জানালার ওপারে পর্ব-১৫

0
291

#জানালার_ওপারে
||১৫তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
রাত যতো নামছে, আমার হার্ট বিট তার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে। আমি ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আমার ভয়ের কারণের দিকে। যা আর কেউ নয়, অবলা বেডটি। কী সুন্দর অবলা, অসহায়ের মতো এক জায়গায় স্থির। অথচ কী চমৎকার ভাবে আমার ব্লাড প্রেশার, টেনশন সব বাড়িয়ে দিচ্ছে।

জীবনের বাইশটা বছর পুরুষবিহীন বিছানায় দিবারাত্রি যাপন করে কী করে সম্ভব আবেগ ভাইয়ের সাথে এক বিছানায় শোয়া? তীব্র অস্বস্তি, অতিরিক্ত চিন্তা, ভীতি সব যেন আমায় জড়িয়ে নিয়েছে।

“মায়াবালিকা! না পড়ে বেডের দিকে তাকিয়ে আছো কেন! পড়া চোর কোথাকার! আইবুড়ো হয়েও পড়া নিয়ে হেলাফেলা!”

বইয়ের দিকে চোখ নামিয়ে ইচ্ছেমতো বকছি অসভ্য লোকটি! তখন তাঁর ঐ ফালতু কথা না শোনায় শাস্তি স্বরূপ আমাকে বারোটা অবধি পড়তে বলেছে। আচ্ছা, এতোটা চিন্তা, বাড়ন্ত হার্টবিটস, ভয় নিয়ে কেউ পড়তে পারে? আমি তো একদমই পারছি না।

‘জোরে জোরে পড়ো মেয়ে! সামনে এক্সাম, ফেইল করে আমার নাম না ডুবাও তুমি ভার্সিটিতে!” পুনরায় তাঁর ধমক।

কী আর করার জোরে জোরে পড়তে শুরু করলাম। তিনিও বসে টপিক্সগুলো বুঝিয়ে দিলেন। পড়তে পড়তে ঘুমে ঢলে পড়ছি। তাও অসভ্যটা ছাড়া দেয় না আমায়। অতঃএব চোখে অঢেল ঘুম নেমে পড়ে, আমিও হারিয়ে যায় নিদ্রায়।

সকাল সকাল ঘুম কিছুটা ভাঙতেই মাথার নিচে শক্ত অনুভব হচ্ছিলো। আমি কিছুটা চমকে যাই। চোখ খুলতেই অসভ্য লোকটার নগ্ন বুকের মাঝে নিজেকে পাই। বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠি আমি।

আবেগ ভাই ধড়পড় করে উঠে বসেন। উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করেন,
“কী হয়েছে? কী হয়েছে? চেঁচাচ্ছো কেন মায়াবালিকা?”

আমি হাতের ইশারায় উত্তর দেই,
“অনেক কিছু হয়ে গেছে। আপনি এখানে কী করছেন? আর আপনার জামা-কাপড় কোথায়? লাজ-লজ্জার বালাই নেই আপনার মধ্যে একটা মেয়ের সাথে কাপড় না পরে শুয়ে আছেন।”

তিনি ঠোঁট কামড়ে আমার দিকে তাকান। আমি চোখ নামিয়ে ফেলি তখনই। কী তীক্ষ্ম দৃষ্টি! ক্ষোভ, রাগও তাতে স্পষ্ট।

“সিরিয়াসলি মায়াবালিকা! তুমি এই সামান্য কারণে আমার ঘুম নষ্ট করে ফেললে! তুমি জানো আমি কয় রাত পর রাতে ঘুমালাম আজ?

আর কী বললে? আমি তোমার সাথে শুয়েছি কেন? আরে মেয়ে তুই আমার বউ, তোর সাথে শুবো না তো পাশের বাড়ির জরিনার সাথে শুবো।

আর আমি কাপড় না পরে শুয়ে ছিলাম? তো এই প্যান্ট কি অদৃশ্য? চোখে পড়ে না তোমার? ঠিক আছে। চোখেই যখন পড়ে না, তখন এই প্যান্ট রেখে আর কী করবো খুলেই ফেলি!”

