অরোনী, তোমার জন্য~৬
লিখা- Sidratul Muntaz
রাবেয়া অরোনীকে নিজের শোবার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন। রিতু এসে বলল,” ভাবী, আপনেরে বড় আম্মা ডাকে।”
অরোনী প্রস্তুত ছিল। এখন তাকে একগাঁদা ভাষণ শুনতে হবে। তবে সেও জবাব তৈরী করে রেখেছে৷ তাকে কথা শুনানো হলে সে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকার মতো মেয়ে না। অরোনী গায়ে ওরনা জড়িয়ে রিতুর কাঁধে হাত দিয়ে বলল,” চল।”
রিতু ভীত কণ্ঠে বুকে থুতু মেরে বলল,” আমার তো ডর লাগতেছে ভাবী।”
” কিসের ডর? কোনো ডর নেই। চল।”
রিতু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। অরোনী ভেতরে ঢুকেই কাটছাট গলায় বলল,” ডেকেছেন মা?”
রাবেয়া বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, চেহারা গম্ভীর৷ তার এই দৃষ্টিকে সবাই ভয় পায়৷ কেবল অরোনী ছাড়া। রাবেয়া যেন হুংকার দিয়ে বললেন,” সেদিন পাত্রপক্ষের সামনে যাওয়ার অনুমতি তোমাকে কে দিয়েছিল?”
” আমি বিনা কারণে যাইনি। কাজে গিয়েছিলাম। আমার হাতে নাস্তাভরা ডিশ ছিল।”
” তোমাকে নাস্তা পরিবেশন করতেই বা কে বলেছে? তুমি কি রিতু?”
” আমি আসলে জানি না মা আমি কে? আপনিই বলে দিন। মাঝে মাঝে নিজেকে পুষ্পর মা মনে হয়, মাঝে মাঝে রিতু মনে হয় আবার মাঝে মাঝে মনে হয় আমি বুঝি এই বাড়ির মেহমান। কিন্তু কখনোই বাড়ির বউ মনে হয় না।”
” সেটা তোমার গাফিলতি। এই বাড়ির বউ হওয়ার মতো কি এমন করেছো তুমি? জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তোমার সাথে আমার ছেলের বিয়ে দেওয়া।”
” এটা শুধু আপনার না, আমার জীবনেরও সবচেয়ে বড় ভুল যে আমি আপনার ছেলেকে বিয়ে করেছি।”
” তাই নাকি? অল্প পানির মাছ হঠাৎ বেশি পানিতে এসে পরলে যা হয়। তোমার মতো লাফালাফি করে।”
” মাছ তো অকারণে লাফালাফি করবে না। যদি পানিতে বিষ থাকে তাহলে জান বাঁচানোর জন্য লাফালাফি করতে হয়।”
রাবেয়া ভয়ংকর হাসি দিয়ে বললেন,” তুমি কি আমাকে বিষ বলতে চাইছো?”
” ছিঃ মা, আপনি যদি আমাকে অল্প পানির মাছ না বলেন তাহলে আমি আপনাকে বিষ কেন বলবো?”
” আশা করি নিজের অবস্থান তুমি ভালো করে বোঝো। সীমা ছাড়িয়ো না। ”
” আমি নিজের অবস্থান অবশ্যই খুব ভালো করে বুঝি। আশা করি বাকিরাও তা দ্রুত বুঝে যাবে।”
” এরপর থেকে আর কখনও আমাদের বাড়ির কোনো মেয়েকে পাত্রপক্ষ দেখতে এলে তুমি তাদের সামনে যাবে না।”
” আমার যাওয়ার কোনো ইচ্ছেও নেই। আর যেই বিয়ে হওয়ার সেটা এমনিই হবে। আমি গেলেও হবে না গেলেও হবে।”
রাবেয়া টিপ্পনী কাটার উদ্দেশ্যে বললেন,” আচ্ছা তুমি কি বুঝে তোমার ছোটবোনের কথা ওদের সামনে বলতে গিয়েছিলে? কি ভেবেছিলে? ওরা রুমাকে রেখে তোমার বোনের জন্য প্রস্তাব পাঠাবে?”
