#রাজকন্যা_হূরিয়া 🌸❤️
#মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৩.
প্রভাতের স্নিগ্ধ আলো তেরছাভাবে এসে মুখের উপর পড়লো। রাজকন্যার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে এটুকুই যথেষ্ট হলো। আধবোজা চোখে তাকালো সে। বাইরের লালিত্যপূর্ন বাসাতে পর্দাগুলো নড়ছে। শরীর বেশ ক্লান্ত রাজকন্যার। প্রাসাদে ফিরেছে দুই প্রহর পূর্বেই। এক্ষনি ঘুমটা ভাঙায় মাথার মধ্যে ঝিম ঝিম ভাব হচ্ছে। চোখ তুলে তাকাতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও উঠলো। তার যে পাতালঘরে একবার যেতেই হবে। কবিরাজ মশাইয়ের সঙ্গে তার কথা বলাটা অত্যন্ত জরুরি। আম্মাজানে বিষয়ে কবিরাজ মশাই এতবড় চক্রান্ত কিছুতেই করতে পারেন না। না না। এ অসম্ভব।
শয্যা ত্যাগ করলো রাজকন্যা। পোশাক বদলে নিয়ে বের হলো কক্ষ থেকে। এতো ভোরে চাচাজান,চাচীজান,ফুপুআম্মা,আদিম,আলিয়া ওরা কেউই জেগে নেই। তাই ভয়ের কোনো কারন নেই। অবশ্য লাবিবা থাকলে তাকে সঙ্গে রাখা যেতো নির্দিধায়। আদিম আর আলিয়া চাচাজানের সন্তান। ফুপুআম্মা নিঃসন্তান। আর লাবিবা হলো মন্ত্রী মশাইয়ের মেয়ে। রাজকন্যার সখীও বলা যায়। আলিয়ার সাথে রাজকন্যার সখ্যতা তেমন নেই বললেই চলে। তবে লাবিবার সাথে কেমন করে যে এতো ভালো সম্পর্ক হয়ে উঠলো কারোরই জানা নেই।
পাতালঘরে নেমে এলো রাজকন্যা। হাতে একটা আধ-জ্বলা হারিকেন। নিভে নিভে জ্বলে। চারপাশে প্রহরীরা কঠিন পাহারায়-রত। তারা বিশ্বস্তের ন্যায় রাজকন্যার হুকুম পালনে নিয়োজিত।
“আসুন রাজকন্যা। আমরা আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম।”
সেনাপতি আতাউল বলল। তিনি এখানকার দেখভাল করেন। রাজকন্যা মৃদু হাসি উপহার দিলো। বলল,
“চাচাজান এই খবর পাননি তো?”
“অসম্ভব রাজকন্যা। এখান থেকে শতশত লাশ বেরোবে তবুও আপনার হুকুমের হেরফের হবেনা।”
দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিলো সেনাপতি আতাউল। রাজকন্যা প্রশান্ত হলো। কারাগারের দিকে নির্দেশ করে বলল,
“জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছে?”
“হয়েছে রাজকন্যা। কিন্তু উনি মুখ খুলছেন না।”
“মুখ খুলছেন না!” (অবাক কন্ঠে)
“না রাজকন্যা। আমার মনে হয় উনার এই কর্মের পেছনে খুব পাকাপোক্ত কোনো মাথা কাজ করছে।”
“কে হতে পারে? কাকে ধারনা করছেন সেনাপতি?”
“ক্ষমা করবেন রাজকন্যা। শুধু এটুকুই ভাবনাতে এলো।”
রাজকন্যা মাথা নাড়লো। পায়ে পায়ে এগোলো কারাগারের দিকে। ভেতরে দুর্বল শরীর নিয়ে শুয়ে আছেন কবিরাজ মশাই। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় উত্তম মাধ্যম দেওয়া হয়েছে নিশ্চয়ই। তাই ক্লান্ত শরীর টেনে তুলতে পারছেন না। এতো অস্ত্রাঘাত পড়ার পরেও মুখ খুললেন না? এ কেমন রহস্য! কি এমন বানীর রক্ষা করছেন কবিরাজ মশাই যে, নিজের জীবনের বিনিময়েও মুখ খুলছেন না! বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। নাহ, এভাবে মুখ খুলবেন না কবিরাজ মশাই। হয়তো এখানে থেকে কারোর ভয়েও মুখ খুলতে চাচ্ছেন না।
“সেনাপতি মশাই, কবিরাজ মশাইকে অতিদ্রুত কালা-পাহাড়িয়ার নীচে আমাদের পুরোনো কারাগারে বন্দি করার ব্যবস্থা করুন।”
রাজকন্যার হুকুম পেয়ে নতশির করলো সেনাপতি আতাউল। আজ্ঞা পালনে শুধু জবাব দিলো, ‘যথাআজ্ঞা রাজকন্যা’ বলেই ছুটলো। রাজকন্যা আর দাঁড়িয়ে রইলো না। ঠিক যেমন করে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পাতালঘরে প্রবেশ করেছিলো ঠিক তেমন করেই আবার সবার চোখের আড়ালে নিজের কক্ষে ফিরে এলো। বড্ড ক্লান্ত লাগছে শরীরটা। ঘুমের অভাবে ভেঙে আসছে হাত-পা। আর তারউপর মস্তিষ্কে নতুন করে যোগ হলো কবিরাজ মশাইের চুপ থাকাটা। উনার মৃত্যুর ভয় নেই! হয়তো নিজের জীবন দিয়ে অন্য কারোর জীবন রক্ষা করছেন। হতে পারে তো! কিন্তু কার? উনি যদি কারোর প্ররোচনায় পড়ে এমন কার্য করেই থাকেন তবে কার প্ররোচনায়? কি এমন রহস্য লুকিয়ে আছে এর পেছনে যা ফাঁস হওয়ার ভয়ে সে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিচ্ছে! কি এমন রহস্য?
