#রাজকন্যা_হূরিয়া 🌸❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
২৪…
ভাঙা কুটিরে পদচারণ ঘটে রাজকন্যার। মাটির গৃহতলে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে নগর রাজ্যের রাজকুমার সাদ্দাত। তার ঠিক পাশেই আরহাম। আরহাম অবশ্য নিজের চেতনেই আছে। তবে জখম অবস্থায়। রেদোয়ান তার পাশে বসে খাবার তুলে দিচ্ছে মুখে। আরহাম নির্দ্বিধায় খাচ্ছে। কোনো রকম বাঁধা কিংবা নাকচ করার ভাব তার মুখে নেই।
রাজকন্যাকে দেখতেই রেদোয়ান কেমন চমকে উঠলো আকস্মিক। তার হাতে ধরে রাখা তালপাতাটা পড়তে পড়তে সামলে নিলো আরহাম। রেদোয়ান শুঁকনো গলায় ঢোক গিললো একবার। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে রাজকন্যাকে একবার দেখে আরহামের দিকে তাকালো। আরহামের দিকে তাকিয়ে তার ভয়টা যেন তরতর করে বেড়ে দিগুন হয়ে গেলো। -তবে কি রাজকন্যা সবটা জেনে গেছে? আরহামকে আর তাকে যে সরদার এখানে এনে রেখেছে? এবার কি হবে তার? রাজকন্যা কি পুরাদস্তুর মে/রে ফেলবে তাকে?
রেদোয়ান আর ভাবতে পারলোনা। কম্পিত আর দুর্বল দেহ খানা টেনে কোনোমতে উঠে দাঁড়ালো। উদ্দেশ্য রাজকন্যার পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়া। মাফ চাইবে সে! অন্তত সরদার এখানে পৌঁছোবার পূর্বে নিজের প্রাণটুকু বাঁচাতে মাফ চাইবে। তাতে কি গলবে রাজকন্যার মন? নাকি তার পূর্বেই-
আবারও কেঁপে ওঠে রেদোয়ান। উদ্দেশ্য মাফিক তড়িঘড়ি রাজকন্যার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই সরদারকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে থমকে দাঁড়ায়। একি? সরদারই কি রাজকন্যাকে এখানে নিয়ে এলো? কিন্তু কেন?-
রাজকন্যা থমকায়। রাজকুমার আর আরহামকে পাশাপাশি দেখে এক অদ্ভুত অপরাধবোধ তাকে তাড়না করতে লাগে। এই তো সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি! তার আব্বাজানের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর একমাত্র পুত্র। যার কথা শুনতে শুনতেই শৈশবের প্রায় অর্ধেকটা সময় সে অতিবাহিত করেছিলো। বড় হলে তাহার সঙ্গে বিবাহের মতো এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবে দু’জনে। বাকি সারাটি জীবন একত্রে, হাত ধরেই পার করবে। সেসব ছিলো এক সহজসরল পথচলার দিবাস্বপ্ন। যা চোখ মেলে তাকাতেই কোথায় যে হারিয়ে যেতো জানা নেই তার। তবে সেই স্বপ্ন আজ কেবলই স্বপ্ন। তা যে আর কোনো কালেও বাস্তব হওয়া সম্ভব নয়। কেননা তার ভাগ্য মিলে গেছে অন্যকারোর সঙ্গে। যাকে সে কোনো দিন দুঃস্বপ্নেও আনেনি ঠিক এমনই কারোর সঙ্গে।
“দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন? আসুন?”
আয়াসের মৃদুস্বর কানে এসে ঠেকতেই ভাবনায় ছেদ পড়লো রাজকন্যার। যার পরিপ্রেক্ষিত কিঞ্চিৎ চমকালো সে। অতঃপর চমকা চমকির পালা শেষ করে পাশ ফিরে দেখলো আয়াসকে। কিছু বলল না। আয়াস উৎসুক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে ছিলো। রাজকন্যা আবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাজকুমারকে দেখলো। খানিকটা ক্রোধযুক্ত কন্ঠে বলল,
“রাজকুমারকে ঠিক কত দিন যাবত এমন অচেতন করে রাখা হয়েছে?”