এই কথা শুনে অরোনী সত্যি হতভম্ব। মহিলার অন্তর এতো নোংরা! অরোনী নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ঠান্ডা মাথায় জবাব দিল,” আমার মধ্যে এতো জটিলতা নেই মা। আমি এসব চিন্তাও করিনি। ওরা সরলমনে জিজ্ঞেস করেছে তাই আমিও সরলমনে উত্তর দিয়েছি। তাছাড়া অথৈ মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ে। ওর বিয়ের কথা চিন্তা করতে খুব দেরি।”
” অথচ তোমার হাব-ভাব দেখলে মনে হয় বোনের বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে-পরে লেগেছো।”
” এমন কথা আপনি চিন্তা কিভাবে করলেন? ওইরকম একটা ত্রিশ বছরের লোকের সাথে আমার বাচ্চা বোনের বিয়ে! এটা কি কখনও সম্ভব?”
” কি জানি? তোমাদের জন্য তো কিছুই অসম্ভব না। যেখানে তোমার মা তোমাকে এক কাপড়ে পাঠাতে পেরেছেন, মেয়ের জামাইকে পর্যন্ত একটা কানা-কড়ি দেননি উল্টো হাত ভরে নিয়েছেন সেই ফ্যামিলিতে বিলং করে তুমি আর কি শিখবে?”
অরোনীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত জ্বলে উঠল। ভদ্রমহিলা আবার এই বিষয়ে খোচা মারছেন। অথচ রাফাত তাকে কথা দিয়েছিল যে তার মা এই বিষয়ে আর কখনও অরোনীর সাথে লাগতে আসবেন না। অথচ তিনি আজকেও একই কাজ করলেন। হ্যাঁ, অরোনীর সাথে যখন রাফাতের বিয়ে হয় তখন রাফাত মোহরানা সাথে সাথেই মিটিয়ে দিয়েছিল। সেই টাকা অরোনী নিজের ব্যাংকে জমিয়ে রেখেছে। কিন্তু রাবেয়া মনে করেন অরোনী টাকা তার বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। অরোনীর বাবা নেই। বড় ভাই আর মা আছেন। বড় আপার স্বামী হিসেবে দুলাভাইও আছেন। বিয়ের পর অরোনীর বড়ভাই অনিকেত রাফাতকে স্বর্ণের ঘড়ি, আংটিসহ অনেক জিনিস উপহার দিয়েছিলেন। অরোনীর দুলাভাইও দিয়েছেন। সেই সবকিছু অরোনী নিজের লকারে রেখে দিয়েছে। রাফাত নিজেই অরোনীর হাতে তুলে দিয়েছিল। কারণ সে যৌতুক নিবে না। তাই অরোনীও শ্বশুরবাড়ির মানুষদের জিনিসগুলো দেখায়নি। পরোক্ষভাবে হলেও এইসব যৌতুকের পর্যায়ে পড়ে। অরোনী জিনিসগুলো বাঁচিয়ে রেখেছে যদি কখনও সুযোগ হয় তাহলে ভাইয়ের জিনিস ভাইকে ফিরিয়ে দিবে। নাহলে নিজে খরচ করবে। তাও শ্বশুরবাড়ির লোকদের দিবে না। রাবেয়া এইসব বিষয় জানে না বলেই ভাবেন অরোনীর পরিবার ফকির। সেজন্যই এতো খারাপ ব্যবহার করার সুযোগ পান। অরোনী গরম কণ্ঠে বলল,” মুখ সামলে কথা বলুন মা। আমার ফ্যামিলি সম্পর্কে এভাবে বলার আপনি কে?”
” আমিই তো বলবো। যাই দেখেছি তাই বলবো৷ নেওয়া ছাড়া দেওয়া কি তারা শিখেছে?”
” দেওয়ার নিয়মটা কে তৈরী করল? আপনার মতো লোভী মানুষরা!”
