#শাপলা_ও_সেতুর_গল্প
#প্রভা_আফরিন
[পর্ব-৮]
শ্রান্ত বিকেলে নওশাদ যখন শ্বশুরবাড়ি এসেছে রুনি নাক-মুখ লাল বানিয়ে হা করে নিশ্বাস নিচ্ছে। চোখ থেকে পানি ঝরছে। নওশাদ ভয় পেলো। ছুটে এসে বললো,
“কি হয়েছে রুনি? এমন অবস্থা কেনো তোমার?”
“বাবুর আব্বু, তুমি এসেছো?”
“এইতো এসেছি।”
“আমার তোমাকে ভীষণ মনে পড়ছিলো জানো? মনে হচ্ছিলো কতদিন তোমাকে দেখি না।”
নওশাদ রুনিকে একহাতে জড়িয়ে ধরে। ভ্রু কুচকে বললো,
“তুমি ঝাল খেয়েছো রুনি? কেনো?”
“দুঃখে ঝাল খেয়েছি।”
“দুঃখে তো মানুষ খাওয়া-দাওয়া ছাড়ে। আর তুমি ঝাল খাও? হায়রে বউ আমার। তা কি খেয়েছো?”
জাহানারা বেগম দুধ হাতে বসার ঘরে এলেন। ওনাকে দেখে নওশাদ রুনিকে ছেড়ে দিলো। জাহানারা বেগম রুনির দিকে ঠান্ডা দুধ এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“একটু আগেই একগাদা বোম্বাই মরিচ দিয়ে ঝালমুড়ি খেয়েছে এই মেয়ে। আর এখন ঝালে লাফাচ্ছে।”
রুনি দুধের গ্লাস হাতে নিলে জাহানারা বেগম মেয়ে-জামাইয়ের কাছ থেকে সরে গেলেন। নওশাদ রাগি গলায় বললো,
“যা সইতে পারো না তা কেনো খাও?”
রুনির বিশেষত্ব হলো কোনো কারণে একবার চোখে পানি এলে সে অনেকক্ষণ তা প্রবাহিত করতে পারে। না চাওয়া অবধি তা থামবেও না। এবারও থামেনি। রুনি ঠান্ডা দুধের গ্লাসে একটু করে চুমুক দিয়ে খানিক আরাম পেলো। এরপর আবারো শব্দ করে কেঁদে ফেললো। নওশাদ ব্যতিব্যস্ত হয়ে আবার বললো,
“কি হলো? কাঁদছো কেন তুমি? শরীর খারাপ লাগে?”
রুনি আহ্লাদ করে বললো,
“জানো, বাবুটা এখনই তুমি পাগল হয়ে গেছে। বারবার তোমায় দেখতে চায়। আমি তো আর তোমাকে প্রতিদিন পাই না। ওর জন্য কষ্ট হয়। তাই দুঃখে ঝাল খেয়েছি।”
রুনিদের বসার ঘর লাগোয়া রান্নাঘর। জায়গা বিশেষ বড় না হওয়ায় এক স্থানের কথা অন্য স্থানে খুব সহজেই শোনা যায়। জাহানারা বেগম দূরত্বে থাকলেও মেয়ের ন্যাকা কথা ঠিকই শুনতে পেয়েছেন। তিনি কোমড়ে হাত দিয়ে বললেন,
“প্রেগন্যান্সির তিনমাস চলে। নড়াচড়ার স্টেজেও পৌছায়নি। অথচ এমনভাবে কথা বলছিস জেনো বাচ্চা জন্ম হয়ে তিনমাস চলছে! তোর পাগলামি অনাগত মাসুম বাচ্চার ওপর কেনো চাপাচ্ছিস?”