তাৎক্ষণাত তিনি প্যান্টের বাটনে হাত দিলেন। আমি তেমন একটা পাত্তা দিলাম না। জানি, ভয় দেখাতে করছেন। কিন্তু আমার ভাবনা ভুল করে তিনি বাটন খুলে চেইনে হাত দিতেই চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে ফেললাম আমি।

হাতজোড় করে অনুরোধ করলাম ইশারায়। মুখের ভাব খানা এমন আমার যে ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’।

“হয়েছে, হয়েছে, চোখ খুলো মায়াবালিকা। কিছুই হয়নি, সব যার যার জায়গাতেই আছে। তবে এর পর থেকে বুঝে-শুনে কথা বলবা, নাহলে অনেক কিছুই জায়গায় থাকবে না। তা তোমারও, আমারও। এখন যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। সোজা রান্নাঘরে আসবা, ব্রেকফাস্ট বানানো লাগবে।”

আমি ভেঙচি কেটে উঠে গেলাম বিছানা থেকে। হাত-মুখ ধুয়ে আসলাম। প্রচণ্ড গরম পরেছে, তাই লাগেজ থেকে একটা শর্ট টপ ও পালাজু নামিয়ে পরে নিলাম। বাসায়ও গরমে এগুলোই পরতাম, তবে এখানে কেমন যেন একটা দ্বিধা বোধ হচ্ছে

আমি রান্নাঘরে পৌঁছাতেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন আবেগ ভাই। তাঁর চোখ সরছেই না আমার উপর থেলে। প্রচণ্ড অস্বস্তিতে আড়ষ্ট হলাম আমি। অনর্থক চুল হাত দিয়ে ঠিক করলাম, মুখ মুছলাম, ওড়না আরও ভালোভাবে পরে নিলাম।

“এতো অস্বস্তি বোধ হওয়ার কিছু নেই মায়াবালিকা। আমি তোমাকে এই অবস্থায় প্রথম দেখছি না। বাই দ্য ওয়ে তোমাকে ভীষণ রকমের এট্রাক্টিভ লাগছে বর্তমানে, আমি কন্ট্রোললেস হয়ে পড়ছি বলতে গেলে।”

এমন নির্লজ্জের মতো দ্বিধাহীন ভাবে একবার পলকও না ফেলে কেউ এমন বাণী উচ্চারণ করতে পারেন? তাও কি না গম্ভীর কণ্ঠে! আমাকে হয়তো তাঁর হতে দূরে থাকার শাস্তি স্বরূপ পদে পদে লজ্জা দেওয়ার শপথ নিয়েছেন না কি? কিন্তু আমাকে এ অবস্থায় আগে দেখেছেন অর্থ কী? আমি তো বাহিরে হিজাব, ঢিলাঢালা, লম্বা জামা-কাপড় ছাড়া বাহিরেই যাই না।

যাই হোক আমি লজ্জা চাপিয়ে কপোট রাগ আনলাম চেহারায়। ইশারায় শব্দহীন ক্রোধ প্রকাশ করলাম।

“চুপ করুন তো! এসব কী লাগামছাড়া কথা বলছেন, হু?”

“আমার তোমার উপর পূর্ণ অধিকার আছে। তাই আমার তাকিয়ে থাকতে মন চাইলে আমি এভাবেই তাকিয়ে থাকবো। তাই যতো দ্রুতো সম্ভব আমার চাহনি, স্পর্শে, লাগাম ছাড়া কথাবার্তায়ও নিজেকে মানিয়ে নেও মায়াবালিকা। তাই-ই তোমার জন্য বেটার। এখন আসো আমাকে রান্নায় হেল্প করো।”

আমার চোখ রাঙিয়ে তাকানোতেও লাভ হলো। তিনি নির্বিকার ভাবে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর ইশারা করলেন।