রাবেয়া কাছে এসে সটান করে অরোনীর গালে চড় মারলেন।
” কোন সাহসে আমাকে তুমি লোভী বলছো? বেয়াদব মেয়ে!”
দরজা থেকে সেই দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে মুখে হাত চলে এলো রিতুর। সে দৌড়ে শীলা চাচীর ঘরে চলে গেল। শীলা চাচীর মোবাইল থেকে রাফাতকে ফোন করে পুরো ঘটনা জানালো। রিতু হচ্ছে রাফাতের ব্যক্তিগত গোয়েন্দা। বাড়িতে কখন কি হয় সব খবর রিতুই চালান করে রাফাতের কানে। অরোনীকে দিয়ে মশলা বাটানীর কাহিনীও রিতুর থেকে জানতে পেরেছিল রাফাত।
চড় খাওয়ার পর একটা শব্দ উচ্চারণ না করেই শাশুড়ীর রুম থেকে বেরিয়ে আসে অরোনী। সে মুখ খুললে আজকে ভয়াবহ ঝড় হতো। অরোনী ঘরে এসে দরজা আটকে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। জামা-কাপড় না খুলেই শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ে। উঁচু শাওয়ার থেকে ঝপাঝপ ঠান্ডা পানি অরোনীর শরীর ভিজিয়ে দেয়। অরোনী মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টায় ব্যর্থ আজ। প্রায় দেড় ঘণ্টার গোসল শেষ করে সে রুমে এসে লাগেজ ব্যাগ গোছায়। এই দেড় ঘণ্টার পুরোটা সময় সে শুধু শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থেকেছে। অন্যকিছু করেনি। ঠান্ডায় গলা বসে গেছে। ভেজা কাপড় বদলানোর পর অরোনীর হালকা জ্বর জ্বর লাগল। তবুও এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত নয়। সে ট্যাক্সি ডেকে এখনি বেরিয়ে যাবে। মোবাইল হাতে নিল উবার কল করার জন্য। দেখল রাফাতের এগারোটা মিসডকল। এখন আবার রাফাত কল দিচ্ছে। অরোনী সেই কল ধরল না, কেটে দিল। রাফাত ম্যাসেজ করল,” প্লিজ অরোনী ফোনটা ধরো। প্লিজ দোহাই লাগে।”
অরোনী তাও ধরেনি। এই মানুষটির প্রতি তার সবচেয়ে রাগ হয়। জোর করে তাকে বিয়ে করেছিল রাফাত। আর এখন এইভাবে কষ্ট দিচ্ছে। যে বাড়িতে অরোনীর কোনো সম্মান নেই, চাওয়া-পাওয়ার দাম নেই সেই বাড়িতে অরোনী থাকবে না। কিন্তু বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর চলে এলো অরোনীর। সিঁড়ি থেকে নামতে গেলে মনে হয় মাথা ঘুরেই পড়ে যাবে। চোখেমুখে সে ঝাপসা দেখছে৷ রিতু এসে অরোনীর পায়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
” ছোট ভাবী, আল্লাহর কসম লাগে। আপনে যাইয়েন না।”
অরোনী শীতল কণ্ঠে বলল,” রিতু, আমাকে ধরে একটু বিছানায় নিয়ে যাবে?”
রিতু অরোনীকে ধরে বিছানায় নিয়ে এলো। অরোনীর শরীর তখন মারাত্মক গরম। রিতু অস্থির হয়ে অরোনীর মাথায় জ্বর পট্টি দিতে শুরু করল। অরোনী চুপচাপ বিছানায় শুয়ে ছিল। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল। সারাদিন কিছু খেলও না সে। জোর করেও তাকে পানি পর্যন্ত খাওয়ানো যায়নি। সন্ধ্যায় রাফাত ফিরল। সে ঢাকার বাহিরে গিয়েছিল। তাই বাড়ি ফিরতে এতো দেরী হয়েছে। রুমে ঢুকেই দেখল রিতু অরোনীর মাথার কাছে থম মেরে বসে আছে। অরোনী ঘুমন্ত। রাফাত নিম্নস্বরে জিজ্ঞেস করল,” কি অবস্থা?”