রুনি কপাল কুচকে বললো,
“বাবুর সাথে আমার মনে মনে কথা হয়। তিনমাস তো কি হয়েছে? যতদিন আমার ভেতরে আছে আমি মানেই সে। ওর সব অনুভুতি আমি বুঝি। তুমি বুঝবে না।”
“ওহহ নাহ! আমি তো বাচ্চা পেটে ধরিনি। তোরা সব আকাশ থেকে টুপ করে মাটিতে পদার্পণ করেছিস।”
জাহানারা বেগম মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেলেন। পূর্ণিমা এসে রুনিকে সমর্থন করে বললো,
“আপায় সারাদিন আপনার কথা কয় দুলাভাই। নানির লগে আহনের পর খালি আপনের কথাই হুনি। সারাদিন খালি বাবুর আব্বু বাবুর আব্বু করে। এমন জামাইপাগল মানুষ আমি কমই দেখছি। আপনে ভাগ্যবান বুচ্ছেন দুলাভাই।”
নওশাদের হৃদয়ে শীতল বাতাস বয়। সারাদিনের সকল ক্লান্তি মুছে যায় নিমিষে। সে রুনির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। চোখাচোখি হতেই রুনি লজ্জা পায়। কান্না থেমে যায়। পূর্ণিমাকে চোখ গরম করে সরে যেতে বলে নওশাদকে টেনে ঘরে নিয়ে আসে। ওর বুকে মাথা রেখে নাক টেনে বললো,
“বাবু তোমাকে ভীষণ মিস করে।”
“আর বাবুর আম্মু?”
“বাবু যতদিন পেটে আছে ততদিন আমি মানেই বাবু। বাবু মানেই আমি।”
“ওলে লে থোত বাবুতা আমাল।”
নওশাদ শব্দ করে হেসে রুনিকে দুহাতে আগলে নেয়। মেয়েটা এমন পাগলামি করে বলেই নওশাদ কখনো ওর সাথে গম্ভীর মুখে কথা বলতে পারে না। বোকা বোকা মুখ, উল্টানো ঠোঁটের ভাজে অভিমানের ছায়া দেখলেই মন গলে যায়। মনের গহীন অরন্য থেকে ভালোবাসারা উষ্ণতা হয়ে ধরা দেয় চামড়ায় মোড়ানো দেহে। নওশাদ রুনির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“বাবুর আব্বুও তোমাদের ভীষণ মিস করে।”
“আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না।”
“আমারও তোমাদের ছাড়া ভালো লাগে না। ফিরে চলো। আর এখানে থাকতে হবে না।”
রুনি নওশাদের বুক থেকে মাথা তুলে ঘুরে দাঁড়ায়। মুখ ফুলিয়ে বলে,
“যাবো না। আম্মা তো আমায় যেতে বলেনি।”
নওশাদ আবারো হাসে। পেছন থেকে রুনিকে আঁকড়ে ধরে ওর কাধে থুতনি রাখে। দাড়ির খোঁ’চায় রুনির দেহে শিহরণ খেলে যায়। নওশাদ বলে,
“মাও চায় তুমি ফিরে যাও। কিন্তু মুখে বলেন না। তোমরা দুজনেই নিজেদের ইগো নিয়ে চলো। মাঝখান দিয়ে আমার যে কষ্ট হয় তা কেনো বুঝতে চাও না? আমার চাওয়াটা কি বড় নয় তোমার কাছে?”
“হু।” রুনির আবেশ নিংড়ানো উত্তর।
“আজ রাতে থেকে কাল সকালেই ফিরবো আমরা। আর যেনো চোখে পানি না দেখি। এবার কাছে আসোতো।”
রুনি তরাক করে নওশাদের বাহুবন্ধন থেকে সরে গেলো। কালিমালিপ্ত ভ্রু যুগল একত্রিত করে দুষ্টু স্বরে বললো,
“কিসের কাছে আসো? অনেকক্ষণ ধরে ঘামের গন্ধ সহ্য করছি। যাও ভাগো, ফ্রেশ হও।”
নওশাদ ব্যথিত কন্ঠে ডাকে,
“রুনি?”