রেদোয়ান ভয়ের দরুন বারবার ঢোক গিলছিলো। রাজকন্যার হঠাৎ এখানে আগমন তার বোধগম্য হচ্ছে না। উপরন্তু তার প্রশ্ন! সবটাই তার মাথার এক হাত উপর দিয়ে যাচ্ছে।
আয়াস স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হেঁটে এসে রেদোয়ানের পাশে দাঁড়ালো। অতঃপর অচেতন রাজকুমারের দিকে একবার দৃষ্টি বুলালো।
“মোট ৩০দিন।”
রাজকন্যা চকিতে তাকালো।
“বলছেন কি আপনি? ত্রিশটা দিন.. মানে পুরো একটা মাস রাজকুমারকে এমন অচেতন করে রেখেছেন? আ্ আপনি কি মানুষ?” ক্রুদ্ধ স্বরে কথা গুলো বলে গেলো রাজকন্যা।
আয়াস ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে কয়েক মুহুর্ত নিশ্চুপ হয়ে রইলো। অতঃপর বলল,
“একাধারে চব্বিশ ঘন্টা তাকে অচেতন করে রাখা হয়েছে তা কিন্তু বলিনি। যে নিদ্রাবি/ষ রাজকুমারকে দেওয়া হতো তা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকতো। এই যেমন রাতের প্রথম প্রহর থেকে দ্বিপ্রহর(দিন-দুপুর) অব্দি। ওখানে রাজকুমারকে দেখার জন্য লোক ছিলো। তাকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে যেকোনো প্রয়োজন সবটাই তারা দেখতো। আমি রাজকুমারের উপর কোনো জু/লুম করিনি রাজকন্যা। নিতান্তই আমার প্রয়োজনে তাকে
নিদ্রাবি/ষ দেওয়া হতো।”
সবটা শুনে কোনো প্রত্যুত্তর করলো না রাজকন্যা। স্রেফ ছোট্ট করে বাক্য আওড়ালো,
“রাজকুমার এবং আরহামকে প্রাসাদে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।”
আয়াস আর জবাব আওড়ালো না। রাজকন্যার আদেশ অনুযায়ী লেগে পড়লো কাজে।
রেদোয়ান এখনও স্থিরচিত্তে দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতি সবটা না বুঝলেও প্রয়োজন অনুযায়ী বুঝে নিলো। তাই আর দাঁড়িয়ে না থেকে লেগে পড়লো আয়াসকে সাহায্য করতে।
_______
নিজের কক্ষে এসে চুপটি করে বসে পড়লো রাজকন্যা। রাতের প্রথম প্রহর। কবিরাজ মশাইকে ডাকা হয়েছে রাজকুমার এবং আরহামের চিকিৎসার জন্য। আয়াস জেদ করে বলল,-আপনাকেও চিকিৎসা নিতে হবে।”
কিন্তু রাজকন্যা দিগুণ জেদ দেখিয়ে নিজের চিকিৎসা নিলো না। কবিরাজ মশাইকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে চলে এসেছে নিজের কক্ষে। আজ সে বড্ড ক্লান্ত। ক্লান্ত নিজের কাছে,নিজর ভালোবাসার কাছে। ক্লান্ত এই গোটা সাম্রাজ্যের কাছে। কি করে লড়বে সে প্রিয় মানুষটার সাথে? কি করে ত/লো/য়ারঘাত করবে ঐ মানুষটাকে, যাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। সে যে এতো অন্যায়, এতো ব্যভিচার করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। ক্ষমা করে দিলেও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া হবে। কিন্তু সে কিছুতেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিবেনা। এটা তার ধর্ম নয়। আয়াসকে শাস্তি পেতেই হবে-
রাজকন্যা ছটফট করতে করতে উঠে দাঁড়ালো। বড়বড় করে কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে এগোলে দরজার দিকে। আয়াসকে শাস্তি দিতে হবে- বাক্যটা বারবার প্রতিধ্বনি হতে লাগলো মস্তিষ্কে। নিমিষেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো সে। নিজের দুর্বলতার কাছে।
“রাজকন্যা! কেন বন্দী করেছো তোমার চাচাজানকে? দু’দিন হলো রাজ সিংহাসনের হাওয়া গায়ে লাগলো কি, এর মাঝেই সাপের পাঁচ দেখেছো তুমি? কত বড় স্পর্ধা হয়েছে তোমার? আমি তো অবাক না হয়ে পারছিনা!”
একাধারে চাচীজানের উত্ত্যক্ত গলার স্বর কাঁপিয়ে তুললো রাজকন্যার কক্ষকে। রাজকন্যা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তে তাকালো সম্মুখে। চাচীজান এবং আলিয়া দাঁড়িয়ে আছে তার কক্ষের দরজায়। চোখে মুখে ক্ষোভের রেশ ফুটে উঠেছে চাচীজানের। যেন এক্ষনি চোখ দিয়েই তিনি গিলে খাবেন রাজকন্যাকে।
“আমি তো আপনাদের আগেই বলেছিলাম আম্মাজান, হূরিয়াকে সিংহাসনে না বসিয়ে ভাইয়াজান বসানোই উত্তম পরিকল্পনা।”
“আলিয়া! আমি বড় বোন তোমার। সম্মান দিয়ে কথা বলতে শেখো!”
উচ্চস্বরে ধমক দিলো রাজকন্যা। আলিয়া নিভলো না। বরং চোখ মুখ রাঙিয়ে তাকিয়ে রইলো রাজকন্যার রাগান্বিত মুখমন্ডলে।
“ওকে তোমার সম্মান করতে না শেখালেও চলবে রাজকন্যা! আগে তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও। কোন অপরাধে বন্দী করেছো উনাকে? কি দোষ উনার? উপরন্তু ভোর থেকে নিখোঁজ আমার পু্ত্র! কোথায় সে? তাকে আবার কোথায় বন্দী করেছো তুমি?”