” জ্বর একটু কমছে। এখন অনেকটাই ভালা। কিন্তু ভাবী সারাদিন কিছু খায় নাই।”
” খায়নি কেন?”
রিতু মাথা নিচু করে বলল,” বড় আম্মার লগে গুষা করছে।”
” তুই যা, নিচে থেকে খাবার নিয়ে আয়। আমি ওর পাশে বসছি।”
” আমি নিচে যাইতে পারবো না ছোটভাইয়া।”
” কেন?”
” বড় আম্মায় আমারে দেখলে বকবো। সারাদিন আমি ভাবীর কাছে ছিলাম। নিচেরতে আমারে অনেকবার ডাকছে। আমি যাই নাই।”
রাফাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” ঠিকাছে। তাহলে তুই এখানে বসে থাক। আমিই যাচ্ছি।”
রাফাত ফ্রেশ হয়ে পোশাক বদলে নিচে নামল। সবাই ড্রয়িংরুমে ভীড় করে বসে আছে। যেন বিচারসভা বসানোর প্রস্তুতি। রাফাত কারো সাথেই কোনো কথা বলল না। রান্নাঘরে ঢুকে অরোনীর জন্য খাবার বাড়তে লাগল। হঠাৎ রাবেয়া উঠে এসে বললেন,” অরোনীকে কিছুদিন তার বাপের বাড়িতে রেখে আয়। ঠিক হয়ে যাবে।”
রাফাত নির্বিকার স্বরে বলল,” অরোনী কোথাও যাবে না মা।”
” এতোক্ষণে নিশ্চয়ই বউয়ের থেকে সব শুনে ফেলেছিস। তাই এখন মাকে দোষী মনে হচ্ছে। তোর বউ আমার সাথে কি করেছে জানিস?”
রাফাত লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বলল,” অরোনী আমাকে কিছুই বলেনি। ওর সাথে আজকে সারাদিন আমার একবারও কথা হয়নি।”
রাবেয়া তীগ্ম কণ্ঠে বললেন,” এটাও আমি বিশ্বাস করবো? এতোক্ষণেও তোর কাছে বিচার না দিয়ে থাকতে পেরেছে ও?”
রাফাত খাবার নিয়ে চলে যেতে যেতে বলল,” তুমি অরোনীকে চড় দিয়ে ঠিক করোনি মা। তাও রিতুর সামনে। এটা খুব অন্যায় করেছো। মনে রেখো,চড়টা অরোনীর গালে না, আমার গালে লেগেছে। আর আমি এটা কোনোদিন ভুলবো না।”
এইটুকু বলেই হনহন করে রান্নাঘর থেকে চলে গেল রাফাত। সিঁড়ির কাছে যেতেই দেখল রুমা দাঁড়িয়ে আছে সামনে। কোমড়ে হাত দিয়ে বলল,” ছোটভাইয়া, কার জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছো তুমি?”
রাফাত জবাব না দিয়ে রুমাকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে যাচ্ছিল। রুমা তখন উচ্চ আওয়াজে বলল,” দিন দিন দেখছি জরুকা গোলাম হয়ে যাচ্ছো। জাদু-টোনা করেছে নাকি ভাবী?”
রাফাতের পা থেমে গেল। উপরেই রিতু দাঁড়িয়ে ছিল অরোনীর রুমের দরজার কাছে। সবকিছু শুনছিল।রাফাত রিতুর হাতে খাবারের প্লেট দিয়ে বলল,” ভেতরে যা।”
রিতু গেল কিন্তু পর্দার আড়ালে ঠিকই কান পেতে রইল সব শোনার জন্য। রাফাত নিচে নামল আবার। রুমার সামনে দাঁড়িয়ে কঠোরভাবে প্রশ্ন করল,” কি বললি তুই?”