রুনি প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে চলে গেলো। নওশাদের জন্য লিচু আনতে রান্নাঘরে ঢুকলো সে। বাবুর আব্বুর লিচু খুব প্রিয়।
____________
মুনিয়া আপুকে পেলে লিখির সাপ্তাহিক ছুটির দিনটা খুব সুন্দরভাবে কাটে। মুনিয়া শান্তশিষ্ট সংসারী মেয়ে। সারাদিন সে ঘরের খুটিনাটি যাবতীয় কাজ করে বেড়ায়। তারপরেও পরিবারে ভাবীদের মাঝে তীব্র অসন্তোষ তাকে নিয়ে। একে তো বয়স রেলের গতিতে ছুটে যাচ্ছে, তারওপর বিয়েও হচ্ছে না। শ্যামলা তেল চকচকে ত্বক। ওজন সত্তরের ঘরে ওঠানামা করে। লিখির ভাষায় মুনিয়া একটি আদুরে, গলুমলু টেডিবিয়ার। আর সমাজের চোখে মুনিয়া হলো বিয়ের বাজারে পিছিয়ে পড়া, মুটিয়ে যাওয়া কালো একটি মেয়ে যার রূপের ওজন তলানিতে। এই ওজন মাপার পাল্লা হচ্ছে চোখ, আর বাটখারা হলো মানসিকতা।
মুনিয়া নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে। আজকাল বাইরের জগতে বের হতেও তার অস্বস্তি। ফলে ছুটির দিনটায় লিখি ইচ্ছে করে ওর কাছে যায় কিংবা মুনিয়াকে ডেকে আনে বাসায়। এরপর দুইজনে একসাথে খাওয়া-দাওয়া করে, আড্ডা দেয়, নেটফ্লিক্সে মুভি দেখে, ঘোরাঘুরি করে। রিথীও মাঝে মাঝে ওদের ভেতর ঠাই পেয়ে যায়। তবে আজকের ছুটির দিনটা ব্যতিক্রম। লিখির কাছে মুনিয়া আপুকে সবচেয়ে বিরক্তিকর বলে মনে হচ্ছে। এই বিরক্তির কারণ মা। তিনি আবার একটা সম্বন্ধ যোগাড় করে এনেছে। পাত্রপক্ষ ছবি দেখে লিখিকে পছন্দ করেছে। এবার দেখাদেখি জন্য লিখির মত নেওয়ার বদলে একেবারে দেখা করার ডেট ফাইনাল করে ফেলেছেন রেবেকা। তবে প্রথম সাক্ষাৎ হবে শুধু পাত্র ও পাত্রীর মাঝে৷ তারা একে-অপরকে পছন্দ করে গ্রিন সিগনাল দিলেই বড়রা এগোবে। লিখি প্রথমে সবটা শুনে বেজায় রেগে গেছিলো। রেবেকা মানসম্মানের দোহাই দিয়ে দিয়ে ওকে শুধু দেখা করার জন্য রাজি করিয়েছে। জাহিদুল ইসলাম এবারও বিশেষ কিছু বলেননি। ওনার মতামত লিখির মতের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছেন।
লিখি বসে আছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে। সে মাথা ঝাকিয়ে গোছানো চুল এলোমেলো করে দিলো। মুনিয়া চিরুনি দিয়ে লিখির মাথায় ঝামটা মেরে বললো,
“কি করছিস এসব? দেরি হয়ে যাবে তো।”
“এত সাজার কি আছে বুঝি না। যেমন আছি তেমনই যাবো।”
“একটু সাজলে যদি সুন্দর দেখায় তবে ক্ষতি কি?”
“তুমি বলতে চাইছো না সাজলে আমি সুন্দর নই?”
“আহা! তা নয়। তুই এমনিতেই সুন্দর দেখতে। কিন্তু নিজেকে উপস্থাপনের একটা ব্যাপার আছে তো। সাজগোজ মেয়েদের সৌন্দর্যকে তুলে ধরতেই ব্যবহার করা হয় নাকি!”
লিখি মুনিয়াকে ঠেলে সরিয়ে উঠে গেলো। ওর পড়নে সোনালী পাড়ের ছাইরঙা শাড়ি। খোলা চুলে বারকয়েক আঙুল চালিয়ে বললো,
“আমি যেমন, তেমন দেখে পছন্দ করলে করবে নয়তো নয়। নাহয় পরে শুনতে হবে মেকআপ করে আসল রূপ লুকিয়ে তাদের ধোকা দিয়েছি।”
“তারমানে তারা পছন্দ করলে কথা এগোবে?”