“চা বানাতে পারো? আর ব্রেড, চিজ, বাটার, জ্যাম, ম্যাগি আছে ঘরে। ফ্রীজে কিছু সবজিও আছে হয়তো। আর গতকালের ডিনারের জন্য আনা কিছু চিকেন ফ্রাই রয়ে গিয়েছে। আমি তা দিয়ে কিছু একটা করছি।”

নিজের বানানো চায়ের স্বাদ মনে পড়তেই মুখটা বিদঘুটে হয়ে গেল আমার। তবে সরাসরি তো নিজের পরাজয় স্বীকার করা যায় না, মান-সম্মানের একটা ব্যাপার আছে।

“নাস্তা বানানো তো বেশ বড়ো কাজ। তা বরং আমি করি। চা তো ছোটো বাচ্চাও বানাতে পারে। সেটাই আপনি করে দিলে অনেক।” ইশারায় বুঝালাম।

আবেগ ভাই ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালেন। আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। বুঝে গেল না কি আবার অসভ্য লোকটা! আমাকে স্বস্তি দিয়ে তিনি চুপচাপ চা বানাতে লেগে পড়লেন।

আমিও নাস্তা বানাতে শুরু করলাম। ফ্রীজ খুলে দেখলাম ফ্রোজেন কাটা সবজি আছে। বেশি করে পানি দিয়ে সবজি সিদ্ধ করতে দিলাম। হালকা সিদ্ধ হতেই ম্যাগি নুডুলস এবং এক চিমটি জিরা গুঁড়ো ও ধনিয়া গুঁড়ো দিয়ে দিলাম। তারপর ম্যাগির মশলা দিয়ে পানি শুকিয়ে নামিয়ে নিলাম। গতকাল রাতের চিকেন ফ্রাইগুলো ভালো করে হাড় থেকে ছাড়িয়ে স্লাইদ করে নিলাম। চিকেন স্লাইস, গাজর, শসা মায়োনিজ দিয়ে মিক্স করে স্যান্ডউইচের পুর বানিয়ে নিলাম। আধঘণ্টার মধ্যেই সব হয়ে গেল।

তবে জীবনে প্রথম বারের মতো রান্নার যুদ্ধে নেমে আমি ঘেমে নেয়ে গিয়েছি। আবেগ ভাই চা করে ফ্লাস্কে রেখে রুমে চলে গেছেন কিছুক্ষণ আগেই। হয়তো তৈরি হতে গেছেন। আজ থেকে তাঁর অফিসে জয়েনিং।

আমি ডাইনিংরুমে সব এনে ফ্যান ছেড়ে বসলাম। ওড়নাও খুলে এক পাশে রেখে দিলাম। আবেগ ভাই কালো প্যান্ট ও কালো চেক শার্ট, উপরে ধূসর রঙের ব্লেজার পরে চলে আসলেন কিছুক্ষণ পরই। আমি তাড়াতাড়ি ওড়না জড়িয়ে নিলাম গায়ে।

তিনি গলায় টাই লাগাতে লাগাতে বললেন,
“আমার সামনে এতো ফর্মালিটি দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই মায়াবালিকা। আমি স্বামী তোমার, পরপুরুষ নই। আর ওভাবেই বরং বেশি মানাচ্ছিলো তোমায়।”

এই লোকটাকে শুধু অসভ্য নাম দেওয়াটা ভুল হয়েছিল। সাথে ফাজিল, লুচু, অভদ্র নামও তাঁর প্রাপ্ত। আর কী করার? চুপচাপ মিস্টার অভদ্রের সাথে খেতে বসে পড়লাম।

আবেগ ভাই অফিসে চলে গেছেন। আমি কাজের অভাবে নিজের আর তাঁর গোছানো কাপড় আবার গুছিয়ে রাখলাম। ঠিক কাজের অভাবে নয়, তাঁর অনুপস্থিতিতে বোধ হওয়া অস্বাভাবিক শূন্যতা ভুলে থাকতে।