রুমাও ফটাফট জবাব দিল,
” বলেছি জরুকা গোলাম। মানে বউয়ের চাকর।”
রাফাতের শরীরে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেল। ঠাস করে একটা চড় রুমার গালে কষিয়ে মারল। রিতু কেঁপে উঠল পর্দার আড়াল থেকে। রাফাত মেঘের মতো গম্ভীর গর্জন করে বলল,” বেয়াদবিরও একটা লিমিট থাকে। তুই সেই লিমিটও ক্রস করে ফেলেছিস। চলে যা আমার সামনে থেকে।”
রিতুর ভয়ে হাত কাঁপছে। আজকে সকাল থেকেই বাড়িতে ঝড়ের তান্ডব শুরু হয়েছে। এইসব কোথায় গিয়ে থামবে কে জানে? রুমা কাঁদতে কাঁদতে রুমে চলে গেল। ধপাশ করে দরজা আটকে দিল৷ এই মেয়ে শুধু একটা কাজই ভালো পারে, আর কিছু না পারুক। রাফাতের মেজাজ এখনও ঠান্ডা হচ্ছে না। অরোনীকে এই বাড়ির কেউ পছন্দ করে না এটা সে জানে।গতকাল যখন অরোনী রুমাদের শাড়িটা দিয়ে দিচ্ছিল তখন রাফাত খুশিই হয়েছিল। ভেবেছিল এবার বুঝি বোনরা ভাবীকে একটু পছন্দ করবে। বাড়ির লোকের কাছে নিজের স্ত্রীর ভালো একটা ইমেজ তৈরী হোক এটা কে না চায়? কিন্তু কিছুই হলো না। উল্টা এখন অরোনীই সবার কাছে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। তাও বিনা দোষে! রুমাকে পাত্রপক্ষ পছন্দ করেনি এখানে অরোনীর কি দোষ?
রাফাত রুমে এসে দেখল অরোনী উঠে গেছে। রাফাত রিতুকে ইশারায় চলে যেতে বলল। রিতু নিঃশব্দে রুম থেকে বের হয়ে গেল। রাফাত অরোনীর সামনে এসে বসল।
” সারাদিন খাওনি কেন?”
অরোনী হাঁটু জড়িয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,” আমি এ বাড়ির অন্ন খাবো না। তুমি এখনি আমাকে আমার বাড়ি রেখে আসবে।”
” তোমার বাড়ি? তাহলে এটা কার বাড়ি?”
” এই বাড়িকে আমার কখনোই নিজের বাড়ি মনে হয়নি।”
” ঠিকাছে, তাহলে তোমাকে তোমার বাড়িতেই রেখে আসবো।”
” সত্যি তো?”
” হুম। কিন্তু খাওয়ার পর।”
” অসম্ভব। আমি খাবো না।”
” তাহলে আমিও তোমাকে যেতে দিবো না।”
অরোনী বাধ্য হয়েই খাবার খেল। রাফাত অপেক্ষায় ছিল কখন অরোনীর খাওয়া শেষ হবে। যখন শেষ হলো তখন কাছে এসে বলল,
” আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনো অরোনী। একটা সংসারে টিকতে হলে অনেক কিছু কম্প্রোমাইজ করে চলতে হয়। পরিস্থিতির প্রয়োজনে অনেককিছু মেনে নিতে হয়। সবসময় মাথা গরম করলে চলে না। তুমি আজকে মায়ের উপর রাগ করেছো এই নিয়ে আমার অভিযোগ নেই। রাগ করে সারাদিন না খেয়ে থেকেছো এটাও মানলাম। ইটস ওকে। তোমার রাগ করাটা নরমাল। কিন্তু তার মানে এই না যে রাগ করে তুমি বাড়ি ছেড়েই চলে যাবে। তাহলে কিন্তু ঘটনাটা অনেক লম্বা হয়ে যাবে।”
অরোনী তিরিক্ষ মেজাজে বলল,” তুমি কি বুঝাতে চাইছো আমাকে? তোমার মা আমাকে থাপ্পড় মেরেছেন। তারপরেও আমি এই বাড়িতে পড়ে থাকবো? আমার কি কোনো মান-সম্মান নেই?”