রাজকন্যা চমকায়।
“আদিম নিখোঁজ! এসব আপনি কি বলছেন?”
“এমন ভাব করছো যেন এমন আশ্চর্যজনক ঘটনা ইতিপূর্বে এই প্রথম শুনলে?”
রাজকন্যা ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকালো চাচীজানের মুখপানে। চিন্তান্বিত মুখ করে তাদের উপেক্ষা করেই দ্রুত বের হতে চাইলো নিজের কক্ষ থেকে। তবে দু’পা এগোবার পূর্বেই পেছন থেকে তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলেন চাচীজান। রাগান্বিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বললেন,
“তোমার সাহস দেখে অবাক হয়ে যাই আমি! আমি তোমায় একটা প্রশ্ন করেছি আর তুমি কি না তা এত সহজে উপেক্ষা করে চলে যাচ্ছো?”
“আপনার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চাইতেও আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো আদিমকে খুঁজে আনা। আমি এখানে দাঁড়িয়ে আপনার অহেতুক প্রশ্নের জবাব দিয়ে নিজের মূল্যবান সময় গুলোকে অপচয় করতে পারবোনা!”
“হুূরিয়া!”
বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন চাচীজান।
“এতো গলার জোর কেমন করে দেখাচ্ছো বলোত? কিসের ভিত্তিতে? ঐ সিংহাসনের জন্য? জানো এতকাল যাবত ঐ সিংহাসনকে আগলে রাখার জন্য কতটা করেছেন তোমার চাচাজান? তোমায় কোলেপিঠে করে কতটা কষ্ট করে মানুষ করার পাশাপাশি ঐ সিংহাসন আগলে রেখেছেন উনি! তোমাদের জন্য এতো সব করার পর এই প্রতিদান তার? এই পুরষ্কার?”
চাচীজান অনর্গল বলে গেলেন। রাজকন্যা নিজেকে শান্ত করতে হাসলো। তার ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিল্য মিশ্রিত হাসি দেখে জ্বলে উঠলেন চাচীজান। কিছু বলবেন,তার পূর্বেই বলে উঠলো রাজকন্যা,
“আব্বাজান নিখোঁজ হয়েছেন ঠিক এক যুগ পেরোলো চাচীজান! কই? কোনোদিন কি একবারের জন্যও তার খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন মানুষটা? নাহ্। যাননি। অথচ তার সিংহাসনকে সযত্নে আগলে রেখেছেন তিনি। আম্মাজানকে কবিরাজ মশাই ওলট-পালট ঔষধি খাওয়াচ্ছিলেন। কই? তখন কি একবারের জন্য জানতে চেয়েছিলেন এর পেছনে কার হাত আছে? নাহ্। জানতে চাননি। বরং এক কথায় তাকে জল্লাদ ডেকে গর্দান নেওয়ার হুকুম দিলেন। আর যখন সে আমার বিবাহ ঠিক করলেন নগর রাজ্যের রাজকুমার সাদ্দাতের সঙ্গে? একবারও কি খোঁজ নিয়ে দেখেছিলেন রাজকুমার কোথায় আছে,কি অবস্থায় আছে,কোন পরিস্থিতিতে আছে কিংবা রাজকুমার আসলেও বেঁচে আছে কিনা? নাহ্। নেয়নি খোঁজ। বরং সে ইচ্ছে করে আমার থেকে সবটা লুকিয়ে আমাকে বিবাহ দিলো! কার সঙ্গে? একজন ডাকাত সরদারের সঙ্গে! এতসব ঘটনা ঘটনার পরও আমি কোনোদিন তাকে একটা প্রশ্নও করিনি! কেন জানেন? কারন, তাকে আমি পিতৃ সমতুল্য মানি। তাকে আমি নিজের আব্বাজানের বরাবর একজন ভাবী, চাচীজান। কিন্তু যখন দেখলাম তার অন্যায়, অবিচার দিনদিন বেড়েই চলেছে তখন আর চুপ থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হলোনা। সেদিন রাজসভায় যে লোকটা বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে ছটফট করতে করতে ম/রে গেলো সেদিনই ভেবে নিয়েছিলাম এই অন্যায় এবার বন্ধ হবে। যেকোনো মূল্যে।”
“তাই বলে নিজের চাচাজানকে তুমি কারাগারে বন্দী করবে রাজকন্যা?”
“এটা আমার রাজ্য চাচীজান। এখানে কেবল আমার শাসন চলবে। আর আমার শাসন সর্বদা অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আমার এই রাজ্যে অন্যায়ের কোনো স্থান নেই। আগেও ছিলো না। আজও হবেনা।”
রাজকন্যার একেকটা বানীতে দমে গেলেন চাচীজান। তার মুখ থেকে আর একটা শব্দও বেরোলা না৷ নিশ্চুপ হয়ে রইলেন তিনি। রাজকন্যা আর দাঁড়ালো না। বড় বড় ধাপ ফেলে চলে গেলো দৃষ্টির অগোচরে।
#চলবে___