তা শেষ করে বারান্দার দরজা খুললাম। এখন অবধি আমি এই ফ্ল্যাটের বারন্দায় আসিনি। অবাক হলাম এই বারন্দাটি তো একদম আমাদের বাসার বারান্দার মুখোমুখি বারান্দাটা। এখানে কখনও কোনো মানুষ দেখিনি। মাঝে মাঝে শুধু রুমের লাইট জ্বলতো। তবে কখনও মনে হতো বারান্দার দেয়ালে থাকা জানালার আড়ালে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এখন বুঝতে পারলাম তিনি কীভাবে আমাকে দেখেছেন।

আবেগ ভাইকে ভয়েস টেক্সট দেওয়ার জন্য আইকনে আঙুল ধরে বারান্দার দরজার পাড় হতেই হাফসার কণ্ঠ কর্ণগোচর হলো,

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আম্মা। আমি চেষ্টা করতাসি আবার সবার মন যোগাতে। কই মাছের জীবন মেয়েটার! এতো কিছুর পরও বেঁচে রইলো। আমি তো হাসপাতালে ভাবসিলাম, মরবোই। আমিও একদম হাতে হাতে আবেগ রে পায়া যাবো। সাত কপালের ভাগ্য হবে আমার, কতো বড়োলোকের ছেলে ও! আমার সেই কবের তে পছন্দ ছেলেটা রে! আমাদের কোচিংয়ে পড়াইতো। কতোবার চেষ্টা করছি পটানোর! পটেই না। শুনসিলাম ওর বড়ো বোন আয়েশার কথার কদর বেশি ঐ পরিবারে। সব ছেড়ে তাই উনাকে পটাতে লেগেছিলাম। সময় পাইলেই যেয়ে আড্ডা দিতাম তার সাথে। বানায়া বানায়া নিজের দুঃখের, সবার অত্যাচার করার কাহিনী শুনাইতাম, কাঁদতাম, পর্দা কইরা, ভালো আচারণের সহিত চলতাম। এতো পরিশ্রম শেষে মহিলা পছন্দও করেছিল।

অথচ, সামুটা কি না ভার্সিটিতে উঠতে না উঠতেই এমনিতেই আবেগটার মন পাইলো। তুমি যে আমারে বকছো, আমি কি কম করসি না কি আবেগকে পাওয়ার জন্য? আর সামুর থেকে আলাদা করার জন্য? আমি তো শুরু থেকাই সব টের পাইসিলাম তাদের বিষয়ে। তাই তো আয়েশার মন মিথ্যে মিথ্যে বদনাম দিয়ে বিষায় ফেলসিলাম একদম। বলতাম, ও খারাপ মেয়েদের সাথে মিশে, সাথে সিগারেটের গন্ধ আসে, অনেক ছেলে বন্ধু, কয়দিন পর পর প্রেমিক বদলায়। আমি কতো বুঝাই দ্বীনের পথে চলতে শুনেই না। আপু তো আবেগ ভাইয়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে কল দেয়। আমারই বুদ্ধি ছিল পুরোটা। আমিই বলেছিলাম, যদি এমন একটা মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করা যেতো যাতে আবেগ ভাই না বুঝতে পারে সামু নয় অন্যকারো সাথে তার বিয়ে হচ্ছে। বিয়ে হওয়ার দিন দেখলেও মান-সম্মানের ভয়ে বিয়ে করে নিতো। আর এমন মেয়ে আমি ছাড়া আর কে ছিলাম? কারণ আমাকে সবাই এই বাড়ির, সামুর বাপের ছোটো মেয়ে হিসেবেই চিনে।

তাও যা হওয়ার তা তো হইসেই, আর কী করার? কিন্তু আম্মা, আমিও ঠিক করসি ঐ সামুকেও আমার চেয়ে ভালো স্বামী পেয়ে সুখে থাকতে দিব না। এখন তো শুধু ওর ননাসের কানে বিষ ঢেলেছি। আস্তে আস্তে শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, কাউকেই বাদ রাখবো না। আচ্ছা, আম্মা রাখি এখন। কে যেন আসছে।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here