” আমি তো স্বীকার করছি যে মায়ের কাজটা ভুল। তিনি অবশ্যই অন্যায় করেছেন। কিন্তু তুমিও কি খুব ভালো কাজ করেছো? মা তোমাকে পছন্দ করেন না এটা জানার পরেও কেন তুমি তার সাথে খারাপ ব্যবহার করো? এভাবে তো তুমি আরও নিজের ইমেজ খারাপ করছো।
” তুমি কি বলতে চাও সরাসরি বলো।”
” আজকে মাকে লোভী বলাটা তোমার উচিৎ হয়নি।”
” ও, এতোক্ষণে তাহলে লাইনে এসেছো। আমার কাছে মায়ের হয়ে ওকালতি করতে চাইছো। আমি তোমার মাকে কেন লোভী বললাম? আর তোমার মা যে আমার গালে চড় মারলেন এটা কোনো দোষ না?”
” আমি কিন্তু আগেই বলেছি কাজটা ঠিক হয়নি। কিন্তু এটাও সত্যি যে তুমি মাকে লোভী না বললে তিনিও তোমাকে চড় মারতেন না। মায়ের হাত তুমিই আনছো অরোনী। মুখে মুখে তর্ক করে মাকে দিন দিন তাতিয়ে তুলেছো। তিনি তোমার মায়ের বয়সী। তার সাথে তুমি এভাবে কথা বলতে পারো না। সে যতই খারাপ হোক তার প্রতি তোমার ন্যূনতম শ্রদ্ধা থাকা উচিৎ। মা হিসেবে সম্মান না দিতে পারো এটলিস্ট অপমান কোরো না।”
অরোনী সটান করে রাফাতের গালে চড় মারল। রাফাত সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলল। আজ আর হতভম্ব হলো না। অরোনীর হাতের চড় খেয়ে সে অভ্যস্ত। অরোনী চিৎকার করে বলল,” তুমি এখনি আমার সামনে থেকে চলে যাবে। আমার তোমাকে সহ্য হচ্ছে না।”
রাফাতের একবার বলতে মন চাইল,” আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল কি জানো? তোমাকে ভালোবাসা।”
কিন্তু কেন জানি কথাটা গলা দিয়ে বের হলো না। রাফাত নিজেই রুম থেকে বের হয়ে গেল।
অরোনী বালিশে মাথা রেখে রাগে কাঁপতে লাগল। রাফাত সবসময় অরোনী দোষটাই দেখে। মা আর বোনকে তো কখনোই কিছু বলে না। যত দোষ সব অরোনীর। ইচ্ছে করছে রাফাতের মাথাটা ফাটিয়ে দিতে। অরোনীর চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। রাগ ও অভিমানের অশ্রু। হঠাৎ পেছন থেকে এসে নরম গলায় কেউ ডাকল,” ভাবী।”
অরোনী পেছনে তাকিয়ে দেখল রিতু দাঁড়িয়ে আছে।
” আপনেরে একটা কথা বলবো ভাবী।”
অরোনী চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসল।
” বলো রিতু।”
রিতু সিঁড়ির ঘটনা অরোনীকে বিস্তারিত জানাল। রুমা অরোনীকে নিয়ে খারাপ কথা বলেছিল তাই রাফাত তাকে চড় মেরেছে। রাবেয়ার সাথেও দূর্ব্যবহার করেছে। রিতু নিচে গিয়ে সব জানতে পেরেছে। রাফাত নাকি বলেছে, “অরোনীর গালে চড় মারা মানে আমার গালে চড় মারা।” অরোনী এসব শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল। রাফাতের থেকে এমন ব্যবহার সে আশাই করেনি। এখন রাফাতকে চড় মারার জন্য খুব খারাপ লাগছে। রিতু চলে যাওয়ার পর অরোনী মন দিয়ে ব্যাপারগুলো চিন্তা করল। রাফাত তাকে আজ খারাপ কিছু বলেনি। যদিও অরোনী কখনোই তার শাশুড়ীর সাথে মিশতে পারবে না৷ কিন্তু রাফাত চায় তারা যাতে মিলেমিশে থাকে। তাই নিজের দিক থেকে শুধু একটা চেষ্টা করেছে। সেইজন্য রাফাতের গালে চড় দেওয়াটা সমীচীন হয়নি। আফসোস হচ্ছে খুব। অরোনী রুম থেকে বের হলো। রাফাত এখন কই আছে সে জানে। নিশ্চয়ই বাগানে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে আছে। অরোনী ছাদের সাথে লাগোয়া স্টিলের সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাগানে চলে এলো। যা ভেবেছিল তাই। রাফাত এখানেই আছে। অরোনী গিয়ে রাফাতের সামনে বসল। রাফাত ওকে দেখেই সাথে সাথে অন্যদিকে ঘুরে গেল। অরোনীও কম যায় না। রাফাত যেদিকে ঘুরেছে অরোনী এবার সেদিকে গিয়ে বসল। রাফাত আবার অন্যদিকে ঘুরে গেল। অরোনী আবারও এদিকে এলো। তাদের এই ঘোরা-ফেরার কাহিনী চলতেই থাকল। এক পর্যায় রাফাত বিরক্ত হয়ে বলল,” সমস্যা কি?”
