন তো?”

“না মানে কন্ডাক্টরের সঙ্গে যেভাবে ঝগড়া করলেন তাতে আপনাকে এই রোডের রেগুলার যাত্রী বলে মনে হলো আরকি।”

“আমার অফিস এই পথে।”

“ওহ, আসলে আমি এই পথে এক আত্মীয়ের বাসায় যাচ্ছিলাম।”

লিখি মুখে কোনো উত্তর দিলো না। তবে ওর এক মুহূর্তের উল্টানো চোখ যেন তাচ্ছিল্য করে রাসিফকে বলতে চাইলো,
“আমি কি জানতে চেয়েছি!”

রাসিফ সেটা ধরতেও পারলো। ভেবেছিলো কথা এগোবে। কিন্তু অপরপক্ষের অগ্রাহ্যতে মানে লাগলেও চুপচাপ হজম করে নিলো। মেয়েটার থেকে সে এখনো ক্ষমা পায়নি। এই ক্ষমা না পাওয়া ওকে বিন্দুমাত্র শান্তি দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে বিরাট কোনো বোঝা ঘাড়ে চেপে আছে। না নামালে শান্তি মিলবে না।

লিখির পড়নে অফ হোয়াইট রঙের লং টপস, গলায় ওড়না পেঁচানো। একটু পর পর সে টিস্যু নিয়ে কপালে, গলায় চেপে ধরছে। রাসিফ সেদিকে আঁড়চোখে পর্যবেক্ষণ করে একটা অটো পেয়ে থামালো। লিখিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“আমরা তো একই পথে যাবো। আপনিও আসুন।”

রাসিফ ভেবেছিলো লিখি আসবে না। ওর ধারণা ভুল প্রমান করে লিখি অটোতে উঠলো। এবং ওর সঙ্গেই বসলো। কিছুদূর যেতে রাসিফ উশখুশ করতে শুরু করলো। লিখি ভ্রু কুচকে বললো,
“কিছু বলার হলে সরাসরি বলুন। মেয়েদের মতো লজ্জা পাচ্ছেন কেনো?”

রাসিফের বললো, “লজ্জা কি মেয়েদের একার সম্পত্তি নাকি যে পাওয়া যাবে না? যদি তাই হয়, আপনি মেয়ে হয়েও তো লজ্জা পাচ্ছেন না।”

“কারণ আমি লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু করিনি।”

” আপনি কি এমনই সিরিয়াস মুডে কথা বলেন? নাকি আমাকে দেখেই এমন করছেন?”

“স্বাভাবিক নয় কি? আপনার সঙ্গে তো আমার মিষ্টি করে কথা বলার সম্পর্ক নয়।”

রাসিফ তেরছাভাবে বাইরে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো, “কি দেমাগ! ঠেকায় না পড়লে আমিও দেখিয়ে দিতাম।”

বাকিটা পথ দুইজনে আর কথা হলো না। রাসিফের যাত্রা দীর্ঘ। লিখিকে নেমে গেলো অর্ধেক পথেই। সে ভাড়া দিতে নামলে রাসিফ মিনমিন করে বললো,
“ইয়ে, আমার সরি কি ঝুলেই থাকবে? এক্সেপ্ট করা যায় না?”

“ঝুলুক। ঝুলে লম্বা হোক। সেতু যতদিন শাপলাকে মাত দিয়ে টসে জিততে পারবে না, সরি এক্সেপ্ট হবে না।”

রাসিফ বিরক্ত হয়। মেয়েটার এই আচরণ ওর কাছে ছেলেমানুষী ছাড়া কিছুই মনে হয় না। বলে,
“একটা কয়েনে কি এমন আছে?”

লিখি প্রস্থানের আগে ঠোঁটের কোণ একদিকে প্রসারিত করে বললো, “আপনার সরি ঝুলিয়ে রাখার ক্ষমতা আছে।”

অটো চলতে শুরু করলে রাসিফ বিড়বিড় করে, “নিকুচি করি ওই কয়েনের।”
___________

রাসিফ আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ফিরলো দুইজন সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে। একজন ওর নানি নাহিদা বানু, আরেকজন নানির সর্বসময়ের দেখভালের সঙ্গী পূর্ণিমা। বিশ পেরোনো ছিপছিপে গড়নের একটি মেয়ে। পূর্ণিমা নামটা অবশ্য মেয়েটর আসল নাম নয়। ওর আসল নাম খালেদা। কিন্তু সে এই নাম পছন্দ করে না। নায়িকা পূর্ণিমার সিনেমা ভালোবাসে বলেই নিজের পিতৃপ্রদত্ত নামখানা বদলে ফেলেছে। জাহানারা বেগম অনেকদিন পর মাকে দেখে আপ্লুত হলেন। বললেন,
“আপনাকে আর যেতে দেবো না মা। এবার থেকে আমাদের সঙ্গেই থাকবেন।”

“তা কি হয়? আমার আরো সন্তান আছে না?”

“আপনি চাইলেই হয়।”

“এইবার অনেকদিন থাকবো বলেই এসেছি। রাসিফের বিয়েটা দেখে তারপরই যাবো।”

রাসিফ মাথা চুলকে সরে পড়লো। রুনি নানিকে দেখে আবেগপ্রবন হয়ে ছুটে আসছিলো। তার আগেই নাহিদা বানু ওকে দেখে চশমা নাকের ওপর টেনে বললেন,
“এই মেয়ে সংসার রেখে আবার চলে এসেছে? তা এবার কয়দিনের নাইওর?”

রুনির মুখে অমাবস্যা নামলো। ভেজা গলায় বললো,
“ভালোমন্দ জিজ্ঞেস না করে কতদিন থাকবো তা জিজ্ঞেস করছো?”

“আমি জানি তুই ভালোই আছিস।”

রুনি রেগে বললো,
“যাবো না, ঘরবউ হয়ে থাকবো।”

“ঘরবউ আবার কি?”

“স্বামীরা যেমন ঘর জামাই হয়ে থাকে, আমি তেমন ঘরবউ হয়ে থাকবো। তবে বাপের বাড়িতে।”

“আর জামাই?”

“বাবুর আব্বুও চাইলে থাকবে আমার সঙ্গে।”

নাহিদা বানু মুখ বেকিয়ে বললেন,
“বাবু না হতেই বাবুর আব্বু! তাও ভালো, আজকালকার ছেলে-মেয়েদের মতো বাবুর আব্বুকে বাবু, বেবি বানাসনি।”

নাহিদা বানু গা ঝাড়া দিয়ে নিজের জন্য সর্বদা বরাদ্দকৃত ঘরে চলে গেলেন। তার পিছু নিলো কোমড় দুলিয়ে চলা পূর্ণিমা।

রুনি এসে মাকে বললো,
“ভাইয়ের জন্য পাত্রী দেখা বাদ দাও। আমার কাছে ভালো পাত্রী আছে।”

জাহানারা বললেন,
“কে তোর ভালো পাত্রী?”

“আমার ননদ জেসমিন। কম বয়সী সুন্দর একটা মেয়ে। ভাইয়ের সঙ্গে বেশ মানাবে।”

“ক্ষ্যামা দেও মা আমার। তুমি নিজের পছন্দে বিয়ে করে যা দেখিয়েছো এরপর তোমার পছন্দে ছেলের বিয়ে দিয়ে বাড়িটাকে ঘর বউ, ঘর জামাইদের সার্কাসঘর বানাতে চাই না।”

রুনি নাক ফুলিয়ে মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here