মাথার মধ্যে দপদপ করছে। আর কিছু ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু বিশ্রামের চেয়েও অতিব প্রয়োজন এতো এতো রহস্যের জাল কেটে বেরিয়ে আসা। কিন্তু পারছেন না সে। যতই রহস্য উদঘাটন করছে ততই রহস্য একে একে সামনে এসে হাজির হচ্ছে।
“রাজকন্যা, আপনাকে বেগমজি স্বরন করেছেন।”
বেগমজি হলো ফুপুআম্মা। দাসীর আওয়াজ আসলো। রাজকন্যা উঠে দাঁড়ালো। ক্লান্ত স্বরে আওড়ালো,
“বলো গিয়ে আমি আসছি।”
“আজ্ঞে।”
দাসী গমন করলো। ফুপুআম্মা নিঃসন্তান! কথাটা বড় অদ্ভুত লাগে রাজকন্যার কানে। কেননা আম্মাজান বলতেন ফুপুআম্মা নিঃসন্তান এ কথা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। উনি এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু দুষ্কৃতকারীরা তার পুত্রকে হনন করেছিলেন জন্মাবার ঠিক কয়েক মুহুর্ত বাদেই। সে কথা কেউ জানেনা। কেননা, ফুপুআম্মা চোখ খুলে তার জীবিত পুত্রের মুখ না দেখলেও দেখেছিলেন এক মৃত পুত্রের মুখ। আর একথা জানেনা ফুপুআম্মার স্বামীও। তিনি অবশ্য এক কালে ডাকাতদলের ছিলেন। ডাকাতি করা,মানুষ খুন করাই তার নিত্যদিনের কাজ। এভাবেই দিন যেতো তার এবং তার দলের। দাদাজনের প্রথম সন্তান কন্যা হওয়াতে তিনি পন করেছিলেন এর পরের সন্তান যদি পুত্র হয় তবে তিনি ফুপুআম্মাকে কোনো ডাকাতদলের হাতে সমর্পণ করবেন। কেননা তিনি কন্যা সন্তান চাননা। কালের বিবর্তনে দাদাজানের মানত ফললো। অতঃপর তিনি তাই করলেন যেটা তিনি পন করেছিলেন। ফুপুআম্মার সন্তানের অপহরন হওয়ার পেছনে তার স্বামীরই কুকীর্তির ফল ছিলো। ফুপুআম্মার নামের পাশে এসে জুড়লো নিঃসন্তানের পদবি। আম্মাজান বলেছিলেন, যেদিন ফুপুআম্মার কোল ভরেছিলো, সেদিনই খালি হলো। শুধু তাই নয়, সেদিনের পর থেকে তার স্বামীও নিখোঁজ। এই প্রাসাদের প্রায় সবাই জানে ফুপুআম্মা নিঃসন্তান। তার কোনো কালে কোনো সন্তানই জন্ম হয়নি।
“ফুপুআম্মা। স্বরন করেছিলেন?”
নামাজের চৌকিতে বসে তছবিহ পড়ছেন তিনি। রাজকন্যার আগমনে শুধু পেছন মুড়ে দেখলেন। জবাব দিলেন না। রাজকন্যা বসলো পাশে। চোখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো ফুপুআম্মার কক্ষ। বড় এলোমেলো হয়ে আছে। কাউকে হয়তো আসতেও দেন না নিজের কক্ষে। গত পঁচিশ বছর ধরে ঘরকুনো হয়ে আছেন। না নিজে বাহিরে যান আর না বাহিরের কাউকে ঘরে প্রবেশ করতে দেন। কেবল সে একাই এ ঘরে আসার অনুমতি পায়। অথবা মাঝেমাঝে নিজেই ডেকে পাঠান তাকে।
“শুনলাম তোমার বিবাহের কথা হয়েছে।”
“জি ফুপুআম্মা।”
গম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন ফুপুআম্মা। রাজকন্যা স্বাভাবিক গলাতেই জবাব দিলো। ফুপুআম্মা উঠে সোজা হয়ে দাড়লেন। দাঁড়ালো রাজকন্যাও।
“নগর রাজ্য থেকে রাজা রাজত আকবরের পুত্র রাজকুমার সাদ্দাত এসেছেন। উনার সাথেই তোমার বিবাহের কথা হয়েছে। শুনেছিলাম রাজা রাজত আকবর আর তোমার আব্বাজানের বড়ই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। এককালে তারা একসাথে থেকে নিজেদের পাঠ্যগ্রন্থ সম্পন্ন করেছেন। বড়ই উদার মনের মানুষ রাজা রাজত আকবর। আশাকরি তার পুত্র আমাদের রাজকন্যার অযোগ্য হবেন না।”
রাজকন্যা অবাক হলো। অবাক মনে আওড়লা, (তবে কি রাজকুমারের সাদ্দাতের সঙ্গেই তার বিবাহ হবে? কিন্তু কথা হলো, ঘরবন্দী থেকে ফুপুআম্মা বাইরের এতো এতো খবর কি করে রপ্ত করেন?)