” কোনো সমস্যা নেই। রুমে চলো।”
” আমি যাবো না।”
” কেন?”
” এমনি।”
” ঠিকাছে, তাহলে আমিও আজকে এখানে থাকবো।”
রাফাত জবাব দিল না। ভ্রু কুচকে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। অরোনী রাফাতের পাশে শুতে শুতে বলল,” আচ্ছা এখানে তুমি ঘুমাও কিভাবে? ভয় লাগে না? হঠাৎ যদি সাপ চলে আসে?”
রাফাত এবারও কিছু বলছে না। অরোনী কনুই দিয়ে রাফাতের পিঠে খোচা মারল। রাফাত ‘চ’ এর মতো বিরক্তিসূচক শব্দ করে বলল,” কি হয়েছে?”
” আমার সাথে কথা বলছো না কেন?”
” ইচ্ছে করছে না।”
অরোনী কিছুক্ষণ রেগে তাকিয়ে রইল। সেও দেখবে রাফাত কতক্ষণ চুপ করে থাকতে পারে!
একটু পরেই আকাশ ভেঙে জোরে বৃষ্টি নামল। বলা নেই, কওয়া নেই, তুমুল বর্ষণ। রাফাত দ্রুত উঠে বসতে বসতে বলল,” অরোনী রুমে চলো। তোমার আবার জ্বর এসে যাবে।”
এবার অরোনী জেদ ধরল। চোখ বন্ধ করে বলল,” উহুম। আমি যাবো না। এতোক্ষণ আমার কথা শুনেছো? এখন আমিও শুনবো না যাও।”
” প্লিজ অরোনী দোহাই লাগে ওঠো।”
” নো, নো, নো।”
রাফাত কিছুতেই অরোনীকে ওঠাতে পারছে না। তাই বাধ্য হয়ে নিজের শরীর দিয়ে এমনভাবে অরোনীকে আবৃত করল যেন একফোঁটা বৃষ্টির পানিও তাকে স্পর্শ করতে না পারে। অরোনী রাফাতের পাগলামো দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল। দুইহাতে রাফাতকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলল,” আজ আমি কোথাও যাবো না।”
রাফাতের শীতল শরীর নিমেষেই উষ্ণ হয়ে উঠল৷ তাদের বিবাহিত জীবনের সাইত্রিশ দিন পর আজ প্রথমবারের মতো তারা এতোটা ঘনিষ্ট হয়েছে। এর আগে কখনোই অরোনীর এতো কাছাকাছি আসা হয়নি। আজকের রাতটা রাফাতের জন্য সবচেয়ে বিশেষ। সে অরোনীর চুলে মুখ ডুবিয়ে দিল। মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সৌরভ বুঝি এই চুলের মধ্যেই আছে। হঠাৎ করেই রাফাতের মনে হলো, বেহেশত কি শুধু মায়ের পায়ের নিচেই থাকে? নাকি বউয়ের চুলের সুগন্ধেও থাকে!
চলবে