“উহু, আমার পছন্দও গুরুত্বপূর্ণ। ছেলেটির সম্বন্ধে যা শুনেছি তাতে তিনি আমার টাইপ নয়।”
“এত যে বেছে বেছে চলিস, দেখবি তোর কপালে শেষে অপছন্দের পাত্রই না জোটে।”
রেবেকা এসে মেয়েদের তাড়া দিলেন। লিখি ঘর থেকে বের হলে রেবেকা মেয়ের জন্য বানিয়ে রাখা মোটা সোনার চেইনখানা এনে বললেন,
“গলাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এটা পড়ে যা।”
লিখি বিরক্ত হয়ে কিছু বলতে নিলে মুনিয়া হাত চেপে নিষেধ করলো। বের হওয়ার সময় মুনিয়া আসতে না চাইলেও লিখি তাকে জোর করে আনলো। রেস্টুরেন্টের সামনে রিক্সা থামলে নামতে বাজলো বিপত্তি। লিখি শাড়ির কুচিতে পা বাধিয়ে হোচট খেলো। পড়ে গিয়ে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির নখ উঠে গেলো। মুনিয়া তড়িঘড়ি করে নেমে ওকে ধরে। লিখি পায়ের আঙুল চেপে ধরলে হাত র’ক্তে ভরে ওঠে। তা দেখে মুনিয়া প্রায় কেঁদেই ফেলবে। লিখি দাত চেপে ব্যাথা সংবরণ করার চেষ্টা করে বললো,
“খবরদার আপু, রাস্তায় কাঁদতে বসবে না। আমি মরে যাইনি।”
“কি থেকে কি হয়ে গেলো রে। সব আমার দোষ। তোকে দেখে নামানো উচিৎ ছিলো আমার।”
লিখি উঠে দাঁড়ালে কেউ একজন ঠান্ডা পানি এগিয়ে দিলো ওদের উদ্দেশ্যে। বললো,
“পায়ে পানি ঢালুন। রক্ত ধুয়ে ওয়ান টাইম স্ট্রিপ লাগালেই হবে।”
লিখি পরিচিত গলা শুনে মুখ ফেরাতেই রাসিফকে দেখতে পেলো। রাসিফ আবার বললো,
“যদি তা না করেন তাহলে ফার্মেসিতে নিয়ে স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে নিতে পারেন।”
মুনিয়া ছো মেরে বোতলটা নিলো। লিখির পায়ে ঠান্ডা পানির স্পর্শ পেতেই ব্যাথার মাঝে খানিক আরামবোধ করলো। কিন্তু র’ক্তের স্রোত না কমায় অবশেষে তাকে ফার্মেসির দ্বারস্থই হতে হলো। রাসিফ পুরোটা সময় ওদের সাথেই রইলো। এতসবের মাঝে রেস্টুরেন্টের কথা লিখিদের মাথা থেকে বের হয়ে গেলো। ফার্মেসি থেকে বের হওয়ার পর মুনিয়া বললো,
“সঙ্গে থাকার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
রাসিফ হাসলো। লিখির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“আমরা কাছাকাছি হলেই কিছু না কিছু ঘটে। তাই না মিস লিখি?”
লিখি তেতো মুখে বললো,
“সেই কিছুটা এবার আমার ওপর দিয়ে গেলো।”
“তাই তো পাশে রইলাম। হাজার হোক আমরা বিপদের সঙ্গী বলে কথা।”
মুনিয়া দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো,
“তোরা একে অপরকে চিনিস?”
লিখি মাথা নাড়ে। গলা নামিয়ে বলে,
“ইনিই সেই আপু। দ্যা গ্রেট আহাম্মক অ্যান্ড চু’ন্নি ইনভেস্টিগেটর রাসিফ রাওয়াদ।”
চলবে…
(দুইদিন গল্প দিতে না পারায় দুঃখিত পাঠক। সামনেই পরীক্ষা। আবার এই বছরেই সম্ভবত আমার প্রথম একক বই আসতে পারে। তার ওপর আমার পাখিদের অসুস্থতা। সব মিলিয়ে সময় মেলাতে পারছি না। তাই এখন থেকে একদিন পর পর গল্প দিবো। কেনো জানি এই গল্পটা লিখতে মন বসাতে পারছি না। কেমন খাপছাড়া লাগে। খুব বড় করার ইচ্ছে নেই।)