“আমার কি এই বিবাহ করা উচিৎ হবে ফুপুআম্মা?”
সরল মনেই প্রশ্ন করলো রাজকন্যা। ফুপুআম্মা তাকে নিরাশ করলেন না। আদুরে সুরে বললেন,
“তুমি বড়ই বিচক্ষণা রাজকন্যা। যা করবে ভেবেচিন্তেই করবে। এই রাজ্যের একমাত্র তুমিই সেই ব্যক্তি যাকে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারি। যাকে আমি দেখলেই বলতে পারি রাজা সিরাজ উদ্দীন আগামী কয়েক শতবর্ষ না ফিরলেও তোমার শাসনে এই প্রাসাদ শতশত বর্ষ জীবিত থাকবে। শত শত বর্ষ পেরোবে তোমার আমল কেউ ভুলবে না রাজকন্যা। এই বিবাহ হলেই তুমি রানীর অধিকার গ্রহন করতে পারবে। মনে রেখো, এই রাজ্য যেন তেমার হাতেই শাসিত হয়। এই রাজ্যে যেন পরবর্তী শাসক তুমিই হও।”
“এ কি হয় ফুপুআম্মা? আদিম থাকতে আবার আমি কেন?”
“এ তোমার অধিকার রাজকন্যা। নিজের অধিকারে অন্যকারোর হস্তক্ষেপ তুমি মেনে নিবে না।”
রাজকন্যা মলিন হাসলো। ফুপুআম্মা বড়ই গম্ভীর। অল্পতেই খুব উত্তেজিত মানুষ। এই যে এক্ষনি, কত গম্ভীর হয়ে এসব কথা বলছেন। যেন এক্ষনি সিংহাসনে রাজকন্যার পদার্পণ না হলে সব ধ্বসে পড়বে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে রাজপ্রাসাদ। যার অজস্র খন্ড হবে। রাজকন্যা এর গোড়া না ধরলে সবটা নিঃশেষ হয়ে যাবে।
“আচ্ছা। ও হবেক্ষন। আপনি কি কিছু্ আহার গ্রহন করেছেন?”
“আজকাল আমার ক্ষিদে পায়না।”
“আহারের অনিয়ম চলবেনা ফুপুআম্মা। এ আমার আদেশ।”
“এই রাজ্যের একমাত্র শাসক তুমি রাজকন্যা। ভুলে যাবেনা কিন্তু।”
“ভুলবো না। আগে বলুন আপনি সকালের নাস্তায় কি খাদ্যগ্রহন করতে চান। আমি নিয়ে আসবো।”
“সামান্য চিঁড়ে-দুধ যথেষ্ট।”
“আচ্ছা বেশ। আমি এক্ষনি নিয়ে আসছি।”
“তুমি কেন? দাসী আছে তো।”
দাসীকে আদেশ করলেন ফুপুআম্মা। দাসী ছুটলো আদেশ পালনে।
“তোমার আহারের কি হবে?”
ফুপুআম্মা প্রশ্ন করলেন।
“হবেক্ষন। আগে আম্মাজানের ভোজনের ব্যাবস্থা করি।”
“সবদিকে নজর। এই তো আমাদের আগামী দিনের শাসক।”
রাজকন্যা হাসলো। তবে এই হাসিতে কোনো খুশি নেই। আছে কেবল একরাশ অসহায়ত্বতা। কি করে সবটা একা হাতে সামলাবে সে। আব্বাজান,আম্মাজান আর এই প্রাসাদ! সব দায়িত্ব একা তার মাথায়। তারউপর নতুন পীড়া বিবাহ! এখনি বিবাহ করিবে? মন যে কোনো উত্তরই দিচ্ছেনা। হ্যাঁ বা না। কোনো উত্তর নেই।
কথা শেষ করে চলে এলো নিজের কক্ষে। এই মুহুর্তে জিন্নাতকে যে ভীষণ দরকার। কোথায় আছে ও? ফিরবেনা কি আর? মনেমনে স্বরন করলো জিন্নাতকে। কিন্তু এলো না জিন্নাত। রাজকন্যা হতাশ হয়ে বসে পড়লো। কোথায় আছে জিন্নাত? কবে ফিরবে সে?
#চলবে